এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৯+২০

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৯+২০
লেখিকা মালিহা খান

ছাত্রীকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই জানালা দিয়ে বারবার আকাশের মতিগতি পরখ করে নিচ্ছে রাত্রি। পাথর পাথর মনটাও জানপ্রাণ দিয়ে চাইছে আজ যেনো বৃষ্টি নামে।কিন্তু মেঘ আর তার মনের কথা শুনছে কই?সে তো ভেসে ভেসে পাড়ি জমিয়েছে কোথাকার কোন শহরে।আর এদিকে মেঘবালকের ব্যক্তিগত মেঘবালিকার যে এ শহরে বৃষ্টি দরকার সেদিকে গোটা আকাশের কারো খেয়াল নেই।রাত্রি মুখ ভার করলো।বৃষ্টির সাথে আজ প্রচন্ড ঈর্ষা হচ্ছে।মানুষটার যে এই বৃষ্টি ভীষণ পছন্দের!

সন্ধ্যা ছ’টা…
রাস্তার হেডলাইট জ্বলছে নিভছে।আবার কতকগুলো একেবারেই নষ্ট।আলো নেই।কয়েকটা শুকনো পাতা বাতাসে লুঁটোপুঁটি খাচ্ছে।বৃষ্টি না হলেও বাতাস ছেড়েছে।ঠান্ডা বাতাস।চুল ওড়না এলোমেলো করে দিচ্ছে নিজ দায়িত্বে।
গেটের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার ধারে নিভ্রানকে অপেক্ষা করতে দেখা গেলো।গায়ে সেই আকাশী শার্টটাই।ব্রাশ করা চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় একটু অগোছালো।রাত্রিকে দেখা মাত্রই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলো সে।
রাত্রির চেহারা তখন বিধস্ত,মলিনতায় ছেঁয়ে আছে।চোখ ভেঙে ঘুম পাচ্ছে।সটান হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়াটা এখন স্বর্গীয় সুখ মনে হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে রাত।জ্বর আছে?দেখি।”বলে রাত্রির গালে-গলায় নিজের ঠান্ডা হাতটা ছুঁইয়ে দিলো নিভ্রান।সেই নিবিড় ছোঁয়ায় রাত্রি কেঁপে উঠলো খানিকটা।নিভ্রানের কপালে সুক্ষ চিন্তার বলিরেখা।প্রিয়জনের অসুস্থতার বেদনা!গা টা হাল্কা গরম।তবে জ্বর উঠেনি।
রাত্রিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে দ্রুত একটা রিকশা থামালো।চেহারায় চাপা রাগের পরিফুস্ট আভাস।
মাথাভর্তি চুল গুলা যখন হাত দিয়ে পিছের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কি যে সুদর্শন দেখাচ্ছে মানুষটাকে।রাত্রি চোরা চোখে তাকালো।সোজাসাপটা তাকালে তো আবার ধরা পড়ে যাবে।নিভ্রান যে তাকে ধরে ফেলেনি সেটা ভুল কথা।রাত্রিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মাথা ঝুঁকিয়ে হাসি থামালো।হাত ধরে ব্যস্ত গলায় বললো,

—“উঠুন।”
রাত্রির ঘোর কাটলো।কি একটা অবস্থা!লোকটা রিকশা দাড় করিয়ে রেখে অথচ সে নাকি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিলো।সে উঠে বসলো।নিভ্রান উঠলে রিকশা চলতে শুরু করলো।
লম্বা হওয়ার দরুন রিকশার হুটতোলা থাকলে মাথাটা একটু কাত করে নামিয়ে রাখতে হয় নিভ্রানের।নতুবা বারবার বারি লাগে।এই রিকশাটা বোধহয় একটু বেশিই ছোট।ফলাফল না চাইতেও রাত্রির মাথার সাইডের সাথে তার মাথা লেগে আছে।একহাত রাত্রির পিঠের পিছ দিয়ে নিয়ে রিকশার হুটের সাথে ঠেস দেয়া।মেয়েটার কপালের চুলগুলো উড়ে মুখের উপর সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে।রাত্রি লজ্জিত ভঙ্গিতে বারবার চুল,জামা ঠি ক করে যাচ্ছে।কামিজের দু’পাশে ফাঁড়া অংশটা বাতাসের উল্টো গতিতে কোলের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে।কি বিশ্রি অবস্থা!তার উপর লোকটা এত এত কাছে।নিশ্বাসের বহর তার উন্মুক্ত কাঁধজুড়ে।বাতাসে ঘোমটা পড়ে যাওয়ায় ওড়না নামিয়ে কাঁধের দু’পাশ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলো।মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।যতবার চুল ঠি ক করছে ততবার নিভ্রানের গালে হাতের উল্টোপিঠ লেগে যাচ্ছে।লজ্জায় বুঁদ হয়ে আরো একবার চুলের গোছা কানের পিছে গুঁজলো রাত্রি।হাত কাঁপছে।নিভ্রানের স্পষ্ট টের পাচ্ছে মেয়েটার কাঁপুনি।
খুঁকখুঁক করে গলা ঝাড়লো সে।রাত্রি একটু তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো।রাত্রিই চোখ নামিয়ে নিলো প্রথমে।নিভ্রান বারকয়েক পলক ঝাপটিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

