এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৩+১৪

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৩+১৪
লেখিকা মালিহা খান

ভাতের নলাটা মুখে তুলতে গিয়েও হাত থেমে গেলো নিভ্রানের।মায়ের প্রতি চাপা রাগটা দপ করে জ্বলে উঠলো শরীরের প্রতিটি শিরায়-উপশিরায়।তবু উচ্চবাক্য করলোনা সে।যথেষ্ট শান্ত গলায় বললো,
—“এসব তোমার কাছে ইম্পোর্টেন্ট হতে পারে কিন্তু আমার কাছে না।আমার আর রাতের ব্যাপারে তুমি আর কিছু না বললেই বরং খুশি হবো।”
নাহিদা যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো তেঁতিয়ে উঠলেন,”তাই বলে এমন একটা মেয়েকে তুই বিয়ে করবি?”
সবেমাত্র পানির গ্লাসটা ধরেছিলো নিভ্রান।নাহিদার কথায় সেটা আর মুখ পর্যন্ত নেয়া হলোনা।রাগের বশে সজোরে গ্লাসটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো।কাঁচগুলো টুকরো টুকরো হয়ে সাদা টাইলস্ পানিতে থৈ থৈ করে উঠলো।চিৎকার করে উঠলো সে,

—“কেমন মেয়ে হ্যাঁ?রাতের ব্যাপারে নূন্যতম ধারণা আছে তোমার?একবার বলেছিনা?আমার ওর কোনো কিছু নিয়ে সমস্যা নেই।বুঝতে পারছোনা তুমি?”
নাহিদা বেগম হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন ফ্লোরের দিকে।ছেলে আজ পর্যন্ত তার সাথে এভাবে কথা বলেনি।কোথাকার কোন মেয়ের জন্য সে এত বদলে গেছে।মেঝের থেকে দৃষ্টি তুলে তিনি নিভ্রানের দিকে চাইলেন।দাঁত কটমট করে বললেন,
—“ওই মেয়ের জন্য তুই আমার সাথে বেয়াদবি করছিস?তোর বাবা ঠি কই বলেছিলো তুই আসলে বড়দের মান রাখতে জানিস না।”
নিভ্রান হাত মুঠো করলো।কয়েকসেকেন্ডের ব্যবধানে সামনের প্লেটটারও স্হান হলো মাটিতে।পানির মধ্যে ঝোল ভাতের মিশ্রণে সাদা ফ্লোর বিচ্ছিরি রূপ ধারণ করল।আবার সেই পুরনো কথাবার্তা।বাবার পারিবারিক ব্যাবসার হাল ধরতে আপত্তি প্রকাশ করা নিয়ে কম ঝামেলা তো হয়নি সেবার।সেই ঘটনার রেশ ধরে সে এখন সবার থেকে আলাদা থাকে।তবু মা কিভাবে আবার সেই কথাটা তুলতে পারলো?নাহিদা আবার বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“ওই মেয়েকে আমি কখনো মেনে নিবো না।”কন্ঠ থমথমে।
—“তোমার মানা না মানা দিয়ে আমার কিছু যায় আসেনা।”বলেই উঠে দাড়ালো নিভ্রান।নাহিদা নির্বিকার।অপমানে স্হির হয়ে আছে মুখশ্রী।স্হান ত্যাগ করার আছে নিভ্রান বললো,”ভুলে যেওনা,তোমাকেও কিন্তু বাবা গরীব ঘর থেকেই বিয়ে করে এনেছিলো।”
নিভ্রান চলে যাওয়ার পরও আরো অনেকক্ষণ ডাইনিংয়ে বসে রইলেন নাহিদা।চোখে জলন্ত আগুন।নিজের পেটে ধরা ছেলে তাকে খোঁটা দিয়ে গেলো?তাচ্ছিল্য করে হাসলেন তিনি।অবশ্য,এই বত্রিশ বছরের সাংসারিক জীবনে এ নিয়ে কম খোটা শোনেনি।শাশুড়ি যখন বেঁচে ছিলো তখন উঠতে বসতে এ নিয়েই খোঁটা শুনতে হতো।কথায় আছে,মানুষ নিজে যা পায়না,তা অন্যের পেয়ে যাওয়াটাও সহ্য করতে পারেনা।
তেমনই সে নিজে যেহেতু শাশুড়ির মমতা পায়নি তবে তার ছেলের বউ কেন পাবে?
সে যেহেতু খোঁটা শুনেছে তাহলে ওই মেয়েরও খোঁটা শুনতে হবে।সে জানে তার ছেলের একরোখা স্বভাব।দুনিয়া উল্টে গেলেও ও একবার যখন বলে দিয়েছে ওই মেয়েকে চাই মানে ওই মেয়েকেই চাই।

