এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৬

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৬
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

ঘুম ভাঙ্গল মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখেই।এপাশ ওপাশ তাকিয়ে জানালার ওপাশটায় চোখ পড়তেই বুঝলাম রাত হয়েছে।বাসে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল বুঝেই উঠিনি আমি।তারপর ঘুমের ঘোরেই বোধহয় মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধে হেলে পড়েছিলাম।মেহেরাজের ভাই নির্ঘাত বিরক্ত হয়েছেন এই ব্যাপারে?

বিষয়টা ভেবেই নিজের প্রতি রাগ জম্মাল।একটা মেয়ে হয়ে একজন পুরুষ মানুষের কাঁধে নিজ থেকে ঢলে পড়াটা নিশ্চয় খুব একটা ভালো দেখায় না।বরং চমৎকার বেহায়াপনা বোঝায় এতে।নিজেকে এই মুহুর্তে জঘন্যতম বেহায়া মানুষ বোধ হলো আমার।দ্রুত মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসলাম।জানালার অপর প্রান্তে তাকাতে নিতেই মেহেরাজ ভাই নড়েচড়ে বসলেন। আমি এক পলক তাকালাম উনার দিকে।সঙ্গে সঙ্গেই মেহেরাজ ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

” ঘুম শেষ? ”
আমি ইতস্থত বোধ করলাম উত্তর দিতে।পরমুহুর্তেই স্বাভাবিক হয়ে স্পষ্ট গলায় বলে উঠলাম,
” মেহেরাজ ভাই, আমি দুঃখিত।বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে আপনার কাঁধে মাথা রাখিনি।বোধহয় ঘুমের ঘোরেই মাথা রেখেছিলাম।এমনটা হবে জানলে আমি সর্বোচ্ছভাবে সচেতন থাকতাম যাতে চোখে ঘুম না নামে।”
মেহেরাজ ভাই কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে নিলেন।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলেন,

” রাতে ঘুমাসনি?নাকি বাড়ি যাওয়ার আনন্দে সারারাত ঘুম হয়নি তোর?”
মেহেরাজ ভাই প্রশ্নটা অতি স্বাভাবিক ভাবে করলেও এই প্রশ্নটা দ্বারাই বুঝতে পারলাম উনি বিরক্ত হয়েছেন।শুধু বিরক্ত নয়, চরম বিরক্ত হয়েছেন।সহসা নিজের মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করল।একটা মানুষ বিরক্ত হচ্ছে আমার কারণে বিষয়টাতে অবশ্যই খারাপ লাগার কথা। আমি চোখ ছোট ছোট করে আড়ষ্ট গলায় বলে উঠলাম,

” ঘুমিয়েছি।তবুও বাসে উঠার পর ঘুম আসল কেন জানা নেই।”
মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে বললেন,
” ঝিমুতে ঝিমুতে তো তোর ঘাড়টা ভেঙ্গে জানালার অপর প্রান্তে যাচ্ছিল আরেকটু হলে।তার কিছুক্ষন পরে দেখি ঘুমিয়েই গেছিস।তাও আবার জানালা ঘেষে মাথা রেখে। কয়েকবার ঠাসঠাস করে মাথায় লাগল ও তোর।কিন্তু তোর ঘুম দেখি ভাঙ্গলই না।তখনই বুঝলাম গভীর ঘুম!তাই জিজ্ঞেস করলাম রাতে ঘুম গিয়েছিলি কিনা।”

মেহেরাজ ভাই বোধ হয় আমার আড়ষ্টতা কাঁটাতেই কৈফিয়তের সুরে কথাগুলো বললেন।তবুও আমার খারাপ লাগা কাঁটল না।মনে মনে নিজেকে হাজারবার সচেতন করলাম আর যাতে ঘুম না পায়।আর যাতে উনার কাঁধে ঘুমন্ত অবস্থায় হেলে পড়তে না হয়।পরমুহুর্তেই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল।মেহেরাজ ভাই মাত্রই বললেন ঘুমিয়েছিলাম জানালা ঘেষে মাথা রেখে।তার মানে উনার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাইনি।তবে?উনিই কি আমার মাথাটা উনার কাঁধে রেখেছেন?বিষয়টুকু ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে মুঁছে নিলাম ভাবনাটা।এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন।হয়তো ঘুমের ঘোরে আমিই মাথা রেখেছিলাম।বললাম,

