এই শহর আমার পর্ব ১৩ || Suraiya Aayat || SA Alhaj

এই শহর আমার পর্ব ১৩
Suraiya Aayat

চোখের ওপর রোদ পড়তেই মুগ্ধতার ঘুম ভাঙলো ৷ কালকে রাতে 3 টে ঘুমের ঔষুধ খেয়েছে, ঘুমের রেশ এখনো আছে ৷চোখ পিটপিট করে তাকাতেই গালে জোরে একটা থাপ্পড় এসে পড়লো ৷
আর কেউ না স্পর্শই চড়টা মেরেছে ৷ এতো জোরে মেরেছে যে যুগ্ধতার মাথার ভিতর চক্কর দিয়ে উঠেছে ৷মুগ্ধতা গালে হাত দিয়ে স্পর্শর দিকে তাকালো ৷ স্পর্শর চোখগুলো লাল , একটা মানুষ সারারাত না ঘুমালে আর কোন কিছু নিয়ে গভীর ভাবনা ভাবলে যেমন তার চোখমুখের হাল হয় , স্পর্শর অবস্থাও ঠিক তেমনই ৷
মুগ্ধতা স্পর্শকে ঘুম থেকে উঠেই যে দেখবে সেটা আশা করেনি, তার ওপর চোখ খুলতে না খুলতেই স্পর্শ সপাটে একটা চড় মেরেছে ৷
মুগ্ধতা কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠলো

” আআআআপনিইইই এত সকালে ৷”
স্পর্শ এখন স্বাভাবিক ভাবে থাকলে মুগ্ধতা হয়তো বলতো যে
” আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে এভাবে চড় মারার ৷”
কিন্তু স্পর্শর এই ভয়ংকর রুপ দেখে মুগ্ধতার সাহস হচ্ছেনা কিছু বলার ৷
স্পর্শ দাঁতে দাঁত চেপে বলল
” তুমি কি আমার থেকে দূরে থাকতে চাও ! ডু ইউ নিড সেপারেশন?”
কথাটা শুনে মুগ্ধতা শিউরে উঠলো, এর আগেও ও অনেক পাগলামি করেছে কিন্তু স্পর্শ কখনো এমন কিছু বলেনি ৷মুগ্ধতা মিনমিন করে বলল
” আই এম সরি , আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে ৷ আমি এবার সুইসাইড এটেম্পট করিনি ৷ আমার তো ঘুম আসছিলো না তাই রাগ করে 3 টে ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলাম ৷”

কথাটা শুনতেই স্পর্শ মুগ্ধতার আর একগালে চড় মারলো ৷ মুগ্ধতার সমগ্র শরীর কেঁপে উঠলো ৷ স্পর্শ আর নিজের মধ্যে নেই , ওর মাথা কাজ করে না ৷ মুগ্ধতার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে হাত দিয়ে মুছছে না ও ৷ স্পর্শ মুগ্ধতার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দাড় করিয়ে ওর দু হাত শক্ত করে ধমকানির সুরে বলল

” জানো কতোটা টেনশনে ছিলাম আমি ! বর্নার বিয়েটা অবধি দেখে আসতে পারলাম না, নিজের হাতে ওকে বিদায় করতে পারলাম না ৷ আমার নিজের কোন বোন নেই তাই বর্নাকে বোনের চোখে দেখি, ভেবেছিলাম ওর ভাইয়ের কাজগুলো নিজের কাধে নিয়ে ওর বিয়েটা খুব ভালো ভাবেই দেবো , কিন্তু নাহ !তা আর হলো কই ! আহানাফ মুগ্ধতা ওপস সরি এটা কি বলছি ফারহাত মুগ্ধতা হবে , সব কাজেই তো ফারহাত মুগ্ধতার একটা গ্যাড়ামি করা চাই ই চাই নাহলে কি আর তার রাতে ঘুম আসে !

