এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১১+১২

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১১+১২
লেখিকা মালিহা খান

দরজা খুলে মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আগাগোড়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো নিভ্রান।মা তো সবসময় তাকে জানিয়ে আসে।এমন হুটহাট এসে পড়েনা কখনো।আর আসলেও এত সকালে কেনো?একবার নিজের রুমের দরজার দিকে পরখ করে নিয়ে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফোটালো সে।বললো,
—“মা তুমি”?
—“যাক,তোকে অবাক করে দিতে সফল হলাম তবে।”প্রসন্ন কন্ঠে কথাটা বলে নাহিদা পাশে দাড়ানো ড্রাইভারকে তার ব্যাগটা ভেতরে রেখে দিতে বললেন।নিভ্রান নিশ্চুপ।মাথায় ঘোলাটে অনুভুতিদের সমাবেশ বসেছে।ড্রাইভার চলে যেতেই সে দরজা লাগাতে লাগাতে বললো,

—“আমাকে আগে জানালে না যে?”
নাহিদা ড্রইংরুমের বড় সোফায় যেয়ে বসলেন।ব্যাগ থেকে ছেলের জন্য নিজ হাতে রান্না করে আনা খাবারের বাক্সগুলো কাঁচের টেবিল ভরে সাজাতে সাজাতে বললেন,
—“তুই জানানোর সুযোগ দিয়েছিস?কতবার করে ফোন দিলাম রাতে?একবারো তো ধরলিনা।খালি ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা।মায়ের ফোনটা ধরার সময়ও নেই।”
বিরক্ত মস্তিষ্কে মনে করার চেষ্টা করলো নিভ্রান।কালরাতে বাসায় আসার পরে ফোন নিজের রুমেই রেখেছিলো।রাত্রি শোয়ার পর আর সেখানে যাওয়া হয়নি তারমানে ফোনটা এখনো ওই রুমেই আছে।হয়তোবা সাইলেন্ট করা সেজন্য রাত্রি রিংটনের আওয়াজ পায়নি।
—“এত সকালে এলে যে?”
—“তোর বাবার গাড়ি লাগবে।সে নাকি কোন কাজে যাবে সারাদিনের জন্য।তাই আমি সকালেই চলে এলাম।একটুপর তো সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লে আর আসতে পারবোনা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভ্রান।মা কে কি এখনই বলে দিবে বাসায় একটা মেয়ে আছে?নাকি রাত্রির ঘুম ভাঙাবে আগে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মনে মনে দোটানা নিয়েই ঘরের ভেতর পা বাড়ালো সে।রাত্রি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।যেনো কতকাল পর এক পশলা শান্তির ঘুম এসে ধরা দিয়েছে চোখদুটিতে।একটা পায়ের অনেকখানি বেরিয়ে আছে ব্ল্যাঙ্কেটের নিচ দিয়ে।হাঁটু থেকে গোড়ালির মাঝামাঝি অংশটা পর্যন্ত কাপড় নেই।শাড়ি উঠে গেছে।নিভ্রান এগিয়ে গিয়ে ব্ল্যাঙ্কেটটা নিচ পর্যন্ত নামিয়ে দিলো।পায়ের পাতায় আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই বুঝতে পারলো মেয়েটার শরীর হিমের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে।যেনো কোনো মৃত মানুষ।চমকে উঠে দ্রুত এসির রিমোটটা নিয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলো সে।এখন ঠান্ডা একটু কম লাগবে।
ব্যালকনিতে ভেজা কামিজটা শুকাতে দিয়েছিলো রাত।এতক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে।নিভ্রান সেটা নিয়ে আসতে আসতেই দরজা খোলার শব্দ হলো।অবিরাম চলতে থাকা হৃদস্পন্দনটা নিজের অজান্তেই একটু খানি বাধাপ্রাপ্ত হলো।
—“বাবা,তুই একটু ওগুলো…”কথাটা মাঝপথেই থেমে গেলো।নাহিদার প্রসারিত হাসিটা সংকুচিত হতে হতে একটা সময় ঠোঁটের ভাঁজেই মিলিয়ে গেলো।চোখেজোড়া উপচে পড়া বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে রইলো বিছানার মাঝে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।সাইড টেবিলে রাখা নিভ্রানের ফোনের দিকে নজর পড়তেই সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো।এই জন্যই তার ছেলে কালরাতে ফোন ধরার সময়টাও পায়নি।
তীব্র তাচ্ছিল্য নিয়ে সে বাজে ভঙ্গিতে বললো,
—“তুই এতো খারাপ হয়ে গেছিস নিভ্রান?ছিহ!”
—“মা তুমি কিছু না জেনে উল্টাপাল্টা বলবানা।”নিভ্রানের সরাসরি প্রতিবাদ।
—“জানার কি আছে?এই মেয়েকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ সারারাত এখানেই ছিলো।এর অর্থ কি অন্যকিছু দাড়ায়?”

