এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১১

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১১
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

” জ্যোতি তুই কি এই পরিস্থিতির জন্য আমাকেই দায়ী করিস কেবল?তোর জীবনটা কি আমিই নষ্ট করি দিয়েছি ভাবিস?নাকি তোর দমবন্ধ অনুভূতির কারণ এই বিয়েটা?বিয়েটা থেকে মুক্তি চাস কি তুই?আমায় সবটা জানাতে পারিস নির্দ্বিধায়।”

মেহেরাজ ভাইয়ের শীতল কন্ঠে আকস্মিক প্রশ্ন শুনে চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম আমি।কালকের মতোই পানির বোতল হাতে নিয়ে দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। রাত প্রায় একটা ছুঁইছুঁই।সামনে পরীক্ষা বলেই পড়ছিলাম।আজও মেহেরাজ ভাই এভাবে হাজির হবেন আমি ভাবিনি।কিয়ৎক্ষন তাকিয়েই পুনরায় দৃষ্টি সরাতেই মেহেরাজ ভাই আমার সামনে এলেন।চেয়ার টেনে বসে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

” সামান্তা যদি কিছু বলে থাকে তা সিরিয়াসলি নিস না।মেহু বলল ও তোকে ছাদে দেখে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে?তুই কি সিরিয়াসলি নিয়েছিস?আশা করি তোকে তা বলেও দিতে হবে না।তুই খুব ম্যাচিউরড জ্যোতি। এইটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে তোর।তাই না?”

আমি মনে মনে হাসলাম।তখন সামান্তা আপু যা বলেছিল তার জন্যই বুঝাতে এসেছেন উনি?কিন্তু বুঝানোর কি প্রয়োজন?আমি কষ্ট পেলে উনার কিংবা অন্য কারোর ও বিশেষ ক্ষতি হবে কি?হবে না।তবে বুঝানোর কি প্রয়োজন?মেহেরাজ ভাই আবারও বললেন,

” কালকে রাতে তোর বলা কথাগুলো আমি অনেকক্ষন ভেবেছি। ভেবে মাথার মধ্যে এই ভাবনা কাজ করছে যে, এই বিয়েটা বোধ হয় আমার দোষের জন্যই হয়েছে।কিন্তু এটা সত্যি যে, বিয়েতে আমারও মত ছিল না জ্যোতি।আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় আমি মাথায় নিয়ে সেদিন তোকে স্যরিও বলেছিলাম।আজ প্রয়োজন হলে আবারও বলছি।”
আমি এবার মাথা তুলে চাইলাম।মেহেরাজ ভাইয়ের দৃষ্টি শান্ত। কন্ঠ শীতল।যেন কোন রাগ নেই আজ।কেমন স্নিগ্ধ চাহনী।নির্বিকারভাবে দুয়েক পলক তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠলাম,

” স্যরি বলেছিলেন।মনে আছে আমার।এখন কি করা উচিত আমার মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ ভাই আগের মতোই তাকালেন শান্তভাবে।বললেন,
” তুই আমাকেই কেন শুধু দায়ী করছিস এই পরিস্থিতির জন্য?”
আমি একপলক তাকিয়ে শান্তভাবে বললাম,
” আচ্ছা, আপনি দায়ী নন।আর কিছু?”
মেহেরাজ ভাই এবার চুপ হয়ে গেলেন।আমি হালকা হেসে বললাম,

” আপনি ইনিয়ে বিনিয়ে এই বিয়েটা থেকে মুক্তি চাইছেন মেহেরাজ ভাই?আমি খুব ভালোভাবে জানি আমি আপনার আর সামান্তা আপুর মাঝখানে চলে এসেছি দুর্ভাগ্যবশত।কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমারও এতে দায় নেই।আমি কখনো আপনাদের সুখ কেড়ে নিতে চাই নি।শান্তি কেড়ে নিতে চাইনি।

আপনি চাইলে সামান্তা আপুর সাথে সম্পর্কটা আগের মতোই চালিয়ে যেতে পারেন। আমি বাঁধা দিব না।তবে বিয়েটা থাকুক।হুহ?বিয়েটা ভাঙ্গবেন না।এমন নয় যে আমি আপনার সামনে বিয়ে নিয়ে কোন অধিকার দাবি করব।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি খুব শীঘ্রই চেষ্টা করব গ্রামের বাড়িতে দাদীর কাছে ফেরত যাওয়ার।আপনি চাইলে সামান্তা আপুকে বিয়ে করতে পারেন।এমন তো অনেকই হয় যে একজন পুরুষ দুই- তিনটে বিয়ে করে।তাই না?”

