উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৩

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৩
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

-“বললাম না ব্যথা পাচ্ছি! হাত ছাড়ুন।”
শামীম উষার কথার প্রতিত্তোরে কিছুই বললনা। তাকে টে*নে মায়ের সামনে দাঁড় করালো। গমগমে স্বরে বলল,
-“মাকে কী বলেছো তুমি? আমার সামনে বলো।”
উষা একটুও ভড়কালো না। বরং কাঠকাঠ গলায় বলল,

-“কেন? আপনার মা বলেনি? আমার মাকে কী বলেছেন আর আমি আপনার মাকে কী বলেছি?”
-“আমি সামনাসামনি শুনতে চাই” শামীমের নির্লিপ্ত জবাব।
ঘটনাচক্রে নাসিমা বেগম খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত হলেন। ভেবেছিলেন ছেলে আড়ালে বউকে শাসন করবে। কিন্তু তিনি দেখছেন ছেলে সামনাসামনি মোকাবেলা করাতে চাচ্ছে। বিষয়টা ধামাচাপা দিতেই বললেন,
-“আমিই খা*রা*প। তাই আমাকে যা বলার বলেছে। শাসন করার নাম করে আর অপ*মান করতে হবেনা আমায়।”
শামীম আবারও জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“কী বলেছো মাকে?”
একবার নাসিমা বেগমের ভীতসন্ত্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা বলে দিলো উষা। সেখানে লিলিও উপস্থিত ছিল এটাও বলে দিল। এবার যা হওয়ার হোক। তার গায়ে হা*ত তুলতে আসলে একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে সে। স্বামী বলে তার অ*ন্যায় শাসন মেনে নেবেনা।
সবটা শুনে লিলির দিকে তাকালো শামীম। অনড়ভাবে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনি ছিলেন সেখানে। উষা আর কিছু বলেছে মাকে?”
লিলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো জবাব দিতে পারলোনা। তার নিরবতা দেখেই যা বোঝার বুঝে গেলো শামীম। নিজের উপরই তাচ্ছিল্য করলো।
উষাকে বলল,

-“দ্রুত ঘরে যাও।”
-“কেন যাবো আমি?”
শামীম দ্বিগুণ রা*গ নিয়ে বলল,
-“যেতে বলেছি তোমায়।”
মেজাজটাই খা*রা*প হয়ে গেল। না দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। শামীম দাঁড়িয়ে দেখলো উষা যাচ্ছে কি-না। ওকে নিজেদের ঘরে ঢুকতে দেখেই মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“কেন করছো এসব? তুমি তো এমন ছিলেনা মা। উষা তোমাকে গা*ল*ম*ন্দ করেছে শুনে আমার কতটা খা*রা*প লেগেছে। তার মাকে যখন তুমি বে*হা*য়া বলে নিচু করলে, তখন তারও নিশ্চয়ই খা*রা*প লেগেছে। আর সেই জে*দ ধরেই তোমার সাথে ত*র্ক করেছে। নিজের দো*ষটুকু ঢেকে রেখে তাকে কেন মি*থ্যে*বাদী বানালে?

আমি আমার মাকে নিচু হতে দেখতে চাইনা। আমি চাইনা আমার মাকে অন্যরা ঘৃ*ণি*ত নজরে দেখুক। কিন্তু ভাবির অসুস্থতার পর থেকেই তুমি কেমন বদলে যাচ্ছো। মানছি তুমি হয়তো একটা ভুল করে ফেলেছো। তাই বলে এখনো একই কাজ করে যাবে? আমি চাই আমার পরিবার মিলেমিশে থাকুক। কিন্তু তুমি উষার মাকে ফোন করে ব্যাপারটা আরও ঘেটে দিলে।”

নাসিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
-“শাশুড়ীর জন্য যখন এতই দরদ, তখন শশুর বাড়ি গিয়েই থাক।”
মাকে বোঝাতে গিয়ে এবারও হতাশার নিঃশ্বাস ফে*ল*লো শামীম। ঘরে ফিরেই উষাকে শুয়ে থাকতে দেখলো। নরম সুরে একবার ‘উষা’ বলে ডাকলো।

