এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৭

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৭
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

রাতে মেহেরাজ ভাইয়ের থাকার ব্যবস্থা হলো আমার ঘরেই।আব্বা অনেকবার আমাকে আর মেহেরাজ ভাইকে তার বিলাশবহুল ইটপাথরের ঘরটায় থাকতে বললেও রাজি হতে পারলাম না৷ টিনের ঘরে ঘুমোতে মেহেরাজ ভাইয়ের অসুবিধা হতে পারে ভেবে উনাকে অবশ্য বলেছিলাম আব্বাদের ঘরেই রাতে ঘুমোতে।কেন জানি না উনি সেই প্রস্তাবে মত দিলেন না।

খাওয়া শেষ করে আব্বাদের ঘর ছেড়ে দাদীর ঘরে এসে খাট গোঁছালাম সর্বপ্রথম। বাকি সব অগোছাল জিনিস গোছালভাবে রেখে দাদীর রুমে গেলাম। দাদী আর মেহেরাজ ভাই তখনও আব্বাদের ঘরে কথা বলছে।হঠাৎ মনে পড়ল মিনার ভাইয়ের কথা।আসার পর থেকে একবারও চোখে পড়ে নি।একবারও কথা বলা হয়নি।একটা সময় মিনার ভাই আমার অধিক খেয়াল রাখতেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

যখন কেউই আমাকে পছন্দ করত না, তখন একমাত্র মিনার ভাইই আমার পাশে ছিলেন।চাচাতো, জেঠাতো ভাইবোনদের মাঝে মিনার ভাই ব্যাতীত বাকি সবাই আমায় খুব একটা পছন্দ করত না।কেন করত না জানা নেই।তবে মিনার ভাই আমার আপন মানুষ।এই মানুষটা যা যা করেছেন আমার জন্য তা অস্বীকার করলে হয়তোবা নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব।

আমি আগ বাড়িয়ে ফুফুদের ঘরে গেলাম।ফুফুদের ঘরে আরমান ভাই আর তার সদ্য বিয়ে হওয়া সুন্দরী বউ।মিনার ভাই নাকি বিকালেই ফুফুকে নিয়ে কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছেন।আমি হতাশ হলাম। পা চালিয়ে আবার নিজের ঘরে আসতেই চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইকে।বিছানায় সটান শুঁয়ে আছেন।কপালে হাত রাখা।দৃষ্টি কেমন ক্লান্ত ঠেকাল।আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বের হয়ে দাদীর ঘরে গেলাম।দাদী তখন পানের বাটা থেকে পান গালে নিয়ে চিবুতে ব্যস্ত।আমাকে দেখেই প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কই ছিলি এতক্ষন?”
জবাবে নরম গলায় বললাম,
” মিনার ভাইকে খুুঁজে আসলাম। আসার পর থেকে দেখিনি তো তাই।কিন্তু গিয়ে দেখি মিনার ভাই নেই।”
দাদী পান চিবানোতে ব্যস্ত থেকেই বললেন,

” মিনার তোর ফুফুরে নিয়া গেছে। রাইত অনেক হইছে। যা ঘুমাইয়া যা।”
” এখানে ঘুমাব না?”
দাদী বোধহয় অবাক হলেন।ভ্রু কুঁচকে সরু চাহনীতে তাকালেন আমার দিকে।তারপর গলা ঝেড়ে বললেন,
” এইহানে ক্যান ঘুমাইবি?তোর ঘরে ঘুমাবি। ”
ইতস্থত বোধ করে উত্তর দিলাম,

” না মানে, ওখানে তো মেহেরাজ ভাই ঘুমাবে দাদী।”
দাদী এবারও ভ্রু কুঁচকে নিলেন।জিজ্ঞেস করলেন,
” রাজ ঘুমাইলে তুই ঘুমাইতে পারবি না ক্যান?বর বউ একলগে একঘরে ঘুমায় এডায় তো দেইখা আইছি আজীবন।তোরা কি আলাদা ঘুমাস?”