খুব ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলো রাত্রির।আড়মোড়া দিয়ে বিছানা থেকে উঠেই সে টের পেলো গায়ের জামা ঘামে ভিজে চুপচুপে।ঘরে ভ্যাপসা গরম।আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসলো সে।চুলে হাতখোঁপা করতে করতে ভাবলো,”একদিন এসির ঠান্ডা বাতাসে শুয়েই কি অভ্যাস খারাপ হয়ে গেলো?এমনেতো এই গরমেই বেশ মানিয়ে নেয়।তবে আজ এত অস্থির লাগছে কেনো?”মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ বের করে আলমারি খুললো সে।গতকাল দুই টি উশনি থেকে মোট ন’হাজার টাকা হাতে এসেছে।চারহাজার দিয়ে বাজার করা আর বইপত্র কিনতে হবে আর বাকি পাঁচহাজার বাড়িভাঁড়া।ভাড়ার টাকাটা আলাদা করে রাখতেই মনে এলো,”নিভ্রান তার কাছে চারহাজার টাকা পায়।সেটাও দিতে হবে।”ফুঁস করে শ্বাস ছাড়লো রাত্রি।আলমারিটা বন্ধ করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বিছানা গোছাতে।

মেঝেটা ঝকঝকে।নাহিদা রাতেই সব পরিষ্কার করে রেখেছে।অফিসের জন্য বেরোনোর আগে একবার মায়ের রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো নিভ্রান।নাহিদা তখন গভীর ঘুমে।দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো নিভ্রান।সেই শ্বাস থেকে বেরিয়ে এলো একরাশ অনুশোচনা।গতকাল মায়ের সাথে এভাবে কথা বলাটা ঠি ক হয়নি।একদম ঠি ক হয়নি।সে ভালো করে বোঝালেই পারতো।কিন্তু রাগটা তখন এতো চড়ে গেছিলো যে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি।দরজাটা আবারো নি:শব্দে আটকে দিলো সে।

সন্ধ্যাটা আজ বড্ড ফিকে।হেডলাইটের টি মটিমে আলোয় রাস্তাটা কেমন ঝিমিয়ে গেছে।গাছের পাতা নড়ছেনা।আকাশে মেঘ উড়ছেনা।চাঁদও উঠেনি।বিষন্ন বাতাস একটু একটু করে ছুঁয়ে দিচ্ছে রাত্রির শীতল দেহ।
মনে মনে গুন গুন করতে করতে এগোচ্ছে রাত্রি।আজও ফেরার আগে নিভ্রানকে দেখেছে গাড়ি ভিতর বসে থাকতে।যতক্ষণ নিভ্রান সেখান থেকে যায়নি ততক্ষণ সে ও বেরোয়নি।তাই একটু দেরি হয়ে গেছে।লোকটা বড় নাছোড়বান্দা।পাক্কা চল্লিশমিনিট মূর্তির মতো গেটের দিকে চেয়েছিলো।রাত্রি আড়াল থেকে লক্ষ্য করেছে।যেন কোনোক্রমেই সে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে না পারে।
আনমনেই হেসে উঠলো রাত্রি।এই স্বৃতি গুলো নিয়েই তো সে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে।একটা লোক তাকে ভালোবাসতো।তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকাতো।তাকে সম্মান করতো।এর থেকে সুন্দর আর কি হতে পারে?হ্যাঁ,হয়তোবা সে লোকটাকে পাবেনা।কখনো আষ্টেপিষ্টে ছুঁয়ে দিতে পারবেনা।তার স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে পিষ্ট হতে পারবেনা তবু…তবু কোথায় যেন একটা সুখময় অনুভূতি।

