এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৫+১৬

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৫+১৬
লেখিকা মালিহা খান

বুকটা ধড়াম ধড়াম করে লাফাচ্ছে।শ্বাস ভারি হয়ে আসছে।ভয়ে কন্ঠ তোতলাচ্ছে।ওপাশের ছেলেটা অনুরোধ করেই যাচ্ছে।একটাবার বের হবার জন্য,তার সাথে যাবার জন্য।প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো রাত্রি।এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে সে ইহজন্মেও পড়েনি।গলা যেন কেও চেপে ধরেছে।আওয়াজ বের করা বড় দুষ্কর।একঝলক ফোনটা নামিয়ে নাম্বারটা পুনরায় দেখে নিলো সে।নাহ্,চেনেনা।অচেনা একটা ছেলের সাথে কোনরকম বাছবিচার না করে এই রাতের বেলা বেড়িয়ে পড়াটা কি উচিত হবে?ছেলেটা ‘ভাইয়া’ ‘ভাইয়া’ বলে কি আসলেই নিভ্রানের কথা বলছে?চোখ খিচলো রাত্রি।অভিসঙ্কিত কন্ঠে বললো,

—“আপনি কে?”কন্ঠ কেঁপে গেছে।ছেলেটা কি তার ভয়টা টের পেয়ে গেলো?সর্বনাশ!বললো তো দরজার বাইরেই দাড়িয়ে আছে।এখন যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়।আচ্ছা,ছেলেটা কি আসলেই সত্যি বলছে?নাকি অযথাই বানোয়াট কথাবার্তা?যাচাই করা দরকার।অযথা ভয় পেয়ে লাভ নেই।নিশব্দে রুম থেকে দৌড়ে মেইন দরজার কাছাকাছি যেয়ে দাড়ালো রাত্রি।ওপাশের লোকটা নিশ্চুপ।হয়তো কিছু ভাবছে।রাত্রি দরজায় কান পাতলো।ঠি ক তখনই ফোনে আর দরজার ওপাশ দুদিক থেকেই স্পষ্ট স্বর শোনা গেলো,
—“আমি নিভ্রান ভাইয়ার ছোট ভাই।”
ভয়টা কমার কথা হলেও তা উল্টো কয়েকগুন হারে বৃদ্ধি পেলো।উত্তেজনার বশে ভুল করা যাবেনা।এত রাত!বাড়ির সদর দরজা আটকানো।ছেলেটা ঢুকলো কি করে?সন্দেহজনক বিষয়!রাত্রি একটু সরে গেলো দরজার পাশ থেকে।স্হির কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“আপনি আপনাকে বিশ্বাস করবো কি করে?”
ওপাশের ছেলেটার অধৈর্য নিশ্বাসপ্রবাহ।রাত্রি স্পষ্ট টের পেলো।দু’সেকেন্ড ভেবে ছেলেটা বললো,”আপনি জানালা দিয়ে দেখুন।আমি ভাইয়ার গাড়ি নিয়েই এসেছি।গাড়ি মিলিয়ে দেখুন।আমার বড় ভাই না হলেতো এমনি এমনি গাড়ি নিয়ে আসতে পারতাম না?তাইনা?”
রাত্রি দেরি করলোনা।ফোনটা কানে ধরেই রুমে গেলো।বহুকষ্টে ক্যাঁড় ক্যাঁড় আওয়াজে বন্ধ জানালাটা খুললো।সাথে সাথেই বাতাসের ঝাপটা চুল এলোমেলো করে দিলো।বৃষ্টি নামবে বোধহয়।পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।হেডলাইটের আলোয় নিভ্রানের গাড়ি দেখা যাচ্ছে।ছাইরঙা চকচকে গাড়িটা রাস্তার উল্টোপাশে অগোছালো ভাবে পার্ক করা।বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা খুব তাড়ায় আছে।মনটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রাত্রির।সে চাচ্ছিলো না এটা সত্যি হোক।লোকটার কি হয়েছে যে তার ভাই এভাবে ছুটে এলো?
ওপাশ থেকে ছেলেটা বললো,
—“আপু?দেখেছেন?”
রাত্রি নিচু স্বরে উওর দিলো,
—“জি।”
—“এবার আসুন প্লিজ।”