—“এত লজ্জার কিছু নেই।আমিই তো।”
কথাটা যেনো লজ্জা উপশমের বদলে তা আরো শক্তপোক্ত করে দিলো।রাত্রি দিরুক্তি করলোনা।তবে মনে মনে খুব চেঁচালো,”আপনি বলেই তো এত লজ্জা লাগছে।”
কেটে গেলো আরো কিছুক্ষণ।সন্ধ্যা হয়ে গেছে বিধায় চারিপাশে তেমন আলো নেই।সব আবছায়া,আলোকশূন্য।রাত্রির চোখ পড়লো নিভ্রানের পায়ের দিকে।লোকটা দিব্যি এই ক্ষত পায়ে জুতো পড়ে আছে।ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো।আসার সময় খেয়াল করেনি।কে জানে সেটাও খুলে ফেলেছে কিনা?
খানিক আমতা আমতা করে সে প্রশ্ন করলো
—“আপনি এই পায়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেনো?”

নিভ্রান আবারো উষ্ণ প্রশ্বাসের ঝড় বইয়ে দিয়ে উওর দিলো,”ব্যান্ডেজ করা আছে তো।সমস্যা নেই।”
রাত্রি শিরশির করে উঠলো।কাঁধের পাশটা মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাবে আজ।সাধারণ কথাটাও কেমন ভয়ংকর ঠেকছে।কথা বলা যাবেনা।কোনো কথা বলা যাবেনা।সে কথা বললে নিভ্রানও কথা বলবে।আর নিভ্রান কথা বললেই বিপদ।ঘোর শনি!তার সেই ভাবনা চিন্তাটা এক ধাক্কায় গুঁড়েবালি করে দিলো ফোনের রিংটোন।নিভ্রানের ফোন বাজছে।রাত্রি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।অদৃশ্য কোনো হাত যেনো ঠাস ঠাস করে কপাল চাপড়ে দিলো।নিভ্রান ফোনটা পকেট থেকে বের করতেই দ্রুত তার হাতের কব্জি ধরে ফেললো সে।নিভ্রান প্রশ্নাত্বক চাহনী নিক্ষেপ করতেই কাটকাট গলায় বললো,

—“আপনি ফোন ধরবেননা।”
নিভ্রানের প্রশ্ন আরো গাঢ় হলো।রাত্রি তখনো হাত ধরে আটকে রেখেছে।বিস্মিত কন্ঠে সে বললো,”কেনো?”
রাত্রি চোখ সরিয়ে বললো,”বলেছি তাই।”
নিভ্রান কিছুক্ষণ নিমীলিত,নিমজ্জিত চোখে মেয়েটাকে দেখে নিলো।তারপর সাইড বাটন চেপে রিংটন বন্ধ করে হাতটা হাঁটুর উপর নামিয়ে রাখলো।একটু সময় যেতেই আবার স্বউদ্যমে বাজতে শুরু করলো ফোন।নিভ্রান একপলক তাকালো।দ্রুত রিসিভ করে অধৈর্য গলায় বললো,
—“ইম্পর্টেন্ট কল,একটামিনিট রাত।”

রাত্রির যেনো দমবন্ধ হয়ে আসলো।নিভ্রান ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে।বোঝা যাচ্ছে,বেশ জরুরি।আচ্ছা,সে কি এখন অজ্ঞান হয়ে যাবে?মাথা ঘোরাচ্ছে কেনো?
নিভ্রান ফোন নামালো একটু পরেই।পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ঠাট্টার স্বরে বললো,
—“আপনি এতো লজ্জা পান রাত।এখনতো আমারই লজ্জা লাগছে।মনে হচ্ছে কথা বলাটাও অপরাধ।”
রাত্রি ফাঁকা ঢোক গিললো।চাপা গলায় জোর দিয়ে বললো,”অপরাধই,আপনি চুপ করুন।”
নিভ্রান দূর্বোধ্য হাসলো।দুরত্ব কমিয়ে জ্বালাময়ী কন্ঠে বললো,
—“আপনাকে লজ্জা পেলে ভীষণ সুন্দর দেখায় রাত।আপনাকে লজ্জা দেয়ার জন্য হলেও আমি এখন অনবরত কথা বলে যাবো।”