কব্জিতে সজোরে টান পড়লো।চমকে উঠলো রাত্রি।স্পর্শটা তার খুব চেনা।শ্বাস আটকে পিছে ফিরলো।ভুল হয়নি,নিভ্রান দাড়িয়ে আছে।চেহারায় উপচে পড়া অভিমান।সুন্দর চোখদুটিতে কি ধ্বংসাত্বক ক্রোধ।রাত্রি মাথা নুইয়ে ফেললো।চাপা গলায় বললো,”মানুষ দেখছে।”
নিভ্রান একরত্তি নড়লোনা।হাতের চাপটা আরো তীব্র করে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
—“দেখুক।”
মাথা নিচু অবস্থায়ই ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলো রাত্রি।হাতটা রীতিমত থেতলে যাচ্ছে।কব্জির রগগুলো থেকে বোধহয় রক্তক্ষরণ হচ্ছে।করুন শোনালো তার কন্ঠ,”লাগছে,ছাড়ুন।”
নিভ্রান বাঁধন ঢিলে করে দিলো।তবে হাত ছাড়লোনা।একবার মুখ তুলে তাকালো রাত্রি।লোকটার ক্রোধপূর্ণ চোখদুটো ভীষণ ঘোলাটে।কপালের রগগুলো স্পষ্ট।আবারো দৃষ্টি নেমে গেলো।নিভ্রান এককদম কাছে এসে দাড়ালো।অদ্ভুত স্বরে বললো,

—“আমার লাগে না?”
রাত্রির ঠোঁটজোড়া থরথর করে কেঁপে উঠলো।চোখের কোঁণ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা বিশ্রি অনুভূতি।এত যন্ত্রনা কেনো ছিলো এই কন্ঠটায়?সে তো বলেনি ভালোবাসতে।তবে কেনো এত দায়ভার?কেনো সে অভিযুক্ত হবে অন্যের ভালো না থাকার কারণ হিসেবে।গলাটা না চাইতেও ভিজে গেলো।কম্পমান কান্নাদের নিয়েই সে ব্যাথায় ফেটে পড়া কন্ঠে বললো,
—“কেনো এমন করছেন?”
নিভ্রান তখনো অবিচল,স্হির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে রাত্রির নতজানু মুখের দিকে।চোখের পানিরগুলোর আঘাতে ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও বাইরে সে শক্তপাথর।কি ভেবেছে মেয়েটা?তাকে কষ্টে রেখে,তার থেকে পালিয়ে বেরিয়ে দুদন্ড চোখের পানিতেই অভিমান গলে যাবে।না তো,এতো সোজা না।আগের মতোই দাম্ভিকতায় মোড়ানো কন্ঠ,”আমি করছি না আপনি করছেন?”

রাত্রি একহাতে পানিটা মুছে নিলো।নাকের ডগা টকটকে লাল।ঠোঁট ফুলে গেছে অনেকটা।নিভ্রানের চোখে চোখ রাখতেই যেন সাজানো গোছানো কথাগুলো চট করে কন্ঠনালি থেকে ধুলিসাৎ হয়ে গেলো।কি আশ্চর্য!এ কেমন মায়া?কেমন ছলনা?নেতিয়ে গেলো সে।ছলকে উঠা ক্রদনে সিক্ত হয়ে বললো,
—“দয়া করুন,সবাই তাকিয়ে আছে।”
নিভ্রান আশেপাশে তাকালো।ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে দুটো লোক হাসাহাসি করছে।বাকিরা চুপটি করে মজা দেখছে।চোখগুলো জ্বলজ্বল।একমূহুর্ত না ভেবে সে পরিষ্কার গলায় হাঁক ছাড়লো,
—“আমার বউ চাচা,রাগ করে রাতের বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে।”
লোকগুলোর যেনো ভরা আড্ডায় ভাটা পড়লো।এতক্ষণ হয়তো ঠাট্টা লুটছিলো।কোনরকমে চোখ লুকিয়ে তারা নিজেদের কাজে মনোযোগী হলো।রাত্রি চাপা স্বরেই চেঁচিয়ে উঠলো,

