এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩+৪

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩+৪
লেখিকা মালিহা খান

তপ্ত গরম চারিপাশে।গায়ের ঘাম তরতর করে ঝরে যাচ্ছে।মানুষজনের ভীড় ঠেলে সামনে এগোনো মুশকিল।
এতো গিজগিজে পরিস্থিতি।বিচ্ছিরি অবস্থা!
চোখমুখ বিকৃতি করে সামনে চেয়ে আছে তোহা।মানুষের কি এত কেনাকাটা যে রোজ রোজই শপিংমলে ভীড় জমাতে হবে!
তার পাশে দাড়িয়ে আছে তার বড় খালামনি আফিয়া।তিহান গেছে গাড়ি পার্ক করতে।
সপ্তাহ খানেক আগে স্বর্ণের গহনা বানাতে দেয়া হয়েছিলো।নিশার বিয়ের গহনা।নানা বাহানার,ব্যস্ততায় তা আর নেয়া হয়নি।কাল যেহেতু বিয়ে তাই আজ সেগুলো নিতে এসে পরেছে।বাড়িতে সবাই খুব ব্যস্ত।তাই তারা তিনজনই এসেছে।
তিহান ফিরে আসতেই আফিয়া খালামনি তোহার হাত টেনে বললো,

—“চল তোহা,তাড়াতাড়ি গহনা নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।”
আরেকবার সামনেটায় চোখ বুলিয়ে নিলো তোহা।ভীড় যেন ক্রমশ বাড়ছে।ইততস্ত কন্ঠে সে বললো,
—“খালামনি,তোমরা যেয়ে নিয়ে আসো।আমি এখানেই দাড়াই।এতো ভীড়ের মধ্য আসলে…”
আফিয়া স্নেহময় কন্ঠে বলে উঠলেন,
—“সেকি,তোর ও না হলুদের চুড়ি কিনা বাকি।তোর চুড়ি কি আমরা পছন্দ করে নিয়ে আসবো নাকি?চল পাগলি।সামনে গেলেই আর ভীড় হবেনা।”
তিহান একবার হাতে পরা সিলভার রংয়ের স্টিলে র ঘড়িটায় চোখ বুলায়।ঘড়িতে বাজে দুপুর ১২:৩০।মাথার উপর সূর্যের উত্তপ্ত তেজ।কপালে,গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে।মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো সে।এরপর সামনে তাকিয়ে তোহার হাতের কব্জি ধরে এগোতে এগোতে তেঁতো কন্ঠে বললো,
—“তোর এত ঢং দেখার সময় নেই আমার।অনেক কাজ পরে আছে।আয়।”
আফিয়া মুচকি হেসে দ্রুত তাদের সাথে সামনে পা বাড়ালো।খানিকবাদে তার হাতটাও ধরলো তিহান।বলল,
—“এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।আস্তে হাঁটো মা।নয়তো তোমার পায়ের ব্যাথা বাড়বে।”
ভীড়ের মাঝেও তোহা খেয়াল করে কারোর শরীর তার শরীর স্পর্শ করছেনা।একটা বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত হাত যত্নে ভরা স্পর্শে তাকে আগলে ধরেছে খুব সাবধানে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গাড়িতে এসে বসেছে তারা।তিহানের শার্ট ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।গাড়িতে বসে স্টেয়ারিংয়ে হাত রেখে দ্রুত এসি ছেড়ে দিলো সে।তোহা আর আফিয়া পেছনের সিটে বসেছে।সামনের সিটে গহনার ব্যাগগুলো রাখা।
গাড়ির সামনে রিভিউ গ্লাস দিয়ে পেছনে তাকায় তিহান।সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমের ভঙ্গিতে চোখবন্ধ করে রেখেছে তোহা।মাথার ওড়না পরে গেছে।গলার গাঢ় বাদামী তিলটা এখান থেকেও একেবারে স্পষ্ট।
হঠাৎই আফিয়া চেঁচিয়ে উঠে,
—“এই তোহা,তোর চুড়িই তো কেনা হলোনা।”
মূহুর্তেই চোখ মেলে তাকায় তোহা।চোখ খুলতেই তিহানের ধূসর চোখের মনিতে দৃষ্টি আটকে যায়।
তিহানের আই লেন্স ধূসর রংয়ের।বাংলায় যাকে বলে,”বিড়াল চোখ”।ঘোলাটে,অসচ্ছ দৃষ্টি।
তোহার দারুণ লাগে এই ব্যাপারটা।ইচ্ছে থাকা সত্তেও তিহানের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনা সে।কেমন যেন ভয় লাগে!এবারো ব্যাতিক্রম হলোনা চোখ নামিয়ে ফেললো সে।
আফিয়া আবারো চেঁচিয়ে উঠতেই তোহা বললো,
—“থাক খালামনি,লাগবেনা।আগের গুলোই পরে নিব”
—“আগেরগুলো পরবি কেনো?যা তিহানের সাথে যেয়ে কিনে আন।আমি বসছি গাড়িতে।তোরা যা।”
তোহা চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে।ভাবছে এখনই হয়তো একটা রাম ধমক দিবে তিহান।কিন্তু না তেমন কোন প্রলংকারী ধমক শোনা গেলো না।শুধু শোনা গেলো তিহানের ভারি কন্ঠের ডাক,