সাড়া দিলোনা সে। বুঝতে পারলো রা*গ করেছে। অফিস যাওয়ার আগে উষার জিনিসপত্র কিনে দিয়ে যেতে হবে বলে আর কথা বাড়ালোনা। শামীম বেরিয়ে যেতেই উষা উঠে ছাদে গেলো। বর্ষার দিনে এই ছাদটির অবস্থা একেবারেই খা*রা*প থাকে। শেওলা জমে পিচ্ছিল অবস্থা। তারউপর ছাদে রেলিং নেই।

তিনদিন টা*না বৃষ্টি র পর একটু সূর্যের দেখা পেতেই জামাকাপড় ছাদে শুকাতে দিয়ে গেল ঊর্মি। ঘন্টাখানেক না যেতেই আবার বৃষ্টি নামলো। দ্রুত শুকনো কাপড় তুলে ফিরতে গিয়েই পা পিছলে ছাদের নিচে পড়লো।
বোনের কথা মনে পড়তেই চোখ ঘোলাটে হয়ে এলো। রাহাত নাকি ঢাকার বাইরে কাজে গিয়েছে। তাকে বাড়িতে দেখা যাচ্ছে না।
উষার জিনিসপত্র নিয়ে এসে তাকে ঘরে পেলোনা শামীম। তাই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো।

উষা ছাদ থেকে নামলো দু’ঘন্টা পর। নাসিমা বেগম লিলিকে বেশ খাতির-যত্ন করছেন। ড্রইংরুমে বসেই তাকে শাড়ি আর কিছু গয়না দেখাচ্ছেন। উষা ঘরে ফিরতে যেতেই থেমে গেলো নাসিমা বেগমের কথায়।
-“এগুলো পরে সবসময় সেজেগুজে থাকবে। রাহাত ফিরলেই তাকে চোখে চেখে রাখবে, বুঝলে? পরিপাটি থাকলে স্বামী হাতের মুঠোয় থাকে। এদিকওদিক দৃষ্টি দেয়না।”

উষা শাশুড়ীর পাশে বসে মিষ্টি করে হাসলো। নাসিমা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলতেই উষা বলল,
-“সব বড় বউয়ের পাওনা। ছোট বউ কি দো*ষ করলো? আমাকেও দিন আম্মা। আমাকেও শিখিয়ে দিন কিভাবে স্বামী হাতের মুঠোয় রাখা যায়।”
-“বে*য়া*দ*ব মেয়ে। লজ্জা করলোনা আমার কাছে এসব বলতে? অবশ্য তুমি তো এ বাড়ি নিজে হেঁটেই এসেছো।”
উষা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল,

-“শাশুড়ীর যদি দৃষ্টি উঁচুনিচু হয়, তবে বধু লজ্জা পাবে কেন? আর রইলো হেঁটে আসার কথা, আমি তো হেঁটে আসিনি। আপনার স্বামী আর ছেলে গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছে গাড়িতে করে।”
নাসিমা বেগম কথায় হেরে গিয়ে অভিক্ষেপের সুরে বললেন,
-“তুমি এত বে*য়া*দ*ব। তোমার বোনটা তো এমন ছিলো না।”

-“ওহ্ তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে, আপনি ভালো মানুষের কদর করতে জানেননা।”
অতিরিক্ত রা*গে ক্ষুব্ধ হয়ে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়লেন নাসিমা বেগম। উষাকে চ*ড় দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাত তুলেও থেমে গেলেন আনোয়ার হোসেনের কথায়।
-“এখানে কী হচ্ছে?”
শশুরকে দেখে উষা মিটিমিটি হেসে বলল,