আমি চুপ হয়ে গেলাম দাদীর প্রশ্নে।দাদী তো জানে না মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে একঘরে থাকা হয়নি।দাদীকে কি বলা উচিত কথাটা?বোধ হয় না বলাটাই ঠিক হবে।দাদী যদি আবার মেহেরাজ ভাইকেই অপরাধী বানিয়ে উনার সামনে প্রশ্নগুলো তুলে?কতটা নিচ মানসিকতার বোধ হবে তখন নিজেকে।আমি পিঁছু ঘুরে বললাম,
” কিছু না।ঘুমাও তুমি দাদী।”

বলেই আবারও নিজের রুমে হাজির হলাম।পড়ার টেবিলের সামনে কাঠের চেয়ারটায় বসে থেকে খাটের দিকে তাকালাম। মেহেরাজ ভাই তখনও কপালে হাত রেখে শুঁয়ে আছেন।তবে এবারে উনার চোখ বুঝে রাখা।ভাবলাম উনি ঘুমিয়ে গেছেন।কিন্তু না।কিছুক্ষন পরই চোখ বুঝে রেখেই বলে উঠলেন উনি,

” তোর কি সমস্যা হচ্ছে জ্যোতি?আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছিস?”
আচমকা প্রশ্নে অবাক হলাম আমি।চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সঙ্গে সঙ্গে। মেহেরাজ ভাই চোখ মেলে চাইলেন এবার।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে আবারও বলে উঠলেন,
” একঘরে অসুবিধা হচ্ছে?আনকম্ফোর্টেবল ফিল করলে বলে ফেলা উচিত। অন্য কোথাও ঘুমানোর ব্যবস্থা করা যাবে।”

আমি মিনমিনে চোখে চেয়ে বললাম,
” না, তেমন কিছু নয় মেহেরাজ ভাই।আপনি ঘুমান।”
মেহেরাজ ভাই কথা বাড়ালেন না। চোখ বুঝে নিয়ে বলে উঠলেন,
” ওকে ফাইন।তুইও ঘুমিয়ে পড়িস।”

কথাটা বলেই মেহেরাজ ভাই আবারও চোখ বুঝে নিলেন।আমি আরো কিছুক্ষন পায়চারি করলাম পুরো ঘর জুড়ে।এতদূর বাসে করে আসায় নাকি কিজানি, আমার শরীরটা যেন ক্রমশ ভেঙ্গে আসল।ঘুমে চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসল দ্রুত। তবুও বুঝে উঠতে পারলাম না কি করা উচিত। ঘুমানো উচিত? নাকি নির্ঘুম থাকা উচিত।অবশেষে অনেকক্ষন সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগে খাটের একপাশে শুঁয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম। যতটুকু সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে খাটের একদম কিনারা ঘেষেই শুঁয়ে পড়লাম।তার কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

আমার ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে। স্বভাবসুলভ ছোটকাল থেকে একা একা খাটজুড়ে ঘুমানোয় অভ্যস্ত থাকায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম মেহেরাজ ভাইয়ের শরীর ঘেষেই।মুহুর্তেই চমকে গিয়ে দূরত্ব বাড়ালাম।খাটের কিনারা ঘেষে বসে খেয়াল করলাম, মেহেরাজ ভাই কাল রাতে যেভাবে ঘুমিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই সটান শুঁয়ে আছেন।হা, পা কোনকিছুর অবস্থানেরই পরিবর্তন ঘটেনি।

এতটা স্থির থেকে ঘুমানে যায়?বিপরীত ভাবে, আমার কথা ভাবতে গিয়েই অস্বস্তিতে মাথা নত হয়ে আসল। অন্যদের মতো হাত পা ছড়ানো অভ্যাস না থাকলেও স্বল্প জায়গায় মানিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস নেই।তাই হয়তো খাটের কিনারা ঘেষে ঘুমানো আমি ঘুমন্ত অবস্থাতে বাকি জায়গাটুকু ও দখল করে নিলাম।ভুলেই গেলাম খাটে অন্য আরেকজন মানুষ ও আছেন।তাও পুরুষ মানুষ।