—“জলদি বের হ তিহু।”
তোহা চোখ মেললো।তার পাশের দরজা খুলে দাড়িয়ে রয়েছে তিহান।স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে বের হলো সে।
মাথায় ওড়না টেনে তিহানের পাশে দাড়ালো।তিহান দরজা লক করে দিয়ে আফিয়াকে বললো,
—“বেশিক্ষণ লাগবেনা মা।দশমিনিটের মধ্যই আসছি।”
আফিয়া সহাস্যমুখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।

চুড়ির দোকানের সামনে দাড়িয়ে চুড়িগুলোর দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে তোহা।তিহান তাঁড়া দিচ্ছে,
—“আদৌ কি তোর কোনোটা পছন্দ হবে?”
উওরে তোহা বিরবির করে বললো,
—“সবই তো ভালোলাগছে।”
তিহান কথাটা শুনতে পেলেও কিছু বললোনা।সবুজ রংয়ের একমুঠো কাঁচের চুড়ি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে নিয়ে দোকানির হাতে দিয়ে বললো,
—“এইটা প্যাকেট করে দেন,দুইডজন।”
দোকানি মহিলাটা হাসলো।বললো,
—“পইরা দেখতে কন।হাতে হইবো নাকি এই মাপেরটা?”
তিহান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো।চুড়ির টাকা বের করে দোকানির দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো,
—“ওর চুড়ির মাপ আমার জানা আছে খালা।”
তোহা চমকালো না।তার আলমারি ভর্তি করা চুড়ি আছে যেগুলো তিহানই কিনে দিয়েছে।তাই হাতের মাপ জানাটা অস্বাভাবিক কিছু না।

হলুদের ছোটোখাটো আয়োজন করা হয়েছে বাড়ির ছাদে।নিশা বসে আছে স্টেজে।তোহার দেখা নেই আশেপাশে।সে আজকেও লেট।এখনো ছাদেই আসেনি।অথচ হলুদ লাগানো শুরু হয়ে গেছে।মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে নিশার।হাতের ইশারায় স্বর্ণালিকে কাছে ডাকলো নিশা।সে আসতেই দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“তোহার বাচ্চাটা কই রে?ওকে ছাদে আসতে বল।ফাস্ট”
নিশার গলার স্বরেই স্বর্ণালি বুঝতে পারলো সে ক্ষেপেছে।দ্রুত মাথা নাড়িয়ে নিচের দিকে ছুটলো।উদ্দেশ্য তোহাকে ডাকা।
তোহা ফোনটা ড্রয়েরে লক করে মাত্র বের হবে তখনই স্বর্ণালির এসে দাড়ালো তার সামনে।হন্তদন্ত কন্ঠে বললো,
—“নিশা ডাকছে তোকে।দ্রত যা।”