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তোমার জন্য বর্নার বসার সবাই চিন্তা করছে সেটা কি জানো? ওর দুপুরে বিয়ে,ভেবছিলাম ওকে বিদায় দিয়েই চলে আসবো কারন আমি আমার কলিজাটাকে এই বিশাল ঢাকা শহরে একা রেখে এসেছি, তার তো আবার ভালো গুনের শেষ নেই !কখনো এক্সিডেন্ট করে, কখনো আবার সুইসাইড এটেম্পট করে ৷ অনেক হয়েছে আর না ৷ ইউ নিড টু গ্রো আপ ৷ 19 বছর বয়স তোমার একেবারে ছোট্ট বাচ্চা নও যে কিছু বললে সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই, যথেষ্ট বুদ্ধি আছে তবুও ম্যাচিউরিটি লেভেল জিরো ৷ এত কথা বললাম বলে এটা ভেবোনা যে আগের মতো ভালো বাসিনা বা তোমাকে দূরে সরানোর জন্য কথাগুলো বলছি, একটা মানুষ সারাজীবন এভাবে কাটাতে পারে না ৷ এভরিবডি নিডস টু গ্রো আপ ৷ বারবার একটা মানুষ সুইসাইড এটেম্পট করে মানে তার অর্থ কি তুমি জানো ? দ্য৷টস মিন হি অর সি ইজ আ সাইকো ৷ তুমিও কি তাই ?”

স্পর্শর কথার মাঝে মুগ্ধতা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো
“আমি আপনাকে প্রমিস করেছিলাম যে আমি আর কখনো সুইসাইড এটেম্পট করবো না তাই আমি করিনি কিছু,আর ঘুম আসছিলো না তাই কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম , আর আমার জন্য যে আপনি সহ সবাই এত চিন্তা করবেন ভাবিনি ৷ সরি ৷ আর চিন্তা নেই আমি কখনো এমন কিছু করবোও না, তাই আপনি আপনার বোনের বিয়েটা নিশ্চিন্তে দিয়ে আসুন ৷”
কথাটা বলে মুগ্ধতা স্পর্শর হাতটা ছাড়িয়ে ওয়াড্রব থেকে ওর একটা থ্রি পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ৷
কান্না পাচ্ছে খুব ৷
মুগ্ধতা ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ারের নীচু বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ৷ হাটুতে মুখ গুজে কাদছে ও ৷ নিজেই নিজেকে বলছে

“তুই সত্তিই সাইকো , সবাইকে সবসময় চিন্তায় ফেলিস, সবসময় বোকামো কাজগুলো করিস, সবাইকে বিপদে ফেলে দিস, কারোর ভালো হতে দিস না ৷”
এসব বলছে আর মুগ্ধতা কাঁদছে ৷ স্পর্শ আজকে ওকে 2 বার চড় মেরেছে, চড়ের আঘাতের তুলনায় কথার আঘাতগুলো বেশি ছিল, যদিও বা ও জানে যে দোষটা ওর নিজেরই ছিলো ৷
দুই গাল লাল হয়ে গেছে ৷ ডানদিকের গালে স্পর্শর পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে গেছে ৷ ফরসা গালদুটোতে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ৷

স্পর্শর নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে , সবকিছুতে বিরক্তি কাজ করেছে, একে মুগ্ধতাকে এতো কথা শুনিয়েছে তার ওপর চড় ও মেরেছে , এদিকে বর্নার বিয়ে , সব মিলিয়ে পাগল পাগল অবস্থা ৷
মুগ্ধর আসার আগে স্পর্শ আবার গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল ৷ আবার সিলেট যাবে, বর্নাকে বিদায় দিয়ে আসবে ৷ স্পর্শ যাওয়ার সময় বর্নার জন্য যে নেকলেসটা কিনেছিলো সেটা বাসায় ফেলে রেখে গিয়েছিলো ৷ এবার যাওয়ার সময় সেটা আবার নিয়ে গেল ৷

