এই শহর আমার পর্ব ১২ || Suraiya Aayat || SA Alhaj

এই শহর আমার পর্ব ১২
Suraiya Aayat

মুগ্ধতা ওর হাতের কাছে থাকা বইগুলো ছুঁড়ে মারলো ৷ রাগ হচ্ছে খুব , ভীষন পরিমানে ভাঙচুর করতে ইচ্ছা করছে, এই নিয়ে 12 বার স্পর্শকে কল করেছে মুগ্ধতা স্পর্শ ফোন ধরেনি ৷ হাতে কাছে থাকা গ্লাসটা নিয়ে ছুড়ে মারলো ৷ ঝনঝন আওয়াজে ভেঙে গেল ৷ মুগ্ধতা ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল
” লাস্ট বার , লাস্ট বারের মধ্যেই যদি কল না ধরে তাহলে,,,তাহলে তাহলে,,,, তাহলে কি করবো আমি নিজেও জানি না ৷”

আর একবার কল করতেই একটা মেয়ে এসে ফোনটা ধরলো ৷
” হ্যালো, ফোন ধরছিলেন না কেন? কতোবার কল করেছি খেয়াল আছে ? আমাকে শান্তিতে থাকতে দিতে ইচ্ছা করে না আপনার !”( গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলল)
মেয়েটা তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল
” কে আপনে, আর এভাবে চিল্লাইতাছেন কেন ! ভাইজান এখন হলুদ লাগাইতাছে , বিয়ের অনুষ্ঠান চলতেছে সে ব্যাস্ত ৷ আপনি ওনার কে হন?”
মুগ্ধতার চোখ ছলছল করছে, তাহলে স্পর্শ ওকে মিথ্যা বলে চলে গেল ! স্পর্শ আবার বিয়ে করছে ! কতটা ভাবতেই মুগ্ধতা শিউরে উঠলো ৷
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল

” আমি ওনার মামুর মেয়ে ফারহাত মুগ্ধতা ৷”
মেয়েটি মুগ্ধতার নাম শুনে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল
” ওহহ আপনিই সেই পাগল মেয়েটা যার জন্য ভাইজানের পাগল পাগল অবস্থা ৷ভাইয়া আপনার কথা অনেক বলে, অনেক কিছুই বলে সব এখন মনে করতে পারতেছি না ৷ আপনি তো ভাইয়ার বাসার লোক বিয়েতে আসলেন না কেন ভাইয়ার সাথে, আপানকে দেখার অনেক ইচ্ছা ছিলো আপা ৷”
মুগ্ধতার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে, হাত দিয়ে মুছে বলল
” আপনাদের ঠিকানাটা ঠিক কোথায় , একটু বলবেন !”
মেয়েটা সাবলীল ভাবেই বলল তাদের জায়গার নাম, মুগ্ধতা সেখানকার কিছু চেনেনা তাই বুঝলোনা কিছুই ৷
” স্পর্শ ভাইয়া একটু ব্যাস্ত আছে, ভাইয়া আইলে কইবানি আপনারে কল করতে ৷”
” আচ্ছা ৷”