নাহিদার উচ্চস্বরে বলা কথায় ঘুম ভেঙে যায় রাত্রির।কিছু কিছু অনাকাঙ্খিত শব্দও কানে আসে।মাথা রীতিমত ঘোরাচ্ছে।ধরফরিয়ে উঠে বসেসে।হত্ববিহল,বিমূড় চোখে চেয়ে থেকে ঘটনার অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করে।
নিভ্রান ঢোক গিলে।রাত কখনোই নিজের সম্পর্কে আজেবাজে মিথ্যা অভিযোগ মেনে নিবে না।মেয়েটা প্রবল আত্নসম্মানী।
রাত্রির ঢিলেঢালা ব্লাউজ কাঁধ থেকে নেমে গেছে অনেকটা।শাড়ির আচঁল ঠিক নেই।নাহিদা সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নাক সিঁটকালেন।এই মেয়ের নোংরা গায়ে তার শাড়ি?মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো।রাত্রি দিকে চেয়ে সে তিরস্কার করে বললেন,
—“ছিহ্,নির্লজ্জ মেয়ে।”
রাত্রি সেই দৃষ্টি অনুসরন করেই দ্রুত কাপড় ঠি ক করলো।নিভ্রান চটজলদি এগিয়ে গেলো।হাতের কামিজটা রাত্রির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“আপনি জামা বদলে আসুন রাত।আমি দেখছি।”
রাত্রি দাঁতে দাঁত চেপে করুন চোখে তাকালো।সেই চাহনী একঝাঁক প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে নিভ্রানের দিকে।নিভ্রান দৃষ্টি সরালো।আলতো করে রাত্রির মাথার উপর হাত রেখে বললো,

—“কিছু হয়নি।আমি সামলে নিবো।আপনি এখন কিছু বলেননা।”
নাহিদা ঘৃনাভরা চোখে চেয়ে রইলো।তার ছেলে এতোটা বদলে গেছে?আসলে ভুলটা তারই।ছেলে বিগত কয়েকটা বছর ধরে একা থাকছে অথচ সে তেমন করে খোঁজখবর রাখেনি।ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিলো সে কোন ভুল করবেনা।ছেলের চরিত্র সম্পর্কে অবগত আছেন তিনি।কিন্তু আজ যে তা ভুল প্রমানিত হয়ে গেলো।
—“মা তুমি চলো আমার সাথে।”
নাহিদা তেঁতো কন্ঠে বললেন,
—“মায়ের থেকে এখন এই রাত কাটানোর মেয়ে তোর কাছে বেশি হয়ে গেলো নিভ্রান?”
“রাত কাটানোর মেয়ে”শব্দগুলো যেনো নিমিষেই স্তব্দ করে ফেললো রাত্রিকে।কি শুনছে এসব?
মাথায় ভোঁতা যন্ত্রনা হচ্ছে।নিভ্রান জোরপূর্বক নাহিদাকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।রাত্রি জামাকপড় নিয়ে ঝড়ের গতিতে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