দ্রুতপায়ে উপরে উঠলো তোহা।ছাদে প্রবেশ করতেই তিহানের চিল্লাচিল্লি কানে এলো।কর্ণারে ফুল লাগানো হয়নি।সে নিয়েই একটা ছেলেকে ধমকাচ্ছে তিহান।বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ তার।রাগের চোটে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।তোহা ধীরপায়ে তাকে পাশ কাটিয়ে গেলো।নিশার কাছে যেতেই সেও ধমকে বললো,
—“কই ছিলি তুই?তোকে দেখেতো মনে হচ্ছেনা তুই আমার আপন বোন।মনে হচ্ছে তুই মেহমান।খেয়েদেয়ে চলে যাবি।কোনো দায়িত্ব নেই”
তোহা বোকা হেসে তার পাশে বসল।বললো,
—“তোমরা সবাই এমন ক্ষেপে আছো কেনো?”
—“ক্ষেপবোনা?ফোন কই তোর?একটা ছবি তুলেছিস আমার সাথে?আমি যে বউ কারো কোন খেয়ালই নেই।”
—“ক্যামেরাম্যান এসেছেতো।তুমি তোলো ছবি।কে মানা করেছে?”
নিশা আগুন কন্ঠে বললো,
—“ডিএসএলআর এ সেলফি তোলা যায়?ফোন কই তোর?”
—“ফোনতো আনিনি।”
চোখজোড়া বন্ধ করলো নিশা।রাগে কান্না পাচ্ছে।বারকয়েক শ্বাস নিয়ে যেই না শান্ত হয়েছে তখনই তোহার কন্ঠ শোনা গেলো,

—“তিহান ভাই,আপনার ফোনটা দিনতো।ছবি তুলবো।”
চোখ বড় বড় করে তাকালো নিশা।তিহান এমনেই রেগে আছে,তার উপর গাধাদের মতো ওর ফোন চেয়েছে তোহা।তিহানের পার্সনাল কোনো জিনিসে হাত দেয়া তার একেবারেই পছন্দ না।আর সেখানে তোহা তো একেবারে পার্সনাল ফোনটাই চেয়ে বসেছে।ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিশা।তিহানের ধমক শোনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।
কিন্তু পরমূহুর্তেই ভাবভঙ্গি বদলে গেলো তার চেহারার।তিহান বিনাবাক্য ব্যায়ে তোহার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে গটগট করে সামনের দিকে চলে গেলো।তোহা স্বাভাবিকভাবেই ফোনের পার্সওয়ার্ড টাইপ করে লক খুলে ক্যামেরা বের করে বললো,
—“আসো,ছবি তুলি।”
নিজের বিস্ময়টা চেপে গেলো নিশা।ভাবলো,হয়তো তিহানের মুড কোনো কারণে ভালো সেজন্যই হয়তো তোহাকে কিছু না বলে ফোনটা দিয়ে দিয়েছে।