—“আপনি তামাশা পেয়েছেন?”
নিভ্রান প্রশ্নের উওর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।ভূত গ্রস্থ গতিতে রাত্রিকে টানতে টানতে সামনে এগিয়ে চললো।কপালের রগগুলো ফোলা কমেনি।হাতের বাঁধনটা আবারো তীব্র হয়ে যাচ্ছে প্রতি মূহুর্তে।
পার্কটা এখন বন্ধ।তবে একটা পাশ সবসময় উন্মুক্ত থাকে।দুইজোড়া লোহার বেন্চি পাশাপাশি।একটার মধ্য
রাত্রিকে ধপ করে বসিয়ে দিলো নিভ্রান।নিজেও পাশে বসে হাত ছেড়ে দিতেই তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়াতে গেলো রাত্রি।নিভ্রান ধমকে উঠলো।রাশভারি কন্ঠে বললো,
—“খবরদার!উঠবেন না।”
রাত্রি একসেকেন্ড কিছু একটা ভাবলো।তারপর চুপ করে বসে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখলো।নিভ্রানের চোখের ভাষা এবার ভিন্ন।গলার স্বরটাও মোলায়েম,

—‘বলুন,কেন এড়িয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
—“তো কি করবো?আবারো অপমানিত হতে আপনার সামনে মাথা পেতে দিবো?”রাত্রির কাঁটা কাঁটা উওর।লোকটার পাগলামি আর বাড়তে দেয়া যাবেনা।
নিভ্রান একটু স্বাভাবিক হতে যেয়েও পারলোনা।মেয়েটার কথা কোরোসিন ঢেলে দিলো শুকনো আগুনে।থমথমে গলায় সে বললো,
—“আমি কখন অপমান করেছি আপনাকে?উল্টো আমি যে তখন এতটা সময় আপনার জন্য অপেক্ষা করলাম আর আপনি কি করছিলেন?দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন।কি মনে করেছেন?আমি দেখিনি?আমি সবটাই দেখেছি।আপনার কি মনে হচ্ছেনা আমাকে এভাব এড়িয়ে আপনি এখন আমার অপমান করেছেন?”

ঘুমিয়ে থাকা কথাগুলো যেনো নিমিষেই জাগ্রত হয়ে উঠলো।দু’দিন যাবত চেপে রাখা ক্ষোভটার নগ্ন বহি-প্রকাশ উন্মাদিনী করে তুললো রাত্রিকে।উঠে দাড়িয়ে গলা কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো সে,
—“আপনার মা আমাকে যা নয় তা বললো সেদিন।এসব অপমান না?আমি আপনার রাত কাটানোর মেয়ে?আমি বলেছিলাম আমাকে আপনার ঘরে নিয়ে যান?আশ্রয় দেন।বলেন?বলেছিলাম?বলেছিলাম,সেদিন মাঝরাস্তায় পাগলামি করতে?আমি কিছু বলিনি তবু সব আমাকেই কেনো শুনতে হলো?আমাকেই কেনো আপনার ভোগের বস্তু হিসেবে দেখলো আপনার মা?আমি কি..”
—“রাত..”নিভ্রান ঠাঠানো ধমকে থামানোর চেষ্টা করলো।
রাত্রি থামলোনা।বরং দ্বিগুন জোরে চিল্লালো,”সবসময় ধমকাবেননা।কি ভেবেছেন?আপনার মা আমাকে অপমান করবে আর আপনি এসে ধমকে দিলেই ভয়ে পানি হয়ে যাবো?এতটা তুচ্ছ ভাবেন?এত সস্তা আমি?এত সস্তা?”বলতে বলতেই কন্ঠ আটকে গেলো।আবছায়া অন্ধকারেও ভেজা গালের অবিরাম অশ্রুপাত স্পষ্ট চিকচিক করে উঠলো।নিভ্রান একমূহুর্ত হতভম্বের ন্যায় চেয়ে থেকে জোরজবরদস্তি করে মেয়েটাকে বুকে টেনে নিলো।রাত্রি প্রচন্ড অভিমানে পাগলের মতো নিভ্রানের বুকে থাপড়ালো।হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করলো নিজেকে ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে।ঘাড়ে,গলায় খামছে দিলো।কাঁদতে কাঁদতেই চিৎকার করলো,
—“ছাড়ুন,লাগবেনা আমার কাউকে।ছাড়ুন বলছি।”