পথের শেষ বাঁক পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও বৃষ্টি নামলোনা।এক সদ্য প্রেমে পড়া রমণীর আকুল আবেদনেও দু’ফোটা জল গড়ালোনা কিপটে আকাশ।মনটা অভিমানী হয়ে উঠলো প্রচন্ড।মাথার উপরের রংহীন বিস্তর সুবিশাল প্রাঙ্গনের দিকে একরাশ অজানা ক্ষোভ নিয়ে চেয়ে থাকার মাঝে ক্লান্ত চোখের পাতা কখন যেনো এক করে দিয়ে গেলো ঘুমপরীরা।প্রেমিকা কখন যেনো ঢলে পড়লো প্রেমিকের বুকের উপর।টের পাওয়া যায়নি।
বাতাসের তান্ডব একটু ক্ষান্ত হয়েছে।ঘুমন্ত রাত্রিকে একহাতে জড়িয়ে নিতে নিতে নিভ্রান বুঝলো,”এই মেয়েটাকে ছাড়া তার জীবনটা বৃষ্টিহীন বর্ষার মতো।পানসে শ্রাবণের মতো।মনহীন মানুষের মতোন।বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মতোন।”
রাত্রি নড়ে উঠলো।বুকভরা উষ্ণতার মাঝে লুটোপুটি খেয়ে আদুরে হাতে নিভ্রানের পেট জড়িয়ে ধরলো।নিভ্রান তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে মৃদু গলায় ডাকলো,

—“চাচা?”তার হাল্কা ডাকে পিছনে ফিরে তাকালো রিকশাওয়ালা চাচা।নিভ্রান মুখে হাসি ফুটিয়ে নিরালা স্বরে বললো,”একটু আস্তে চালান।ও ঘুমাচ্ছে তো।ঝাঁকি দিলে ঘুমটা ভেঙে যাবে।আমি ভাড়া বাড়িয়ে দিবোনে,আপনি একদম ধীরেধীরে চালান।”মধ্যবয়স্ক লোকটা যেনো একটু হোঁচট খেলো।সহসা রিকশায় যুবক-যুবতী উঠলে তিনি চক্ষুলজ্জায় হলেও পিছনে ফিরে তাকাননা।তার অভিজ্ঞ মন জানে পিছনে নিশ্চিত নিষিদ্ধ কাজকর্ম হচ্ছে।এই প্রথম এমন ব্যাতিক্রমি ঘটনার সাক্ষী হয়ে অজান্তেই হেসে উঠলো সে।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো নিভ্রানের কথায়।

চলন্ত রিকশার চাকাদুটো থেমে গেলো একটা সময়।চাচার ডাকে হুঁশ ফিরলো নিভ্রানের।রাত্রি তখন শরীর ছেড়ে ঘুম দিয়েছে।চোখের পাপড়িগুলো বিন্দুমাত্রও নড়ছেনা।মেয়েটা যে কি পরিমাণে ক্লান্ত তা এই নির্জীব দেহটাই সশব্দে বলে দিচ্ছে।নিভ্রান কোনরকমে পকেট হাতরে মানিব্যাগ বের করলো।ভাড়া মিটিয়ে দিলো।
নির্নিমেষ চেয়ে থেকে দ্বিধাগ্রস্ত হাতে রাত্রির কাঁধ থেকে পড়ে কোলের উপর ছড়িয়ে থাকা ওড়না গলায় তুলে দিলো।গালে হাত রেখে কোমল কন্ঠে ডাকলো,”রাত,উঠুন।”
রাত্রি আধবোজা নয়নে পিটপিট করলো।মনে হচ্ছে শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যাথা।হাড়গুলো বাঁধা বাঁধা।।
নিভ্রান মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”আপনার বাসায় পৌছে গেছি।”
নিভানো গলায় “ওহ” বলে রাত্রি মাথা উঠালো বুক থেকে।নিভ্রান বাহুতে রাখা হাত সরিয়ে নিলো।
রাত্রি এলোমেলো চুল গুছিয়ে জামাকাপড় টেনে নিতেই নিভ্রান নিষ্প্রভ স্বরে বললো,”শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”
রাত্রি একটু হাসার চেষ্টা করলো।মলিনগলায় বললো,

