এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২৫

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২৫
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

” জ্যোতি?দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে তোর মতামত কি?দ্বিতীয় বার বিয়েটা কিন্তু আগের বারের মতো আমার অনিচ্ছাতে কিংবা হুটহাট জোরজবরদস্তিতে হবে না।এবার আরামে বিয়ে করে সুন্দর একটা সংসার করব। তোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।”

টংয়র দোকানে কাঠের বেঞ্চে ধোঁয়া উঠা এক কাপ চা হাতে নিয়ে বসে ছিল জ্যোতি। পাশাপাশি বসে আছে মেহেরাজও।নির্লিপ্ত চাহনীতে চেয়ে ছিল পাশে থাকা রমণীর দিকে।ডাগর চোখজোড়ায় , শ্যামলা মুখে আজ ভিন্ন মায়া, ভিন্ন তৃপ্তি।মুখে সাঁজ নেই তবুও এই মুখে তাকিয়েই হৃদয় ক্রমশ শীতল হয়ে জমে উঠল তার।বুকের ভেতর সে জমাটবাঁধা হিম অনুভূতিরা জানান দিল পাশে থাকা নারীর গভীর মায়ায় ডুবে মরার যন্ত্রনা৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

নিজের করেও নিজের করে না পাওয়ার যাতনা। অনুুভূতির তীব্র অস্থিরতা সহ্য করেও অনুভূতিদের কথা সেই রমণীর সামনে জানান দিতে না পারার কষ্ট। মুহুর্তেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শ্বাস ফেলল মেহেরাজ।তারপর কি মনে করেই ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই আয়েশ করে কথাগুলো বলে ফেলল সে।অন্যদিকে জ্যোতি সবেমাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিতেই কানে পৌঁছাল মেহেরাজের আকস্মিক বলা কথাগুলো। মুহুর্তেই থমকে গেল তার চাহনী।

চোখের সামনে ভেসে উঠল সমান্তার প্রতিচ্ছবি। মেহেরাজদের বাসা ছেড়ে আসার আগে মেহেরাজের সাথে সামান্তার হাত ধরার সেই দৃশ্য।বুক ভার হয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। মস্তিষ্কে গিয়ে সর্বপ্রথম গেঁথে গেল যে কথাটা তা হলো, মেহেরাজ দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাইছে।দ্বিতীয়বার কারো সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছে।কোন নারীর পক্ষেই বোধ হয় এমন একটা মুহুর্তকে আনন্দমুখর মুহুর্ত হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। জ্যোতিও পারল না।

মুখভঙ্গি বদলে গেল।তপ্তশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল মেহেরাজের এভাবে আকস্মিক ভোরে ভোরে এতদূর এসে হাজির হওয়ার পেছনে তাহলে এই কারণটাই লুকায়িত ছিল।অবশ্য মেহেরাজ যে তার কারণে কোনদিন দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না এমনও তো প্রতিজ্ঞা বদ্ধ ছিল না। তবুও সে মানতে পারল না।চাপা যন্ত্রনা ভেতরটা নড়বড়ে করে দিচ্ছে।জ্বলন্ত আগুনের শিখায় যেন ঝলসে গেল তার হৃদয়। ঠোঁট চেপে কিছুক্ষন নিশ্চুপ থম মেরে বসে থেকেই পরমুহুর্তে ভাবল, যে মানুষটা তার নয় কিংবা যে মানুষটা তার ছিলই না কোনদিন সে মানুষটা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে তার কি?