রাত্রি আর ভাবলোনা।বেশি দেরি করলে পরে না আফসোস করতে হয়।ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভাবে ভেঙে পরলেও কোনরকমে নিজেকে সামলালো সে।এলো চুল গুছিয়ে মাথায় ওড়না টানতে টানতে বললো,
—“আসছি।একটু দাড়ান।”
বেশ আস্তে করে দরজাটা খুলে গেলো।ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অল্পবয়সী একটা মেয়ে।নিশাদ একপলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো।এতক্ষণ কথা শুনে মনে হচ্ছিলো কত বড় একটা মেয়ে।কেমন ধারালো কথাবার্তা।কিন্তু এ তো দেখি নিতান্তই ছোট্ট একটা মেয়ে।তার এত বড় ভাই এই মেয়ের জন্য সব উথাল পাথাল করে দিচ্ছে।বেশ অবাকই হলো নিশাদ।রাত্রি অসস্তি তে কুঁকড়ে যাচ্ছে।নিভ্রানের ছোট ভাই হলেও ছেলেটার বয়স তার দিকে বড় হবে।না জানি কি ভাবছে।নিশাদ মাথা নিচু করেই একটু সাইড দিয়ে বললো,
—“আসুন আপু।”
রাত্রি চুপচাপ সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।নিশাদ পিছে পিছে আসছে।নিচ পর্যন্ত যেয়েই এককদম দাড়ালো সে।সন্ধিহান কন্ঠে বললো,
—“আপনি ভেতরে এলেন কিভাবে?কেউ দেখেনি?দারোয়ান কোথায় ছিলো?”
—“আমি দেয়াল টপকে এসেছি আপু।”

রাত্রি আৎকে উঠলো।ছেলেটা যেহেতু ওভাবে এসেছে তারমানে এখনো সেভাবেই যেতে হবে।চোখ বড় বড় করে তাকাতেই হেসে ফেললো নিশাদ।অভয় দিয়ে বললো,
—“ভয় পাবেন না।আমি সাবধানের নামিয়ে দিব আপনাকে।আপনার গায়ে একটা ফুলের টোঁকা পরলেও ভাইয়া নিশ্চিত জানে মেরে ফেলবে আমাকে।এমনেই ভয়ে আছি।”
রাত্রি লজ্জা পেলো।অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।লোকটা কি না কি বলেছে কে জানে।
দেয়ালের পাঁচিল থেকে খুব যত্ন করে রাত্রিকে নামালো নিশাদ।রাত্রি রাস্তায় দু’পা ফেলে দাড়াতেই হাত ছেড়ে সরে দাড়ালো সে।রাত্রি ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।কেউ দেখে ফেললো নাতো?নাহ্,কেউ নেই।রাস্তা ফাঁকা।নিশাদ যেয়ে গাড়ির দরজা খুললো।বিনীত স্বরে রাত্রিকে ঢোকার ইশারা করে বললো,
—“আপু দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
রাত্রি চুপটি করে সিটে বসলো।নিশাদ ড্রাইভিং সিটে বসে একমূহুর্ত দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দিলো।বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ড্রাইভ করছে সে।স্পিড হাই।চোখেমুখে তাড়াহুড়ো।রাত্রি ফাঁকা ঢোক গিললো।আমতা আমতা করে বললো,
—“এত ভয় পাচ্ছেন কেনো?”
—“আপনাকে না দেখলে ভাইয়া অনর্থ ঘটিয়ে ফেলবে।দোয়া করুন যাতে জলদি পৌছাতে পারি।”