” খেয়াল করিনি মেহেরাজ ভাই।আপনাকে ইচ্ছে করেই শুধু শুধু বিরক্ত করিনি।এটা সম্পর্ণ অনিচ্ছাকৃত।”
মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লেন,
” কি?”
বললাম,

” আপনার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই।”
মেহেরাজ ভাই এবার আর কিছু বললেন না।কাঁধ ঝাকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি ও আর তাকালাম না উনার দিকে। বাকিটা পথ জানালার ওপাশে অন্ধকার পথ দেখেই কাঁটালাম।

আমরা বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা কি দশটা বাঁজল। দাদী তখনও ঘরের সামনে কাঠের চেয়ারে বসা।বোধ হয় আমাদেরই অপেক্ষা করছিল।বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই উঠোনে দাদীকে বসা অবস্থায় দেখে খুশিতে চকচক করে উঠল আমার চোখজোড়া।এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়েই জড়িয়ে ধরলাম দাদীকে।দাদীর শরীরে সেই পান চিবানো স্যাঁতস্যাঁত ঘ্রাণটা নিয়েই তৃপ্ত হলো মন।কতক্ষন জড়িয়ে রাখলাম জানি না।এক পর্যায়ে দাদীই ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,

” হইছে তোর? আইয়াই এমনে ঝাপটাইয়া ধরছস ক্যান?ছাড়।দমবন্ধ হইয়া আইতাছে আমার।”
দাদী যে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে বলছে তা আমার জানা। তবুও ছেড়ে একপাশে দাঁড়ালাম।বলে উঠলাম,
” কেমন আছো দাদী? এত রাতে উঠানে চেয়ার নিয়ে বসে আছো যে?আমাদের অপেক্ষায়?”
দাদী নিখুঁত ভাবে গোপন রাখলেন নিজের ভালোবাসা।বললেন,

” বাইরেডায় বাতাস আছে দেহস না?তার লাইগাই বইসা ছিলাম।সর, রাজের লগে কথা কই।”
আমি সরে দাঁড়ালাম।দাদী দু পা এগিয়ে মেহেরাজ ভাইয়ের সামনে দাঁড়াতেই মেহেরাজ ভাই ঠোঁট চওড়া করে হেসে সালাম দিলেন। দাদী বোধহয় খুশিই হলো।সালামের উত্তর দিয়েই বলে উঠলেন,
” আইতে আইতে এত রাইত করলা।আরো তাড়াতাড়ি বাইর হইতে পারতা তো।”
মেহেরাজ ভাই ভদ্রভাবে উত্তর দিলেন,

” বিকালের বাসে উঠেছিলাম।রাস্তায় হালকা জ্যামও ছিল তাই দাদী।ভালো আছেন আপনি? ”
” হ, ভালাই আছি।চলো, ঘরে চলো।টিনের ঘরে ঘুমাইতে পারবা তো?নাকি তোমাগো বাড়ির চাবি আনছো?”
মেহেরাজ ভাই পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন।বললেন,

” আসলে দাদী, আমি তো থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি।তাই বাড়ির চাবিও আনিনি।রাতের বাসেই ফেরত যাব।”
দাদী মুহুর্তেই ক্ষেপে উঠলেন।কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলে উঠলেন,
” তা কি কইরা হয়?আইছো যহন রাইতটা থাইকাই যাইবা।এই কথায় শেষ কথা।”

দাদীর কথায় মেহেরাজ ভাই চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন।তারপর নিজ উদ্যমে বুঝাতে লাগলেন যে উনার রাতে ফিরে যাওয়াটাই উচিত কাজ হবে।মেহু আপুও বাসায় একা।কিন্তু দাদী মানতে নারাজ।অবশেষে ঠিক হলো মেহেরাজ ভাই রাতে থাকবেন।উঠোনে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত ঠিক করে তবেই ঘরে ডুকলেন দাদী। পিঁছু পিঁছু আমি আর মেহেরাজ ভাইও গেলাম।স্যাঁতস্যাঁতে মাটির মেঝেতে পা রেখে মেহেরাজ ভাইয়ের কিরুপ প্রতিক্রিয়া হলে জানা নেই।তবে জুতোজোড়া খুলতে নিতেই আমি বলে উঠলাম,