রাত প্রায় অনেক।মেহমানরা নেই কেউ।সারা শহর আবছা অন্ধকার।ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে অনেকক্ষণ হয়েছে।তোহাদের বাসার জেনারেটর এর লাইনও সপ্তাহখানেক যাবত বন্ধ।মেইন কানেকশনে সমস্যা হয়েছে।তিহান ফোন করে জেনেছে সকালের আগে কারেন্ট আসার কোনো চান্স নেই।
জোছনা রাত।গোল থালার মতো চাঁদের আলোয় আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে সবকিছু।ছাদের এককোঁণে
পাটি বিছিয়ে বসে আছে সব কাজিনরা।আড্ডায় মশগুল তারা।শুধু তূর্য নেই।সে নিচে।
ঠান্ডা হাওয়া বইছে।গরম ভাবটা নেই।একের পর এক ম্যাচের কাঠি নষ্ট করে মোমবাতি জ্বালাতে চাচ্ছে স্বর্ণালি।কিন্তু সে ব্যর্থ।মোমবাতিটা বারবার হাওয়ায় ধাক্কায় নিভে যাচ্ছে।
প্রায় আটবার চেষ্টার পর যখন সে আবারো ম্যাচের কাঠি জ্বালালো তখনই তিহান ধমকে উঠে বললো,
—“রাখ তো তোর মোমবাতি।মোমবাতি জ্বালিয়ে বিশ্ব উদ্ধার করে ফেলবে নাকি?রাখ ওটা।কোনো দরকার নাই আলোর।”
স্বর্ণালি পিটপিট করে তাকিয়ে তিহানের ধমকটা হজম করে মোমবাতিটা সাইডে রেখে দিলো।
তোহা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে চুপচাপ।তার চোখ ঘুমঘুম।তিহান বসেছে ঠি ক তার বরাবর।
চাঁদের আলোটা সোজা যেয়ে পরছে তিহানের মুখে।তোহা তাকাচ্ছেনা।ঢুলুঢুলু চোখে আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে।

খানিকবাদে সকলের পিড়াপিড়িতে গান গাওয়ার জন্য রাজি হলো তিহান।অন্ধকারের মধ্যেই সাইফ আর নুহাশকে পাঠালো তার ঘর থেকে গিটার আনার জন্য।তারা সেটা এনে দিতেই কোলের উপর গিটার নিয়ে টুংটাং শব্দ তুলল।তার দৃষ্টি তোহার চোখের দিকে।গিটারের শব্দে নড়েচড়ে বসলো তোহা।ঘুম ভাবটা চলে গেছে ততক্ষনে।
তিহান সেই অতি আকৃষ্ট মোহনীয় ভরাট কন্ঠে গান ধরলো,
“আমি তোর মনটা ছুয়ে সপ্ন দিয়ে,আঁকবো যে তোকে।
আমি তোর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাই তোকে।
আমি তোর মনটা ছুয়ে সপ্ন দিয়ে,আঁকবো যে তোকে।
আমি তোর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাই তোকে।
তুই থাকলে রাজি,ধরবো বাজি
কোনোকিছু না ভেবে
ও একটু নয়
অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে…”

তোহা থমকালো।আধো অন্ধকারেও সে বুঝতে পারছে তিহানের দৃষ্টি তার চোখের দিকেই।চাঁদের আলোয় জলজল করছে তার ধূসর মনিজোড়া।ঠোটের কোঁণে রয়েছে মৃদু হাসির রেখা।কয়েকটা ফাঁকা শুকনো ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে নিল তোহা।বাকি সবাই গানে মশগুল।তিহান তখন গেয়ে চলেছে,
তুই তাকালে মেঘের পানে,ডানা মেলে উড়ে গাঙচিল
তোর ইশারা দিচ্ছে সাড়া,হৃদয় সুখের অন্তমিল
ও….
তুই তাকালে মেঘের পানে,ডানা মেলে উড়ে গাঙচিল
তোর ইশারা দিচ্ছে সাড়া,হৃদয় সুখের অন্তমিল
তুই থাকলে রাজি,ধরবো বাজি
কোনোকিছু না ভেবে
ও একটু নয়
অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে…”
এতটুকু গাইতেই উঠে দাড়ালো তোহা।তিহান গান থামালো।রূঢ় কন্ঠে বললো,

