এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৮

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৮
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

সময় চলে গেল খুব দ্রুত। মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে প্রতি সপ্তাহে এক দুইবার করে কথা হয়েছে এই কয়েকমাস।সে কথোপকোতনে কখনো বা মেহেরাজ ভাইয়ের রাগ রাগ কন্ঠ , আবার কখনো বা গাম্ভীর্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমায়।উনাদের বাসায় না যাওয়ার বিষয়টা দাদীকে এই সেই বুঝিয়েই রাজি করিয়েছিলাম।ফরস্বরূপ দাদীর আদেশ শুনে মেহু আপু বা মেহেরাজ ভাইও খুব একটা জোর করেননি।এর মাঝেই এইচ এস সি পরীক্ষা প্রায় শেষ হতেই চলল ।

আরো পাঁচটা পরীক্ষা বাকি।ব্যবহারিক পরীক্ষাও বাকি আছে।কাল বন্ধ। পরীক্ষা নেই।সেই জন্যই রাত প্রায় তিনটে পর্যন্ত জেগে থেকেই ঘুমোতে গেলাম।সকালে উঠতে কিঞ্চিৎ দেরিও হলো আমার।তখন সকাল সাতটা।দাদী আজ এখনও ঘুম ছেড়ে উঠেনি দেখে অবাক হলাম।এমনিতেই এই কয়েকমাস দাদীর শরীরের অবনতি বাদে উন্নতি চোখে পড়েনি আমার।প্রত্যেকটা দিন কেঁটেছে অসুস্থতায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

কখনো প্রেসার লো, কখনো বা হাঁটু ব্যাথা, কখনো কোমড় ব্যাথা,কখনো বা জ্বরে অসাঢ় অবস্থা।এই তো সাতদিন হলো তীব্র জ্বর দাদীর শরীরে।এই যায় তো এই আসে।আব্বা আর চাচারা ডাক্তার দেখিয়ে এনেছেন।নিয়মমতো ঔষুধ চলছে।তবুও দাদীর জ্বর সারছে না।কাল আবারও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছিল আব্বা। এর মাঝেই অজানা চিন্তায় মুহুর্তেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

দাদী যেমনই অসুস্থ হোক না কেন, শুঁয়ে থাকার মানুষ নয়।তীব্র অসুস্থতায় ও তার হাত পায়ের চলন তাকে সচল রাখতেই হয়।আমি দ্রুত দাদীর রুমে গেলাম। দেখলাম ওপাশ করে শুঁয়ে আছে।বালিশটা তেলে চিপচিপে হয়ে আছে।কাল রাতেই দাদীর মাথায় তেল দিয়ে দিয়েছিলাম।সেজন্যই সব তেল বালিশে লেগেছে।আমি এগিয়ে ডাক দিলাম,

” দাদী?ঘুম ছেড়ে উঠোনি যে?সকাল তো হয়ে গেল।”
দাদী উত্তর দিল না।আমি ফের বললাম,
” দাদী?কি হলো শুনছো না?উঠছো না কেন ঘুম থেকে আজ?”
দাদী এবার ও কোন উত্তর দিলেন না।আমি হতাশ হলাম।পা বাড়িয়ে বিছানার এককোণে বসেই বলে উঠলাম,
” দাদী?জ্বরটা কি বেড়েছে?খারাপ লাগছে তোমার ভীষণ?

কথাটা বলেই হাতটা এগিয়ে ছুঁয়ে দিলাম দাদীর কপাল।দাদীর কপালে উষ্ণতা অনুভব হলো না।অনুভব হলো শীতলতার।কি ভীষণ শীতল অনুভব করলাম দাদীর শরীর।আমি হাতটা সরিয়ে নিলাম দ্রুত।অবিশ্বাস্য চাহনী রেখেই আবারও কপালে ছুঁয়ে দিলাম হাতের তালু।এবারে ও বোধ করলাম যে, দাদীর কপাল ঠান্ডা।ভীষণ ঠান্ডা।আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,

” দাদী?তোমার জ্বর কি কমে গিয়ে….”
বাকিটুকু আর বলতে পারলাম না আমি । অজানা শঙ্কায় হাত পা কাঁপতে লাগল আমার।নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসল মুহুর্তেই।মনে পড়ল মিথির মৃত চেহারা।মিথির শীতল শরীর। মিথির সেই নিশ্চুপ থাকা মুহুর্ত। মিথির সেই নিথর শরীর।আমার শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগল।খেয়াল করলাম আমার ভেতরকার অস্থির উত্তেজনা। কাঁপা স্বরে বললাম,

” দা.. দাদী কথা বলো দয়া করে।”
“দা্ দী?”
” এই দা্ দা্ দী?”