ড্রইংরুম ঠান্ডা।এসির বাতাস হু হু গতিতে বাড়ছে।নাহিদা থমথমে চেহারায় বসে আছে।নিভ্রান তার পাশে বসলো কথা বলার জন্য।বললো,
—“মা শোনো,ও কোনো..”
রাত্রি বেরিয়ে এলো ঠি ক তখনই।পরণে কালরাতের কামিজ।মাথায় সুন্দর করে ওড়না টানা।ফ্রেশ হতে বোধহয় দু’মিনিটও সময় নেয়নি মেয়েটা।চোখের সাদা অংশ গাঢ় লাল।নিভ্রান তপ্ত শ্বাস ফেললো।কন্ঠে এলোমেলো ভাব,”রাত,আপনি বসুন।মা আসলে ভুল বুঝেছে..”
—“কিছু ভুল বুঝিনি আমি।এই মেয়েটা..”
রাত্রি তার মাঝেই গমগমে গলায় বলে উঠলো,
—“আমি বসতে চাচ্ছিনা।আপনি কালরাতটা থাকতে দিয়েছেন সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।আসছি।”
নিভ্রান উঠে দাড়ালো।দ্রুত রাত্রির পথ আটকে বললো,
—“রাত দেখুন…”
রাত্রি চোখ বন্ধ করলো।মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললো।নাহিদার সেই হীনভরা চাহনী সে নিতে পারছেনা।নিজেকে সত্যিই খুব খুব নোংরা মনে হচ্ছে।প্রচন্ড লজ্জা অপমানে নিজের ওড়নার ছেড়ে দেয়া আঁচলটা খামছে ধরে সে জোরালো গলায় বললো,
—“দয়া করে যেতে দিন।”

রাত্রি বসেছে নাহিদার ঠি ক মুখোমুখি।দেহভঙ্গি খুবই আঁটসাঁট।কঠিন দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ।সে এখানে আছে শুধুমাত্র নিভ্রানের ধমকাধমকিতে।সিঁড়ির নিচ পর্যন্ত নেমে যাওয়ার পরও লোকটা তাকে জোরপূর্বক ধমক দিয়ে নিয়ে এসেছে।
নাহিদা ক্রমে ক্রমে অবাক হচ্ছেন মেয়েটার স্পর্ধা দেখে।চোখে মুখে বিন্দুমাত্র ভয়,লজ্জা,সংকোচ নেই।শুধুই একটা দৃঢ় কাঠিন্য ভাব।নিভ্রান বিরতিহীন ভাবে সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ বলে যাচ্ছে।ভুল বোঝাবুঝি খুবই খারাপ জিনিস।একবার এর শিখা জ্বলতে শুরু করলে তা অন্তিম অংশটা পর্যন্ত পুড়িয়ে না দেয়া পর্যন্ত থামে না।জ্বলে পুড়ে সব নি:শেষ করে দেয়ার পর শুধু ছাই গুলো অবশিষ্ট রেখে তবেই বিদায় নেয়।তাছাড়া ঝামেলা তার মোটেও পছন্দ না।পারিবারিক কলহবিবাদ থেকে দুরে থাকতেই সে এখানে একা থাকে।সম্পূর্ণ কথা শেষ হতেই সে নাহিদার দিকে চেয়ে বললো,
—“এখন বলো মা,তুমি যে রাত কে কিছু না জেনে এত বাজে কথা বলে দিলে তা কি উচিত হলো?তাছাড়া তুমি আমাকেই বা কিভাবে এক নিমিষে অবিশ্বাস করে ফেললে?রাত কে নাহয় তুমি চিনতেনা।ওর সম্পর্কে জানতেনা।কিন্তু আমি?আমাকে তুমি এত নিচু কাজের যোগ্য বলে মনে করো?

