একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৬

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৬
সাদিয়া জাহান উম্মি

অর্থ কাউচে বসে বসে ল্যাপটপে নিজের অফিসের কাজ করছে।প্রাহি স্টাডি টেবিলে পড়ছে। পড়ার মাঝে মাঝেও আঁড়চোখে অর্থ’র দিকে তাকাতে ভুলছে না ও।কি করে এতো লোকটা ল্যাপটপ নিয়ে।আজ দু’দিন যাবত দেখছে সারাদিন কি যেন করে ল্যাপটপ নিয়ে।ভালো লাগে না প্রাহির এসব আর।দু’দিন যাবত ভালোভাবে কথাও বলে না অর্থ ওর সাথে।মন খারাপ হলো প্রচুর প্রাহির।এই মন খারাপের কারনে আর পড়ায় মন বসলো না ওর।বই খাতা গুছিয়ে রেখে উঠে চলে গেলো বারান্দায়।প্রাহিকে এইভাবে পড়া রেখে উঠে বারান্দায় যেতে দেখে ভ্রু-কুচকে তাকালো অর্থ।হলো কি আবার এই মেয়ের?এমন মুখ গোমড়া করে রেখেছে কেন আশ্চর্য! অর্থ ভাবলো হাতের কাজটা শেষ করেই নাহয় প্রাহির কাছে যাওয়া যাবে।তাই আবারও কাজে মনোযোগ দিলো ও।

অর্থ’র বারান্দাটায় হাফ রেলিং দেওয়া।বাকিটা স্লাইডিং গ্লাস।প্রাহি স্লাইডিং গ্লাসগুলো একটানে খুলে দিলো।স্নিগ্ধ দমকা হাওয়ায় প্রান জুড়িয়ে গেলো ওর।প্রাহি আকাশের দিকে তাকালো।আজ আকাশে চাঁদ তারা কিছুই নেই।আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি।থেকে হালকা আওয়াজে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।এই একটু পরেই বোধহয় অঝোরে নামছে বৃষ্টিধারা এই ধরনীতে।এই বৃষ্টির দিনে এরশাদ সাহেব আর প্রাহি কতো বৃষ্টিতে ভিজতো লুকিয়ে লুকিয়ে।আর রাবেয়া বেগম কতো চিল্লাচিল্লি করতেন।তবে স্বামি আর মেয়ের পছন্দমতো ভুনা খিচুরি, নানান পদের ভর্তা আর কষা মাংস করতে ভুলতেন না।সেই দিনগুলোর কথা মনে পরতেই চোখ ভরে এলো প্রাহির।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ সকালেই মাকে আর বাবার কবরটা দেখে এসেছে ও।মা’কে প্রতিদিন দুবেলা দেখতে যায় ভার্সিটি যাওয়া আসার পথে।আর বাবার কবরটা দু’দিন পর পর যায় দেখতে।উনাদের না দেখলে যে প্রাহির মন ভালো থাকে না।তবে প্রাহি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ওর মা বাবার এই করুন পরিনতি করার পিছনে যেই থাকুক তাকে কঠোর শাস্তি দিবে প্রাহি।পুলিশ তো এটা এক্সিডেন্ট কেস বলে ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু প্রাহি আসল সত্যিটা টেনেহিছড়ে বের করে আনবে সবার সামনে।এতে ওর যা করার লাগে ও করবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।ভাবনার মাঝেই হুট করে প্রাহির ফোনে একটা ম্যাসেজ আসলো।প্রাহির ম্যাসেজের আওয়াজ পেয়ে সেটা ওপেন করতেই যেন হাজার বোল্ডের ঝটকা খেলো।

‘ সেদিন আমাকে অপমান করার শাস্তিটা কেমন হলো জান?আমার স্পর্শ ভালোলাগে না তাই নাহ?অথচ একই সাথে আপন দুইভাইয়ের সাথে তো ঠিকই ফষ্টিনষ্টি করতে পারিস।সেদিন আমাকে এইভাবে সবার সামনে অপমান করার শাস্তি হিসেবে তুই হারিয়েছিস তোর বাবাকে হারিয়েছিস।মা’ও একপ্রকার থেকেও নেই।এইবার ওই শিকদার বাড়ির লোকেদের পালা।তিলে তিলে মারবো এক একটাকে।পারলে আমাকে আটকে দেখা।আমি নিজেই সব স্বিকার করলাম।দেখি তুই কি করতে পারিস।শুনলাম বিয়েও না-কি করে ফেলেছিস?তা কি শুধু ওই অর্থ’র সাথেই সাথে সুয়েছিস? না-কি হেমন্ত’,র কাছেও গিয়েছিস?শোননা আমার কাছে একরাত কাটাছে চলে আসিস।আমি কিন্তু খুব ভালোভাবে সেটিস্ফাইড করবো তোকে।বি রেডি প্রাহি।বি রেডি।”