সে তো অনেক আগেই মেহেরাজকে বলে এসেছিল সামান্তাকে বিয়ে করে সংসার গুঁছিয়ে নিতে। তখন কেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করল না?আজ এতগুলো দিন, এতগুলো মাস পরই দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা মাথায় আসল?জ্যোতি শ্বাসরুদ্ধকর সে মুহুর্তটায় নিশ্চুপে পাশ ফিরে তাকাল মেহেরাজের দিকে৷ এই প্রথম তার মধ্যে জ্বলন্ত স্ত্রী স্বত্ত্বা টের পেল। বুঝতে পারল কোন স্ত্রীই তার স্বামীকে ভাগ করতে পারে না। স্বামীকে অন্যের সাথে ভাগ করার অনুমতি ও দিতে পারে না।কোনকালেই পারে না। তবুও জ্যোতি বুকে পাথর চেপে অনুমতি দিল। উপরে উপরে নিজেকে একদম স্বাভাবিক দেখিয়ে বলল,

” আমার কিছু বলার থাকবে কেন মেহেরাজ ভাই? আপনি নির্দ্বিধায় বিয়ে করতে পারেন দ্বিতীয়বার। আমি তো আগেই বলেছিলাম কোন অধিকার নিয়ে আপনার সামনে যাব না।হ্যাঁ, আপনি যদি আমার আর আপনার বিয়েটা নিয়ে ইনসিকিউরড ফিল করেন তাহলে বরং খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি ডিভোর্সে অমত করব না।তাহলেই বোধহয় স্বাধীনভাবে,দ্বিধাহীনভাবে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারবেন। এটাই তো চাইছেন রাইট?”

জ্যোতির স্পষ্ট ভাবে বলা কথা গুলোতে মুহুর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল মেহেরাজের। চোয়াল ও শক্ত হয়ে উঠল। রাগে, জেদে চোখমুখ টানটান করল মুহুর্তেই।তাদের বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো স্বাভাবিকভাবে হয়নি।কারণবশত সুন্দরভাবে সংসারও করা হয়ে উঠেনি তাদের। তাই মনে মনে ভেবে রেখেছিল সংসার শুরুর আগে আনুষ্ঠানিক ভাবে সবার উপস্থিতিতে আরো একবার বিয়ে নামক বিষয়টা সম্পন্ন করবে।দ্বিতীয়বার বিয়েটা সে অন্যকাউকে নয় বরং জ্যোতির সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়েটা হবে ভেবেই বলেছিল।কিন্তু মেয়েটা বুঝল না। উল্টো “ডিভোর্স” নামক শব্দটা তুলে আনল যা আকস্মিক তার মেজাজ খারাপ করতে বাধ্য করল।লালাভ দৃষ্টিতে জ্যোতির দিকে তাকিয়েই শীতল গলায় বলে উঠল সে,

“ডিভোর্সের কথা আসছে কেন?তিনবছর আগে না আমাকে বলেছিলি, আমি সামান্তাকে বিয়ে করে নিতে পারি৷কিন্তু তোর সাথে যেন বিয়েটা ভেঙ্গে না দিই। সেসব এখন কোথায় গেল?”

মেহেরাজের মুখে সামান্তা নামটা আবারও শুনে জ্যোতি মনে মনে নিশ্চিত হলো বিয়েটা সামান্তার সাথেই হচ্ছে।মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে এক সমুদ্র যন্ত্রনা নিজের ভেতর চেপে রেখে স্থির ভাবে তাকাল মেহেরাজের চোখের দিকে। কি অমায়িক সুন্দর সেই চোখজোড়া। শুধু চোখজোড়া নয়, তার সামনে বসে থাকা আস্ত পুরুষটাই অমায়িক সুন্দর। এই অমায়িক সুদর্শন পুরুষটাই ভাগ্যক্রমে তার স্বামী হলেও বরাবরই এই পুরুষটা আর তার মাঝে ছিল বিস্তর দূরত্ব, অধিকারহীনতা আর দায়িত্বের সমীকরণ। জ্যোতি ঠোঁট এলিয়ে বলল,