-“আম্মা আমাদের শাড়ি – গয়না ভাগ করে দিচ্ছেন, বাবা।”
আনোয়ার সাহেব সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে নাসিমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তুমি তো দুই ছেলের বউয়ের জন্য বেশ কিছু গয়না বানিয়েছো। কিছুটা ঊর্মিকে দিয়েছো। বাকিটা ওদের দুজনকে দিয়ে দাও।”

নাসিমা বেগম সবকিছু আনোয়ার হোসেনের সামনে রেখেই লিলির হাত ধরে টে*নে নিয়ে গেলেন।
-“এসব গয়না তোমার লাগবেনা, আমার গুলোই ব্যবহার করবে তুমি। চল লিলি।”
আনোয়ার হোসেন লিলিকে থামিয়ে দিলো,
-“দাঁড়াও মা।”

তিনি দুজনকেই সব কিছু ভাগ করে দিলেন। নাসিমা বেগম আর দাঁড়ালেননা। মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলেন। আনোয়ার হোসেন ঘরে ফিরতেই লিলি উষার সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে বলল,
-“আম্মার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছো? আমিও তো বউ, কই আমি তো এমন কিছু করছিনা যাতে বড়রা কষ্ট পায়। এরপর থেকে নিজেকে শুধরে না নিলে বড় হিসেবে আমি তোমাকে শাসন করতে বাধ্য হব।”
উষা কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলল,

-“আমি আমার প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছি। আপনার সাথে আমার কোন শ*ত্রু*তা নেই। তাই আমাকে উল্টোপাল্টা জ্ঞান দিতে আসবেন না।”
চোখ ছোট করে মনে করার চেষ্টা করে বলল,
-“আর কী যেন বলছিলেন? আমাকে শাসন করবেন?
আমার স্বামী কি আমাকে শাসন করার অধিকার আপনাকে দিয়েছে? না-কি আমি দিয়েছি?”

চোখমুখ কঠিন করে লিলির পাশ কাটিয়ে চলে গেলো উষা। তার যাওয়ার পথে নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো লিলি। মুখ থেকে একটি শব্দ ও উচ্চারণ করলো না। হয়তো এখনো সবটা মস্তিষ্কের আয়ত্ত্বে আনতে পারেনি।
প্রথমেই দীর্ঘ একটা গোসল দিলো উষা। এখন শরীর আর মন দুটোই বেশ ভালোলাগছে। খাটের উপর তার সব জিনিসপত্র রেখে গিয়েছিলো শামীম। সেখান থেকেই একটা জামা পরে নিলো। হালকা সাজগোছ ও করলো।

তিমিরে তলিয়ে যাওয়া রজনী। আলোহীন কক্ষে সুনশান নিরবতা বিরাজমান। দু’দিক থেকেই কঠোর নিরবতা জারি হয়েছে। সকালের পর থেকে দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হয়নি। শামীমের বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়েছে উষা। হঠাৎ ডান হাতে টা*ন পড়লো। দৈবাৎ কী ঘটেছে দেখতে গিয়েই উপলব্ধি করলো কক্ষের বাতি জ্বালানো হয়েছে।

এতক্ষণ যাবত অন্ধকার চোখ সয়ে গিয়েছিল বিধায় প্রথমে চোখ খুলে তাকাতে একটুখানি বেগ পেতে হলো উষার। শামীম গভীর মনযোগ দিয়ে উষার হাতের নীলছে দাগ পর্যবেক্ষণ করছে। সকালে বেশ শক্ত হাতেই চেপে ধরেছিল সে। আচমকা ব্যথা দাওয়া স্থানে চুমুর স্পর্শ দিয়ে বসলো শামীম। তড়িৎ হাত সরিয়ে নিলো উষা। তার লজ্জার চেয়ে রাগটাই বেশি হচ্ছে। শামীম উঠে গিয়ে একটা মলম খুঁজে নিলো। উষার হাতের ব্যথাস্থানে হাত ছোঁয়াতে গেলেই উষা ঝাড়ি মে*রে সরে গেলো। থমথমে গলায় বলল,