—“তোর আবার কি হলো?বস চুপচাপ।”
তোহা বসলোনা।কয়েককদম সামনে এগিয়ে বললো,
—“আমার ঘুম পাচ্ছে।আমি নিচে যাচ্ছি।”
বলে এগোতে নিলেই তিহান পকেটে থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে সাইফের হাতে দিয়ে বললো,
—“ওকে নিচে দিয়ে আয়তো।একা যেয়ে আরো ঝামেলা বাঁধাবে।”
তোহা কিছু বললোনা।সাইফের সাথে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে গেলো।
ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে।আলোকিত হয়ে আসছে চারিপাশ।আকাশের নীলাভ আভায় নীলবর্ণ ধারণ করেছে প্রকৃতি।নিরব,শান্ত পরিবেশ।পাখিদের এখনো ঘুম ভাঙেনি।ঘুম ভাঙেনি তোহারও।
নিজের রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তোহা।ঠান্ডা বাতাসে তার কোমড় পযর্ন্ত ছড়ানো ঘনকালো খোলা চুলগুলো স্নিগ্ধভাবে উড়ছে।চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে আছে।
চোখে মুখে বিচরণ করছে শুভ্র সৌন্দর্য।

তার বারান্দার পাশাপাশি বারান্দাটাই তিহানের।মাঝখানের ব্যাবধান খুব একটা বেশি না।কারেন্ট এসেছে আধঘন্টা আগে।সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।কারেন্ট আসতেই শাওয়ারে ঢুকেছিলো তিহান।ঘেমে চুপচুপে ছিলো তার শরীর।
আধঘন্টায় শাওয়ার নিয়ে গলায় সাদা তোয়ালে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো সে।পরণে শুধু কালো ট্রাওজার।গা না মুছেই বেরিয়েছে সে।পানি গড়িয়ে পরছে উন্মুক্ত সাদা ফর্সা শরীর থেকে।
সোফায় শুয়ে আছে সাইফ।আর নুহাশ বিছানার এককোণে।মূলত রুম শেয়ার করা তার বিশেষ পছন্দ নয়।তবুও উপায় না পেয়ে করতে হচ্ছে।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় যেয়ে দাড়ালো তিহান।
ভেজা গায়ে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যেতেই লেপ্টে থাকা পশম গুলো পর্যন্ত দাড়িয়ে গেলো।অদ্ভুততো!আজকে এতো ঠান্ডা কেনো?কালইতো গ্রীষ্মের পঁচা গরম ছিলো।দরদরিয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছিলো।আর আজকে কি শীতল পরিবেশ!রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে!
আকাশের দিকে চোখ গেলো তিহানের।হাল্কা হাল্কা ধূসর কালো মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ দিকটায়।বৃষ্টি হবে নাকি?গ্রীষ্মের স্বস্তিদায়ক বৃষ্টি?
চুলের পানি ঝেড়ে যেইনা রুমে ঢুকতে যাবে তখনই তার চোখ যায় পাশের বারান্দায়।তোহাকে সেখানে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে যায়।মৃদু স্বরে সে ডাকে,
—“তিহু?এই ভোরবেলা এখানে বসে আছিস কেনো?এই তিহু?”
তোহার সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা।মেয়েটাকি ঘুমিয়ে আছে?তার দিকে পিঠ দেয়া তাই বুঝতেও পারছেনা।
কোনো উওর যেহেতু দিলোনা তারমানে ঘুমিয়েই আছে।কারণ তার কথার জবাব না দিয়ে সে বসে থাকবে এত সাহস এই মেয়ের নেই!কিন্তুএই ঠান্ডার মধ্য বারান্দায় ঘুমাচ্ছে কেনো?তারপরতো সর্দি জ্বর বাঁধিয়ে বসবে।
তিহান রুমে ঢুকলো।গলার টাওয়ালটা টেবিলে রেখে জামা না পরেই ড্রয়ার থেকে তোহাদের ফ্ল্যাটের এক্সট্রা চাবিটা নিয়ে নি:শব্দে বেরিয়ে গেলো।