নাহিদা আমতা আমতা করলো কিছুক্ষণ।তার ছেলে মিথ্যা বলবেনা।যা বলেছে সবই সত্যি তবু কেন যেন মেয়েটাকে তার মনে ধরছেনা।তার বড় ছেলের বউ হবে রুপে গুনে অনন্যা।লাজুক,নম্র-ভদ্র,অভিজাত বংশের মেয়ে।হ্যাঁ,মেয়েটা খুব রুপবতী,সুন্দরী।কিন্তু এই মেয়ের পারিবারিক পরিচয় তার খুব একটা মনে ধরেনি।একা থাকে,আর্থিক সমস্যা,বাসায় বাসায় পড়ানো,আরো কত কি।গলা ঝেড়ে তিনি বললেন,
—“আচ্ছা ঠি কাছে,আমার তখন ওভাবে বলাটা উচিত হয়নি।আসলে তখন ওভাবে দেখে সবাই এটাই ভাববে তাইনা?কিন্তু ..”বলেই তিনি রাত্রির দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন।রাত্রি তখন দাঁতে দাঁত চেপে এই মহিলার বচনভঙ্গি খেয়াল করছিলো।তার যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই নিজের বলা কথাগুলো নিয়ে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।বরং এই বাঁকা চাহনীতেই সে বুঝে গেলো মহিলা তাকে এখনো খুব একটা ভালো চোখে দেখছেনা।

—“আর কোন কিন্তু কি থাকার কথা মা…”নিভ্রানের আগ্রাসী উওর।মায়ের এহেন কথাবার্তা তার পছন্দ হচ্ছেনা।সে জানে তার মায়ের স্বভাব কেমন।অতোটাও সচ্ছ মস্তিষ্কের নন তিনি।
—“না বলছিলাম,তোমার মা যে মেয়েকে এভাবে একা রেখে…”
—“সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার আন্টি।”পাথর গলায় কথাটা বলে নিভ্রানের দিকে তাকালো রাত্রি।উঠে দাড়িয়ে বললো,”আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।ভার্সিটিতে যেতে হবে।আপনার কথাবার্তা শেষ হলে আমি বেরোতে চাচ্ছি।”
—“চলুন,আমি পৌছে দেই।”
রাত্রি না তাকিয়েই বললো,”না ধন্যবাদ।আমি একাই পারবো।”
নিভ্রান ব্যাথিত নয়নে তাকালো।এইতো ক’টাদিন যাবত তার সাথে আসা যাওয়া নিয়ে রাত্রি একবারো আপত্তি করতোনা।তবে আজ কেন এই রূঢ় স্বর?
রাত্রি চলে গেলো।নিভ্রান আর আটকালোনা।

রাস্তার ধার ধরে হাঁটছে রাত্রি।এখন বাসায় যেয়ে জামাকাপড় বদলে নতুন করে কয়েকটা বই ব্যাগে নিয়ে তারপর ভার্সিটিতে যেতে হবে।আজকে দুটো ক্লাস খুব ইম্পোর্টেন্ট।সামনেই ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা।সেটা ভালো করে পাশ করে বেরিয়ে গেলেই একটা চাকরি খুঁজবে।এই টি উশনি করে আর কতদিন?মা কে মামার বাসা থেকে আনতে হবে যে করেই হোক।মা যে বিনে পয়সায় মামার বাড়িতে থাকে এ নিয়েও যে কত সমস্যা মামির।অবাক হয় রাত্রি,”নিজেরই তো বোন।একটু থাকলে কি হয়?”অথচ বাবা মারা যাওয়ার আগে মামাকে কতো যত্ন-আত্তি করতো।মামার ব্যাবসা দাড় করিয়ে দিলো নিজের টাকা দিয়ে।মার কাছে মামা যখন টাকা চাইতো তখনই মা দিয়ে দিতো।অথচ লোকটা এখন এই বোনকেই কত কুটু কথা শুনায়।মামার কথা মনে আসতেই একটা ঘৃণা ভরা শ্বাস ছাড়লো রাত্রি।