” সত্যি বলতে কি, নিজেকে কারোর জীবনে এইটুকু সমস্যার কারণ হওয়া দেখাটাও অপমানজনক মেহেরাজ ভাই। বিশেষ করে বিয়ের মতো এমন একটা সাংঘাতিক সম্পর্কে। এটা ঠিক, আমি আপনাকে ভালোবেসেছি কিংবা ভালোবাসি। আপনার দায়িত্ব, আচার আচরণ, ব্যাক্তিত্ব সবকিছুতেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সত্যি বলতে আমি এখনও আপনার দায়িত্ব পালন, আচার আচরণ, ব্যাক্তিত্ব এসবকে সম্মান করি।

আপনার সাথে বিয়েটা অনিচ্ছায় হলেও একটা সময় পর বোধহয় আমি তা মেনে নিয়েছিলাম নির্দ্বিধায়। এমনকি আজও আমি মানি যে আমি বিবাহিত। কিন্তু তাই বলে আপনার সুখে বাঁধা হবো কেন? আমার আর আপনার বিয়ে নামক সত্যটা যদি আপনাকে সুন্দর-সাবলীল জীবন শুরু করতে ভয় দেখায় তাহলে সত্যটা মুুঁছে ফেলাই বোধ হয় উচিত। তাই না মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজের চোখজোড়ার রক্তিমতা গাঢ় হলো। হাতের চায়ের কাপটা আওয়াজ করেই টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” না, উচিত না।”

কথাটা শুনে জ্যোতির মুখে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যতা।বছর তিনেক আগে তার দাদীর আর আব্বার প্রশ্নের বিনিময়ে মেহেরাজের বলা উত্তরগুলো আবারও মনে করিয়ে দিল মস্তিষ্ক। সে উত্তরগুলোতে স্পষ্ট ছিল যে মেহেরাজ বাধ্য হয়েই বিয়েটা মেনেছিল। বাধ্য হয়েই জ্যোতির প্রতি দায়িত্ব পালনে রাজি হয়েছিল। সেসময়ে এত এত যত্ন, পাশে থেকে আগলে রাখা সবকিছুই যদি দায়িত্ব হয়ে থাকে তবে আজ বোধহয় সেই দায়িত্বটুকুও অবশিষ্ট নেই। তাই তো দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা সুন্দর সাবলীল ভাবেই বলে নিয়েছে তার সম্মুখে।এসব ভেবে মেহেরাজের দিকে আগের মতোই স্থির তাকিয়ে থেকে বলল,

” উচিত না হলে তো এই ভোর ভোর আপনি অতোদূর থেকে এখানে ছুটে আসতেন না মেহেরাজ ভাই। আপনার যে দ্বিতীয় বিয়ের এত তাড়া এটা জানলে বিশ্বাস করুন, এত কষ্ট করে আপনার এতদূর আসারও প্রয়োজন ছিল না। আমি ডিভোর্সে একবারও অমত করতাম না। আমি সত্যিই চাই আপনি আর সামান্তা আপু সুখে সংসার করুন। সুন্দর ভাবে বাঁচুন।সুন্দর একটা জীবন উপভোগ করুন।সত্যিই চাই। ”

মেহেরাজ ক্ষ্রিপ্ত চাহনীতে তাকাল। ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে তপ্ত মেজাজে বলে উঠল,
“সামান্তা আসছে কেন এখানে?”
জ্যোতি নরম গলায় উত্তর দিল,

” সামান্তা আপুকেই তো বিয়ে করবেন।তাই না?ভালোবেসেছেন যখন নিজের ইচ্ছায় বিয়ে তো অবশ্যই তাকেই করবেন।এই বিষয়ে তো দ্বিধা নেই কোন। ”
উত্তর শুনে ভ্রু উঁচাল মেহেরাজ। প্রশ্ন ছুড়ল,
” যদি দ্বিধা থেকেও থাকে? ”
ফের নরম গলায় উত্তর দিল জ্যোতি,