কথাগুলো একদমে বলে ফেলেই থামলাম।পরমুহুর্তে মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে একপলক তাকাতেই শিউরে উঠলাম।এতক্ষন যতোটা শান্ত, স্নিগ্ধ চাহনী ছিল এখন ঠিক ততোটাই রাগ মিশ্রিত হলো তার চাহনীতে।চেহারায় জ্বলজ্বল করল অদৃশ্য রাগ!চোখজোড়াও লালচে দেখাল।আমি তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে।মেহেরাজ ভাই শীতল অথচ শক্ত গলায় বলে উঠলেন,

” তোর কি আমাকে তেমন পুরুষ মনে হয় জ্যোতি?যে বিয়ে করেও পরকীয়ায় জড়াবো আমি?তোরা মেয়েরা পুরুষদের কি ভাবিস আসলেই জানা নেই।তোদের কি মনে হয় পুরুষরা মেয়ে বলতেই পাগল?যেখানেই মেয়ে দেখছে সেখানেই মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে?মেয়েদের বিয়ে করে নিচ্ছে?”
ছোট্টশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম,

” আপনি কথাগুলোকে নেগেটিভলি নিচ্ছেন মেহেরাজ ভাই।যেখানেই মেয়ে দেখছেন সেখানেই সম্পর্কে জড়াচ্ছেন কিংবা বিয়ে করছেন, এমন কোন কথা আমি উল্লেখ করিনি।আমি উল্লেখ করেছি আপনাদের ভালোবাসার কথা।দুইজন দুইজনকে ভালোবেসেছেন। বিয়ে করার, সংসার করার স্বপ্ন দেখেছেন।আমার জন্য কেন সেসব থেমে যাবে?”
মেহেরাজ লালভ দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলে উঠলেন কঠোর গলায়,

” আমি যদি চাইতাম তবে সেদিনই বিয়েটা থেমে যেতে পারত জ্যোতি।আমি চাইলে তোকে বিয়ে না করে চলে আসতে পারতাম।পারতাম না?কেন করিনি?কারণ আমি অতোটাও মনুষ্যত্বহীন নই।অতোটাও অমানুষ নই। আমার জন্য তোকে এসবের দায় নিয়ে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হবে মানতে পারতাম না।তাহলে নিজেই নিজের কাছে অনেক নিচু হয়ে যেতাম।তখন বিয়েটা অনেক ভেবেচিন্তেই করেছিলাম।পুরোরাত ভেবেছিলাম।ভালোবাসার কথা ভাবলে সেদিনই বিয়েটা করতাম না।আর একটা কথাও মাথায় রাখিস, আমি অন্যায় কাজে মত দিতে পারি না।না তো, দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারি।”

তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।প্রশ্ন ছুড়লাম,
” দয়া করেছেন মেহেরাজ ভাই?আমার কি কৃতজ্ঞবোধ প্রকাশ করা উচিত আপনাকে?”
” সারারাত ভেবে চিন্তে যখন বিয়েটা করেছিলাম যেহেতু অবশ্যই যুক্তি নিয়ে করেছিলাম।দয়া হলে সেটা বিয়ে পর্যন্ত যেত না জ্যোতি।”