বয়সটা তুলনামূলক কম হলেও দুনিয়া কম দেখেনি সে।চোখের ভাষা কঠিন থেকে নরম হয়ে যায় হঠাৎই।বাসার কাছাকাছি এসে পড়েছে।সেই কদম গাছটা আজও ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত।কালরাতের ঝড়ে কয়েকটা আবার রাস্তায় পড়ে কাঁদাপানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।মনটা খারাপ হয়ে গেলো।নিভ্রান সাথে থাকলে নিশ্চয়ই দুটো কদম ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো,ধরুন,আরো দিচ্ছি।”আর সে লাজুক গলায় উওর দিতো,”আর লাগবেনা।”
খুব সন্তর্পনে চোখের কোঁণে আসা পানির ফোঁটাটাকে মুছে ফেললো রাত্রি।অতিপ্রিয় কদম গাছটা হঠাৎই অপ্রিয় হয়ে উঠলো।ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্য বেশ বুঝতে পারছে,তার আসলে নিজেকে এত প্রশয় দেয়াটা উচিত হয়নি।নিভ্রান তার আয়ত্তের বাইরে।তাকে পাওয়াটাও আয়ত্তের বাইরে।নিভ্রানের মায়ের কথাবার্তায় সে তীব্র অসন্তুষ্টি দেখেছে।দেখবেই না কেনো?সে সাধারণ একটা মেয়ে।জীবনে উথালপাথালের শেষ নেই অপরদিকে নিভ্রান এত উচ্চবিত্ত।তার পাশে যে ওকে বড্ড বেমানান লাগবে।

সবাই তো আর নিভ্রানের মতো অন্যরকম না যে গরীব-বড়োলোকের মাঝে কোনো তফাত দেখবে না।
বাড়িতে পৌঁছতেই বাড়িওয়ালা চাচার মুখোমুখি হলো সে।সালাম দিতেই উনি প্রশ্ন করলো,
—“এখন ফিরলা নাকি?”
রাত্রি সময় না নিয়েই উওর দিলো,
—“জি আংকেল,কালরাতে বান্ধবীর বাসায় ছিলাম।সামনে পরীক্ষা তো।একটা নোটস আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিলো তারপর ঝড় ছেড়ে দিলো।তাই রাতটা ওখানেই থেকেছি।”
—“আচ্ছা যাই হোক,তুমি কিন্তু সামনে মাসে ভাড়া দিতে দেরি কইরোনা।এর আগেও অনেকবার বাজায় রাখসো কিছু বলিনাই।কিন্তু এবার আমার টাকাটা দরকার বুঝলা?দেরি কইরোনা।”
রাত্রি মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনে মৃদু মাথা নাড়িয়ে বললো,”আচ্ছা আংকেল,দেরি হবেনা।”

পৃথিবীতে রাত না নামলেও নিভ্রানের মন মস্তিষ্কজুড়ে যেনো সারাদিনই রাত নামে।তাকে রাতের অন্ধকারে ডুবিয়ে মেয়েটা এভাবে সরে যেতে পারেনা।কখনোই না।শেষবারের মতো তীক্ষ্ণ নজরে রাত্রির স্টুডেন্টের বাসায় সামনের রাস্তাটার একূল থেকে ওকূল চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো নিভ্রান।গাড়িটা এগোতে এগোতে চোখের আড়াল হয়ে যেতেই গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো রাত্রি।একটা কথা আছেনা,ভুল ট্রেনে উঠে পড়লে,ট্রেন বেশি দূর যাওয়ার আগেই নেমে পড়।কারণ ট্রেন যত দূরে যাবে,তোমার ফিরাটাও তত কষ্ট হবে।”
তেমনটাই নিভ্রানের তার প্রতি আকর্ষণটা ভয়াবহ পর্যায়ের বেড়ে যাওয়ার আগেই সে তা নি:শেষ করে দিতে চাচ্ছে।কি দরকার শুধু শুধু দহন যন্ত্রনা বাড়ানোর?

বাসায় এসে মায়ের রুমে একবার উঁকি দিলো নিভ্রান।তারপর সোজা নিজের রুমে ঢুকে গেলো।কিছু ভালোলাগছেনা।মাত্র হয়তো নয় দশ ঘন্টা হয়েছে রাত্রিকে দেখেনি।তাতেই যেনো হাঁসফাঁস লাগছে।
এ কয়দিনের একটা স্বভাব হয়ে গেছে রাত্রির সাথে দেখা করে তারপর বাড়ি ফেরা।আজ এতক্ষণ অপেক্ষা করেও মেয়েটার দেখা না পেয়ে কেমন যেনো দমবন্ধ লাগছে।একবার পকেট থেকে ফোন বের করলো সে।রাত্রির নাম্বার আছে তার কাছে কিন্তু কখনো ফোন দেয়নি।আজ কি দিবে?কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ফোনটা রেখে দিলো ।ভাবলো,”না থাক,দেখা তো হবেই।না হলে সোজা বাসায় চলে যাবে।”
কোনরকমে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বই-খাতা নিয়ে বসেছে রাত্রি।তখনই ফোন বাজলো।মামার নাম্বার।কপালে বিশদ ভাঁজ পড়লো।গতকাল মাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে পারেনি।আবার কোনো ঝামেলা বাঁধলো নাতো?তাড়াহুড়ো করে ফোন কানে তুললো সে,

