এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৩+২৪

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৩+২৪
লেখিকা মালিহা খান

নিশিথীনির স্তব্দতা ফুঁড়ে প্রবল জলধারার ঝমঝম শব্দ এখন অবধি প্রবহমান।বৃষ্টি থামেনি।
বৃষ্টিমূখর ঝিমানো আবহাওয়ায়ও রাত্রির চোখে ঘুম নেই।বরং অস্থিরতায় কাঁতরাচ্ছে সে।উৎকন্ঠা,রুদ্ধশ্বাসে পার হচ্ছে প্রতিটি সেকেন্ড।বারবার ঘাম দিয়ে উঠছে শরীর।ওড়নার আচঁল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বামহাতটা ক্লান্ত।

তখন বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় দশটাই বেজে গেছিলো।রাতের খাবার রান্না করা ছিলোনা।গোসল সেড়ে,ভাত-তরকারি রান্না করে খেয়েদেয়ে সব গুছিয়ে বিছানায় আসতে আসতে প্রায় বারোটা বেজে গেছিলো।মায়ের সাথে গতপরশু কথা হয়েছে।গতকাল হয়নি,ফোনে টাকা ছিলোনা।আজ আগেভাগেই টাকা ভরে এনেছিল রাতে ফোন দিবে বলে।কিন্তু তখন ফোন হাতে নিয়ে দেখেছে মামার নাম্বার থেকেই পাঁচটা মিসকল।লাস্ট ফোনটা এসেছিলো ঘন্টাখানেক আগে।
সেই থেকে এখন রাত দুইটা পঁচিশ।এইযে ফোন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কল রিসিভই হচ্ছেনা।না জানি কোন বিপদ হয়েছে?মামা নামক লোকটার উপর একরত্তিও বিশ্বাস নেই।টাকার জন্য সব করতে পারে।একটা বিশ্রি মনমানসিকতার সর্বোত্তম উদাহরণ এই মামা।
রাত্রি আবার ফোন দিলো।রিং হয়ে একপর্যায়ে কেটে গেলো ফোন।দুশ্চিন্তায় মাথা ফেঁটে যাচ্ছে।ব্যাকুলতায় রগগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে বোধহয়।রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক।ফোন রেখে উঠে দাড়ালো রাত্রি।বারকয়েক এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করলো।মায়ের কিছু হলো নাতো?আল্লাহ সহায় হও।
রিং বাজলো গুনে গুনে আধঘন্টা পর।রাত্রি এলোমেলো হাতে কানে তুললো।শ্বাস গলায় আটকে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“হ্যালো?মা?”
ওপাশ থেকে মায়ের কন্ঠ শোনা গেলোনা।শোনা গেলো মামির রাগি কন্ঠ,
—“মা আইবো কোথ থেইকা?মা রে তো ফালায়া শহর চইড়া বেড়াইতেছো।যত বোঝা আমাদের ঘাড়ের উপর।”
রাত্রির মেজাজ বিগরে গেলো।
—“ফালতু কথা বলবেন না খবরদার।মা কোথায়?ফোন ধরছিলেননা কেনো?মা কে দিন আমি কথা বলবো।”
—“মাইয়া বানাইছে একটা বেয়াদব…”
—“চুপ করোতো..”মামার আবছা কন্ঠস্বর।ফোনটা বোধহয় মামির কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো।রাত্রি বুঝলো কিছু একটা তো হয়েছে।মামা কিছু বলার আগেই সে কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,”আমিতো বললাম মা কে দিন।দিচ্ছেননা কেনো?”
ওপাশ থেকে মামার আমতা আমতা শোনা গেলো।রাত্রি আবারো চিৎকার করতেই সে ধমকে বললো,
—“বুবু হাসপাতালে।একটু অসুস্থ হয়ে পড়ছে।ডাক্তাররা দেখতেছে।এত চিল্লাচিল্লির কি আছে..”
রাত্রি থমকে গেলো।চোখ দিয়ে পানি পড়লেও গলায় দরাজ ভাব,