ম্যাসেজটা পরেই প্রাহির সারাশরীর ভয়ে কাঁপতে লাগলো।জয়ের এতো নোংরা কথা শুনে গা গুলিয়ে আসলো প্রাহির।নিজের আপন ভাইয়ের থেকে বেশি হেমন্তকে নিয়ে এইসব বাজে কথা আর সহ্য করতে পারলো না।মুখে হাত চেপে একদৌড়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে।বেসিনের সামনে যেতেই বমি করে দিলো প্রাহি।শেষ হতেই চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে সেখানেই বসে পরলো প্রাহি।হাতের চাপ লেগে ঝর্না চালু হয়ে ভিজিয়ে দিলো ওর সারা শরীর।কি করলো এটা জয়? তার মানে এইসব কিছুর পিছনে ওই জয় ছিলো।সেদিনের অপমানের কারনে শয়তানটা ওর পুরো পৃথিবী কেড়ে নিলো।এখন যখন আবার একটু সুখের খোঁজ করতে নেমেছে প্রাহি।কুকুরটা সেখানেও ওর নজর দিয়ে ফেলেছে।নাহ,প্রাহি আর কাউকে হারাতে পারবে না। ওই জয়কে এর প্রাপ্য শাস্তি পেতেই হবে। কুকুরের থেকেই নিকৃষ্ট ওই লোকটার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

এদিকে প্রাহিকে বারান্দা হতে ওইভাবে দৌড়ে ওয়াশরুমে ছুটে যেতে দেখেই ভয় পেয়ে যায় অর্থ।প্রাহির পিছু যেতে নিলেই প্রাহি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।ভেতর থেকে বমি করার শব্দ পেতেই যেন ভয়টা আরো কয়েকশোগুন বেরে গেলো ওর।ওয়াশরুমের দরজা বার বার ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলছে,
‘ প্রাহি? কি হয়েছে তোমার?দরজা খুলো প্রাহি।আমি কিন্তু নাহলে দরজা ভেঙ্গে ফেলবো। প্রাহি শুনছো তুমি?’
প্রাহির গায়ে একফোটা শক্তি নেই যে ও উঠে দরজাটা খুলে দিবে।শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়েছে।প্রাহি খানিকটা জোড় প্রয়োগ করেই বললো,
‘ ভেঙ্গে ফেলুন।’

প্রাহির জবাব শুনে ভ্রু-কুচকে ফেললো অর্থ।তবে আর বেশিক্ষন সময় নষ্ট না করে ড্র‍য়ার হতে দরজার চাবিটা এনে দরজা খুলে ফেললো।দরজা খুলতেই অর্থ অবাক।ঝর্নার পানিতে প্রাহির শরীর ভিজে একাকার।মেয়েটা নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্থ’র দিকে।অর্থ তাড়াতাড়ি ঝর্নাটা ওফ করে দিয়ে প্রাহির কাছে গেলো।তারপর একটানে প্রাহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।প্রাহি ধীর কন্ঠে বলে,
‘ আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন অর্থ।আমার প্রচুর শীত করছে।’
অর্থ আর এক মিনিট অপেক্ষা করলো না কথাটা শোনার সাথে সাথে প্রাহিকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো।প্রাহিকে বিছানায় সুইয়ে দিলো।মেয়েটাকে শুকনো কাপড় পরাতে হবে। কিন্তু কিভাবে?এতোরাতে কেউ তো সজাগ নেই।হিয়াকে ডাকলে পাবে বোধহয়।ওতো অনেক রাত পর্যন্ত স্টাডি করে।অর্থ প্রাহির নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকালো।নরম কন্ঠে বলে,

‘ তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি হিয়াকে ডেকে নিয়ে আসছি।তোমাকে শুকনো কাপড় পরাতে হবে।’
অর্থ যেতে নিলেই প্রাহি অর্থ’র হাত ধরে আটকে দিলো।দূর্বল কন্ঠে বলে,
‘ ওকে ডাকার দরকার নেই।আপনি আমার কাপড়গুলো এনে দিন আমি নিজেই চেঞ্জ করে নিতে পারবো।’
অর্থ চিন্তিত স্বরে বলে,
‘ কিন্তু তুমি তো সামান্য উঠতেও পারছো না। তোমার শরীরটা দূর্বল প্রাহি।আমি হিয়াকে ডেকে নিয়ে আসছি।কিছু হবে না।’