” ভালোবাসায় অতো দ্বিধা কাজ করে না। দ্বিধা থাকলেও একটা সময় পর তা মুঁছে যায়। আপনাদের ক্ষেত্রেও তাই।আমি নামক দ্বিধাটা বোধহয় এতদিন আপনাদের মাঝে উপস্থিত ছিলাম। তবে আশা করি এই দ্বিধাটা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে। আপনাদের নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজের মেজাজ তুলনামূলক খারাপ হলো। তবুও নিজেকে স্থির, শান্ত রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

” ধন্যবাদ।”
সৌজন্যতামূলক হাসল জ্যোতি। হাতে থাকা চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই বলল,
” তবে আসি?যে প্রয়োজনে এসেছিলেন তা নিশ্চয় শেষ।”
মেহেরাজ শীতল চাহনীতে তাকাল একনজর।উঠে দাঁড়িয়ে চা ওয়ালার দেওনা মিটিয়ে বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়াল জ্যোতির সামনে। কপাল কুঁচকে নিয়ে ঠোঁটজোড়া গোল করে তপ্তশ্বাস ফেলল।তারপর শান্ত গলায়ে বলল,
” না শেষ হয় নি।”

জ্যোতি চোখ তুলে তাকাল। চোখজোড়া দিয়ে প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধাল,
” আর কি প্রয়োজন?”
মেহেরাজ উত্তর দিল না। তপ্ত মেজাজে মুখ থমথমে রেখে হেঁটে গেল সামনের দিকে। জ্যোতি এগিয়ে গেল না। ঠাঁই সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে রইল মেহেরাজের যাওয়ার পানে।দেখতে পেল মেহেরাজ কিছুটা দূর গিয়েই থেমে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় বাকিয়ে তার দিকে তাকিয়েই কপাল কুঁচকাল বিরক্তিতে। ভ্রু উঁচিয়ে ছুড়ে দিল প্রশ্নময় দৃষ্টি।জ্যোতি সেই দৃষ্টির প্রশ্ন বুঝতে পেরেই পা বাড়াল। এগিয়ে গেল অল্প দূরে দাঁড়ানো পুরুষটির দিকে।

সামান্তার পরনে লাল রাঙ্গা শাড়ি।চুলগুলো খুলে রাখা৷ কপালে ছোট্ট লাল টিপ।দুধে আলতা গায়ের রংয়ে এরূপ সাঁজে যে কোন পুরুষই প্রেমে পড়তে বাধ্য।অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিও সে বাধ্যবাধকতায় নাম লিখাতে ভুলল না। অপলক তাকিয়ে থেকেই মুচকি হাসল। পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে থাকা সুন্দরী রমণীর দিকে।

সামান্তা হাসল। এই ছেলেটার সাথে পরিচয় আরো বছর ছয় আগে থেকেই৷ সে কলেজ জীবনে প্রথম পরিচয়।প্রথমে তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে শুরু হলেও এখনকার সম্পর্কটা কেবলই বন্ধুত্বে থেমে নেই৷ তা রূপ নিয়েছে প্রণয়ে৷ দ্বিতীয়বার দ্বিতীয় পুরুষের প্রণয়ে মেতে উঠা যাকে বলে৷ দ্বিতীয়বার বার দ্বিতীয় পুরুষের হাতে হাত রাখা, একসাথে পথচলার স্বপ্নদেখা যাকে বুঝায়৷ সামান্তা মুখে চঞ্চলতা ফুঁটিয়ে হাসল। দু পা এগিয়ে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়েই বলল,

” গোলাপ এনেছিস আরাব? ”
আরাব মুচকি হাসল এবারও। চোখের সামনে অসম্ভব রূপবতী মেয়েটাকে দুচোখে পরখ করে নিয়েই সেই হাসির উজ্জ্বলতা দ্বিগুণ হলো। প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা গোলাপটা বের করে এনেই সামনে ধরল৷ বলল,
” আরাব কখনো আপনার আদেশ ভুলে নাকি?”
সামান্তা চমৎকার হাসল। হাত বাড়িয়ে গোলাপটা নিয়েই আরাবের হাতের ভাজে নিজের নরম হাতটা ডুবিয়ে দিল। চঞ্চল গলায় বলল,

