এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৪

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৪
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

” আবেগ আর ভালোবাসা দুটো জিনিস কিন্তু এক নয় জ্যোতি।তোর বয়সটা আবেগের। তবে আমার কেন জানি মনে হয়েছে তুই কখনোই অতোটা ইমম্যাচিউরড না যে আবেগে আপ্লুত হয়ে জীবনের সর্বনাশ ঘটাবি।আবেগ আমাদের মুগ্ধ করে, বিভোর করে।যেমনটা আমরা মরিচীকার পেছনে দৌঁড়াই?

আবেগেও আমরা ঠিক সেভাবেই বিভোর হয়ে ছুটে যাই।কিন্তু যখনই দেখি সেটা মরিচীকা তখনই আমার ভুল ভাঙ্গে। তখনই বুঝতে পারি, আমাদের ধারণা ভুল ছিল।আবেগটাও তেমন।সাময়িকভাবে আমরা আবেগকে ভালোবাসা বলে দাবি করে।তবে একটা সময় পর ঠিকই বুঝতে পারি তা কেবলই আবেগ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

আমরা জোনাক পোঁকার আলো দেখে মুগ্ধ হই। বিভোর হই।কাছে ছুটে যেতে চাই।ছুঁতে চাই সেই জোনাক পোঁকার আলোকে।কিন্তু আগুনের আলোককে কি ঠিক সেভাবেই ছুঁতে চাই?আগুনের আলোক দেখে কি ঠিক সেরকমই মুগ্ধ হই?হই না।ভালোবাসা হলো জ্বলন্ত আগুনের ন্যায় যাতনা।কাউকে ভালোবাসলে নির্দ্বিধায় সেই জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দেওয়া যায়।সেই আগুনে পুড়ে দগ্ধ হওয়া যায়। কিন্তু আবেগে তা কখনোই করা যায় না জ্যোতি।আবেগ হলে তা আগুনের স্বল্প তাপ অনু়ভূত হতেই লোপ পায়।আর ভালোবাসায় মানুষ বারংবার দগ্ধ হয়েও ভালোবেসে যায়।এটাই পার্থক্য!”

বিছানা গুঁছিয়ে রাখিলাম।ঠিক সেসময়ই কথাগুলো কানে আসল।নিরবে শুনে গেলাম সবগুলো কথা।তারপর জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলাম,
” এসব কথা আমাকে বলার মানে কি মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন। বললেন,

” কথাগুলোর মানে এটাই যে, তোর এই বয়সটা যেমন আবেগের? তেমনই জীবনের মেইন পয়েন্টটা হচ্ছে এই বয়সটা।এই বয়সে তুই কতটুকু ভুল করবি, কতটুকু পরিশ্রম করবি, কতটুকু অর্জন করবি তার সমস্তটুকুর ফলই তোকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।শুধু এই কথাটা মাথায় রাখতে পারবি?”
মাথা নেড়ে বললাম,

” পারব।”
মেহেরাজ ভাই ঠোঁট চওড়া করলেন।নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও বললেন,
” গুড!নিজের জীবনটা নিজের স্বপ্ন অনুযায়ী সাঁজানোর জন্য সর্বোচ্ছ চেষ্টা কর জ্যোতি।সো কল্ড আবেগ কিংবা রিলেশন এসবের পেছনে সময় ব্যয় না করে নিজের জীবনে ফোকাস কর। সত্যি বলছি,বাস্তবতা কঠিন। ভয়ংকর কঠিন!পরে দেখা যাবে সবকিছুর পেছনেই সময় ব্যয় করলি কিন্তু নিজের জীবন গুঁছাতে পারলি না।”

আমি চুপ থাকলাম।বুঝলাম, মেহেরাজ ভাই কেন কথাগুলো বলছেন।সাঈদ ভাই মানুষটার প্রতি তীব্র বিরক্তি ভর করল।কি দরকারে এত বড় মিথ্যেটা বলে দিলেন উনি?মেহেরাজ ভাই সত্যি সত্যিই ভাবছেন আমি উনার প্রতি দুর্বল? আমি উনার প্রেমে হাবুডুবু খেয় সাঁতার কাঁটছি?ছিঃ!