কথাটা বলে মুগ্ধতা কেটে দিলো ৷ কান্না পাচ্ছে খুব স্পর্শ ওকে মিথ্যা কথা বলেছে ৷
ফোনটা পাশে রেখে গুটিগুটি হয়ে শুয়ে পড়লো ৷ রাত 12 টা বাজে প্রায় ৷ অনেক চেষ্টার পরও ঘুম আসছে বা বারবার মনে হচ্ছে স্পর্শ ওকে এত সহজে ওকে মিথ্যা বলে দিলো ৷ রুম থেকে বেরিয়ে গেল মুগ্ধতা ৷
?
রাত 1 টা””’
বিয়ে বাড়ির উৎসব মুখর পরিবেশ, লোকজন বাসায় গেছে, কালকে বিয়ে ৷ লোকজন আবার কালকে আসবে ৷ রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে স্পর্শ ওকে যে রূমে থাকতে দিয়েছে সেই রুমেই ঢুকতে গেলেই পিছন থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠস্বর ডেকে উঠলো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” বাবা আমার লগে কথা কহনের লাইগা 2 মিনিট সময় হইবো ?”
স্পর্শ পিছন ঘুরে দেখলো তৌমুর সাহেব ৷ ওনাকে দেখে স্পর্শ বলে উঠলো
” আরে আপনি, এভাবে বলছেন কেন? রুমে আসুন একসাথে বসে কথা বলি ৷”
উনি হাসি উজ্জল চোখে স্পর্শর সাথে ঘরে ঢুকলেন ৷ ওনার হাতে পুটলি জাতীয় জিনিস কিন্তু খুব সুন্দর করে মোড়ানো ৷
উনি স্পর্শর সামনে বসে একটু ভাঙা গলায় বললেন
” তুমি কি কালকেই চলে যাইবা বাবা ?”
স্পর্শ মুচকি হেসে বলল

” আপনার বৌমা বড্ড বাচ্চামো স্বভাবের, আমি ছাড়া তাকে সামলানো যাইনা, সামনে তার পরীক্ষা তাই তার একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন ৷ তাকে নিয়ে পরে আসবো কোন একদিন ৷”
” তুমিও কালকে চলে যাইতেছো, আমার ঘর খালি করে পরের ঘরে আমার মেয়েটাও চলে যাইতেছে ৷”
কথাটা বলে উনি ফুপিয়ে কেঁদে দিলেন ৷ স্পর্শ ওনার কাধে হাত রেখে বললেন
” কাঁদবেন না, বর্না আপনাদের মেয়ে অন্য ঘরে দিয়ে তাকে এমন পরপর ভাববেন না ৷ মেয়ে দের কে একদিন না একদিন তার বাসা ছাড়তেই হয়, বর্নাকেও ছাড়তে হবে ৷ কাঁদবেন না ওর জন্য দোঁয়া করুন যাতে বিবাহিত জীবন সুখের হয় ৷
উনি নিজেকে সামলে বললেন

” তুমি কখন চলে যাইবা !”
” এই তো বর্নার বিদায়ের পরই রওনা দেবো ৷”
উনি ওনার হাতে থাকা পুটুলিটা স্পর্শর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
” এইই নাও বাবা, এটা বৌমাকে দিয়ে দিও,যদিও বা তাকে দেওয়ার মতো আহামরি সামর্থ আমাদের না থাকলেও এটুকু তাকে দিয়ে দিও, সে আসলে খুব খুশি হতাম ৷ তাছাড়া তুমি আমাদের জন্য যা করেছো তার ঋন আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না ৷”

কথাটা বলতেই উনি কেঁদে দিলেন ৷ পুরোনো কতো কথা মনে করছেন উনি ৷
দুই বছর আগে স্পর্শ এক সপ্তাহের জন্য সিলেটের “National heart foundation hospital ” এ ডিউটির জন্য এসেছিলো, সেইবার ই প্রথম স্পর্শ মুগ্ধতাকে ছেড়ে এতো দিন বাইরে কোথাও ছিলো ৷