” বাহ! একেবারে পার্ফেক্ট প্রেমিক! ”
আরাব এবারেও ঠোঁট চওড়া করে হাসল। নিজের ডান হাত দিয়ে সামান্তার নাকটা আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
” এমন একটা সুন্দরী, রূপবতী প্রেমিকা থাকলে পার্ফেক্ট প্রেমিক না হয়ে উপায় কি শুনি?”
সামান্তা ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” সুন্দরী না হলে পার্ফেক্ট প্রেমিকের রোল প্লে করতি না? ”
আরাব এবারও হাস্যোজ্জ্বল চাহনীতে জিজ্ঞেস করল,
” কি মনে হয় তোর?”
সামান্তার চাহনী হঠাৎ নিভে এল। কিয়ৎক্ষন নিরব থেকে নরম গলায় বলল,
” জানি না। শুধু জানি বছর দুয়েক আগে আমি দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছি কারোর। দ্বিতীয়বার কাউকে সারাজীবনের জন্য চাইছি আমার করে। এইবার আর নিজের ভুলে হারাতে পারব না ভালোবাসার মানুষকে। পার্ফেক্ট না হলেও হারাতে পারব না। ”

আরাব হেসে উঠল। সামান্তার হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেই অপলক তাকিয়ে থাকল মেয়েটার দিকে। এই মেয়েটা যে তাকে হারাতে চায় না তা তার চোখের চাহনীতে স্পষ্ট৷ মেয়েটাকে সে কলেজ জীবন থেকে ভালোবেসে আসলেও কখনোই ভাবেনি মেয়েটা একটা সময় তার হবে। কখনো তার দিকে প্রণয়ী হাত বাড়াবে। কখনো তার প্রেমে পড়বে এমনটা ভাবনার বাইরেই ছিল।

ভাবনার বাইরে থাকার পেছনে অবশ্য কারণ ছিল। কারণটা হলো সামান্তার থেকে প্রত্যাখান।প্রথমবার নিজের ভালোবাসার অনুভূতি সামান্তাকে জানানো মাত্রই সামান্তা মেহেরাজের সাথে নিজের প্রেমের কথা নির্দ্বিধায় বলে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল আরাবকে।তারপর থেকে অবশ্য সামান্তার পাশে শুধু মাত্র বন্ধু হিসেবেই ছিল সে। এমনকি মেহেরাজের সাথে বিচ্ছেদের পরেও সর্বক্ষন বন্ধু হয়েই আগলে নিয়েছে এই মেয়েটাকে।অবশেষে সামান্তার পাগলামো, অস্থিরতা, যন্ত্রনা সবকিছুকেই লাঘব করতে সক্ষম হয়েছিল। বিনিময়ে পেয়েছিল মেয়েটার আস্থা, ভালোবাসা আর স্বচ্ছল প্রেম।

বিল্ডিংয়ের দোতালায় তিনরুম বিশিষ্ট ফাঁকা বাসাটা জ্যোতি ঘুরে ঘুরে দেখল। বসার ঘর,রান্না ঘর সহ বাসাটা ভালোই বোধ হলো৷ টুলেট দেখে দেখে এই নিয়ে চারটা বাসা দেখেছে দুইজনে।তার মধ্যে এই বাসাটাই উত্তম মনে হলো।তাই মেহেরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এই বাসাটা ঠিক আছে মেহেরাজ ভাই।আপনার বন্ধুকে ডিটেইলস বলে জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন পছন্দ হবে কিনা।”

মেহেরাজ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়ল।এখনও রাগ রাগ ভাব বর্তমান তার মুখে। পকেটে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“জিজ্ঞেস করতে হবে না, এই বাসাটা ঠিকই আছে।”
জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আপনার বন্ধুর যদি অপছন্দ হয়?”
শান্ত গলায় উত্তর আসল,