ফলস্বরূপ ভোরে ভোরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম মেহেরাজ ভাইয়ের দেহ ঘেষেই।বিষয়টা ভাবতেই খারাপ লাগার উদ্ভব হলো মনের ভেতর।দ্রুত বসা ছেড়ে উঠে গিয়ে বাইরে গেলাম।মুখচোখ ধুঁয়ে এদিক ওদিক হাঁটলাম।কিছুক্ষন বসলাম পুকুর পাড়টাতেও। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এভাবেই কাঁটল।তারপর উঠে গিয়ে ঘরে যেতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই উঠে পড়েছেন। চোখমুখ ভেজাও দেখাল।কপালে আসা চুলের একাংশও ভিজে লেপ্টে আছে।আমি স্বাভাবিক হয়ে সামনে গেলাম।একটু আগের অস্বস্তিকে কাঁটিয়ে প্রশ্ন ছুড়লাম,

” মেহু আপুর সাথে কথা হয়েছে আপনার?রাতে কোন সমস্যা হয়নি তো?”
মেহেরাজ ভাই তাকালেন । গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
“রাতে নাফিসাকে পাঠিয়েছে চাচী।আশা করি সমস্যা হবে না।এখন কল দিলে কল তুলবে না। হয়তো ঘুমোচ্ছে। ”
বললাম,
” আচ্ছা।”

মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে আমার কথা ততটুকুই হলো সেদিন।তারপর উনি রওনা হলেন নিজস্ব গন্তব্যে৷ সেদিনের পর সপ্তাহ খানেক আমার কিংবা মেহেরাজ ভাই কারোরই আর যোগাযোগ হলো না।যোগাযোগ হলো হঠাৎ এক সপ্তাহ দুই-তিনদিন পার হওয়ার পর।

সেদিন কোন এক প্রয়োজনেই ব্যাগটা খুলতে চোখে পড়ল ছোট বাটন ফোনটা।বাড়িতে আসার পর থেকে তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না বলেই মোবাইলটা আর বের করা হয়নি। ওভাবেই ব্যাগের মধ্যে পড়ে ছিল। হঠাৎ মোবাইলটা হাতে নিয়ে আগ্রহ জাগল মেহেরাজ ভাই কল দিয়েছিল কিনা তা দেখার।কিন্তু আমি হতাশ হলাম।

দেখলাম মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে।মেহেরাজ ভাইয়ের কল এসেছে কিনা তা দেখার আগ্রহ থাকলেও মোবাইল চার্জে বসানোর জন্য ব্যাকুল হলাম না।এমনিতেও উনার জীবনে খুব একটা বিশেষ গুরুত্ব নেই আমার।আহামরি ভাবে আমাকে স্মরন করে কল করবেন রোজ এমনটা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই।হয়তো বা দায়িত্ব পালন করার জন্য দুয়েকবার কল দিলে দিতে পারেন।

ভেবেই মোবাইলটা আবারও আগের মতোই ব্যাগে রেখে দিলাম।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বিকেল বেলায়ই জানতে পারলাম আব্বার মাধ্যমে মেহেরাজ ভাই আমার খোঁজ নিয়েছেন।বিষয়টা কতটুকু দায়িত্বের জন্য, কতটুকু কর্তব্যের জন্য তা জানা নেই।তবে আমার ভেতরে সুপ্ত ভালো লাগা কাজ করল।সেই ভালো লাগা প্রকাশ না করার জন্যই আব্বার সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম।আব্বা গলা উঁচিয়ে আবারও বললেন,

” কি হলো কি বলতেছি ?রাজের সাথে যাওয়ার পর থেকে যোগাযোগ করেছিস?তোর মোবাইল আছে। আম্মা তো মোবাইল দিয়েছিল তোকে। যোগাযোগ করিস নি কেন?তা না করে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিস?”
এক নজর তাকিয়ে বললাম,