ধীরপায়ে তোহার রুমে প্রবেশ করলো সে।দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে।
ততক্ষনে মাথাটা আরো একটু কাত হয়ে গেছে তোহার।মুখের উপর এসে পরেছে এতগুলো চুল।মাথাটা আরেকটু হেলে পরে যেতে নিলেই দ্রুতহাতে তা ধরে ফেলে তিহান।একহাঁটু গেড়ে বসে নিজের বুকের উপর ঠেঁকিয়ে রাখে।চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে গালে কপালে হাতের উল্টোপিঠের ছোঁয়া দেয়।তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করে।মেয়েটার শরীর বরফ শীতল হয়ে আছে।
পরণে আকাশী রংয়ের কামিজ।গায়ে ওড়না নেই।অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে রাতে নিচে নামার আগে তোহার গায়ে সাদা ওড়না জড়ানো ছিলো।
সন্দেহবশত রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাতেই তিহান লক্ষ্য করে তোহার সাদা ওড়না ঝুলছে তাদের নিচের ফ্ল্যাটের বারান্দার গ্রিলে।হতাশ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন সেদিকে চেয়ে থেকে তোহাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয় তিহান।রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সরার আগেই তোহা একটু নড়েচড়ে দুহাতে তিহানের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটজোড়া কিন্চিৎ ফাঁক করে অস্ফুষ্ট স্বরে বলে,
—“আপনি কেনো রোজ রোজ আমার সপ্নে আসেন?”
তিহান শব্দহীন হাসি হাসে।তোহা আষ্টেপিষ্টে তার গলা জড়িয়ে রেখেছে।মধ্যেকার দুরত্ব নেই।তোহার ঠোঁট বারবার তার গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে।
তিহান তোহার কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
—“তুমি বাস্তবে যা নিয়ে ভাববে তাই তোমার সপ্নে প্রতিফলিত হবে।তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো সেজন্যই আমি রোজ তোমার সপ্নে আসি।বুঝলে?”

তোহা ঠোঁট উল্টায়, জড়ানো কন্ঠে বলে,
—“আমি আপনাকে নিয়ে কেন ভাববো?”
—“হয়তো আমি তোমার ‘বিশেষ’ কেউ,সেজন্যই।”
—“বিশেষ কেউ”?
তিহান আর উওর দিলোনা।তোহার হাত ছাড়িয়ে উঠে পরলো।দু’বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তোহা আবারো ঘুমে তলিয়ে গেলো।
কাঁধের কাছটায় হালকা জ্বলছে তিহানের।তোহার নখগুলো খুবই ধাঁরালো।
ঘরের ফ্যান ছেড়ে দিয়ে তার গায়ে কাঁথা দিয়ে দিলো তিহান।বারান্দার দরজা লক করে,জানালার পর্দা টেনে দিলো।অত:পর তোহার কপালে অঁধরের ছোঁয়া দিয়ে নিশব্দে রুম ত্যাগ করলো।

সকালে বাইরের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো তোহার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই খেয়াল হলো,সে তো রাতে কারেন্ট নাই বলে গরমে বারান্দায় যেয়ে বসেছিলো।তারপর?তারপর কি সে নিজেই এসেছে ঘরে?মনে পরছেনা তো।ধুর!
চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে আয়নার সামনে যেয়ে দাড়ালো সে।একটা কাঁটা দিয়ে তা আটকে নিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো তার গায়ে ওড়না নেই।বিছানায়ও নেই।বারান্দায় যেতে নিলেই দেখলো দরজা ভেতর থেকেই লক।সে কি ঘুমের মধ্য দরজাও লক করেছে?স্ট্রেন্জ!
বারান্দায়ও ওড়নাটা নেই।তার খুব প্রিয় ছিলো ওড়নাটা।কোথায় গেলো সেটা?নিচে ঝুঁকে দেখলো কোথাও পড়েছে নাকি।কিন্তু নাহ্।কোথাও নেই।সকাল সকালই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তোহার।তার প্রিয় ওড়নাটাই কেনো হারাতে হলো?