একবার পুকুরঘাটে চরম অপমান করার পরও বেহায়ার মতো এখনও আমি উনাকে ভালোবাসি কথাটা ভেবে আমার প্রতি উনার কেমন ধারণা জম্মাল?নির্ঘাত পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাক্তিত্বহীন আর বেহায়া মেয়েটা আমায় ভেবে নিয়েছেন। আমি ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লাম।স্পষ্ট গলায় বললাম,

” সাঈদ ভাই মিথ্যে বলেছেন। আমি আপনার নামের অক্ষর লিখিনি মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” আমি তো বলিনি তুই আমার নামের অক্ষর লিখেছিস। ”
জিজ্ঞেস করলাম,
” তবে এসব বলছেন যে?”
মেহেরাজ ভাই ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন,

” অক্ষর লেখায় কতটুকু কি প্রকাশ পায় জানা নেই, তবে চোখের ভাষাতে অনেককিছুই বুঝা যায় জ্যোতি।তাই বলছি, অসময়ে অনুচিত বিষয়ের পেছনে সময় না ব্যয় করে পড়ায় মনোযোগ দে।পড়ালেখার বিষয়ে হেলাফেলা করিস না।পরে নাহলে আপসোস করবি।”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথার মানেটা বুঝতে পেরেই প্রবল অপমানে অপমানিত হলাম আমি।অনুচিত?হ্যাঁ অনুচিতই তো। অন্যের প্রেমিককে নিয়ে ভাবনা অনুচিতই হবে।তবে তা এভাবে মুখের সামনে বলে অপমান করে কি উনি মহান হয়ে গেলেন?হয়তো হয়ে গেলেন মহান।আমি অপমানে জর্জরিত মুখখানা নিয়ে পিছু ঘুরলাম।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম মেহেরাজ ভাইকে এবার থেকে শুধুই এড়িয়ে যাব।জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি এড়িয়ে যাব।এমনকি চোখ তুলেও উনার দিকে আর তাকাব না আমি।উনার প্রতি এইটুকু অনুভূতিও আর জমা রাখব না নিজের মধ্যে।

সেদিনকার সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো আরো দুই সপ্তাহ পর।এই দুই সপ্তাহ প্রয়োজন ছাড়া মেহেরাজ ভাইয়ের সামনেই যাইনি।ঘরে পড়লেও দরজা লাগিয়ে পড়েছি।কথা হলেও টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা।ব্যস এইটুকুই!কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধল শিমা আপাকে নিয়ে।শিমা আপা উনার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন।সকাল থেকে মেহু আপু আর আমি এই খবর জানতাম না।জানা থাকলে রান্নার কাজ অনেকটাই হয়ে যেত এতক্ষনে।জানলাম তখনই, যখন মেহেরাজ ভাই ঘুম থেকে উঠলেন।কপালে আসা এলোমেলো চুল আর সদ্য ঘুম ভাঙ্গা ফোলাফোলা চোখে পুরো রান্নাঘরে একবার তাকিয়েই বললেন,

” শিমা আপা বলেছে এক সপ্তাহ আসবে না।তোরা কি খাবি বলে ফেল। মুখ ধুঁয়ে এসে রান্না করব।”
আমি আর মেহু আপু দুইজনই চোখ ছোটছোট করে তাকালাম।মেহু আপু প্রশ্ন ছুড়লেন,
” কেন আসবে না শিমা আপা?”
উত্তরে মেহেরাজ ভাই বললেন,
” গ্রামের বাড়ি যাবে তাই ছুটি চেয়েছে।”

কথাটুকু বলেই থমথমে মুখে আবারও নিজের ঘরে চলে গেলেন।মেহু আপু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।বললেন,
” আজ সবাই বাসায়ই আছি।আমিও ভার্সিটিতে যাব না।আজ সবাই একসাথে রান্না করি জ্যোতি?মনে আছে তোর ছোটবেলার চড়ুইবাতির কথা?সবাই মিলে জমিয়ে রান্না করতাম না তখন?”