—“না,ঠি ক আছি।”
নিভ্রান নেমে গেলো রিকশা থেকে।হুট নামিয়ে দিয়ে রাত্রির পাশে যেয়ে মেজাজ করে বললো,”আপনিতো সবসময়ই ঠি ক থাকেন।আসুন।”বলে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।রাত্রি দিরুক্তি করলোনা।চুপচাপ নেমে দাড়ালো।রিকশাওয়ালা চাচা এক অদ্ভুত দায়িত্বশীল প্রেমিকের মনমাতানো যত্ন দেখে নিরবে হাসলেন।রিকশা নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতেই রাত্রি বুঝলো নিভ্রান ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।লোকটার কাছে দিনকে দিন ঋনীই হয়ে যাচ্ছে সে।প্রেমের ঋণ,যত্নের ঋণ আবার টাকার ঋণ।এত ঋণ কিভাবে মিটাবে?এখন ভাড়া প্রসঙ্গে কথা বললে লোকটা রেগে যাবে।বাড়ি যাওয়ার আগে রাগিয়ে দেয়ার দরকার নেই।আবার বড়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে।অগত্যা কিছু বলত যেয়েও থেমে গেলো সে।দৃষ্টি রাস্তায় নামিয়ে লতানো গলায় বললো,”আসি”।

নিভ্রান চেয়ে রইলো শুধু।বুকের ভেতর দাঙ্গা চলছে।এত কষ্ট হচ্ছে কেনো?আবার তো দেখা হবেই।
এই একদিনের বিচ্ছেদেই এত যন্ত্রনা তবে জীবনভর বিচ্ছেদ সে কি করে সইবে?অসম্ভব।অথচ মেয়েটা কি না তাকে সাতটা দিন ধরে এড়িয়ে চলছিলো।সে কিভাবে সয়েছে কোন ধারনা আছে?
রাত্রি গুটিগুটি পায়ে গেটের কাছাকাছি পৌছে যেতেই পেছন থেকে হাত আটকে ধরলো নিভ্রান।রাত্রি চকিতে তাকালো।নিভ্রান সেই মায়া চোখে চোখ রেখে ধারালো গলায় বললো,
—“”আমাকে আর কখনো এড়িয়ে চলবেন না রাত।কক্ষনো না।…মনে থাকবে?”
নিভ্রানের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে মূহুর্তেই চুপসে গেলো রাত্রি।লোকটা হঠাৎ এত রেগে গেলো কেনো?সে তো কিছুই করেনি।বারকয়েক আমতা আমতা করে মাথা দুলিয়ে ভীত কন্ঠে উওর দিলো সে,”থাকবে।”
নিভ্রান হাত ছেড়ে দিলো,”যান,যেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়বেন।”
রাত্রি আবারো মাথা নাড়ালো।অর্থ্যাৎ,”সে ঘুমিয়ে পড়বে।”

নাহিদা বসে ছিলেন ড্রইংরুমে।প্রাণহীন চোখ থেমে আছে রংচঙা টিভি স্ক্রীনে।নওশাদ সাহেব বিকেলেই চলে গেছেন।নিশাদ আছে নিজের ঘরে।কাল তারা দুজন একসাথে বাড়ি যাবে।নিভ্রান একা থাকে।সে একাই থাকবে।এবার আর ফিরে যাওয়ার ব্যর্থ অনুরোধ টা করারও সুযোগ নেই।ছেলে তো তার সাথে কথাই বলেনা।
নাহিদার চোখ ভিজে আসলো।মেইন গেট খোলার শব্দে দ্রুত চোখ মুছলো সে।নিভ্রান এসে পড়েছে।বেল বাজায়নি কারণ তার কাছে চাবি আছে।নাহিদা মুখোমুখি সোফাটায় বসে ছিলো।না চাইতেও চোখে চোখ পড়ে গেলো।সুপ্ত অপরাধবোধটা আবারো জাপটে ধরলো নিভ্রানকে।মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করা তার মোটেও উচিত হয়নি।রাত ঠি কই বলেছে।শত হোক সে তো মা।