—“কি হয়েছে মার?অসুস্থ নাকি আপনারা কিছু করেছেন?মামা,দেখুন ভালো হবেনা কিন্তু..”
—“আমরা কেন কিছু করমু?আমি তো আরো হাসপাতালে নিয়া আসলাম।এমনেই হাসপাতালের খরচ দিতে যাইয়া হিমশিম খাইতেছি,তোমাকে তহন এতবার ফোন দিলাম।কিছু টাকা পাঠাও।সব চিকিৎসার খরচ কি আমরাই দিমু নাকি?”
রাত্রি দাঁতে দাঁতে চেপে উওর দিলো,
—“আপনার টাকা দিতে হবেনা।আমিই দিবো সব।দয়া করে টাকার জন্য আবার হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আইসেন না।দোহাই লাগে।…মা কে দিন আমি কথা বলবো একটু..”
—“বুবু এখন কথা বলতে পারবোনা।জ্ঞান নাই।”পাশ থেকে কেউ একজন বললো,”আপনাদের না বললাম রক্তের ব্যবস্থা করতে।পেশেন্টের অবস্থা খারাপের দিকে।”
রাত্রি সজোরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“আমার মার কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়বোনা কিন্তু…।”

ওপাশ থেকে ফোন কেটে গেলো।হেঁচকি তুলে ফুঁপিয়ে উঠলো রাত্রি।আবার ফোন করে শুধু বললো,”দয়া করে সকাল পর্যন্ত একটু খেয়াল রাখেন মামা।আমি এখনি রওনা দিচ্ছি।আমি আসলে আপনার আর কিছু করতে হবেনা।দোহাই লাগে ততক্ষণ একটু খেয়াল রেখেন।”
রাত তখন তিনটা।।তার উপর বৃষ্টি।বাড়িভাড়ার জন্য রাখা পাঁচহাজার টাকা আলমারি থেকে বের করে ব্যাগে ভরলো রাত্রি।মাথায় শুধু চলছে মায়ের কাছে যেতে হবে।সে ছাড়া তার মাকে দেখার কেউ নেই।আর ওই লোকটার ভরসায় তো একদমই না।
কাপড় টাপরের ঝামেলা করলোনা।শুধু হ্যান্ডব্যাগে টাকা,ফোন নিয়ে গেট তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।বেল বাজালো বাড়িওয়ালার দরজায়।খুললো রাহেলা।চোখে ঘুম ঘুম প্রচন্ড বিরক্তিভাব।রাত্রিকে দেখেই তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো সে,
—“পাগল টাগল হইয়া গেসো তুমি?এতরাতে এমন পেরেশানির মানে কি?”
রাত্রি গায়ে মাখলোনা।বিনীত কন্ঠে বললো,”আন্টি আমি বের হবো।মেইন গেটের তালাটা খুলতে হবে।আংকেলকে বলুন একটু খুলে দিতে।”

—“পাগল হইসো?এই মাঝরাতে মাইয়া মানুষ একলা একলা কই যাইবা তুমি?”
—“মা খুব অসুস্থ আন্টি।মাত্র খবর পেলাম।এখনই রওনা দিতে হবে।চট্রগ্রাম দূরের রাস্তা।পৌছাতে খুব দেরি হবে।আপনি আংকেলকে ডেকে দিন।আমি উনার অনুমতি নিয়েই যাবো।”
—“তোমার আংকেল ঘুমে।শরীর ভালোনা উনার।তোমার এই রাতে যাওয়া লাগবোনা।সকালে যাইয়ো।এখন ঘরে যাওগা।”
বিনীত স্বর বদলে গেলো রাত্রির,”বলছিতো আমি এখনি যাবো।আপনি রহমান আংকেলকে ডাকুন না।”
রহমান সাহেবকে ডাকতে হলোনা।তিনি নিজেই উঠে এলেন।তিনি আসতেই যেনো একটু ভরসা পেলো রাত্রি।সব খুলে বলতেই রহমান সাহেব বললেন,
–আচ্ছা,চলো।তোমারে বাস স্টান্ডে পৌছায় দিয়াসি।একলা কেমনে যাইবা?চলো।”
রাহেলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।গরম কন্ঠে রহমান সাহেব কে বললো,”খবরদার তুমি বৃষ্টির মধ্য বাইর হইবানা।শরীর ভালোনা তোমার।এই মাইয়া কোন ঝামেলায় ফালাইবো কে জানে?গেট খুইলা দাও।যাওগ্গা।”
রহমান সাহেব আপত্তি করে কিছু একটা বলতে নিচ্ছিলেন।রাত্রি তাকে থামিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,”সমস্যা নেই আংকেল।আমি একাই পারবো।আপনি শুধু গেটটা খুলে দিন।দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
তিনটা পয়তাল্লিশ।