মেহু আপুর কথাতে হালকা হাসলাম।স্মৃতিতে ভেসে উঠল ছোটবেলার সেই প্রাণবন্ত স্মৃতি।মিথি, আমি, মেহু আপু, নাবিলা, নাফিসাসহ সব ক্ষুদে বাচ্চারাই উঠোনে ইট দিয়ে চুলা বানানোয় ব্যস্ত হতো।কেউ চাল, কেউ তেল, কেউ বা নুন আনত!রান্নার দায়িত্বে থাকত বড় কেউ।আমরা ছোটরা সব সাহায্য করতাম রান্নার কাজে।কেউ কেউ আলু কাঁটত, কেউ বা পেয়াজ কাঁটত।তখন মিথিও থাকত আমার আশপাশে।ছোট ছোট তুলতুলে হাত পা নাড়িয়ে নেচে নেচে বেড়াত চারপাশটায়।কি সুন্দর স্মৃতি!ইশশ!আবারও যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই সুন্দর শৈশবকালে?কত সুন্দর হতো।মিথিকেও ফেরত পেতাম তাহলে আবার।পরমুহুর্তেই নিজের অবাস্তব ভাবনায় নিজেই হাসলাম।একবার মেহু আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

” হ্যাঁ আপু।সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো।”
” অনেক সুন্দর ছিল রে জ্যোতি।এবার বাড়ি গেলে আবারও আগের মতো চড়ুইবাতি করব কেমন?সুন্দর হবে না?”
আমি আবারও হাসলাম।বললাম,
” হ্যাঁ,আপু।সুন্দর হবে।”

মেহু আপু হাসলেন।ততক্ষনে উপস্থিত হলেন মেহেরাজ ভাই।চোখমুখে আবছা পানির ছোঁয়া।চুলও পরিপাটি।পরনে কালো টিশার্ট।টাউজারের পকেটে হাত ডুকিয়ে টানটান বুক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন উনি।মেহু আপু ঠোঁট চওড়া করে বলে উঠলেন,

” ভাইয়া?আমি আর জ্যোতিও হেল্প করব।ঠিকাছে?”
মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচু করলেন।একনজর আমার দিকে তো একনজর মেহু আপুর দিকে তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
” কেন?”
মেহু আপু হেসে হেসেই বললেন,

” আমি তো কাজ পারি।মন চাইছে কাজ করতে তাই। নুডুলস খাব।চলো রান্না করে ফেলি।”
মেহেরাজ ভাই তাকালেন শীতল চাহনীতে।তারপর যেতে যেতেই বললেন,
” আয়।”

মেহু আপু লাফিয়ে উঠলেন।শুধু যে নিজেই লাফিয়ে উঠলেন তা নয়।আমার হাতটাও চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে।একপাশে দাঁড়িয়ে হুট করেই হাতে চুরি নিয়ে বলে উঠলেন,
” কি করতে হবে ভাইয়া?”

মেহেরাজ ভাই ছোট ছোট চোখ করে তাকালেন।পেয়াজ কাঁটার কাজটা আমাদের দিয়ে চুলায় কড়াই বসালেন।আমি আড়চোখে দেখে গেলাম উনাকে আর উনার কাজকর্মগুলোকে।ছেলেমানুষ হিসেবে কাজকর্ম খুব একটা গোছাল না হলেও রান্নাটা দক্ষ ভাবেই চালিয়ে গেলেন।কিন্তু হঠাৎই বাঁধল বিপত্তি।অসাবধানতা বশত মেহু আপুর হাত কেঁটে বসল চুরির ধারালো আঘাতে।

মেহেরাজ ভাই ব্যস্ত হলেন মেহু আপুর কাঁটা হাত নিয়ে।দুয়েকটা বকাবকি করে টেনে নিয়ে গেলেন রান্নাঘর থেকে।আমি একপলক তাকিয়ে চুলার দিকে তাকালাম।চুলায় তখনও কড়াই বসানো।ধীর পায়ে এগিয়ে দেখলাম রান্না প্রায় হয়েই এসেছে।বাকি রান্নাটাও সম্পন্ন করে কড়াই নামালাম চুলা থেকে। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম রান্নাঘরের অবস্থা বেহাল!