আমার বুকের কম্পন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ল। কথারা গলায় আটকে রইল এবার।হাত পা কেমন জমে এল দ্রুত।তবুও চেষ্টা চালালাম নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখার।হাতটা বাড়িয়ে দাদীর নাসারন্ধ্রের সামনে ধরতেই আমি চমকে উঠলাম।দাদীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের অস্তিত্ব টের না পেয়েই আমি দমে গেলাম এবার।হাত সরিয়ে আবারও হাত রাখলাম একইভাবে৷ এবারেও একই উত্তর।দাদীর নিঃশ্বাস চলছে না।

অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলাম দাদীর ঘুমন্ত চেহারায়।মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেল।এক মুহুর্তের জন্য যেন সব থমকে গেল।বুকের ভেতর অদ্ভুত যন্ত্রনাময় কষ্ট অনুভব করলাম।তবে কান্না পেল না আমার।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল না নোনতা পানি।শুধু স্থির চেয়ে থাকলাম দাদীর দিকে।কঠিন সত্যটা মানতে কষ্ট হলে ও কঠিন সত্যটা আমার অজানা নয়।তবুও সেই কঠিন সত্যটা আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারলাম না মনপ্রাণ থেকে।উঠে গিয়ে আব্বাকে ডেকে এনে বললাম,

” আব্বা?দাদী আজ ঘুম ছেড়ে উঠছে না কেন?দাদীকে বলুন না ঘুম থেকে উঠতে।”
আব্বা আসলেন।একে একে বাড়ির সবাই আসলেন। এমনকি ডাক্তারও আসলেন।এসে শুধালেন, দাদী আর জীবিত নেই।দাদী আর এই পৃথিবীতে নেই।দাদী আর আমার সাথেই নেই।কোথাও নেই!কোথাও না।দাদী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা মানতে কতোটা কষ্ট হলো জানা নেই, তার থেকে বেশি অভিমান হলো দাদীর উপর।

দাদী জানত, এই পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই তেমন।থাকার মধ্যে শুধু দাদীই ছিল।তবুও কিভাবে পারল আমায় ছেড়ে যেতে?একবারও কি বুক কাঁপল না?একবারও আমার মুখটা মনে পড়ল না দাদীর?সবাই স্বার্থপর।সবাই!আমি যাকেই ভালোবাসি, সেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়।আম্মা ছেড়ে গেল, মিথি ছেড়ে গেল, অবশেষে দাদীও ছেড়ে গেল।

এই নিয়ে বিশেষ দুঃখ হলো না নাকি দুঃখ সইতে সইতে এই দুঃখটা বিশেষ বোধ হলো না আমার কাছে তা বুঝে উঠলাম না।একদম স্বাভাবিক থেকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলাম ঘরের এককোণে।একে একে মানুষের ভীড় জমল। কেউ বিলাপ করল, কারো বা চোখজোড়া দিয়ে অঝোরে পানি ঝড়ল।আমি সবাইকেই খেয়াল করলাম। নিশ্চুপে দেখে গেলাম সবার বাহ্যিক দুঃখ। কিন্তু কাউকেই দেখাতে পারলাম না নিজের অন্তরের দুঃখটা।কি ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে সে অন্তরে।কি ভীষণ জ্বালা ধরেছে।

সন্ধ্যা হলো।ততক্ষনে দাদীর দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে।আমার পাশে ফুফু, মেহু আপু,ছোট আম্মা সহ অনেকেই উপস্থিত তখন। মেহু আপু বিকালেই এসেছেন৷ সঙ্গে উনার চাচা চাচীরাও খবর পেয়ে বিকালের দিকেই বাড়ি এসেছেন।শুনেছি মেহেরাজ ভাইও এসেছেন।তবে দেখিনি। আসার পর থেকেই মেহু আপু আমার পাশে বসা।মাথায় হাত বুলিয়ে ক্রমশ সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।