একদিন রাত 2.45,,,,বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে ,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে প্রচুর , স্পর্শ নাইট ডিউটি করছিলো ৷ একটা পেশেন্টকে দেখে এসে নিজের কেবিনের দিকে যেতেই দেখলো বাইরে প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে, চিৎকারের মাঝে একজন মহিলার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ৷ স্পর্শ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বাইরে গিয়ে দেখলো স্ট্রেচারে একটা অল্পবয়সী মেয়ে কতই বা বয়স হবে 17 কিংবা 18 ,ক্রমাগত তার শ্বাস আটকে আটকে আসছে,চোখ মুখ ও কেমন একটা করছে, মেয়েটার বাবা ক্রমাগত নার্সদের সাথে কথা কাটাকাটি করছে যাতে এই অবস্থায় আর মেয়েকে ভর্তি নিয়ে চিকিৎসা কর হয় ,মেয়েটার মা ক্রমাগত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কাঁদছে ৷ ডক্টররা বারবার বলছেন যে তাকে ইমিডিয়েট ঢাকা নিয়ে যাওয়ার কথা তারা কোন রিস্ক নিতে পারবে না ৷ স্পর্শ শুধু দেখছে , হঠাৎ মেয়েটার মুখের ওপর যেন ওর মুগ্ধর মুখের আভা পেল, বারবার মনে হচ্ছে আজ যদি এই পরিস্থিতিতে ওর মুগ্ধ থাকত তখন নিশ্চয়ই এমন একটা মূহুর্তে ও প্রানপনে চেষ্টা করতো যেন মুগ্ধতাকে সুস্থ করতে পারে ৷ কথাগুলো ভাবতেই স্পর্শ শিউরে উঠলো ৷ তাড়াতাড়ি তাদের কাছে গিয়ে বলল

” পেশেন্টকে জলদি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসুন, ওনার অপারেশন এখানেই হবে, ঢাকা নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগবে , ততখনে পেশেন্টের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না, তাছাড়া ডক্টর হয়ে যদি এতটুকু রিস্ক নিতে পারি তাহলে এই প্রফেশান অন্তত আমার জন্য না ৷”
বহু কিন্তু কিন্তুর পর অপারেশন সাকসেসফুল হলো ৷ স্পর্শ যখন তাদেরকে কথাটা বলেছিলেন সেদিন ওনারা স্পর্শর হাত ধরে কান্নায় লুটিয়ে পড়েছিলেন ৷
তারপর থেকে ওনারা স্পর্শকে নিজেদের ছেলের মতো মনে করেন ,বর্না ও স্পর্শকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করে ৷ মুগ্ধতার কথা স্পর্শ তাদেরকে বলেছে ৷ শেষবার এসেছিলো স্পর্শ আগের বছর শীতের সময়,তবে একদিনের জন্য ৷ বলেছিলো যে পরেরবার আসলে মুগ্ধতাকে নিয়ে আসবে ৷ কিন্তু এবার ও স্পর্শ নিয়ে আসতে পারলো না, মুগ্ধতার এক্সাম বলে ৷ ও জানে যে মুগ্ধতা একবার এখানে আসলে ঢাকায় ফিরতে চাইবে না সহজে আর ওর এক্সামের আগে এভাবে পড়ার ঘাটতি হবে ৷
স্পর্শ ওনার হাতটা ধরে বলল

” পরেরবার আপনার বৌমাকে নিয়ে আসবো ৷ আর আপনাদের দেওয়া উপহার মুগ্ধতা খুব পছন্দ করবে, ও নিজেই কেমন বাচ্চাদের মতো ব্যাববহার করে ৷ ওকে এখনো আপনাদের কথা বলা হয়নি, বলে এসেছি যে দরকারে এসেছি, যদি একবার জানে যে বর্নার বিয়ে উপলক্ষে এসেছি আর ওকে আনিনি তাহলে কুরুক্ষেত্র বাধাবে ৷ বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ওকে বোঝাবো সবকিছু ৷ আর আপনারা ভালোবেসে দিয়েছেন ও এই উপহার মাথা পেতে নেবে ৷”
উনি চোখটা মুছে বললেন
“তোমরা সুখে থাকো ৷ সত্তিই তোমার মতো একটা ছেলেকে নিজের ছেলের মতো আদর যত্ন করতে পারছি আমি এতেই খুশি ৷”
ওনাদের কথার মাঝে স্পর্শর ফোনটা বেজে উঠলো, ফোনে sms এসেছে মুগ্ধতার থেকে
” গুড নাইট ৷”