” হবে না। ”
” তাহলে ঠিকাছে। ”
মেহেরাজ বিনিময়ে কিছু বলল না। চুপচাপ হেঁটে গিয়ে দরজার দ্বারে দাঁড়ানো বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলল। তারপর পা বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল জ্যোতিও। এরপর অবশ্য মেহেরাজ আর জ্যোতির মাঝে তেমন একটা কথা হলো না।

চুপচাপ পাশাপাশি চলল কেবল দুইজনে। মেহেরাজের মুখচোখ কঠিন। চাহনী থমথমে। তাই আর আগ বাড়িয়ে জ্যোতিও কথা বাড়াল না।মনে মনে মেহেরাজের আকস্মিক রাগের কারণ খুুঁজলেও ব্যর্থ হলো। এভাবেই নিশ্চুপতায় কাঁটল পুরোটা সময়। তারপর একটা সময় পর রিক্সায় উঠল দুইজনে। পাশাপাশি বসেও একে অপরের মাঝে একটা শব্দও বিনিময় হলো না।অবশেষে তার বাসার সামনেই রিক্সা থামিয়ে মেহেরাজ তাকাল তার দিকে। শান্ত গলায় বলল,

” নেমে যা। ”
জ্যোতি অবাক হলো। গলাটা শান্ত হলেও সে শব্দ দুটো যেন সহস্র রোষের প্রকাশ ঘটাল। চোখের সামনে তুলে ধরল যেন শীতল রাগ। নরম গলায় সে বলল,
” হ্ হু?”
মেহেরাজ ফের থমথমে গলায় বলল,

” কানে শুনিস না?”
জ্যোতি এবার আর বসে থাকল না। দ্রুত রিক্সা ছেড়ে নেমে পড়ল। একপাশে দাঁড়িয়ে অপমানে জর্জরিত হওয়া মুখখানা নিয়ে মেহেরাজের দিকে তাকাতেই দেখল মেহেরাজও নেমে পড়েছে। তারপর পকেট থেকে কি যেন বের করে হঠাৎই ঝুকে বসল। হাতজোড়া জ্যোতির পায়ের দিকে এগিয়ে নিতেই জ্যোতি সরে গেল। অবাক হয়ে বলল,
” কি করছেন মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ চোখ তুলে গরম চাহনীতে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তোর পায়ে ধরে বসে থাকব না নিশ্চয়?”
মেহেরাজের ত্যাড়া কথা শুনে আবারও অপমানে জর্জরিত হয়ে থমথমে মুখে দাঁড়াল জ্যোতি। মেহেরাজ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে আলতো হাতে তার পায়ে পরিয়ে দিল নুপূর।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একবারও আর জ্যোতির দিকে তাকাল না। রিক্সায় উঠে বসেই রিক্সাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলে উঠল দ্রুত,

” চলেন মামা।”
মুহুর্তেই রিক্সাটা এগিয়ে গেল। চোখের সামনে থেকে কয়েক সেকেন্ডে বিলীন হয়ে গেল সে রিক্সা।তবুও জ্যোতি সেদিক পানেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল।মনে মনে আওড়াল,”একবারও ফিরে চাইল না? একবারও না। তাহলে এই নুপূরজোড় পরিয়ে কি বুঝাতে চাইল?

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২৪

এটাও দায়িত্ব? শুধুই দায়িত্ব?পরমুহুর্তেই আবার মস্তিষ্ক জানা দিল,দায়িত্ব না হয়ে অন্যকিছু হলে তো সে এতগুলো দিনে একবার হলেও ভালোবাসার কথা বলত। এতগুলো দিনে একবার হলেও কাছে টানত। শুধু দায়িত্ব না হলে তো সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাইত না। কখনোই চাইত না।

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২৬