” জুতো না খুললে কিছু হবে না মেহেরাজ ভাই।আপনার পায়ে ময়লা লাগবে নয়তো।”
মেহেরাজ ভাই একবার তাকালেন। কি বুঝে জুতা না খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।দাদী উনাকে বসালেন আমার ঘরের কাঠের খাটটায়।কিছুক্ষন সেখানেই গল্পগুজব করলেন দাদী আর মেহেরাজ ভাই।

আমি ততক্ষনে দাদীর ঘরে নিজের পরনের জামাটা পাল্টে সুতির সালোয়ার কামিজ পরলাম।মাথায় ঘোমটা টেনে বের হয়েই বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে কলে গিয়ে চোখমুখে পানি দিলাম।একবার চারপাশে তাকিয়ে অন্ধকারে গাছ গাছালিগুলো দেখলাম।কতদিন পর আবার সেই গ্রামে। আবার সেই প্রশান্তির বাতাস। আবার সেই গাছাগাছালি নড়েচড়ে উঠা সবুজ পাতার সান্নিধ্যের ছোঁয়া।চোখ বুঝে একবার অনুভব করলাম আশপাশের ঠান্ডা হাওয়া।তারপর আবারও ঘরে গেলাম।নিজের রুমের দরজা ঘেষে দাঁড়াতে কানে এল দাদীর গম্ভীর স্বর,

” হুনো রাজ, তোমারে ভালা ছেলে জানি বইলাই তোমার লগে ঐ দুর্দশায়ও বিয়া দিতে আমি এক মুহুর্তেই মত দিয়া ফেলছিলাম। রাইতের বেলায় ঘুমাইতে আইলে অন্তত এইটুকু বিষয় ভাইবা স্বস্তি পাইতাম যে জ্যোতিরে একজন ভালা মানুষের হাতে তুলে দিতে পারছি।জ্যোতিরে ছোড থেইকা বড় আমিই করছি।

শরীরের অবস্থা এহন আমার ভালা যায় না।কয়দিন বাঁচি তারও ঠিক নাই।শরীর দুইদিন ঠিক থাহে যদি তো তিনদিন থাহে বেঠিক।ভাবছিলাম মইরা গেলেও স্বস্তি পামু।জ্যোতিরে অন্তত তোমার মতো একডা ভালা পোলার হাতে তুইলা দিছি। কিন্তু হাছা কইতে এহন আর সেই স্বস্তি পাই না যেইদিন থেইকা হুনছি তোমার লগে সামান্তার ভালোবাসার সম্পর্ক আছে।”

কথাগুলো শুনেই আমার পা থেমে গেল মুহুর্তেই। তারমানে দাদীও সবটা জানে?মেহেরাজ ভাই যে সামান্তা আপুকে ভালোবাসে এটা দাদীও জানে বোধ হতেই মস্তিষ্ক শূণ্য অনুভব করলাম।দাদী কি করে জানে?কে বলল?আব্বা এসেই কি দাদীকে বলেছে এসব?এসব ভাবতে ভাবতেই আঙ্গুলে ওড়না পেঁচিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানে। মেহেরাজ ভাই গলা ঝাড়লেন। উত্তরে বলে উঠলেন,

” দাদী,এটা তো সত্যিই যে জ্যোতির সাথে আমার বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি।তাই সংসারটাও স্বাভাবিক ভাবে হবে আশা করাটা বোকামো নয়?বিয়েটা আকস্মিক ভাবেই হয়েছে।তো আমার আগে একটা সম্পর্ক থাকা, কিংবা তখন অন্য কাউকে ভালোবাসাটা তো অস্বাভাবিক ছিল না দাদী।তাই না?আপনারা তো তখন খোঁজ নিলেন না আমি কাউকে ভালোবাসি কিনা।জোর করেই একটা সিদ্ধান্ত ছাপিয়ে দিলেন।তাও বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।”
দাদী প্রশ্ন ছুড়লেন,