” উনাদের বাসায় মোবাইলটা হাতে হাতে রাখতাম। কারণ দাদীর কল আসবে এই ভেবে।দাদীর সাথে কথা হবে এই ভেবে সারাদিন অপেক্ষা করতাম।এখন তো সেই অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই আব্বা।তাই মোবাইলটা ব্যাগের ভেতরেই পড়ে আছে।তার উপর পরীক্ষা চলছে।পরীক্ষার পড়া, কাজকর্ম সব মিলিয়ে মোবাইলের কথা খেয়ালই নেই আমার।মেহেরাজ ভাইকে আমার তরফ থেকে বলে দিবেন, আমি দুঃখিত। ”
আব্বা এবারও রাগ ঝাড়লেন।চাপাস্বরে বললেন,

” আমি কেন জানাব?”
” না, আবার কল দিলে জানাবেন আরকি।যদিও জানি,উনি আর কল দিবেন না।”
বাবা চোখ গরম করে তাকালেন।বললেন,
” রাজ এই নিয়ে তিনবার কল দিয়েছে আমায়।তোর মোবাইল বন্ধ বা তোর সাথে যোগাযোগ হয়নি এটা আগের দুবার না বললেও আজই বলেছে। এটা তো তোর উচিত হয় নি।”
আমি ছোট শ্বাস ফেললাম।জানতে চাইলাম,

” উনি কি আমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন আব্বা?”
আব্বা চুপ থাকলেন কিছুটা সময়।তারপর একই রকম গম্ভীর থেকে বললেন,
” মোবাইল চার্জে বসিয়ে রাজকে কল দিস। ”

আমি মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম, হ্যাঁ দিব।তারপর আব্বা আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন নিজের ঘরে।আমি ঠাঁই উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকলাম।মেহেরাজ ভাই আব্বাকে তিনবারই আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য কল দিয়েছেন? তিনবার!প্রথম দফায় কিছুটা বিস্ময় কাজ করলেও পরমুহুর্তেই মস্তিষ্ক বলে উঠল, অতোটা আহামরি খুশি হওয়ার বিশেষ কারণ নেই।দায়িত্ব পালনের জন্য উনি তিনবার কল দিতেই পারেন। আমি পা চালিয়ে ঘরে এলাম।দেখলাম বিদ্যুৎ নেই।

পুনরায় হতাশ হলাম।বিদ্যুৎ এল একেবারে রাত আটটার পর।তখনই মোবাইল চার্জে বসালাম।চার্জ হতেই মোবাইল অন করে চমকে গেলাম।দু দুটো নাম্বার থেকে কল এসেছে।একটা মেহেরাজ ভাইয়ের নাম্বার অপরটা মেহু আপুর নাম্বার।নাম্বারগুলো আমার চেনা। মেহেরাজ ভাই মোট মিলে আঠারোবার কল করেছেন আর মেহু আপু সাতবার।আমি শুকনো ঢোক গিললাম।

পড়া ফেলে জানালার কাছ ঘেষে প্রথমেই কল দিলাম মেহু আপুকে।মেহু আপু প্রথমে কল রিসিভড না করলেও পরমুহুর্তেই নিজ থেকে কল দিলেন।আমি কল তুলে কানের সামনে ধরলাম মোবাইল। তারপর কথা হলো প্রায় আধ ঘন্টারও বেশি।মেহু আপুর সাথে কথা শেষে করার পর সময় দেখলাম।সাড়ে নয়টা।কাঁপা কাঁপা হাতে কল দিলাম মেহেরাজ ভাইকে।মেহেরাজ ভাইয়ের নাম্বারে প্রায় পাঁচবার কল দিয়ে থেমে গেলাম। উনি কল তুললেন না।হতাশ হয়ে মোবাইলটা একপাশে রেখেই পড়ায় মন দিলাম।ঠিক তখনই মোবাইলটা বেঁজে উঠল।বুকের ভেতর অদ্ভুত কম্পন টের পেলাম। অনুভূতিদের একপাশে ঠেলে রেখেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্বাভাবিক হলাম। কল তুলে গলা ঝেড়ে সালাম দিলাম।বললাম,