নাহিদার মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ।চেহারা থমথমে।নিভ্রানের রুম থেকে এখন আর কোনো শব্দ আসছে না।পাশের সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে নিভ্রানের বাবা নওশাদ সাহেব।তার চোখমুখ একেবারেই স্বাভাবিক।যেনো বাসায় ঘটে যাওয়া ঘটনা কোনো প্রভাব ফেলেছি মস্তিষ্কে।
নিশাদ ঢুকলো তখনই।তার পিছু পিছু রাত্রি।
—“আপুকে নিয়ে এসেছি মা।ভাইয়া আর কিছু করেছে?”
নাহিদা শীতল চোখে চাইলেন রাত্রির দিকে।রাত্রির নত দৃষ্টি মেঝের দিকে।এই মধ্যরাতেও বাসাটা একেবারেই সজাগ।লোকটা নিশ্চিত ভয়ার্ত কান্ড ঘটিয়েছে।নাহিদার মাথার ব্যান্ডেজ সেটার জলজ্যান্ত প্রমান।
নিশাদ বুঝলো মায়ের নিশ্চুপ ইশারা।রাত্রিকে বললো,
—“আপু ভাইয়ার রুমে চলুন।”
তারা রুমের সামনে যেয়ে দাড়াতেই উঠে আসলেন নাহিদা।রাত্রি বিচলিত ভঙ্গিতে সাইড দিলো তাকে।নিশাদ লক ঘুরালো।দরজা খুলতেই প্রকাণ্ড একটা শোপিস এসে ঝংকার তুলে চুরমার হয়ে গেলো পায়ের কাছে।ছিঁটকে গেলো ওরা তিনজনই।নিভ্রান বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করলো,
—“কাউকে আসতে মানা করেছিনা?”

নিশাদ ধড়াম করে দরজাটা আটকে বুকে থুথু ছিটালো।রাত্রি হতভম্ব।এই শান্তশিষ্ট লোকটাও এভাবে চিৎকার করতে পারে?নাহিদা চুপচাপ।কোনোকিছু যেন তাকে চমকে দিতে পারছেনা।নিশাদ ঢোক গিলে দরজাটা আবার একটু ফাঁক করলো।নিভু নিভু কন্ঠে বললো,
—“তোর রাতকে নিয়ে এসেছি ভাইয়া।ও কে তো আসতে দিবি।”
“রাত” শব্দটা কানে যেতেই যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো নিভ্রানের চোখেমুখে।তার ভাই অত্যন্ত এই সময় মিথ্যা বলবেনা।এত সাহস নেই!বিছানা থেকে নিজেই নেমে গেলো সে।নিশাদের অর্ধেক খোলা দরজাটা ভেতর থেকে সজোরে টেনে রো খুলে নিলো।রাত্রি ভয়ে দরজার পাশের দেয়ালে কাঁধ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে ছিলো।নিভ্রান তাকে তৎক্ষণাৎ দেখতে না মূহুর্তেই হুঙ্কার ছাড়লো,
—“কোথায় রাত?”

নিশাদ আবারো থতমত খেলো।নাহিদা নিস্পৃহ নয়নে চেয়ে রয়েছে ছেলের মুখের দিকে।নিশাদ আলতো করে রাত্রির হাত ধরে তাকে নিভ্রানের সামনাসামনি দাড় করালো।নিভ্রান একমূহুর্ত ভাবলো না।তাদের সামনেই শক্তহাতে রাত্রিকে টেনে নিলো নিজের কাছে।একহাতে কোমড় পেচিয়ে আরেকহাতে মাথাটা চেপে ধরলো বুকের মাঝে।লজ্জায় জবুথবু হয়ে গেলো রাত্রি।নিশাদ চোখ নামিয়ে ফেললো।তার সাদামাটা ভাইযে এভাবে কাউকে ভালোবাসে বিষয়টা একেবারেই হজম হচ্ছেনা।ঘরটা অন্ধকার হলেও ড্রইংরুমের আলোর ঝলকানিতে সবই দেখা যাচ্ছে।লজ্জাটা যেনো আরো ভালোভাবে আঁকড়ে ধরলো রাত্রিকে।মা,ভাইয়ের সামনে এভাবে ধরে রেখেছে লোকটা।তারা কি ভাববে!
নিভ্রান অনড়।রাত্রিকে যেনো নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলবে।রাত্রি কাঁচুমাচু করলো,
—“শান্ত হন,আমি কোথাও যাচ্ছিনা।একটু ছাড়ুন..”