” ভুলটা আমগোরই কইতে চাইতাছো তুমি?তার মানে তুমি এহনও ঐ সামান্তারেই ভালোবাসো?জ্যোতিরে মানবা না তাই তো?”
মেহেরাজ ভাই নরম গলায় বললেন,

” আমি এমন কোন কথা উল্ল্যেখ করিনি দাদী।বিষয়টা ভুল ভাবে নিচ্ছেন আপনি।আমার সাথে সামান্তার সম্পর্ক ছিল।কিন্তু এখনও সম্পর্ক আছে এমনটা বলিনি তো।জ্যোতির সাথে বিয়েটা আমি অস্বীকার করি না।জ্যোতিকেও অস্বীকার করি না।আর এমনও বলিনি যে আমি জ্যোতিকে মানব না বা মানি না।”
দাদী বলল,

“তো কি কইতে চাও?দুইজনরেই তুমি জীবনে রাখতাছো?একজনরে ভালোবাসতা, অন্যজন কেবল চাপাইয়া দেওয়া সিদ্ধান্ত হইয়াই থাকব গোটা জীবন?”
মেহেরাজ ভাইয়ের গলাটা এবার আরো শান্ত শুনালো।নরম কন্ঠে অল্প আওয়াজে বলতে লাগলেন,

” ভালোবাসা বিষয়টা তো অতোটা স্বস্তা নয় দাদী।একজনকে ভালোবেসেছিলামই যখন তখন তাকে সারাজীবন পাওয়ার স্বপ্নও দেখেছিলাম।তাকে মনে জায়গাও দিয়েছিলাম।সেসব কিছু কি এক মুহুর্তেই মুঁছে দেওয়া যায়? ভালোবাসা তো অতোটা ঠুনকো নয়।তবে এমনটাও নয় যে জ্যোতির প্রতি আমার কোনদিন অনুভূতি জম্মাতে পারে না।পারে, অবশ্যই পারে।তবে সেটা সময় সাপেক্ষ!ভালোবাসা কখনো কয়েক মুহুর্তেই সৃষ্টি হয় কখনও বা কয়েক যুগ লেগে যায়।কখনো একজনেই সীমাবদ্ধ থাকে, কখনো বা নতুন করে অন্য কাউকেও ভালোবাসা যায়।”

দাদী চুপ থাকলেন কিছুক্ষন। তারপর অনুরোধের সুরে বললেন,
” তোমারে ভরসা করি রাজ।ভরসাডা ভাইঙ্গা দিও না দয়া কইরা।জ্যোতির জীবনডা শেষ করার দায়টা বয়ে বেড়াইতে যে পারুম না আমি।”
মেহেরাজ ভাই গম্ভীর স্বরে বলল,
” আশা করি আপনার ভরসা ভাঙ্গবে না।”
তারপর আর কোন কথা আসল না ও ঘর থেকে।কয়েক মুহুর্ত পর দাদী বের হলেন ঘর ছেড়ে। আমায় ঘরের সামনে দেখে বলে উঠলেন,

” আজ তোর আব্বাগো ঘরে খাবি।তোর ছোট আম্মায় রান্না করতাছে কইয়া গেছিল আনোয়ার ঘন্টা দুই আগে।”
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। আব্বাদের ইটের প্রাচীরের ঘরে সেই ছোটবেলায় আম্মা চলে যাওয়ার পর দুয়েকটা বছর কেঁটেছে আমার।সেই দুয়েকটা বছর ছিল আমার কাছে অসহনীয় যন্ত্রনার। আম্মার প্রতি আব্বার তীব্র রাগ, ক্ষোভ আর ক্রোধের স্বীকার হতাম তখন আমি আর মিথি।মিথি তখন ছোট্ট শিশু।নরম তুলতুলে ঠোঁট উল্টে আওয়াজ তুলে কান্না করে উঠত আব্বার ধমকে।

আর আমি নিরবে চোখের পানি ফেলতাম।কখনো বা আম্মুর প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে অনশন করতাম। আম্মার কাছে কি সেই অভিমান পৌঁছাত? পৌঁছাত না। আমার আম্মা আব্বা দুইজনই নিষ্ঠুর। একজন সন্তানের কথা না ভেবে অন্য পুরুষকে আপন করেছে। অন্যজন চিরকাল কেবল আমায় ধমক, চড়- থাপ্পড় আর অবহেলা দিয়েছেন।সেই চড়- থাপ্পড় থেকে বাঁচাতেই মূলত দাদী আমাদের এই টিনের ঘরে আনলেন।