স্পর্শ ফোনটা রেখে দিয়ে ওনার সাথে আরো কিছুখন কথা বার্তা বললেন ৷ ওনারা পাহাড়ী এলাকার মানুষ, মনটাও পাহাড়ের মতোই বড়ো, সবাইকে খুব ভালোবেসে আপন করে নেই ৷ এই মূহুর্তে মুগ্ধতাকে মিস করছে খুব ৷ এই কদিন ওর মেজাজটা খিটখিটে ছিলো খুব ,হসপিটাল , বাসা, মুগ্ধতা, বর্নার বিয়ে এসব,নিয়ে ৷
ফোনটা হাতে নিলো ৷ এতো রাতে মুগ্ধতা জেগে আছে, আর ওকে গুড নাইট sms দিয়েছে তারমানে নিশ্চয় মুগ্ধতা জেগে আছে ৷ স্পর্শ আসার সময় বারবার বলেছিলো যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে , তাহলে মুগ্ধতা কি স্পর্শকে মিস করছে যেমনটা স্পর্শ ওকে মিস করছে ৷
স্পর্শ মুগ্ধতা কে কল করলো ৷ বেশ কয়েকবার রিঙ হতেই মুগ্ধতা কল তুললো ৷ মুগ্ধতা কল ধরতেই স্পর্শ মুচকি হেসে বলল

” আমার পিঁংকিশ নাগিনটা কি আমকে মিস করছে ?”
মুগ্ধতা আধো আধো গলায় ফোন ধরে বলল
” কি আপনার বিয়ে শেষ ? পাশে কি আপনার বউ আছে এখন? আজে কি আপনার বাসর রাত ? সরি সরি আমিও না খুব পাগল , বারবার আপনাকে কল করে ডিসটার্ব করি ৷ হাউ স্টুপিড আই এম ৷”
স্পর্শ মুগ্ধতার গলার আওয়াজ শুনে বলল
” পাগলের মতো এসব কি বলছো ? আর তুমি কি কিছু খেয়েছো ?”
মুগ্ধতা টলতে টলতে হাসতে লাগলো ৷ ওর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম ৷
স্পর্শ রেগে গিয়ে বলল

এই শহর আমার পর্ব ১১

” স্পিক আপ মুগ্ধ কি খেয়েছো ?”
মুগ্ধতা বিছানায় টলে পড়ে গেল ৷ ফোনটা হাত থেকে অনেকটাই দূরে পড়ে গেছে,,,
মুগ্ধতা বলল
” চিন্তা নেই এবার সোজা ছক্কাই মেরেছি, এবার আর কোন হজমির ঔষুধ না, ঘুমের ঔষুধই খেয়েছি ৷ আপনার প্রেসক্রাইব করা একটা ঘুমের ঔষুধ কিনেছি, পরশু দিন আম্মুর জন্য যেই ঘুমের ঔষুধটা লিখেছিলেন সেই প্রেসক্রিপশানটার ঔষুধটা কিনেছি, ঐটা হাই ডোজের খেলে খুব ভালো ঘুম হয় নাকি ৷ হমম সত্তিই ভলো ঘুম হয় নাও আই কেন রিয়েলাইজ ইট ৷ আমার এখন ভালো ঘুম হচ্ছে ৷ কিন্তু আই এম নট স্টুপিড, ফারহাত মুগ্ধতা কটা ঘুমের ঔষুধ খেয়েছে তা আপনাকে বলবে না, না না , একদম না ৷”

কথাটা বলে মুগ্ধতা হাসতে হাসতে চোখ বন্ধ করে ফেলল ৷
এদিকে স্পর্শর যেন দুনিয়া ঘুরছে, ও মুগ্ধতার কাছে নেই, না জানি মেয়েটা আবার কি ভেবে এসব করেছে ৷ ও আর ভাবতে পারছে না ৷ এবার যদি মুগ্ধতা বেঁচে যাই তো স্পর্শ আর ওকে আস্ত রাখবে না ৷

এই শহর আমার পর্ব ১৩