মুগ্ধতা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো ৷ মাথার ভিজে চুল থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে , মাথাটাও ভালো ভাবে মোছেনি ৷থ্রি পিসের পিঠের দিকের অংশটা অনেকটাই ভিজে গেছে ৷ রুমে এসে স্পর্শকে দেখলোনা ৷ মুগ্ধতা দরজার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ওয়াড্রবের কাছে গেল , জামাকাপড় বার করতে ৷ ওয়াড্রবের মধ্যে কালকে রাত্রে মুগ্ধতা ওই নেকলেসটা দেখেছিলো , ও ভেবেছিলো স্পর্শ ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলে এখানে রেখেছে, কিন্তু জুয়েলারির প্রতি ওর আহামরি কোন ইন্টারেস্ট নেই তাই ও সেটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে রেখে দিয়েছিলো , কারন স্পর্শ এখনো জুয়েলারিটা ওকে দেইনি তাই না বলে সেটা পরা ওর উনিত নয়, এইটুকু নীতিবোধ মুগ্ধতার মধ্যে আছে, তাই সেটা ওখানেই রেখে দিয়েছিলো ৷ এখন ওয়াড্রব খুলতেই দেখলো জুয়েলারিটা আর নেই,বুঝতে পারলো স্পর্শ ওটা বর্নার জন্য কিনেছিল ৷ কথাটা ভেবে মুচকি হসলো মুগ্ধতা ৷

স্পর্শর মা অনেক খুজে খুজে পরশু দিন মুগ্ধতাকে একটা পিংকিশ ব্যান্ড কিনে দিয়ে ছিলো যদিও তাতে নাগিন ছিলো না, তবুও মুগ্ধতা খুশি ৷ ব্যান্ডটা বার করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো ৷ আর জিনিসপত্র বলতে ওর নিজের বইখাতা ছাড়া আর কিছুই নিলো না ৷
আয়নাতে নিজেকে একবার দেখে নিলো ৷ চোখ দুটো ফোলা ফোলা, গালটা লাল হয়ে আছে, ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে নিয়ে একটা সানগ্লাস চোখে দিয়ে নিলো,
ব্যাগ নিয়ে নীচে নামতেই তনিমা বললেন
” মুগ্ধ তুই এই সকাল সকাল ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস ?”
মুগ্ধতা মুচকি হেসে বলল

” বাসায় যাচ্ছি ফুপি, প্রায় 1 মাস হতে চলল বাসায় যাইনা ৷ বাসার সকলের জন্য খুব মন খারাপ করছে ৷ তাই আরকি ভাবলাম সকাল সকাল যাই ৷ তোমাকে আগে থেকে বলা হয়নি তার জন্য এত্তোগুলা সরি ৷”
কথাটা বলে ওনাকে সাইড থেকে জড়িয়ে ধরলেন ৷
উনি কিছু একটা ভেবে বললেন

” স্পর্শ জানে ? ওউ তো দেখলাম আবার বেরিয়ে গেল ৷ছেলেটা কালকে রাত 3টের সময় যখন ফোন করে বলল যে আম্মু মুগ্ধ ঘুমের ওষুধ খেয়েছে ওকে ইমিডিয়েট হসপিটালে নিয়ে যাও আমি আসছি তখন আমার কলিজা কেঁপে উঠেছিলো, ভাবলাম এই বুঝি তুই আর নেই, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ৷ তারপর তুই তো ঘুমে কাতর, তোকে নিয়ে হসপিটালে গেলাম, কিছু টেস্ট করার পর ডক্টর জানালো যে কোন সমস্যা নেই ৷ তোকে বাসায় আনলাম ৷ তারপর সেই ভোরবেলা স্পর্শ ফিরলো ৷ তোকে ডাকবো ভাবলাম কিন্তু স্পর্শ বলল যে তোর যখন ঘুম ভাঙবে তখনই ও তোর সাথে কথা বলবে ৷ সেই ভোর 5 থেকে সকাল 7টা অবধি ও একই ভাবে বসে ছিলো তোর সামনে ৷ ”
কথাটা শেষ হতেই মুগ্ধতা অবাক হয়ে বলল