নাহিদা বললেন,”মেয়েটাকে…”কথা শেষ করতে দিলোনা নিভ্রান।চোখ গরম করে হাত উঠিয়ে থামার ইঙ্গিত করতেই চুপ হয়ে গেলো নাহিদা।নিশাদ তোতলালো,”ভাইয়া,রেগে গিয়ে আপুকে আবার কিছু করোনা।”
পেছন থেকে নওশাদ সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন,
—“তোমরা চলে আসো,ওদেরকে একা থাকতে দাও।”
নিভ্রানের নিরবতাই নওশাদ সাহেবের কথার সাথে সম্মতি জানালো।নিশাদ বিনাবাক্য দরজা ভিড়িয়ে বেরিয়ে গেলো।একহাতে রাত্রির কোমড় জড়িয়ে রেখেই অন্যহাতে দরজা লক করে দিলো নিভ্রান। সুইচ চেপে আলো জ্বালালে।মেঝের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁচগুলো পরখ করে অস্থির হতে হতেও থেমে গেলো সে।রাত্রির পায়ে স্যান্ডেল আছে।কাঁচ ঢোকার কথা নয়। এতদিনের ক্ষোভটা আচমকা মেয়েটার দেখা পেয়ে একটু শান্ত হলেও এখন যেনো তা গলিত লাভা-র ন্যায় গড়িয়ে পড়লো রাত্রির উপর।কোমড়ের বাঁধনটা লোহার মতোন শক্ত করে ধরে ধমকে উঠলো সে,

—“কেন এমন করছেন রাত?”বলুন,কি লাভ হচ্ছে আমাকে অবহেলার ধারালো করাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে?”
রাত্রি কেঁপে উঠলো।বুক থেকে মুখ তুলে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়েই যেন স্তব্দ হয়ে গেলো।লোকটার এ কি অবস্থা!চোখদুটো টকটকে লাল।চুল অগোছালো।সবসময়ের সুসৃঙ্খল আবেশটা হারিয়ে গেছে কোথায় যেনো।
হুঁশ ফিরলো।চোখ লুকাতে মেঝের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আতঙ্কিত হয়ে গেলো সে।সাদা টাইলস এ রক্তের ফোয়ারা।হাত পা কাঁপুনি ধরে গেলো।এলোপাথারি কাঁচ বিঁধে নিভ্রানের দু’পা ক্ষতবিক্ষত।অথচ লোকটা অনুভূতিশূন্য।রাত্রি শ্বাস আটকে আটকে বললো,
—“আপনার..আপনার পা দিয়ে এত রক্ত….আল্লাহ!কি করেছেন?দেখি বসুন।”
নিভ্রান পায়ের দিকে তোয়াক্কা করলোনা।রাত্রিকে ছেড়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো।অসহ্য করুণ গলায় বললো,

—“আরে মানুষের তো পশুর উপরও মায়া জন্মে যায়,আপনার আমার জন্য মায়া হয়না?মায়া বাদ দিন একটু দয়াই করুণ নাহয়।দয়া করেই আমার হন।”
রাত্রি সেই হৃদয় ঝাঁঝড়া করা কথাগুলো শুনেও কোনরকমে হজম করলো।নিভ্রান ড্রিংক করেছে।হাল্কা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।কথাবার্তায় ও কেমন ঘোলাটে ভাব।হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়লো সে।নিভ্রানের এক পা কোলের উপর তুলে নিয়ে নিশ্চিত হাতে ছোট্ট টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে ফাস্ট এইড বক্স বের করলো।তুলা বের করতেই নিভ্রান তাচ্ছিল্য করে হাসলো।খাপছাড়াভাবে বললো,
—” বাদ দিনতো এসব।কতশত রক্তক্ষরণ হচ্ছে অথচ আপনি টেরও পাচ্ছেন না।”
রাত্রি ধরা গলায় বললো,
—“চুপ করে থাকুন,আমি বলেছি আমার জন্য রক্তাক্ত হতে?”
নিভ্রান চুপ করলো।রাত্রি দু’পায়ে ব্যান্ডেজ করে উঠে দাড়ালো।সাবধানে পা ফেলে দরজা পর্যন্ত যেয়ে লাইট নিভিয়ে ফিরে এলো।মাথার বালিশ ঠি ক করে দিয়ে বললো,
—“আপনি ঘুমান তো একটু।”
নিভ্রান শুলো ঠি ক।কিন্তু পরক্ষণেই হাল্কা,তেজ হীন গলায় বললো,