আসলেই কি আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন আছে?আমি তো জানি দাদী আর ফিরবে না। দাদীকে চাইলেও আমি আর কখনো সামনে পাব না।হাত দিয়ে দাদীর চুলে সিঁথি কেটে দিতে পারব না, মাথায় তেল দিয়ে দিতে পারব না।সকাল সকাল চা বানিয়ে চা খাওয়াতে পারব না।দাদীর হাঁটুতে, কোমড়ে মলম দিয়ে মালিশ করে দিতে পারব না।কিছুই পারব না।কিছুই না!সবকিছু জেনেবুঝেও অবুঝের মতো সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য দুঃখে নেতিয়ে থাকাটা হাস্যকর।তবুও আমাকে সবাই মিলে বুঝাতে লাগল।ফুফু বলল,

” জ্যোতি, জানি তুই আম্মারে অনেক ভালোবাসতি। এমন পাথরের মতো জমে থাকিস না। একটু তো কান্না কর।নিজেকে এমন পাথর বানিয়ে রাখিস না জ্যোতি।”
মেহু আপু বলল,

” এভাবে দুঃখ পেয়ে নিজেকে গুঁটিয়ে রাখিস না জ্যোতি।মানুষের জম্ম মৃত্যু তো আমাদের হাতে নেই। দাদী আর নেই এটা কঠিন সত্য হলেও আমাদের মেনে নিতে হবে।এভাবে নিজের হৃদয়কে শক্ত করে রাখিস না।কান্না পেলে কান্না কর।দেখবি হালকা লাগবে।”
ছোট আম্মাও বলল,

” দেখো তোমার দাদী আর বেঁচে নেই। কোন মানুষই তো সারাজীবন বেঁচে থাকে না।তোমাকে তো এটা মেনে নিতে হবে। এভাবে স্থির হয়ে বসে থেকো না।নিজেকে স্বাভাবিক করো। ”
সবার এত এত কথায় বিরক্তবোধ করলাম আমি।আমি কি স্বাভাবিক নেই?আমি কি মেনে নিই নি যে দাদী আর নেই?তাহলে অহেতুক আমাকে এসব বলার মানে কি?

সবাই আমাকে আরো অনেকক্ষন বুঝাল।এক পর্যায়ে হতবিহ্বল চাহনীতে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলে উঠলাম,
” আমি একটু একা থাকতে চাই।একা থাকতে দাও একটু।”

আমার বলা কথাটার পরপরই সবাই একে একে চলে গেল।মেহু আপু কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিলেন।তারপর চলে গেলেন।আমি হাঁটু ভাজ করে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম হাঁটু।তারপর হাঁটুর উপর মুখ রেখে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে নিরবে একা বসে থাকলাম।বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত কষ্ট হলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম যেন। চেষ্টা করলাম সেই কষ্ট নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখতে। হাঁটু আঁকড়ে ধরে তাকিয়ে থাকলাম স্যাঁতস্যাঁতে মাটির দিকে। সেভাবে কত সময় গেল আমার জানা নেই।আকস্মিক কানে এল পরিচিত এক কন্ঠস্বর,

” জ্যোতি?আসলে অসুবিধা হবে তোর?”
কন্ঠস্বরটা আমার চেনা। মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠ।উনার কন্ঠস্বর শুনে ও আমি চোখ তুলে তাকালাম না। আগের মতোই তাকিয়ে থাকলাম মাটির দিকে।মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে উত্তর দিলাম,অসুবিধা হবে না।মেহেরাজ ভাই পা বাড়িয়ে এগিয়ে আসলেন।হাঁটু ভেঙ্গে আমার সামনে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে বসেই বলে উঠলেন,
” কষ্ট হচ্ছে?”