” অনেক কিছুই ঘটিয়ে ফেলেছি দেখছি আমি এটুকু সময়ে ৷”
উনি ভাবুক সুরে বললেন
” মুগ্ধ , মা রে তোকে আজকে একটা কথা না বলে পারছিনা না , দেখ আমার ছেলেটা কিন্তু অনেক রাগী, ওকে আমরা সবাই খুব ভয় পাই কিন্তু তুই হলি এমন একজন যে ওকে ভয় পাই না ওর ওপর দিয়ে চলিস সবসময়, তবুও ও থেকে কখনো কিছু বলে না , কিন্তু ও একবার রেগে গেলে ওকে সামলানো মুশকিল, তারপর তুই মাঝে মাঝে যা করিস ও খুব রেগে যাই তবুও নিজেকে অনেক কনট্রোল করে, তাই এবার ওকে একটু বোঝ, ওর কথা শুনে চল ৷ ও তোকে খুব ভালোবাসে, তোর কিছু হলে ও বাঁচবে না ৷ দয়া করে আর কখনো এমন করিস না, আমি হাতজোড় করছি তোর কাছে ৷”

মুগ্ধতা ওনার হাতটা নামিয়ে নিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে বলল
” আই এম সরি ফুপি , আমি আর কখনো এমন করবো না ৷”
উনি মুগ্ধকে ছাড়িয়ে বললেন
” কথাটা যেন যনে থাকে, আর কদিনের জন্য যাচ্ছিস মা ? তাড়াতাড়ি ফিরিস তুই ছড়া বাসা বড্ড ফাকা ফাকা লাগবে ৷”
মুগ্ধতা সানগ্লাসটা খুলে ওনার দিকে চোখ টিপ মেলে বলল
” ছেলেকে আবার বিয়ে দাও ফুপি নতুন বউ আসবে, তোমার এ সংসার সুখের হবে ৷”
উনি মুগ্ধতার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল
” খবরদার আর একবার এমন বললে তোর মার হবে এবার ৷”
কথাটা বলে দুজনেই হেসে ফেলল ৷

এই শহর আমার পর্ব ১২

রাত 9.30,,,,,
কিছুখন আগে শুভ্রতা ফোন করেছিলো, শুভ্রতাকে সব কথা বলেছে মুগ্ধতা, শুভ্রতাও অনেক বুঝিয়েছে মুগ্ধতাকে , তবে কোনকিছুতেই যেন মনের ভিতর শান্তি পাচ্ছে না, এখন যদি ওর গালে স্পর্শ আলতো করে হাত বুলিয়ে বলতো
” এই মুগ্ধপরী রেগে আছো আমার ওপর চড় মেরেছি বলে , তাহলে আমাকে কি পিংকিশ টাইপের পানিশমেন্ট দেওয়া যাই না ?”
তাহলে হয়তো মুগ্ধতা একগাল হেসে স্পর্শর বুকে লুটিয়ে পড়তো, কিন্তু তা তো হওয়ার নই কারন ও যে সবসময় ভুলই করে ৷
বারবার এই কথাগুলো মনে করছে মুগ্ধতা ৷ যতদিন না ওর নিজের ম্যাচিউরিটি আসবে ততদিন ও স্পর্শর কাছে ফিরবে না, যদি তাতে ওর আরো বিশ বছর লাগে তাতেও ও অপেক্ষা করতে রাজি ৷ কিছু কিছু কথা মনের মাঝে খুব সহজেই দাগ কেটে যাই , যেগুলো সহজে ভোলা যাই না ৷

” আম্মু আমি আজকে বাসায় ফিরবো না ৷ শ্বশুরবাসা যাচ্ছি ৷”
কথাটা শুনে তনিমা আহমেদ হাসলেন ৷ মুচকি হেসে বললেন
” সাবধানে যাস, ড্রাইভ করবি দেখে শুনে ৷ বাইরে কিন্তু ঝড় উঠেছে, ছিটছিটে বৃষ্টিও পড়ছে, পৌছে ফোন করে দিস ৷”
” আচ্ছা আম্মু, আল্লাহ হাফেজ ৷”
স্পর্শ ফোনটা কেটে গাড়ি থেকে নামলো ৷ আইসক্রিস পার্লারে ঢুকেছে, মুগ্ধতার জন্য আইসক্রিম নেবে, এই বৃষ্টির রাতে আইসক্রিম খেয়ে ঠান্ডা ধরিয়ে দিলেও স্পর্শ তো আছে উষ্ণতা দেওয়ার জন্য ? ৷

এই শহর আমার পর্ব ১৪