—“আমি ঘুমালেই আপনি চলে যাবেন তাইনা?নিশাদ জোর করে নিয়ে এসেছে আপনাকে?থাক,আর থাকা লাগবেনা।আমি ঠি ক আছি।আপনি চলে যান।নিশাদ কে বললেই আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।”
—“কোথাও যাবোনা আমি।”দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বললেও অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো রাত্রির।টপটপ করে পানিও গড়ালো কয়েক ফোঁটা।নিভ্রানের বুকের উপর পড়লো সেই পানি।রাত্রি ঠোঁট কামড়ে ধরলো।কান্নার শব্দ যেনো নিভ্রান না শুনে।কোনোভাবেই না।সেভাবেই দ্রুত গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেটটা টেনে দিয়ে নিভ্রানের মাথার কাছছায় বসলো সে।বাইরে আজও বৃষ্টি নেমেছে।মুষুলধারে বৃষ্টি।
নিভ্রান একদৃষ্টে চেয়ে থাকলো ব্যালকনির কাঁচের দরজার দিকে।বৃষ্টির জল কাঁচে এসে বাড়ি খাচ্ছে।তারপর বক্ররেখায় এলোমেলো হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে।বেশ কিছুক্ষণ মত্তের মতো চেয়ে সে আবিষ্ট স্বরে বললো,

—“কাঁচটা সরিয়ে দিন রাত,ঘরে বৃষ্টি আসুক।একরাতে এই বৃষ্টির সাথেই প্রেম এসেছিলো।এবার নাহয় একটু ভালবাসাও আসুক।ভালবাসার মানুষটাও আসুক।”
হাল্কা শব্দে কাঁচটা সরিয়ে দিতেই দমকা বাতাসে ভেসে বেড়ানো বৃষ্টির শীতল পানি ছুঁয়ে গেলো রাত্রির শুকনো চোখমুখ।প্রতিটি ধুলোকণায় প্রেমের বার্তা নিয়ে ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো মিষ্টি হিমেল হাওয়া।শিরশির করে উঠলো শরীরের লোপকূপগুলো।ঘরে এসি চলছে তার উপর এমন ঠান্ডা পরিবেশ।দাঁত কেঁপে উঠলো রাত্রির।এত ঠান্ডায় থাকা যায় নাকি?
দৈবাৎ উড়তে থাকা পর্দাগুলো একপাশে চাপিয়ে দিয়ে পিছনে ফিরতেই বিষম খেলো সে।নিভ্রান শোয়া থেকে উঠে সটান বসে আছে।বশীভূত দৃষ্টি ঘুরছে তারই সর্বাঙ্গে।রাত্রি বিব্রতবোধ করলো।লজ্জিত ভঙ্গিতে গায়ের ওড়না টেনে টুনে ঠি ক করতে করতে বললো,”উঠলেন যে?”
উওর আসলোনা।জড়োসড়ো হয়ে কাছাকাছি এসে দাড়ালো রাত্রি।নিভ্রান একবার পলক ফেললো।রাত্রির হাত টেনে তাকে মুখ বরাবর বসিয়ে দিলো।মাথা নুইয়ে ফেললো রাত্রি।লোকটা বোধহয় হুঁশে নেই।সামনে বসায় মদের গন্ধটা বেশ ভালো করেই পাওয়া যাচ্ছে।

নিভ্রান আলতো করে হাত রাখলো তার গালে।মুখ ক্রমশ এগিয়ে খুব নিকটে এসে বললো,
—“ওড়না ঠি ক করছেন কেনো?লজ্জা লাগছে?।রাত্রি অস্পষ্ট আওয়াজ করলো।নিভ্রান তার উওরের অপেক্ষা করলোনা।ধীরগলায় বললো,
—“মেয়েরা কখন লজ্জা পায় জানেন?সব চাহনী কিন্তু তাদের লজ্জা দিতে পারেনা।যখন মেয়েটা বুঝে যে
অপরপাশের মানুষটা তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে,ওই চোখে অন্য ভাষা আছে।তখনই তাদের দৃষ্টি নেমে যায়,মাথা ঝুকে চায়,ঠোঁট কেঁপে উঠে।ঠি ক আপনার মতোন।তারমানে আপনি বুঝতে পারছেন যে আমি আপনার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি।তাইনা?”