রিকশায় করে বাসস্ট্যান্ডে পৌছালো রাত্রি।ভাড়া মিটিয়ে মাথায় ছাতা ধরে ডুবো পানিতেই পা নামিয়ে দিলো।রহমান আংকেল ছাতা দিয়ে দিয়েছিলেন সঙ্গে।রিকশাও তিনিই ঠি ক করে দিয়েছিলেন।রাস্তা সুনসান।একটু দূরে কয়েকজনকে অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে বাসের জন্য।রাত্রির মুখে ভয়ের ছিঁটেফোটাও নেই।মাঝেমধ্য অবশ্য চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।তবে পানি গড়ানোর আগেই মুছে ফেলছে সে।ভেঙে পড়লে চলবে না।
কিছুদূর এগিয়ে টি কি ট কাটার জন্য কাউন্টারে যেতেই মাথা রীতিমত ঘুরে উঠলো।চট্রগ্রামের বাস নাকি আসতে দেরি হবে।ভোর পাঁচটার মতো বেজে যেতে পারে।এমনেই ঝড় বৃষ্টি তারউপর কোনো একটা কারণে বাস আটকা পড়েছে কোথাও।রাত্রি চুপচাপ সরে আসলো কাউন্টারের সামনে থেকে।একহাতে মাথা চেপে ধপ করে বসে পড়লো পাশের বেন্চিতে।এখন কি করবে?কিভাবে যাবে?এখানে অপেক্ষাই বা করবে কিভাবে?চরম অসহায়ত্বে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়লো।মাথা নিচু করে আশেপাশের সবার থেকে তা আড়াল করে নিলো।মানুষজন কাঁদতে দেখলে সুযোগ পেয়ে যাবে।দূর্বল ভেবে ফেলবে।

শেষমেষ নিরুপায় হয়ে নিভ্রানকে ফোন দিলো রাত্রি।এতক্ষণ নিভ্রানের কথা মাথায় আসলেও অযথা তাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছিলো না।নিজের কাজের জন্য অন্যকে বিরক্ত করা তার পছন্দ না।
প্রথববারেই রিসিভ হলো ফোন।ওপাশ থেকে নিভ্রানের আদরমাখা ঘুমজড়ানো কন্ঠ,
—“হ্যালো রাত,এত রাতে ফোন দিলে যে?তুমি ঠি ক আছো?”
রাত্রি ডুঁকরে উঠলো।শক্তপোক্ত মেয়ের আদলে লুকিয়ে থাকা মায়ের চিন্তায় বিধস্ত,ভাঙাচোরা মেয়েটা বেরিয়ে এলো।নিভ্রানের ঘুম ছুটে গেলো মুহুর্তেই।ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে,
—“কাঁদছো কেনো?কি হয়েছে?..রাত,কথা বলো।”
রাত্রি ভাঙা স্বরে বললো,”আপনি একটু বাসস্ট্যান্ডে আসতে পারবেন?”
—“বাসস্ট্যান্ডে?তুমি এতো রাতে ওখানে কেনো?হ্যালো?”
রাত্রির কান্না বেড়ে গেলো।এই মানুষটার সামনে নিজেকে লুকাতে পারেনা সে।
—“মা খুব অসুস্থ।বাড়ি যেতে হবে।এখানে বাস নেই।আমি..”