‘ লাগবে না বললাম না।আপনি এনে দিন আমি পারবো।’
প্রাহির জেদের কাছে হার মেনে প্রাহির কাপড়গুলো এনে দিলো ওকে। প্রাহির গালে হাত রেখে বললো,
‘ তুমি চেঞ্জ করে নেও।আমি গিয়ে তোমার জন্যে একটু গরম গরম স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি ওকে?’
প্রাহি ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত বারোটা বাজে।এতো রাতে অর্থ ওর জন্যে কিচেনে যাবে? নাহ এটা হবে না।প্রাহি দূর্বল হাসলো।বলে,
‘ তার দরকার নেই।একটু ঘুমালেই আমি ঠিক হয়ে যাবে।আপনি শুধু শুধু কষ্ট কেন করবেন?’
অর্থ রেগে গেলো প্রাহির কথায় ধমকে বলে,

‘ সেটা তোমার থেকে জিজ্ঞেস করে নিবো না নিশ্চয়ই?আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না।আমি ভালোমন্দ তোমার থেকে ভালো বুঝি।চুপচাপ চেঞ্জ করে নেও।আমাকে রাগিও না।’
অর্থ ধুপধাপ শব্দ করে চলে গেলো।প্রাহি মলিন হাসলো।তারপর জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে কম্বল মুরি দিয়ে সুয়ে পরলো।এতো রাতে ভেজার কারনে জ্বর আসছে বোধহয় ওর।প্রচন্ড শীত করছে।আরেকটা কম্বল হলে ভালো ছিলো।কিন্তু উঠে দাড়ানোর শক্তি নেই ওর মাঝে।অনেক কষ্ট কাপড়গুলো চেঞ্জ করেছে ও।

এদিকে অর্থ স্যুপ বানিয়ে নিয়ে এসে দেখে প্রাহি কম্বল মুরি দিয়ে সুয়ে আছে।বিছানার কিনারে ফ্লোরে ওর জামা কাপড় পরে আছে।অর্থ স্যুপটা টি-টেবিলে রেখে জামাকাপড়গুলো উঠিয়ে বাস্কেটে রেখে দিলো।তারপর প্রাহির কাছে বসে।ওর গা থেকে কম্বল সরাতেই প্রাহি কেঁপে উঠলো।সাথে সাথে কম্বল টেনে ধরে আবারও গায়ে দেয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো।শীতে ওর কান্না চলে আসছে।এমনিতেই মন ভালো না ওর।প্রাহি ক্রোদন স্বরে বলে,
‘ শীত করছে কম্বলটা ছাড়ুন প্লিজ।’

প্রাহি কথায় অর্থ ভ্রু-কুচকালো।প্রাহির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে হাত রাখলো।যা ভাবছে তাই।এতো রাতে ভেজার কারনে জ্বর এসে পরেছে।কিন্তু অতোটাও না হালকা গরম শরীরটা।অর্থ প্রাহিকে ভালোভাবে কম্বল পেচিয়ে দিয়ে খাটের সাথে হেলাম দিয়ে বসালো।তারপর যত্নসহকারে স্যুপ খাইয়ে দিলো।খাওয়া শেষে মেডিসিন দিতেও ভুললো।প্রাহি খাওয়া শেষ করে ধুপ করে সুয়ে পরলো।অর্থ উঠে গিয়ে ফ্রেস হয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে নিজেও প্রাহির পাশে এসে সুয়ে পরলো।প্রাহির শরীরের সাথে হাত লাগতেই বুঝতে পারে প্রাহি কাঁপছে।অর্থ ডাকলো,
‘ প্রাহি ঘুমিয়েছো?’

প্রাহি অর্থ’র দিক ফিরলো।নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে থেকে বুঝালো যে ও এখনো জেগে আছে।
অর্থ দুহাত মেলে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
‘ শীত করছে তোমার অনেক। আমার বুকে এসে সুয়ে পরো।শীত কম লাগবে।’
কথাটা বলতে দেরি প্রাহির অর্থ’র বুকে ঝাপিয়ে পরতে দেরি নেই।অর্থ’র শরীরের উষ্মতা পেয়ে প্রাহি একেবারে অর্থ’র বুকের মাঝে বিড়ালছানার মতো লেপ্টে রইলো।অর্থ হাসলো।আদুরেভাবে প্রাহির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।কিছুক্ষনের মাঝে প্রাহির ঘুমিয়ে পরলেও।অর্থ’র চোখে ঘুম নেই।প্রাহির জন্যে ওর চিন্তা হচ্ছে।মেয়েটা তো ঠিকই ছিলো।হঠাৎ এমন কি হলো যে ও এতোটা অসুস্থ হয়ে পরলো?না এভাবে ভাবলে হবে না।কাল সকালে প্রাহি ঘুম থেকে উঠতেই ওকে সবটা জিজ্ঞেস করতে হবে।নাহলে ওর শান্তি নেই।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৫

অর্থ তাকালো আবারও প্রাহির দিকে।মায়াবি এইমুখটার দিকে একবার তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে মনচায়।অর্থ প্রাহির গালে আর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে।নিজেও প্রাহিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টায় লেগে পরলো।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৭