রাত্রির সারা শরীরে কেও যেনো দাউদাউ করে আগুন ধরিয়ে দিলো।কিসব অলুক্ষুণে কথাবার্তা!কি অদ্ভুত শিহরণ।হৃদপিন্ডের কম্পন কমছেনা কিছুতেই।নিভ্রান দুরত্ব বিনাশ করলো।সর্বোত্তম নিকটে এসে রাত্রির ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলালো।ক্ষণিকেই চমকে উঠলো রাত্রি।লোকটা কি এখনই ভয়ানক কিছু করে ফেলবে?চোখ তুলে তাকালো সে।লোকটার দৃষ্টি তার পাতলা ঠোঁটজুড়ে।
নিভ্রানের ঠোঁটের এককোঁণ প্রসারিত হলো খানিকটা।রাত্রি হাত মুঠো করে ফেললো।ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,”নাহ্”।কিছুক্ষণ কেটে গেলো সেভাবেই।মুখের উপর আছরে পড়া নিশ্বাসের তীব্রতা কমে আসতেই ধীরগতিতে বুজে ফেলা চোখ মেললো সে।নিভ্রান তখন স্বাভাবিক দুরত্বে আছে।তবে হাতটা লেপ্টে আছে গালের উপরই।রাত্রি ফাঁকা ঢোক গিললো।নিভ্রান তার কপালের উপর অবিন্যস্তভাবে উড়তে থাকা চুল কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে ভারি গলায় বললো,

—“আমি মাতাল নই রাত।ভয় পাবেননা।”
রাত্রি একটু সহজ হলো।নিভ্রানের চোখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বললো,
—“ভয় পাচ্ছিনা।…কিন্তু আপনি এসব খেয়েছেন কেনো?আপনাকে তো কখনো সিগারেটটাও ছুঁতে দেখিনি।”
নিভ্রান স্নান হাসলো।গাল থেকে হাত সরিয়ে বললো,
—“আপনি তো কতো কিছুই দেখেননি।এইযে আমি মৃতপ্রায় হয়ে কাতরাচ্ছিলাম শুধু একটাবার আপনার দেখা পাওয়ার জন্য।আর আপনি পরশুদিন কি করলেন?গমগমে গলায় বললেন,”চলে যান।”জানেন আমার কেমন লেগেছিলো?আচ্ছা বলেনতো,এই নরম পাথরটাকে আমি কেন ভালোবাসতে গেলাম?”
রাত্রি দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করে বললো,
—“আপনি ঘুমাবেননা?”
—“আপনি সত্যি চলে যাবেননাতো?”নিভ্রানের সন্দেহজনক প্রশ্ন।
রাত্রি দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো।এতক্ষণ ধরে সে ঘরে ঢুকেছে।বাইরের সবাই না জানি কি ভাবছে?।এ বিষয়ে কিছু বলতেও পারছেনা।নিভ্রান রেগে যেতে পারে।অতএব,কিছু না বলাই শ্রেয়।নিভ্রান ঘুমালে অন্তত বের তো হওয়া যাবে ঘর থেকে।
নিভ্রানকে জোরপূর্বক শুইয়ে দিলো সে।মাথার কাছে বসে চুলে আস্তে আস্তে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,