নিভ্রান পুরো কথা শুনলোনা।গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বললো,”আচ্ছা,আমি আসছি।কাঁদেনা,আমি আসছি।”
নিভ্রান পৌছালো খানিকবাদেই।ঝড়ের বেগে গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছে।রাত্রিকে সহি সালামত বেন্চির এককোণায় বসে থাকতে দেখেই বুকভরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে।রাত্রি জবুথবু হয়ে চুপচাপ বসে আছে ছাউনির নিচে।নিভ্রান কাছে গেলো।আশেপাশে দেখে নিয়ে হাত ধরে গাড়িতে নিয়ে বসালো।মেয়েটার চোখমুখ ফুলে আছে।নিভ্রান শ্বাস ফেললো।ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললো,
—“আমাকে আগে বলবা না রাত?এভাবে একা একা কেউ আসে?যদি কোনো বিপদ হয়ে যেতো?”
এই নরম স্বরের বিপরীতে নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা রাত্রি।এতক্ষনের সব কষ্ট যেনো এক ধাক্কায় বেরিয়ে এলো চোখ ফেটে।নিভ্রান একহাতে তাকে বুকে টেনে নিলো।রাত্রি তখনো কাঁদছে।এই একটা মানুষই তো আছে যার কাছে সে কাঁদতে পারে!
নিভ্রান অবাকচোখে ক্রন্দনরত মেয়েটার দিকে চেয়ে রয়েছে শুধু। চোখে বিস্ময়। রাত্রি হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার দমকে শ্বাস আটকে আটকে আসছে। কয়েকবার মুখ হা করে দম নিতে হচ্ছে। নিভ্রান বিহ্বল চোখে চেয়ে দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে এতোটা ভেঙে পড়তে দেখেনি কখনো। এমন পাগলের মতোকাদতে দেখেনি। রাত্রি আবারো মুখ হা করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলো। এবার তাকে বুক থেকে সরালো নিভ্রান।

গালে হাত রেখে চোখমুখ মুছিয়ে দিলো।লাভ হলোনা, পানি গড়িয়েই চলেছে।অবিশ্রাম, অনবরত।
রাত্রি থমকে থমকে বললো,”আ..আমার…মা..মাকে..ওরা..”উত্তেজনায় বাকিটা উচ্চারিত হলোনা।কন্ঠ আটকে গেলো।চিবুক উঁচিয়ে হেঁচকি তুললো সে।
নিভ্রান ফের চোখ মুছিয়ে দিলো। দু’গালে হাত রেখে মুখ বরাবর ঝুঁকে বোঝানোর মতো করে বললো,আচ্ছা ঠি কাছে,আমার কথাটা শুনো।এভাবে কাঁদলে হবে?বলেছিলাম না তোমাকে কান্না মানায় না।শান্ত হও,কাঁদেনা।দেখি।আর কাঁদেনা রাত,হয়েছে।”
রাত্রি মাথা নুয়ে ফেললো। থুতনির সাথে গলা ঠেকে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো সে। ভয়ে আৎকে উঠছে মন। কখন যেনো মামা ফোন করে খারাপ সংবাদ শোনায়। এই মাকে ঘিরেই তো তার যতো উথাল পাথাল। জীবনযুদ্ধের উত্তাল ঢেউয়ে সে তো মা নামক খুঁটি টাকে ধরেই আটকে আছে। মা না থাকলে আর কি নিয়ে বাঁচবে?
রাত্রিকে কিছুটা শান্ত হতে দেখে নিজেকেও ধাতস্থ করলো নিভ্রান। গাল থেকে হাত সরিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিলো। সিটবেল্ট বেঁধে দিলো। ততক্ষনে কান্নার শব্দ থেমেছে রাত্রির। চোখের মনি লাল। গোলাপি ঠোঁট ফুলে মনে হচ্ছে টোকা দিলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে।যেনো কোনো রক্তে ভেজা লাল পাপড়ি।

নিভ্রান স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।কোমলস্বরে বললো,
—“কি হয়েছে আন্টির?খুলে বলো।এভাবে কাঁদলে হবে?আমাকে বলতে হবে তো রে বাবা..”
রাত্রি ফোঁপানো কন্ঠে উওর দিলো,”মা..মা হসপিটালে।”
—“হসপিটালে কেনো? কি হয়েছে?”
—“আমি জানিনা। আমি..”কথা শেষ হলোনা। চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। পাপড়িগুচ্ছ ভিজে উঠছে আবারো।
নিভ্রান স্হির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পকেট থেকে ফোন বের করলো। সময় দেখলো।ড্ রাইভ করে চট্রগ্রাম পৌছাতে পৌছাতে কম করে হলেও পাঁচ-ছয় ঘন্টা লেগেই যাবে। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো সে। গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে ব্রেকে হাত চালাতে চালাতে বললো,
—“আচ্ছা ঠি কাছে,জানতে হবেনা।তুমি চুপ করে বসো।আমরা পৌছে যাবো সময়মতো।”
রাত্রি চোখ মুছলো।নাক টেনে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,”আপনাকে বিরক্ত করলাম।”
নিভ্রান আড়চোখে তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।দাঁতে দাঁত চেপে ঠান্ডা গলায় বললো,
—“কান্না না করলে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগাতাম গালে। আমি কি মারা গেছি? এমন একটা সময় একা না এসে আমাকে বলা যেতোনা? যদি কিছু হয়ে যেতো? খারাপ মানুষের অভাব আছে পৃথিবীতে? ফোন পেয়ে কিভাবে এসেছি তা শুধু আমি জানি।”
নিভ্রানের কন্ঠে তীব্র ক্ষোভ,চাপা অভিমান,প্রিয়জনের চিন্তায় অস্থির হওয়া প্রেমিকের হাহাকার।রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা।চুপটি করে বসে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো।কয়েকবার ফোন দিলো মামার নাম্বারে।ওপাশ থেকে রিসিভ হলোনা।
নিভ্রান লক্ষ্য করলো পুরোটাই। কিছু একটা ভেবে ভ্রু কুঁচকে বললো,