-“মে*রে ধরে মলম লাগানোর মতো যত্ন আমার লাগবেনা।”
শামীম ছোট করে জবাবে বলল,
-“সরি!”
উষা ব্যঙ্গ করে বলল,

-“সরি! আপনার সরি আপনি কাগজে লিখে পানিতে গুলিয়ে খান। তাহলে বুদ্ধি বাড়বে।”
শামীম মৃদু হাসলো উষার রা*গ দেখে। জোর করেই হাতে মলম লাগিয়ে দিলো। উষা লাইট অফ করে আবার শুয়ে পড়লো। নড়াচড়ার শব্দে বুঝতে পারলো শামীমও শুয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত এসে ঝাপটে ধরলে উষা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,

-“আমার এভাবে ঘুম হয়না।”
শামীম চোখের পাতা বন্ধ রেখেই বলল,
-“এখন থেকে এভাবে না শুতে পারলে আমারও ঘুম হবেনা।”
উষা রাগে ফুঁসে উঠে বলল,

-“অসহ্য!”
শামীম মুচকি হেসে বলল,
-“সহ্য।”
উষা হম্বিতম্বি করেও কোন কূল করতে না পেরে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো। তার রা*গ এখনো পানি হয়নি।

একটা সুতি শাড়ির সাথে হালকা কিছু গয়না পরে বের হলো উষা। শামীম নাস্তা করে অফিসে যাওয়ার আগে উষাকে বুঝিয়ে গেল অযথা জে*দে*র বশে উল্টোপাল্টা কাজ যেন না করে। ঠান্ডামাথায় মাকে বোঝানো উচিত।
উষা ঠা*স করে বলে ফেললো,

-“আপনার মায়ের মতো ভালোমানুষ দের সাথে আমার ভালোমানুষি আসেনা।”
শামীম কিছুক্ষণ নিরবে দেখে গেল উষার ফোলানো গাল। অতঃপর বলল,
-“তুমি কেবল জে*দ দেখাতে জানো। কাজের কাজ কিছুই জানোনা।”
-“আপনার না অফিসের দেরি হচ্ছে? বের হন।”

শামীম যাওয়ার পূর্বে উষার ললাটে অধর ছোঁয়াতে ভুললোনা।
উষা কেমন জানি শামীমকে বিশ্বাস করতে গিয়েও পারছেনা। অবচেতন মনে বার বার একই প্রশ্ন উঁকি দেয় “শামীমও কি রাহাতের মতো?”
যদি তার মাঝে তেমন কিছুই এখনো দেখেনি।

দুপুরে খেয়ে নিজের খাবার প্লেট ধুতে রান্নাঘরে ঢুকলো উষা। প্লেট ধুয়ে তাকে রাখতে যাবে, মনে হলো কেউ তার ঘোমটা ফেলে দিয়েছে। তড়াক করে উঠলো হৃদয়। তড়িৎ বেগে পেছন ঘুরতেই দেখলো শান্তি আপার হাজবেন্ড একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উষাকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে দেখে হাসির রেখা আরেকটু চওড়া করে বলল,
-“দেখছিলাম ছোট শালাবাবুর বউয়ের চুল কেমন লম্বা।”

উষার প্রচুর রা*গ হলো। ইচ্ছে করছে এই লোকের হাতটা চুলার উপর ধরে ছ্যাঁকা দিতে। কত বড় সাহস, তার ঘোমটা ফেলে চুল দেখতে আসে। উষা দ্বিধাহীনভাবে বলল,
-“বউয়ের চুল দেখে মন ভরে না, দুলাভাই? শালার হকে নজর দিচ্ছেন? চোখজোড়া নিজের বউয়ের উপরই সীমাবদ্ধ রাখুন। নয়তো দুদিন পর আর চোখজোড়া খুঁজে পাবেন না।”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ২

উষার আক্র*মণে চোখমুখের আকৃতি পাল্টে গেলো রিয়াদের। পেছন থেকে শান্তি আপার সন্দিহান গলা শোনা গেল,
-“কী হচ্ছে এখানে?”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৪