মেহেরাজ ভাই মনোযোগ দিয়ে রান্না করেছেন ঠিক তবে আশেপাশে আর খেয়াল রাখেননি।সব জিনিসপত্র অগোছাল করে খুশিমনে রান্না করেছেন।পরে অবশ্য গুঁছিয়ে নিতেন।উনার মতো গোছাল মানুষ অগোছাল জিনিস অগোছালই রেখে দিবেন ভাবা বোকামো।আমি ধীরে ধীরে সব জিনিস গুঁছিয়ে রাখতে লাগলাম।তার মধ্যেই মেহেরাজ ভাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রান্নাঘরে।একপলক তাকিয়ে বলে উঠলেন,

” শেষ রান্না?”
আমি শুধু উত্তরটুকুই দিলাম,
” হ্যাঁ।”
মেহেরাজ ভাই চুলায় তাকিয়ে বলে উঠলেন,
” কড়াই তুই নামিয়েছিস?”
আবারও কেবল উত্তরটুকুই বললাম,
” হ্যাঁ।”

মেহেরাজ ভাই এবার সামনে এসে দাঁড়ালেন।কিঞ্চিৎ রাগ ঝেড়ে বললেন,
” কে বলেছে নামাতে?হাত টাত পুড়ে গেলে তখন দোষ তো আমারই হতো। আর কখনো নিজ থেকে চুলায় কাজকর্ম করতে আসবি না।”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথায় ব্যাপক হাসি পেল।যার শৈশব থেকে রান্না করার অভ্যাস আছে তাকে এসব বলা কেমন জানি হাস্যকর ঠেকায়।যদি রান্নায় অপটু হতাম তবে বোধহয় এসব শাসন আমার ভালো লাগত।আহ্লাদে খুশিও হয়ে উঠত বোধহয় আমার মন। দাদী বলত,প্রিয় মানুষের শাসনেও ভালো লাগা অনুভব হয়।কিন্তু তার কিছুই আমি অনুভব করলাম না।মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

” পুড়ত না।পুড়লেও আপনার উপর দোষ দিতাম না মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে বললেন,
” মেহুর কাছে যা।”
আমি অগোছাল ঘর গুঁছিয়ে নিতে নিতেই বললাম,
” গুঁছিয়েই যাচ্ছি।অল্প বাকি।আপনি বরং যান।”
মেহেরাজ ভাই কিঞ্চিৎ শাসিয়েই বললেন,

” যেতে তোকে বলেছি।আর তুই আমাকে বলছিস?”
মেহেরাজ ভাইয়ের গম্ভীর আওয়াজে এক পলক তাকালাম উনার দিকে।উনার ভ্রু কুঁচকানো। মনে মনে ভাবলাম এভাবে

” আপনি বরং যান ” কথাটা বোধহয় বলা উচিত হয়নি।মৃদু গলায় বললাম,
” আপনার তো কাজ নেই আর।তাই বললাম যেতে।আমি একেবারে নাস্তা নিয়েই আসছি।”
” আমি আনছি।তুই যা।”

আমি মাথা নাড়ালাম।গোঁছানোর কাজটুকু শেষ করার জন্যই চুলার পাশ থেকে হলুদের বক্সটা নিয়ে অন্যপাশে রাখতে যেতেই মেহেরাজ ভাই ধরে নিলেন বক্সটা।আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েই চাপাস্বরে বললেন,
” বললাম না তোকে যেতে? দুপুরের রান্না করতে আবারও এসব অগোছাল হবে।একেবারে রান্না শেষে সব গোছালভাবে রাখব।”

আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হলো।মেহেরাজ ভাই দাম্ভিক চেহারায় অন্যদিক ফিরে হলুদের বক্সটা আগের মতোই রেখে দিল।আমি আগ বাড়িয়ে আর কিছু বললাম না।বেরিয়ে এলাম দ্রুত।

দুপুরের খাবার রান্না হওয়ার পরপরই মেহেরাজ ভাই রান্নাঘর ছেড়ে বের হলেন।চোখমুখে ঘামের আবছা ছাপ।রুমালের একাংশে সে ঘাম মুঁছতে মুঁছতেই আমার আর মেহু আপুর সামনে এসে দাঁড়ালেন।একনজর কাঁটা হাতের দিকে তাকিয়েই বললেন,

” কি দরকার ছিল রান্নার কাজে হাত লাগানোর মেহু?”
মেহু আপু ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়েই হেসে দিল। কাঁটা আঙ্গুলটা দেখেিয়ে বলল,
” উহ!আমি তো টুকটাক রান্না পারিই ভাইয়া। এইটুকু কাঁটাতে এত চিন্তার কি আছে বলো তো?ঠিক হয়ে যাবে।অল্প একটুই তো কেঁটেছে।”

মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে কিছু বললেন না।শুধু একবার তাকিয়েই নিজের ঘরে পা বাড়ালেন।আমি তখনও মেহু আপুর সাথে বসে টুকটাক কথা বলছিলাম।তার কিছুক্ষন পরই নাবিলা আসল বাসায়।পাশে বসেই চঞ্চল গলায় বলে উঠল,
” হোস্টেল থেকে মাত্রই ফিরেছি।শুনলাম মেহু আপুও আজ বাসায় থাকবে?জ্যোতির সাথেও অনেক গল্প বাকি।তাই চলে এলাম।”

আমি হাসলাম।নাবিলার কথাগুলো সুন্দর।ছোটবেলার বন্ধু বলেই কিনা কিজানি তবে আমার কেন জানি না মনে হয় ও আমার আপন মানুষ।হোস্টেলে থাকে বিধায় তেমন একটা সময় কাঁটানো হয়ে উঠেনি ওর সাথে।তবে যখনই আসে তখনই ও খুব আপনভাবেই কথা বলে। আমি ঠোঁট চওড়া করে হেসেই বললাম,
” কেমন আছিস?”
নাবিলা হেসেই উত্তর দিল,

” ভালো ছিলাম না।তোদের দেখে ভালো হয়ে গেছি।শুনেছি তুই নাকি কার প্রেমে পড়েছিস জ্যোতি?তার নামের প্রথম অক্ষর নাকি এম?সাঈদ ভাইয়া না বললে তো জানতেই পারতাম না আমি।আরো একটা কথা, তুই সাঈদ ভাইয়ার কাছে পড়িস এটা জানার পর থেকেই চরম আপসোস হচ্ছে আমার। সাঈদ ভাইয়া মানেই কিন্তু আগুন!”
নাবিলা কথাটা বলার সাথে সাথেই মেহু আপুর চোখ ছোট ছোট হলো।মুহুর্তে বলে উঠল,

” আগুন মানে?উনার গায়ে কি আগুন জ্বলে জ্বলে উঠে নাকি? ”
নাবিলা হেসে উঠল।বলল,
” তা কেন হবে।দেখো না সাঈদ ভাইয়ার কথায় সব মেয়েই কেমন সম্মোহিত হয়ে যায়।উনার কথায় একটা জোস জোস ব্যাপার আছে না আপু?”

মেহু আপুর মুখভঙ্গি পাল্টাল।ভ্রু উুচিয়ে বলে উঠল,
” জোস জোস ব্যাপার আবার কেমন?আমার তো কোনদিন উনার কথায় কিছু মনে হয়নি।”
নাবিলা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

” তুমি মানুষটা কেমন জানি মেহু আপু।সাঈদ ভাইয়ার কথায় প্রেম প্রেম ব্যাপার আছে।আমার তো উনার কথা শুনলেই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে।কেমন একটা অনুভূতি হয়।কেমন জানি ফিল করি মেহু আপু। ”
মেহু আপু ফের ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
” তো উনি তোকে এইসব প্রেমময় বাক্য বলে শোনায় কখন?”
নাবিলা উত্তর দিল,

” যখন দেখা হয় তখনই তো কথা হয়৷ আজ থেকে জ্যোতির সাথে সাথে আমিও পড়ব সাঈদ ভাইয়ার কাছে বুঝলে?ভাইয়াকে অবশ্য বলেছিও আমি।”
মেহু আপু জিজ্ঞেস করল,
“কখন বলেছিস?”
নাবিলা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,

“ম্যাসেজে বলেছি। জ্যোতির কথাটাও তো সাঈদ ভাইয়া ম্যাসেজেই বললেন।”
মেহু আপুর মুখখানা নিভে গেল কেমন।আমি চুপচাপ দুইজনের কথা শুনছিলাম।মেহু আপুর মুখাবয়ব লক্ষ্য করেই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠলাম,

” নাফিসা কোথায়?ওকে আনলি না যে?”
নাবিলা মুখ কুঁচকে উত্তর দিল,
” ও কোথায় জানি না৷ হোস্টেল থেকে ফিরলামই তো মাত্র৷ দেখিনি রে।”
কথাটা শুনে সৌজন্যতামূলক হাসলাম ।আরো কিছুক্ষন গল্পগুজব চলল তিনজনের।