চোখ লুকিয়ে উল্টোপাশে ঘুরে দরজা আটকালো সে।নাহিদা উঠে দাড়ালো। টি ভিটা বন্ধ করে দিলো।নিশব্দে পা বাড়ালো রুমের দিকে।নিভ্রান দীর্ঘ-শ্বাস ফেললো।মায়ের সাথে একটু কথা বলার সুযোগও কি হবেনা?
রাতের খাওয়া একসাথেই সাড়া হলো।তবে খুব নিশ্চুপে।নিশাদ ছাড়া কেউই কোন কথা বলেনি।একপাক্ষিক কথা চালিয়ে যেতে না পেরে একপর্যায়ে নিশাদও চুপ হয়ে গেছিলো।
রাত তখন এগারোটা চব্বিশ…
ঘরের মধ্য বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করে অবশেষে নাহিদার রুমে বিনা অনুমতিতেই ঢুকে পড়লো নিভ্রান।
নাহিদা চোখ খুলেই শুয়ে ছিলো।হঠাৎ নিভ্রানের আগমন বেশ অবাক করলো তাকে।উঠে বসতে বসতেই
নিভ্রান পাশে এসে আচমকাই তার হাতদুটো মুঠোবন্দি করে ফেললো।উল্টোপিঠে চুমো খেয়ে ছেলেমানুষি কন্ঠে বললো,

—“আমাকে ক্ষমা করা যায়না মা?”
নাহিদা কেঁদে উঠলো।হু হু করে চোখের জল ছেড়ে দিলো।মান অভিমান ভুলে হেঁচকি তুলে বললো,
—“আমি কি তোর খারাপ চাই?মানছি মেয়েটাকে অনেক ভুলভাল বলেছি।কিন্তু তুই কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারতিনা?একবারো বলেছিস?বলেছিস যে ওকে ছাড়া তোর একেবারেই চলবেনা?বললে কি আমি আপত্তি করতাম?আমাকে কি এতই পাষাণ মনে হয়?”
নিভ্রান মুচকি হেসে আবারো চুমু খেলো হাতে।বললো,”এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি মা।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৭+১৮

নাহিদা শান্ত হলেননা।কেঁদে চললেন অবিশ্রাম।নিভ্রান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।হাত বাড়িয়ে গালের পানি মুছিয়ে দিয়ে মাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলো।বাচ্চাদের মতে শাসন করে বললো,
—“আর কেঁদোনা।তোমার মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠে যাবে।”
নাহিদা কান্না থামালেন।বুকটা হাল্কা লাগছে।আলতো করে নিভ্রানের মাথার চাঁটি মারলেন তিনি।নাক টেনে বললেন,”মায়ের এতো খেয়াল রাখতে হবেনা।”
নিভ্রান মুচকি হেসে বললো,
—“একশবার হবে।..তুমি কাল যেওনা।আরো ক’টাদিন থেকে যাও।”
—“মেয়েটাকে আবার নিয়ে আসিস।ভালো করে কথা হয়নি।”
—“সে আসতেই চায়না।”হতাশ কন্ঠ নিভ্রানের।
নাহিদা হাসলেন।নিভ্রানের কপালের চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে আঁচড়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বিয়ে করবি কবে?”
নিভ্রান অন্যমনষ্ক গলায় বললো,”করবোতো,সময় হোক।”

ঘরে এসে বেশ কয়েকবার ফোন লাগিয়েও ওপাশ থেকে কোনরুপ সাড়া পাওয়া গেলোনা।রাগটা আবারো দপ করে জ্বলে উঠলো।মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আগ্রাসী অনুভূতি।বাকিসব ভুলে তখন কেবল রাগটাই মূখ্য হয়ে উঠলো।মেয়েটাকে বলে পর্যন্ত আসলো এড়িয়ে না চলতে অথচ দু’তিনঘন্টা না পেরোতেই আবার অবহেলা শুরু হয়ে গিয়েছে?তার একটা কথাও মান্য করা যায়না?এত অবাধ্য মেয়েকে সামলানো সম্ভব?কক্ষণো না।
নিভ্রান আবার কল দিলো।রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলোনা।একপর্যায়ে লাইন কেটে গেলো।রাগের চোটে ফোনটা সজোরে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো সে।বাউন্স করে তা ফ্লোরে ছিঁটকে পড়লো।ভাঙার শব্দ!
নাহ্,সহ্য করা যাচ্ছেনা।কাল আর কিছুতেই নরম হওয়া যাবেনা।হুমকি ধামকি না দিলে এই মেয়ে ভালো হবেনা।

মনে মনে রাত্রিকে কড়া করে কয়েকটা ধমক দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে ঘুমাতে গেলো নিভ্রান।অথচ পাগলাটে প্রেমিক মন বুঝতেই পারলোনা তার অবাধ্য প্রেয়সী যে প্রেমিকের কথা মেনে ঘরে ফিরেই বাধ্য মেয়ের মতোন ঘুমিয়ে পড়েছে।তার আর ফোন তোলার সময় কোথায়?

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২১+২২