নিভ্রান ছাড়েনি।খুব খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে।উন্মাদ রাত্রি একসময় থেমে গেলো।চুপটি করে লেপ্টে থাকলো বুকের সাথে।শার্ট ভিজিয়ে দিলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হৃদপিন্ডের জলরঙের রক্তে।আহাজারি করে বললো,
—“আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না?আপনার এই দামি দুনিয়ায় আমার মতো কমদামি মেয়ের জায়গা হবেনা।এ অসম্ভব!”
কথাটা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো নিভ্রান।তারপর অতি নরম স্পর্শে রাত্রির চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বললো,
—“আমার কাছে সবচেয়ে দামি ‘আপনি’।”
রাত্রি থমকে থমকে ডুঁকড়ে উঠলো।বললো,”সে তো শুধু আপনার কাছে।অন্য সবাই কি আর আপনার মতো?তাদের চোখে তো আমার মতো মানুষ সর্বদাই উচ্ছিষ্টের সমতূল্য।একটু আর্থিক সমস্যা হলেই তাচ্ছিল্যর চোখে তাকায় তারা।”
অত্যন্ত গোপনে একটা দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো নিভ্রান।অত:পর খুব কায়দা করে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমি কার?”
ছোট্ট বাচ্চাদের কথা শিখিয়ে দিলে তারা যেমন মুখস্তের মতো উওর দেয়,ঠি ক তেমন করেই রাত্রি উওর দিলো,”
—“আমার।”

মনে মনে প্রান উজার করে হাসলো নিভ্রান।গলা খাদে নামিয়ে উত্তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,”তবে আমার কাছে দামি হওয়াটাই কি আপনার জন্য যথেষ্ট না?”
রাত্রি নিশ্চুপ,নির্বাক।লোকটা তাকে কথার জালে ফাঁসাচ্ছে।কি ধূর্ত!
সময় গাঢ় হয়েছে।নিভ্রানের বুক থেকে একটু আগে ছাড়া পেয়েছে রাত্রি।এখন সে একদম শান্ত,নিষ্প্রভ।হাঁটতে হাঁটতে ওড়না দিয়ে ভেজা চোখমুখ মুছে নিচ্ছে বারবার।নিভ্রান মলিন হাসলো।রাত্রি তার হাসি দেখে শুকনো গলায় বললো,
—“আপনি আর পাগলামো করেন না।”
নিভ্রান উওর দিলোনা।গলা বাড়িয়ে রিকশা ডাকলো।রাত্রিকে উঠিয়ে দিতে দিতে তার অগোচরে রিকশাওয়ালার মামার হাতে ভাড়াটা ধরিয়ে দিলো।রাত্রি ঘুনাক্ষরেও টের পেলোনা।ওড়নার আঁচলটা কাঁধ গলিয়ে রাস্তা ছুঁইছুঁই।নিভ্রান রিকশার হুট তুলে দিলো।ওড়নাটা কোলের উপর গুছিয়ে দিয়ে রাত্রির তখনকার কথাটার উওর দিলো,”এসব ভুলে যান রাত।আমার আপনাকে লাগবেই।আপনার যদি এটাকে পাগলামি মনে হয় তবে আমি পাগলামিই করবো।”