তারপর থেকে অবশ্য আর কখনো পা রাখা হয়নি আব্বার সেই ঘরে।সেই যে দাদীর এই টিনের ঘরে থাকা শুরু করেছিলাম। এখন পর্যন্তও সেই ঘরই আমার বাসস্থান।দাদীরও এই টিনের ঘরটা ভীষণ প্রিয়।কারণ এই ঘরটা দাদার থাকাকালীন ঘর।আব্বা, ফুফু সহ দাদা-দাদীর দাম্পত্য জীবন এই ছোট্ট টিনের ঘরেই কেঁটেছে।আব্বা, ফুফুরা সবাই ছোট থেকে বড় হয়েছেও এই টিনের ঘরটাতেই।

মাঝেমাঝে টিন পাল্টানো হলেও দাদী নাকি এই ঘরে দাদার অস্তিত্ব খুঁজে পায়।খুঁজে পায় দাদার ভালোবাসা ও।তাই তো এই ঘর ছাড়া, এই বাড়ি ছাড়া দাদীকে কখনো একরাতও অন্য কোথাও থাকতে দেখিনি।ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে দাদীর কথায় মাথা নাড়ালাম।জিজ্ঞেস করলাম,
” উনাদের আবার এসব করার কি দরকার ছিল দাদী?তুমি যা রান্না করতে তাই নাহয় খেয়ে নিতাম।”
দাদী হালকা হাসলেন।বললেন,

” তুই যাওয়ার পর থেইকা তোর ফুফুই রাইন্ধা দিয়া যায়।আইজকা ও নাই বাড়িতে। তাই তোর ছোট আম্মায় খাবার দিয়া গেছে।”

দাদীর কথায় কষ্ট হলো।মানুষটার বয়স হয়েছে।চোখমুখ কেমন আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।চোখের দৃষ্টিও কেমন ফাংসে হয়ে এসেছে যেন।আমার না থাকাকালীন না জানি কতোটা কষ্টে কেঁটেছে।আচ্ছা, দাদীর যে সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস।সকাল সকাল চা করে দিত কি ফুফু?দাদীর যে মাথায় তেল দেওয়ার অভ্যাস আছে প্রতিদিন।প্রতিদিন তেল দিয়ে দিত কেউ?দাদীর যে প্রায়সই কোমড় ব্যাথায়, হাঁটু ব্যাথায় মলম লাগাতে হতো। কে লাগিয়ে দিত?দাদীকে যে প্রতিবেলায় বেলায় ঔষুধ দিতে হতো।কে দিত প্রতিবেলায় ঔষুধ?দাদীর মাথা ব্যাথা করলে যে উঠোনে বসে দাদীর চুলে সিঁথি কেঁটে দিতাম।কে দিত?আমি বিহীন দাদীর সময়গুলো কি আসলেই খুব ভালো কেঁটেছে?জানা নেই।মুহুর্তেই দাদীকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” এবার আর তোমায় ছেড়ে যাব না দাদী।রান্না, চলাফেরা সব আগের মতো খেয়াল রাখব। ”
দাদী ধমক দিয়ে বললেন,
” হ, তুই এহন পরীক্ষার পড়া ফালাইয়া আমার পেঁছনে পইড়া থাইকবি?”
বললাম,
” থাকলে কি সমস্যা?”

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৫

দাদী আমাকে অনুকরন করেই ব্যঙ্গ করে বললেন,
“এ্যাঁ,থাকলে কি সমস্যা? বহুত সমস্যা।তোরে কইত হইব ক্যান?”
দাদীর কথা শুনে আমি হেসে দিলাম আওয়াজ করে।কতদিন পর এভাবে আওয়াজ তুলে হাসলাম জানা নেই।কিয়ৎক্ষন সে হাসিতে মেতে থাকতেই চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইয়ের অদ্ভুত দৃষ্টি। মুহুর্তেই আমার হাসিটা থেমে গেল।

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১৭