আকস্মিক আহ্লাদী প্রশ্নে ভেতরের কষ্টগুলো যেন উগড়ে আসতে চাইল। কিন্তু উগড়ে আসল না।উনার কথার উত্তর দিলাম না আমি।চুপচাপ সেভাবেই বসে থাকলাম।মেহেরাজ ভাই আবারও বললেন,
” জ্যোতি? তাকা আমার দিকে। এভাবে অনুভূতিহীন হয়ে থাকবি না।ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরবি না প্লিজ।”

আমি এবার স্থির চাহনীতে তাকালাম মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে।পরনের সাদা পাঞ্জাবি।হাতাগুলো কনুই অব্দি গুঁটানো আছে। স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে।কিন্তু আমার কাছে আজ মেহেরাজ ভাইকে অতোটা নজরকাড়া সুন্দর বোধ হলো না।শুধু সৌন্দর্যই নয়, মেহেরাজ ভাইকে এতমাস পর, এতটা কাছে দেখেও আমার ভেতরে কোন অনুভূতি কাজ করল না আজ।না প্রেম, না ভালোবাসা, আর না তো ভালোলাগা।

জীবনের কঠিন বাস্তবতা গুলোর কাছে বোধহয় সকল অনুভূতিই ফাংসে হয়ে যায়।কথায় আছে, অভাবে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।হয়তো অভাবটাও জীবনের কঠিনতম এক বাস্তবতা বলেই ভালোবাসার মতো তীব্র অনুভূতিকেও হারিয়ে দিয়ে যায়।আমিও এই মুহুর্তে তেমনই এক কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন।

যে বাস্তবতা আমার হৃদয় থেকে প্রেমানুভূতি, ভালোবাসার অনুুভূতি সবকিছুই নিংড়ে চুষে নিয়েছে।অসার করে দিয়েছে আমার সমস্ত অনুভূতিকে।আমি টের পেলাম, আমি সত্যিই অনুভূতিহীন হয়ে গেছি।আমার নিজের ভেতর কোন অনুভূতিই আর কাজ করছে না এই মুহুর্তে। না দুঃখ, না সুখ! না খারাপ লাগা, না ভালো লাগা।শুধু নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে থাকলাম আমি।মেহেরাজ ভাই আমার কাঁধ ঝাকানোতেই সে তাকানোর অদলবদল হলো।সচকিত হয়ে তাকাতেই মেহেরাজ ভাই বললেন,

” দাদী আর নেই। এ কঠিন সত্যিটা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তোর আছে আমি জানি।কিন্তু এতটা স্বাভাবিক থাকা কি উচিত জ্যোতি?সব দুঃখ নিজের ভেতর রেখে দুঃখ জমানো উচিত? ”
অস্ফুট স্বরে বললাম,

” কি করা উচিত আমার? বিলাপ ধরে কান্না করা?”
মেহেরাজ ভাই আমার দিকে তাকালেন।শান্তস্বরে বলে উঠলেন,
” পৃথিবীতে সকল কষ্ট লুকাতে নেই জ্যোতি।কিছু কষ্ট প্রকাশ পেলে বিশেষ ক্ষতি হয় না।কষ্ট ভাগ করলে কষ্ট কমে।আমার সাথে তোর কষ্টটা ভাগ করবি?”

মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠ শান্ত, নরম।শেষের কথাটা যেন হৃদয়ের আকুতি নিয়েই বললেন।আমি স্পষ্টভাবে তাকালাম মেহেরাজ ভাইয়ের চোখজোড়ায়। দেখলাম আশাহত দৃষ্টি, দীর্ঘশ্বাসের অস্তিত্ব আর একরাশ চিন্তা।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” না।”
মেহেরাজ ভাই ফের প্রশ্ন ছুড়লেন,
” কেন?”
নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলাম আমি,

” প্রথমে সবাই কষ্টের ভাগ নেয় মেহেরাজ ভাই। আগলেও রাখে। পাশেও থাকে। কিন্তু একটা সময় পর আর কেউই থাকে না।কঠিন হলেও এটাই বাস্তব সত্য।”
মেহেরাজ ভাই আকস্মিক আমার হাতজোড়া নিজের হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন।শীতল চোখে তাকিয়ে আশ্বাস দিয়ে দৃঢ় গলায় বললেন,

” মেহেরাজ থাকবে।মিথ্যে নয়, সত্যিই থাকবে।”
মেহেরাজ ভাই এই প্রথম আমার হাত ছুঁয়েছে এভাবে।যাকে প্রণয় বুঝে উঠার পর থেকেই মনে জায়গা দিয়েছি সেই মানুষটাই পরম যত্ন করে আমার হাতজোড়া আগলে ধরেছে।যে মানুষটাকে কিশোরী বয়স থেকে ভালোবেসেছি, যে মানুষটাকে জীবনে প্রথম ভালোবাসা হিসেবে স্বীকার করেছি সে মানুষটাই আমার হাত আগলে ধরে শীতল কন্ঠে বলছে, সে আমার পাশে থাকবে।