—“আন্টি না তোমার মামার বাসায় থাকেন?উনারা আছেনা সাথে?”
—“আছে।”
—“তবে?এত ভয় পাচ্ছো কেনো?”
রাত্রি ধীর গলায় উওর দিলো,
—“উনারা আছে দেখেই ভয় পাচ্ছি।”
—“মানে?”
কিছুক্ষণ চুপ!নিভ্রান উওরের অপেক্ষায়। রাত্রি মুখ তুলে কাতর চোখে তাকালো। একপলক সেই চোখে চোখ পড়তেই বাকিটা বুঝে ফেললো নিভ্রান। রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। আচমকাই করে বসলো এক অদ্ভুত আকুতি,”আমার হাতটা একটু ধরবেন প্লিজ?”
নিভ্রান থতমত খেলো।শূন্যচোখে তাকালো।উতলা অবিশ্বাস ঘন্টা বাজাচ্ছে।মেয়েটা কি সত্যিই নিজ থেকে হাত ধরতে বলছে?নিজের কানকে মিথ্যাবাদির তকমা লাগিয়ে দিয়ে ভ্রু উচিয়ে সে বললো,”হু?”
রাত্রি আবার বললো,”ধরুননা।”কন্ঠে কাতরতা,অধৈর্য আবদার,আদুরে মিনতি।
প্রেমানুভূতিরা সাদরে অভিবাদন জানিয়ে আলিঙ্গন করে গেলো। নিভ্রান হাসলো মনে মনে। আলতো করে রাত্রির ছোট্ট নরম হাতটা টেনে নিলো নিজের শক্তপোক্ত হাতের মধ্যিখানে। আঙ্গুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে ঠোঁটের কাছে এনে আচমকাই তপ্ত এক চুমু খেলো উল্টোপিঠে। বললো,

—“কিছু হবেনা রাত।”
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাত্রির চোখে ঘুম নেই। চাতক পাখির মতো সূদুর রাস্তার পানে চেয়ে আছে নির্ঘুম নয়ন। নিভ্রান একমহূর্ত বিরতি নেয়নি। গাড়ি থামায়নি। অবসন্ন হাত অবিরাম গাড়ির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে রাস্তার বাঁকে বাঁকে। বৃষ্টির সুরের তাল কেটেছে। আকাশের মেঘ ফুরিয়ে গেছে। জলপাতে বিঘ্ন ঘটেছে।
নিভ্রান দেখলো রাত্রির চোখে দীর্ঘকায় ক্লান্তি। মেয়েটা তবুও চোখের পাতা বুজতে নারাজ।
—“রাত,ঘুমাও একটু।পৌছাতে আরো অনেকক্ষণ।”
—“ঘুম আসছেনা।”বাইরের দিকে তাকিয়েই নির্বিকার উওর দিলো রাত্রি। কন্ঠই বলে দিচ্ছে সে কিছুতেই ঘুমাবেনা।নিভ্রান শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো পাগল এক সন্তানের মায়ের প্রতি অগাধ ভালবাসা।