রাতে সাঈদ ভাইয়া পড়াতে আসলেন ঠিক তবে আজ পড়ার থেকে কথায় বেশি চলল।নাবিলার সাথে সাঈদ ভাইয়ের প্রেম প্রেম বার্তা শুনে মস্তিষ্ক তিক্ত হয়ে উঠল।এতদিনের কথাবার্তায় সাঈদ ভাই সম্পর্কে কতটুকু কি ধারণা করেছিলাম জানি না। তবে আজকের কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম সাঈদ ভাই কোন পর্যায়ে গিয়ে ফ্লার্ট করতে পারেন।আর নাবিলা যেন সেইসব কথাবার্তায় আপ্লুত হয়ে আত্মহারা হয়ে পড়ল।

মাঝেমাঝেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে পুরো ঘর মাথায় তুলছে।আমি বিরক্ত হলাম সাঈদ ভাইয়ের প্রতি।এক পর্যায়ে সেই বিরক্তি আকাশ ছুঁয়ে গেল।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকলাম আর দুইজনের কথোপকোতন শুনতে লাগলাম।ঠিক সে সময়ই টেবিলের সামনে এসে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন মেহেরাজ ভাই।শীতল চাহনী ফেলে ভরাট গলায় বলে উঠলেন,
” সাঈদ!তোকে পড়াতে বলেছিলাম নাকি হাসাতে বলেছিলাম?এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হাসাহাসির আওয়াজ শুনেছি।। ”

সাঈদ ভাই মুহুর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।নিভু নিভু দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলেন,
” তুই বাসায় আছিস?জানতাম না তো।”
মেহেরাজ ভাইয়ের চাহনী পাল্টাল।গরম চোখে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” মানে আমি বাসায় না থাকলে তুই সবসময় এমন ফ্লার্টিং চালিয়ে যাস জ্যোতির সাথে?”
সাঈদ ভাই মুহুর্তেই উঠে দাঁড়ালেন।মাথায় হাত দিয়ে দ্রুত বলে উঠলেন,
” সত্যি বলছি মামা!আজই করেছি কেবল।জ্যোতির সাথে সেভাবে কোনদিনই কিছু বলিনি। তুই ওকে জিজ্ঞেস কর।”
মেহেরাজ ভাই পাত্তা না দিয়ে বললেন,

” তোকে বিশ্বাস নেই।”
সাঈত ভাই চুপসে যাওয়া মুখ করে বললেন,
” ধুরর!জ্যোতিকে বোন বলছি আমি।ওর দিকে সে নজরে তাকানো নিষেধ।তাছাড়া তোরা ভাইবোন প্রথমেই যেভাবে শাসিয়ে বলেছিস আমি জীবনেও ওর সাথে ফ্লার্ট করতাম না বন্ধু।বিশ্বাস কর।”
মেহেরাজ ভাই বুক টানটান করে শ্বাস ফেললেন।বললেন,

” করলাম।এবার জ্যোতিকে যে নজরে দেখছিস নাবিলাকেও সে নজরেই দেখবি।বন্ধুর বোন মানে তোরও বোন।মনে থাকবে?”
নাবিলার মুখটা মুহুর্তেই চুপসে গেল কেমন।সঙ্গে সাঈদ ভাইয়ের মুখটাও নিভু নিভু হলো।তবুও দমলেন না সাঈদ ভাই।মুখে চমৎকার বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,

” তুই বললেই হলো নাকি?বন্ধুর বোন মানে আমার বউ।দেখিস না তোকে কত শ্রদ্ধা করে শালা ডাকি।”
মেহেরাজ ভাই পাত্তা দিলেন না।বললেন,
” এটা স্বপ্নতেই সম্ভব।তোকে আমার কোন বোনকেই দিচ্ছি না। তুই যে লেভেলের খেলোয়াড়!”
সাঈদ ভাই বাঁকা হেসে শুধালেন,

” তুই দেওয়া লাগবে না।তোর বোনই চলে আসবে রে বন্ধু।”
কথাটা বলেই সাঈদ ভাই হাসলেন।ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়েই বলল,
” আসি তাহলে বাচ্চারা?”

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৩

কথাটা বলতেই নাবিলা নাজুক হাসল।মুখ নত করে লজ্জ্বায় লাল করল ওর দুই গাল।আমি সবই খেয়াল করলাম।হতাশ চাহনীতে ফের উপরের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই আর সাঈদ ভাই দুজনই বেরিয়ে গেছেন।থেকে গেল কেবল নাবিলার লজ্জ্বায় লাল হওয়া মুখ।

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৫