সত্যিই থাকবে।এসবে বোধ হয় আমার আবেগে আপ্লুত হওয়া উচিত।খুশিতে মূর্ছা যাওয়া উচিত।সুখ সুখ অনুভূতিতে চোখ টলমল করে উঠা উচিত।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো আমার মধ্যে কোন অনুভূতিই কাচ করল না ।কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়াই হলো না মেহেরাজ ভাইয়ের হাতের আলতো ছোঁয়ায়। আমি আগের মতোই নির্লিপ্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।স্পষ্টভাবে বললাম,

” আমি চাই না আর কেউ থাকুক আমার পাশে।আমি একা, সম্পূর্ণ একা থাকতে চাই মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ ভাই হাতজোড়া আরেকটু চেপে ধরলেন।গম্ভীর অথচ দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলেন,
” আমি চাইছি না তুই একা থাক।”
“কেন?”

” এতটা স্বাভাবিক থাকার কারণে ভয় হচ্ছে।এতটা স্বাভাবিক থেকে পরে অস্বাভাবিক কিছু করে পেলবি না তো জ্যোতি?আমি চাই এই প্রশ্নের উত্তরটা না হোক।তুই অস্বাভবিক কিছু করার কথা মাথায় আনবি না।”
আমি শান্তস্বরে বললাম,
” আমি বাচ্চা নই মেহেরাজ ভাই। কোনটা করা উচিত আর কোনটা অনুচিত তা জানি।”
মেহেরাজ ভাই শীতল কন্ঠে বলতে লাগলেন,

” সব উচিত অনুচিত আমরা জম্মের পর থেকেই শিখে ফেলি না জ্যোতি।আমাদের জীবনে উচিত অনুচিত শিখানোর জন্য একজন মানুষ থাকা প্রয়োজন।নিজের সুখগুলো ভাগ করার জন্য একজন মানুষ থাকা প্রয়োজন।নিজের মনের ভেতরের ব্যাথা গুলো বলার জন্য একজন মানুষ থাকার প্রয়োজন।সবশেষে নিজের খেয়াল রাখার জন্যও একজন মানুষ থাকা প্রয়োজন জ্যোতি।এই পৃথিবীতে কেউই একা একা বেঁচে থাকে না।বাঁচতে পারে না।”
দ্বিধান্বিত চাহনীতে তাকিয়ে আকস্মিক প্রশ্ন ছুড়লাম আমি,

” তাহলে কি মরে যাওয়া উচিত আমার?”
মেহেরাজ ভাই শীতল অথচ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।চোখজোড়া দেখাল রক্তলাল।মুখ দেখাল টানটান। চোয়ালও বোধহয় শক্ত হলো।আকস্মিক আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।পকেটে হাত গুঁজে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

” এজ ইউর উইশ!”
অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম,
” মরব না। মরতে তো পারব না মেহেরাজ ভাই। আমি একা বেঁচে থাকতে পারব।পারতে হবে।”
মেহেরাজ ভাই কিছু বললেন না।শুধু তাকিয়ে থাকলেন জমাট রাগ নিয়ে।আমি ফের বললাম,
” আমি মনের ব্যাথা মনে রাখতে অভ্যস্ত মেহেরাজ ভাই। ”
মেহেরাজ ভাই এবারেও উত্তর দিলেন না।আমি আবারও বললাম,
” আমার সুখে কোন মানুষই হয়তো অতোটা খুশি হবে না যে সুখগুলো ভাগ করার প্রয়োজনীয়তা পড়বে মেহেরাজ ভাই।”

ফের আবার বললাম,
” সবশেষে আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি মেহেরাজ ভাই।এসবের পরও একা বেঁচে থাকতে পারব না? ”
মেহেরাজ ভাই আগের মতোই রক্তলাল চক্ষু নিয়ে তাকালেন।গম্ভীর স্বরে বললেন,

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৭

” না, পারবি না।”
কথাটুকু বলেই আর দাঁড়ালেন না মেহেরাজ ভাই।ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন দ্রুত।আমি অবশ্য তাকালাম না সেদিক পানে।

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৯