বের হতেই শুনলো খালামনি ডেকে পাঠিয়েছে তাকে।শুধু তাকেই নয়,নিশা-স্বর্ণালি আর তূর্য কেউ যেতে বলেছে।
সাইফ এসে খবর দিতেই তারা বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো সেখানে যেয়ে উপস্থিত হলো।

ডাইনিং টেবিলে সাজানো সাদা রুটি আর গরুর মাংসের ভুনা।সাথে ঝোল করা খাসির মাংস।বাসার বাচ্চাদের জন্য নাস্তা বানিয়েছে আফিয়া।যদিও তারা বাচ্চা নেই তবুও আফিয়ার কাছে সবসময় এরা বাচ্চাই।নিশার শেষ নাস্তা এ বাড়িতে তার জন্যই এ আয়োজন করা।
সবাই টেবিলে বসতেই তোহা কাঁচুমাচু করে বললো,
—“খালামনি,আমিতো…”
তার বাক্য পূর্ন করার আগেই আফিয়া বললো,
—“হ্যাঁ,আমি জানি তুই গরু,খাসি খাসনা।তোর জন্য আলাদা মুরগি করেছি।এনে দিচ্ছি।”
তোহা দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বললো,
—“আমি আনছি,তুমি বসো।”
—“তোর আনা লাগবেনা,তবে উঠেই যখন পরেছিস একটু কষ্ট করে তিহানকে ডেকে আননা মা।সবাই নাস্তা করছে অথচ ও এখনো ঘুমোচ্ছে।”
তোহা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলোনা।চুপচাপ পা বাড়ালো তিহানের রুমের দিকে।দরজার লক ঘুরাতেই তা খুলে গেলো।
রুম অন্ধকার।তোহা লাইট জ্বেলে দিলো।খালি গায়ে উল্টো হয়ে ঘুমাচ্ছে তিহান।গায়ের কাঁথা কোমড় পর্যন্ত নেমে গেছে।
চোখ নামিয়ে বিছানার পাশে যেয়ে দাড়ালো তোহা।ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ১+২

—“তিহান ভাই?উঠুন।”
তোহা হাল্কা ঝুঁকে গেলো।আলতো করে তিহানের বাহুতে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললো,
—“তিহান ভাই?খালামনি ডাকছে আপনাকে।উঠুননা।”
তিহান চোখ মেললো।তার চোখের সাদা অংশগুলো লাল হয়ে আছে।তোহা হাত সরিয়ে ভাবলো,”উনি কি ঘুমাননি রাতে?চোখ এত লাল কেনো?”
তিহান সোজা ঘুরতে ঘুরতে বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
—“সমস্যাটা কি তোর?সারাক্ষণ খালি মায়ের চামচামি করা।উঠাতে বলেছে বলেই উঠাতে হবে?দেখছিস না ঘুমাচ্ছি,তারপরও কেনো ডাকলি?থাঁপড়ে গাল লাল করে দিবো একদম।”
চোখজোড়া একটু ছলছল করে উঠলো তোহার।লোকটা সপ্নের মধ্য কি সুন্দর করে কথা বলে আর বাস্তবে শুধু ধমকায় কেন?
চোখের পানি গুলোকে আটকে নিয়ে সে ভারি কন্ঠে বললো,
—“নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।জলদি আসবেন।”বলেই দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো সে।

নাস্তা শেষে খালামনির সাথে সব হাতে হাতে গুছিয়ে দিচ্ছিলো তোহা।বাকি সবাই ওদের ফ্ল্যাটে গেছে।
সব গুছিয়ে সেও বেরোতে যাবে তার আগেই তিহানের ডাক শুনে থেমে যেতে হলো।তাকে রুমে ডাকছে তিহান।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে পিছিয়ে যেয়ে রুমে উঁকি দিলো তোহা।তিহান শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এগিয়ে এলো।তোহার হাত টেনে রুমের ভেতর নিয়ে এসে সাদা রংয়ের ওড়নাটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—“কালরাতে বারান্দায় ঘুমিয়েছিলি কোন খুশিতে?”

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৫+৬