” কেমন আছেন মেহেরাজ ভাই? ”
মেহেরাজ ভাই গম্ভীর স্বরে স্বল্প শব্দে উত্তর দিলেন,
” ভালো আছি।”
আমি চুপ থাকলাম। ভেবেছিলাম উনিও পাল্টা প্রশ্ন করে কেমন আছি তা জিজ্ঞেস করবেন।কিন্তু না, জিজ্ঞেস করলেন না।চুপচাপ সেভাবেই কয়েক সেকেন্ড কাঁটল।কথারা যেন বিলীন হয়ে গেল। অনেক খুঁজেও কি বলব বুঝে উঠলাম না।অবশেষে অনেক ভেবে বললাম,

” আব্বার কাছে কল দিয়েছিলেন? ”
মেহেরাজ ভাই শান্তস্বরে বললেন,
” হ্যাঁ দিয়েছিলাম। কেন?”
আমি স্পষ্টভাবে জানতে চাইলাম,
” আমাকে কি কল করতে বলেছেন?”
” না, কেন?”

” না এমনিতেই। আব্বা বিকালে বলল আপনাকে কল দিতে তাই কল দিয়েছি। আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?”
মেহেরাজ ভাই চাপা কন্ঠে শুধালেন,
” যদি হ্যাঁ বলি?”
ইতস্থত বোধ করে বলে উঠলাম,

” দুঃখিত।আব্বা বিকালে বলেছে বলেই কল দিয়েছিলাম আপনাকে।”
মেহেরাজ ভাই চুপ থাকলেন কিয়ৎক্ষন। তারপর প্রশ্ন ছুড়লেন শীতল অথচ দৃঢ় কন্ঠে,
” তো বিকাল পেরিয়ে রাত হওয়ার পর তোর কল দেওয়ার কথা মনে পড়েছে?”
মেহেরাজ ভাইয়ের শীত কন্ঠে রাগ ছিল কি ক্রোধ ছিল বুঝে উঠলাম না। তবে সেই কন্ঠে আমি কেঁপে উঠলাম।বললাম,

” না আসলে, মোবাইলে চার্জ ছিল না মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ ভাই শাসনের সুরে একরাশ রাগ নিয়ে বলতে লাগলেন,
” তোর উচিত ছিল আমি কল দেওয়া মাত্র কল তোলা।কিন্তু না, তুই আমার কল এড়িয়ে গেলি।টানা তিনদিন কল দেওয়ার পর দেখি তোর ফোন সুইচড অফ।আমার কল না তুলে তুই ফোন সুইচড অফ করে রাখলি?এটা কোন ধরণের বিহেভিয়ার জ্যোতি?”

মেহেরাজ ভাইয়ের চাপা রাগের সম্মুখীন হয়েই থম মেরে গেলাম।মেহেরাজ ভাই ছোটকাল থেকেই দম্ভে পরিপূর্ণ। নিজেকে কোথাও দ্বিতীয় হিসেবে মেনে নিতে পারেন না হয়তো।ছোটবেলায় একবার ক্লাসে ফার্স্ট হতে পারেনি বলে কি ভীষণ রাগ দেখিয়েছিলেন সবার উপর। এমনকি টানা এক সপ্তাহ স্কুলেও যায় নি।দম্ভে পরিপূর্ণ সে মেহেরাজ ভাইয়ের বোধহয় ইগোতে লাগল এই বিষয়টা। তার কল না উঠানোটা বোধহয় চরম বেয়াদবিও মনে হলো উনার কাছে।কিন্তু এটা তো ইচ্ছাকৃত নয়।আমি তা বুঝাতেই বলে উঠলাম,