আবারও প্রশ্ন করলাম তাচ্ছিল্য নিয়ে,
” তবে?বিয়েটা করে দায়িত্ব পালন করেছেন?”
মেহেরাজ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। টাউজারের পকেটে হাত গুঁটিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেললেন।তারপর বললেন,
” আমার দ্বারা অন্যায় কাজ হয় না সচারচর।তোকে বিয়ে না করলে বিষয়টা সেদিন চরম অন্যায় হতো।হয়তো বা নিজেকেই ক্ষমা করতে পারতাম না।আমি যেটা বলতে এসেছিলাম, সামান্তা হয়তো নিজের হুশে নেয়।আদরে, আহ্লাদে বেড়ে উঠেছে ও।বয়সে তোর থেকে বড় হলেও ও তোর থেকে বেশ ইমম্যাচিউরড জ্যোতি।পরবর্তীতেও যদি ও এমন কোন দোষারোপ করে বুঝে নিতে পারবি না নিজ থেকে?”

আমি আনমনর হাসলাম।প্রিয় মানুষকে এতটাই ভালোবাসেন যে তারই প্রিয় মানুষের আচরণে অন্য কেউ কষ্ট পেয়ে ভুল বুঝুক এটাও চাননা।কত ভালো গুণ!মাঝেমাঝে আপসোস হয়!মেহেরাজ ভাই যদি এই ভালোবাসাটা আমায় দিতেন, ঠিক এভাবেই আমায় ভালোবাসতেন?খুব বেশি ক্ষতি হতো কি?হয়তো হতো।হয়তো এই কঠিন হৃদয়ের মানুষটির ভালোবাসা হারিয়ে সামান্তা আপুর মতোই পাগলপ্রায় অবস্থা হতো আমার।তার থেকে না হয় এই সর্বনাশা ভালোবাসা না পাওয়ায় শ্রেয়!

মেহু আপু আর মেহেরাজ ভাই বেরিয়ে যাওয়ার পরই শিমা আপা আসলেন।আমি হালকা হাসলাম।শিমা আপা বেশ অদ্ভুত মানুষ।কেমন জানি ক্ষ্যাপাটে স্বভাব।কথা বলার ক্ষেত্রে কি কিি বললে কেউ কষ্ট পাবে, আঘাত পাবে না ভেবেই কথা বলে যান।তবুও এই ক্ষ্যাপাটে মহিলার সাথে আমার দুই চারটা কথা হয় এই অনেক।শিমা আপাকে রান্না ঘরে টুকটাক সাহায্য করে রান্না প্রায় শেষ হয়ে আসতেই আমি গোসলের জন্য গেলাম।কিছুক্ষন পর বের হয়ে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুঁছতে মুঁছতেই কানে এল শিমা আপার কন্ঠ,

“জ্যোতি মাইয়াডার মায় নাকি ছোডবেলায় মাইয়াডারে রাইখা অন্য পুরুষের লগে পালাইয়া গেছে।হায়রে!কেমন হের মা আর কেমনই বা হের মার চরিত্র!মাইয়ার দিকেও তাকাইল না ঐ মায়?নাজানি মাইয়াডার চরিত্র কেমন হয়।বড় ভাই তো বহুত ভালা মানুষ।ভালো মাইনষের কপালে ভালা জুটলেই ভালা।”

শিমা আপার বলা কথাগুলো শুনে পা থেমে গেল আমার।গ্রামের বাড়িতে মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা শুনতে শুনতে এখন এসবে আর বিশেষ অপমানিত বোধ করি না।বরং অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।কিন্তু এখানে এসেও যে সে একই অপমানের সম্মুখীন হতে হবে কখনো ভাবিনি আমি।শুকনো ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে থাকতেই এবার আরো একটা কন্ঠস্বর কানে এল।কন্ঠস্বরটা ফাতেমা আন্টির। শিমা আপার কথাগুলোকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই উনি বলে উঠলেন,

” সে কি বলো শিমা।মেয়েটারে দেখতে তো নম্র ভদ্র পরিবারেরই লাগল।মেয়ের মা যে এমন ছিল তা তো শুনিনি।তুমি কার কাছে শুনলে এমন কথা?”
” আরে নাবিলা আপার আম্মাই কইছে আমারে।”