—“কোথাও যাবোনা।আপনি চোখ বন্ধ করুন।”
নিভ্রান চোখ বন্ধ করলো।সময় কেটে গেলো অনেকক্ষণ।
ভোর তখন চারটা।নিভ্রান ঘুমিয়েছে একটু আগে।রাত্রির একহাত তার আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে নিবদ্ধ।অন্যহাত তখনো অবিশ্রাম বিলি কেটে যাচ্ছে চুলের মাঝে।
নিভ্রানের ঘুম আরো একটু গভীর হতেই খুব সাবধানে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় রাত্রি।মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিশব্দে উঠে দাড়ায়।ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে পর্দা টেনে দেয়।ঘর অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়।ফাস্ট এইড বক্সটা এখনো বিছানায় ই আছে।রক্তমাখা তুলো গুলো পড়ে আছে টেবিলে।কোনরকমে পা ফেলে ড্রয়ার খুলে বক্সটা জায়গামত ঢুকিয়ে রাখে সে।তুলোগুলো হাতরিয়ে হাতরিয়ে একপাশে জড়ো করে রাখে।একটা দীর্ঘ হতাশ শ্বাস বেরিয়ে আসে।কম চেষ্টাতো করলোনা লোকটার পাগলামি কমানোর জন্য।আর কি ই বা করার আছে তার?

ড্রইংরুমে তখন নিশাদ আর নাহিদা।নওশাদ সাহেব ঘরে চলে গেছেন।নাহিদার চোখে ঘুম নেই।নিশাদ একটু আধটু ঢুলছে।রাত্রি বেরিয়ে এলো।সাথে সাথেই দু’জোড়া চোখ উজ্জল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে।
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রাত্রি।গলা নামিয়ে কোনরকমে বললো,
—“উনি ঘুমিয়েছেন।”
নিশাদের চোখেমুখে স্বস্তি খেলে গেলো।নিজে নিজেই বিরবির করলো সে,
—“যাক অবশেষে!বাঘিনীর থাবায় বাঘ শান্ত হয়েছে।”
রাত্রি বুঝতে পারলোনা সে কি করবে।এখানে বসবে নাকি চলে যাবে?নাহিদার সাথে এখানে বসতেও ইচ্ছা করছেনা।আবার নিভ্রানকে বলেছে সে কোথাও যাবেনা।তার ভাবনার মাঝেই নাহিদা গলা ঝাড়লেন।নিচু গলায় বললেন,

—“তুমি এখানেই থাকো।ঘুম ভেঙে তোমাকে না দেখলে আবার রেগে যাবে।”
নাহিদার কাছ থেকে এমন কথা মোটেও আশা করেনি রাত্রি।এই উদ্ভট মহিলার এহেন মিষ্টভাষা তার হজম হচ্ছেনা।বসবে নাকি না দোটানার মাঝেই নিশাদ লম্বা হাই তুলে সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“আমি এখন আপনাকে দিয়ে আসতে পারবোনা আপু।ঘুম পাচ্ছে।আপনি বসুনতো।”
অগত্যা বসতেই হলো তাকে।নাহিদা যেখানে বসেছে সেই সোফার এককোণেই চেপে বসলো সে।কিছুক্ষণ কেটে গেলো নিরবতায়।
খানিকবাদে নাহিদা মিনমিন করে বললো,
—“ও সারাদিন কিছু খায়নি।কোথথেকে যেনো ওই ছাইপাঁশ খেয়ে এসেছে।রাতে ফিরেও খায়নি।সকালে উঠলে যদি না খেতে চায় তবে তুমি একটু খাইয়ে দিয়ে যেও।তোমার কথা ফেলবে না।”
রাত্রি থতমত খেয়ে মাথা নাড়লো শুধু।নাহিদার সাথে কথা বলার রুচি হচ্ছেনা আবার মহিলার অসহায়,মলিন চেহারা দেখে মায়াও হচ্ছে।মাথার ব্যান্ডেজ রহস্যটা জানতে ইচ্ছা করছে খুব।এটাও কি নিভ্রানের দ্বারা হয়েছে?হয়তোবা হ্যাঁ।।লোকটা আর কি কি অঘটন ঘটিয়েছে কে জানে।নিশাদ মিটিমিটি হাসছে।রাত্রির দৃষ্টি এড়ালোনা।নিভ্রান যতো শান্ত এই ছেলে ততোই চন্চল।