“এর জন্যও দুঃখিত মেহেরাজ ভাই।আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে আপনার কল এড়িয়ে যাইনি।সত্যি বলছি।বাড়িতে আসার পর মোবাইলটার কথা মনেই ছিল না আমার।আজই ব্যাগ থেকে বের করেছি ফোনটা।”
মেহেরাজ ভাই আবারও চাপা কন্ঠে রাগ দেখিয়ে বললেন,

” আওয়াজ হয়নি ফোনের?”
শান্ত স্বরে উত্তর দিলাম,
” আমি খেয়াল করিনি হয়তো।”
” আগে কি করে খেয়াল করতি?আগে তো দেখতাম সারাক্ষন ফোন নিয়ে বসে থাকতি।”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

” মানে?”
গম্ভীর স্বরে বললেন,
” নাথিং।পরীক্ষা কেমন চলছে তোর?”
“ভালো।”
” ওকে।পরীক্ষা শেষে কোনদিন আসবি জানিয়ে দিস।গিয়ে নিয়ে আসব।”
আমি থামলাম।কাঁপা গলায় বললাম,

” আমি আর ওখানে যাব না মেহেরাজ ভাই।বাড়ির অবস্থা এখন স্বাভাবিক।আমি বাড়িতেই থেকে যাব।আপনাকে একটা কথা বলি?”
মেহেরাজ ভাই আমার কথার বিপরীতে বিশেষ কোন উত্তর করলেন না।বললেন,
” বল।”
শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলাম,

” সামান্তা আপুর সাথে সবটা মিটিয়ে নিন মেহেরাজ ভাই।আমি চাই না আমার জন্য একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাক।আপনারা আগের মতোই সম্পর্কটা গড়ে নিন।যেমনটা স্বপ্ন দেখেছেন তেমনই পূরণ করুন সবটা।আমি বাঁধা হয়ে থাকব না।সব ছেড়ে এসেছি।আমি আর আপনাদের মাঝে যাব না সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি মেহেরাজ ভাই।তবে একটা অনুরোধ রাখবেন?সব ছেড়ে দিলেও বিয়েটা ছাড়তে পারব না আমি।এমনটা ভাববেন না যে টিপিক্যাল বাঙ্গালি মেয়েদের মতো বলব, আমাকে আপনার পায়ে একটু জায়গা দেন। তেমন কিছুই বলব না।তবে আমি চাই বিয়েটা না ভাঙ্গুক।আমার আপনার বিয়েটা হয়েছে।আমি এই বিয়েটা মানিও খুব করে।বিয়েটা ভাঙ্গবেন না দয়া করে৷ ”
মেহেরাজ ভাই শান্তস্বরে ছোট শব্দে উত্তর দিলেন,

” আচ্ছা।”
আমি আবারও বললাম,
” এমনটা ভাববেন যে বিয়েটা ভাঙ্গতে নিষেধ করার পেছনে অন্য কারণ আছে। আমি বিয়ের অধিকার নিয়ে আপনার সামনে হাজির হবো এমনটাও ভাববেন না।”
মেহেরাজ ভাই বোধ হয় বিরক্ত হলেন।কিঞ্চিৎ বিরক্তি দেখিয়ে বললেন,

“বারবার একই কথা ভালো লাগে না জ্যোতি। আর কিছু বলবি?”
” না।”
মেহেরাজ ভাই আদেশের সুরে বলে উঠলেন এবার,
“আচ্ছা, এর পর থেকে ফোন বন্ধ রাখবি না।কল দিলে কল তুলবি।রাখলাম।”

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৬

কথাটা বলেই মুখের উপর কল রাখলেন মেহেরাজ ভাই। আমি হতবিহ্বল চাহনীতে তাকিয়ে থাকলাম ফোনের দিকে।মেহেরাজ ভাই কি এসব আদেশ করলেন?কিন্তু কেন?আমার সাথে যোগাযোগ না হলেও বা কি হবে মেহেরাজ ভাইয়ের?

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৮