” সত্যি নাকি?মেহেরাজ প্রেম ট্রেম করে শেষ পর্যন্ত এমন মেয়ে বিয়েই বা করল কেন?হয়তো মেয়েটা ভালো।মেয়ের মা ছিল আরকি তেমন।নয়তো মেহেরাজের মতো বুদ্ধিমান ছেলে নিজ থেকে বিয়ে করত নাকি এমন মেয়েকে?”
” নিজ থেইকা বিয়া করল কে কইল?বিয়া তো ওগো জোর কইরা দিল। সে বহুত কাহিনী!আপনে আবার এডি কারোরে বইলেন না ফাতেমা আপা।”
ফাতেমা আন্টি মাথা নাড়ালেন।মুহুর্তেই বলে উঠলেন,

” আরেহ না না, বলব না।”
কথাটা বলে সামনে তাকাতেই আমাকে দেখে চমকে গেলেন।চোখ বড়বড় করে বলে উঠলেন,
” একি মা!তুমি গোসল সেরে বের হলে নাকি?একটু এসেছিলাম বাসায় একা একা কি করছো দেখতে।দেখি শিমা রান্না করছে তাই ওর সাথে কথা বলছিলাম।”

আমি সৌজন্যতা দেখিয়ে হাসলাম।মানুষজাতি অদ্ভুত!পেছনে পেছনে একটা মানুষের নামে চরম পর্যায়ের খারাপ কথা বলতে পারলেও সামনে এলেই প্রশংসার জুড়ি মেলে।বললাম,
” ভালো তো।বসুস আন্টি।”
আন্টি বসলেন না।হেসে বলে উঠলেন,
” না না, মা।কাজ আছে বাসায় অনেক।যেতে হবে যে।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না।আন্টি চলে যেতে নিয়েও থেমে গেলেন যেন।বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়েই পরখ করলেন কি যেন।আমি স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফাতেমা আন্টির দৃষ্টি দেখছিলাম।হঠাৎই চোখে চোখ পড়ল।চোখাচোখি হলো।সঙ্গে সঙ্গে আন্টি থমমত খেয়ে গেলেন।আমি হাসলাম।দু পা বাড়িয়ে কিছু বলব ঠিক তখনই কলিং বেল বাঁজল।

ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক দরজার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলাম।পরমুহুর্তেই দরজা খুলে চমকে গেলাম আমি।আব্বা আর মেহেরাজ ভাই দুইজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছালেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালালাম।মনে মনে ভাবলাম, আব্বা কেন আসল?এতদূর পাড়ি দিয়ে আব্বা কি আমাকেই দেখতে এল?আমি কেমন আছি তা দুচোখে দেখার জন্যই এলেন?কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অনুভব করলাম কষ্ট হচ্ছে আমার।আজ যদি অন্যসব বাবা মেয়ের মতে আমার আর আব্বার সম্পর্কটাও স্বাভাবিক থাকত কত ভালো হতো।কি দোষ করেছি আমি?আমি কষ্টকে দমিয়ে নিলাম।আব্বাকে দেখে কেমন আছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো।দেরিও করলাম না।দ্রুত সালাম দিয়ে বললাম,

” কেমন আছেন আব্বা?দাদী ভালো আছে?বাড়ির সবাই কেমন আছে?”
আব্বা আমার দিকে তাকালেন।আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গলা ঝাড়লেন।তারপর কিছু বলতে নিতেই আকস্মিক এক ঘটনা ঘটল।নিচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ছুটে এলেন সামান্তা আপু।চোখমুখে কান্নার স্পষ্ট চিহ্ন।

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১০

আমি নির্বিকার ভাবে উনার ছুটে আসার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম।কিন্তু তার পরমুহুর্তেই আরো এক আকস্মিক ঘটনা ঘটালেন তিনি।হুট করেই এসে মেহেরাজ ভাইকে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।আব্বা বোধ হয় সেই দৃশ্য দেখে আমার থেকেও বেশি অবাক হলেন।চোখমুখে সে অবাক হওয়ার রেশ দ্রুতই জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল তার।

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১২