রাত্রি কাতর চোখে তাকালো।বললো,”প্লিজ..।”
নিভ্রান যেনো তার কথাটা শুনেও শুনলোনা।ঘাড় বাকিয়ে রিকশাওয়ালা মামার দিকে চেয়ে বললো,”ওকে সাবধানে নামিয়ে দিবেন মামা।আমার নজর কিন্তু এই রিকশার উপরই রইলো।”
রিকশাওয়ালা মামা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালেন।নিভ্রান এবার রাত্রিকে বললো,
—“ভয় পাবেন?আমি আসবো সাথে?”তারপর একটু অন্যগলায় বললো,”আমি আসলেতো আবার আপনার সমস্যা হয়।”
রাত্রি ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে একপাশে চেপে বললো,”আসুন,তবে এই শেষ।”
নিভ্রান ঠোঁট বাকিয়ে উঠে বসলো।রাত্রির একহাত নিজের দু’হাতের মাঝে চেপে ধরে বললো,”এই শুরু।”
রাত্রি গমগম করলো,”একদম না।”
—“মায়ের ব্যাপারটা আমি সামলে নিবো রাত।চিন্তা করবেন না।”
রাত্রি বিরস গলায় কোনরকম প্যাঁচ ছাড়াই বললো,”আপনার মা হয়তো আপনার কথায় আমাকে মেনে নিবে।কিন্তু ভেতরে ভেতরে উনি কখনোই আমাকে পছন্দ করবেন না।একবার চোখে খারাপ লেগে গেলে তা কখনোই ভালো হয়না।”
—“আর একবার মনে ধরে গেলে যে বের করা যায়না।আমি কিভাবে বের করবো আপনাকে?”
—“বাদ দিন,কথা বাড়বে।”বলে চুপ করলো রাত্রি।এই লোকের সাথে তাল মেলালে তার চলবেনা।হাজার সমস্যায় ঘেরা জীবনে তিক্ততা আরো বাড়াতে চায়না।কোনোভাবেই না।

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১১+১২

সাত দিন পরের কথা…
বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে রাত্রি।চোখদুটো খোলা।মনটা একনাগাড়ে ভেবে চলেছে সেই লোকটার কথা।এই একটা সপ্তাহ নিভ্রানের সাথে দেখা হয়নি।হয়েছে তবে একদম সরাসরি হয়নি।রাত্রি তাকে রাস্তায় দেখলেই চোরের মতো পালিয়ে গেছে।কতবার ফোন দিয়েছে নিভ্রান।রাত্রি তুলেনি।শুধু গতপরশু বাসার নিচে এসেছিলো তখন ফোনে শুধু একবার বলেছিল,”চলে যান।”নিভ্রান দিরুক্তি করেনি।তখনই চলে গিয়েছিলো।এরপর আর ফোন আসেনি ওই নাম্বার থেকে।না এই দুদিন একবারো তার আশেপাশে দেখেছে।চোখ বুজলো রাত্রি।কোঁণ দিয়ে গড়িয়ে গেলো দহনের আঁচ ওয়ালা তপ্ত পানি।

রাত তখন গভীর।ঘড়ির কাঁটা প্রায় দুটো ছুঁইছুঁই।রাত্রি সারাদিনের ক্লান্তিতে বুঁদ হয়ে ঘুমোচ্ছে।আকাশে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে।সেই গর্জন কান অবধি গেলেও মস্তিষ্ক ছুঁতে পারছেনা।সারাদিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে।শরীর ভেঙে ঘুম দিয়েছে সে।ঠি ক তখনই বিকট শব্দ তুলে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় প্রচন্ড বিরক্ত হলো রাত্রি।পরমূহুর্তেই চমকে উঠলো।এতো রাতে কে ফোন দিলো?তাকে তো শুধু মা ই ফোন দেয়।তাছাড়া ভার্সিটির বান্ববীরা?নাহ্,ওরা তো এতো রাতে ফোন দিবেনা।ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে।দরদর করে ঘাম ছুটে গেছে।ফোনটা পড়ার টেবিলের উপর রাখা।এলোমেলো পা ফেলে দ্রুত ফোনটা হাতে তুললো।স্ক্রীনে আননোন নাম্বার।ওদিক থেকে একটা চাপা রুদ্ধ কন্ঠ ভেসে আসলো,
—“আপু?আপু দয়া করে একটু বাইরে আসুন।আমি আপনার দরজার বাইরেই অপেক্ষা করছি।দয়া করুন আপু,ভাইয়ার অবস্থা ভালোনা।আপনাকে আমার সাথে যেতেই হবে।প্লিজ..।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৫+১৬