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৯+১০

—“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে মনে মনে বিস্তর হাসলেন রুবিনা।মেয়ের কন্ঠ একদিন না শুনলেই খুব অস্থিরতা কাজ করে।মনে হয়,এই বুঝি কোনো বিপদ হলো।একা থাকে মেয়েটা।মুখে কিছু না বুললেও সে বুঝে রাত্রির হাঁড়ভাঙা কষ্ট।তবু কিছু করার নেই।সে নিরুপায়।ভাইয়ের বাসায় নিজেই মুখ গুঁজে থাকে।টাকা না থাকলে আসলে কেউই আপন না।
—“মা?”রাত্রি আবার প্রশ্ন করলো।ফোনের ওপাশে যদি মামা থাকে তবে আর কথা এগোনোর ইচ্ছে নেই তার।
বিষাদময় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো রুবিনা।কন্ঠে হাসি হাসি ভাব নিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ রে মা,আমিই।”
এতক্ষণ মুখে একটু হাসি ফুটলো রাত্রির।তড়িঘড়ি করলো সে,”আমি লাইন কেটে ফোন করছি মা।ওই লোকটার টাকায় কথা বলার দরকার নেই।দাড়াও।”বলে লাইন কেটে আবার ফোন দিলো রাত্রি।বললো,
—“কিছু হয়েছে মা?তুমি নিজ থেকে ফোন দিলে যে?ওই লোকটা আবার ঝামেলা করেছে?”
—“আরে ধুর,তুই খালি এসব ভাবিস কেনো?আমি তো বেশ আছি এখানে।”
—“শুধু শুধু মিথ্যা বলবা না।আমি বাচ্চা না।”
প্রসঙ্গ এড়ালেন রুবিনা।বললেন,
—“তুই ফোন দিলি না কেনো কালরাতে?চিন্তা হয়না আমার?।”
—“কাল একটু ব্যস্ত ছিলাম মা।তাই দেয়া হয়নি।”কথাটা বলেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো রাত্রি।ইশ!কালরাতে যদি বৃষ্টিটা না নামতো তবে হয়তো আজ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরিই হতোনা।

ভাত খাচ্ছিলো নিভ্রান।মা তরকারি রেঁধে এনেছে।রোজ রোজ বুয়ার ধরাবাঁধা খাবার খেতে খেতে মুখের যে অরুচিটা তৈরি হয় তা সবসময় মায়ের আনা তরকারির স্বাদেই কাটে।নাহিদা নিজেও খাচ্ছেন।মাঝেমধ্য সুযোগ খুঁজছেন কিছু বলার জন্য।সকালে নিভ্রান অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ায় বলতে পারেনি।সে বুঝতে পেরেছে তার ছেলের ওই রাত্রি নামের মেয়েটার জন্য দূর্বল জায়গা আছে।হয়তো তাদের মধ্য সেরকম সম্পর্কও আছে।কিন্তু আবেগে গা ভাসালে তো চলেনা।এই মেয়ে যে তার ছেলের জন্য উপযুক্ত না।আরো কিছুক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে সে অবশেষে বলেই ফেললো,
—“আচ্ছা বাবা,এই রকম গরীব ঘরের একটা মেয়ের সাথে কি তোর যায় বল?মেয়ে শুধু সুন্দর হলেই তো চলেনা।বংশ পরিচয়ও তো দেখতে হয়।তাইনা?”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৩+১৪