হাসপাতালে পৌঁছালো সকাল ন’টা নাগাদ। এদিকের পথঘাট নিভ্রানের চেনা নেই। রাত্রি দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। মামাকে ফোনে পেয়েছিলো একবার। সদর হাসপাতালে এডমিট আছে তার মা। কেবিন নাম্বার জেনে নিয়েছিলো তখনই বিধায় খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি।
রাত্রির ডানহাত নিভ্রানের শক্তমুঠোয় আবদ্ধ। কেবিনের সামনে যেতেই মামা লিয়াকত হোসেনকে দেখা গেলো। সাতসকালে রাত্রিকে দেখে তিনি যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকলেও নিভ্রানকে তার পাশে দেখে মূহুর্তেই চেহারার আকার বদলে গেলো। কুন্চিত হয়ে গেলো চোখ। কাছাকাছি আসতেই বাঁকা গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
—“এ কে?”
রাত্রি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করলোনা। মানুষের উল্টো কথাবার্তাকে সে ইহজনমে দাম দেয়নি আর না এখন দিবে। নিভ্রানকে নিয়েও সে বিন্দুমাত্র বিচলিত না। কাঠকাঠ কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,
—“মা কেমন আছে? ভেতরে ঢোকা যাবে? ডাক্তার কি বলেছে? আর হয়েছিলো কি? আমি তো গতপরশুও কথা বললাম তখনতো দিব্যি ভালোমানুষ। একদিনে তো কেউ এত অসুস্থ হয়ে যায়না মামা?”
লিয়াকত হোসেন কপালের ভাঁজের পরত বাড়িয়ে বললেন,

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২১+২২

—“তুমি সঙ্গে পোলা মানুষ নিয়া আইসো কেন? এইসব কেমন বেহায়াপনা?”
—“যেটা বলেছি সেটার উওর দিন। কাকে নিয়ে এসেছি সেটা তো আপনার দেখার বিষয় না নিশ্চয়?”
লিয়াকত হোসেন দমে গেলেন। নিভ্রান তখন মনোযোগ দিয়ে ফোনে কাজ করছে। আজকে অফিসে যেতে পারবেনা। তাছাড়া সে যে রাতে বাসা থেকে বেরিয়েছে কেউ জানেনা। সময় নিয়ে নিশাদকে লম্বা টেক্সট করে ফোন নামালো সে। রাত্রির আর ভদ্রলোকের কথা কানে এসেছে। কিন্তু মাঝে একহাত বাড়িয়ে কথা বলেনি। সে জানে তার রাত একাই যথেষ্ট উল্টাপাল্টা মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য। রাত্রির কথার আকারে ইঙ্গিতে বোঝা হয়ে গেছে সামনের লোকটা অতি সম্মানীয় কেউ নন। সুতরাং শ্রদ্ধাভক্তির কোন মানে হয়না। কেবিন থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এলো।নিভ্রান তাকে থামিয়ে বললো,
—“এক্সকিউজ মি? এই কেবিনের পেশেন্টের সাথে দেখা করা যাবে?”

নার্স সম্মতি দিলো।বললো পেশেন্টের জ্ঞান নেই তবে ভেতরে গেলে সমস্যা হবেনা।নিভ্রান আলতো করে রাত্রির হাতে টান দিলো,
—“আসো,আন্টির কাছে চলো।”
রাত্রি নামানো গলায় বললো,”বাকি বিষয়ে পড়ে কথা বলছি মামা। আগে মা কে দেখে আসি।”
বলে একপা বাড়িয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো সে।ব্যাগ খুলতে খুলতে বললো,”কত টাকা খরচ হয়েছে আপনার?”
লিয়াকত সাহেব চড়া গলায় উওর দিলেন,”সাতহাজার গেছে।”
রাত্রি মনে মনে শ্বাস ফেললো। গোলমেলে চিন্তাযুক্ত শ্বাস। তবে বাইরে একেবারেই প্রকাশ পেলোনা কিছু। ব্যাগ থেকে পাঁচহাজার টাকা বের করে লিয়াকত সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্পষ্টভাষায় বললো,”বাকি দু’হাজার পরে দিবো।আমাকে রিসিপ্টটা দেখাবেন।আপনি আদৌ সত্যি বলছেন কিনা আমারতো তা জানা নেই।”
নিভ্রান শুধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে মত্ত হয়ে শুনলো তার প্রেয়সীরূপী শান্তশিষ্ট বাঘিনীটার তলোয়ারের মতো ধারালো শব্দবাচন।কে বলবে এই মেয়েটা কয়েকঘন্টা আগেও তার বুক ভাসিয়ে কাঁদছিলো?

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৫+২৬