সকাল সকালই ঘুম ভাঙলো নিভ্রানের।চোখের পাতায় কেউ যেন দশ টনের পাথর রেখে দিয়েছে।মাথায় ঝিমঝিম অনুভূতি।দু’হাতে কপাল চেপে টলতে টলতে উঠে বসলো সে।আশেপাশে রাত নেই।মেয়েটা ঠি কই চলে গিয়েছে।হাহ্!রাত শুনবে তার আবদার।চরম অবাধ্য মেয়ে!
পায়ে হাল্কা ব্যাথা হচ্ছে।তবু বিছানা থেকে নেমে সটান দাড়িয়ে গেলো নিভ্রান।টেনে দেয়া পর্দা দেখে একটু গলে গেলেও পাহাড়সমান অভিমানের ভিড়ে সেই খুশিটা নিমিষেই যেনো পিষ্ট হয়ে গেলো।
এলোমেলোভাবে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।মুখের উটকো গন্ধটা এখন নিজেরই সহ্য হচ্ছেনা।এই দুর্গন্ধ নিয়ে সে রাতের এতো কাছে ছিলো ভাবতেই লজ্জা লাগছে।মেয়েটা না জানি কিসব ভেবে বসে আছে নে!সবসময়ই তো একধাপ বেশি বুঝে!

ফ্রেশ হয়ে চোখ মুখ না মুছেই পায়ে স্যান্ডেল দিয়ে ঘরের দরজা খুললো নিভ্রান।মেয়েটা কে কি ঠি ক ঠাক পৌছে দিয়েছে নাকি খোঁজ নিতে হবেতো।ফ্লোরে কাঁচের টুকরাদের পসরা বসেছে যেনো।সব ছড়িয়ে আছে।
শান্ত দৃষ্টিতে ড্রইংরুমে চোখ বুলাতেই সবিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার।এ কি দেখছে!রাত্রি তার মায়ের কোলের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।হতবিহ্বল গোছেই সামনে এগোলো সে।
নাহিদা ঘুমাচ্ছে সোফায় পিছের দিকে মাথা দিয়ে।আর রাত্রি তার কোলের উপর মাথা রেখে সোফায় পা ভাঁজ করে কাত হয়ে শুয়ে আছে।নাহিদার একহাত রাখা রাত্রির কপালের উপর।অজান্তেই ঠোঁটে একটা গাঢ় হাসি চলে এলো নিভ্রানের।

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৩+১৪

আরো কিছুক্ষণ একাধারে রাত্রি আর নাহিদাকে পর্যবেক্ষণ করলো সে।বিস্মিত ভাবটা একটু কেটে যেতেই
ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো পাশের সোফায় উল্টো হয়ে গভীর ঘুম দিয়েছে নিশাদ।
নিভ্রান নিশব্দে নিশাদের সামনে যেয়ে দাড়ালো।মাথায় আলতো করে চাঁটি মারতেই হুরমুর করে উঠে গেলো নিশাদ।নিভ্রানকে সটান দাড়িয়ে থাকতে দেখে মূহুর্তেই একটু ভড়কে গেলো।বেগতিক কন্ঠে বললো,
—“কি সমস্যা?আমার মাথাও ফাটিয়ে দিবি নাকি?”
নিভ্রান ধ্যান দিলোনা তার বেসামাল কথাবার্তায়।তার ভাই এমনই।একটু থেমে রাত্রির দিকে ইশারা করলো সে।বললো,

—“এসব কি?ও এখানে ঘুমিয়েছে কেনো?”
নিশাদ ঘাড় উচিয়ে দেখলো।দৃশ্যটা দেখে নিতেই দুই ভ্রু উঁচু করে বিস্ময় প্রকাশ করলো।তারপর আবারো ঘুমের ভাব করে বললো,
—“আমি জানিনা কিছু।এসব আমার ঘুমানোর পরে হয়েছে হয়তো।তোর তো খুশি হওয়া উচিত।এখন যা পাগলামি না করে বিয়ে করে ফেল।তারপর শান্তিতে থাকতে দে।”বলে একটু থামলো সে।তারপর দ্বিগুন ভাব ধরে বললো,
“তুই তো সাতদিনেও পারলি না আর আমি একরাতেই কিভাবে নিয়ে আসলাম দেখলি?”
নিভ্রান মনে মনে হাসলো।রাত্রির ঘুমন্ত চেহারার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে স্বগোতোক্তি করলো,
—“সবার সাথেই নরম।শুধু আমার বেলাতেই রাজ্যের যত সমস্যা এসে জুড়ে যায়।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১৭+১৮