এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৫+২৬

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৫+২৬
লেখিকা মালিহা খান

বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন রুবিনা। কপালে মোটা ব্যান্ডেজ। রাত্রি তার ক্যানেলা লাগানো হাত ধরে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ। নিশ্চিত বুঝতে পারছে মায়ের মাথার ভয়াবহ আঘাতটাই তার অসুস্থতার পেছনের রহস্য। আর এই কাজটা যে তার মামির দ্বারাই হয়েছে সে ব্যাপারেও শতভাগ নিশ্চিত।
এই জন্যই তার মামির দেখা নেই আশেপাশে।
নিভ্রান কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রাত্রি চোখ মেলে তাকালো। দৃষ্টিজোড়ায় রাজ্যের ক্লান্তি। নিভ্রান কাছে এসে আলতো করে মাথার উপর হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,

—“ডক্টরের সাথে কথা বলেছি রাত। আন্টির কন্ডিশন এখন যথেষ্ট স্টেবল। চিন্তার কিছু নেই। স্যালাইনটা শেষ হোক। তারপর ডক্টর এসে দেখে যাবে। চিন্তা করোনা।”
রাত্রি মাথা নাড়ালো। মুখ ফুটে কিছু না বললেও নিভ্রান সহজেই বুঝতে পারছে মেয়েটার মাথাভর্তি চিন্তা। একয়দিনে এতটুকু অনন্ত চিনেছে সে যে রাত্রি মরে গেলেও মুখ ফুটে কিচ্ছু বলবেনা। মাথা থেকে হাত সরিয়ে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলো সে। আলতো করে রাত্রির হাত টেনে মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো,”রাখো।”
রাত্রি চকিতে তাকালো। হাতের মধ্য মোটাসোটা ওয়ালেট। নিভ্রান হাত সহ মুঠ করে রেখেছে বিধায় ফিরিয়ে দেয়ার উপায় নেই। আমতাআমতা করলো। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠ তার,”লাগবেনা..”
নিভ্রান স্নান হাসলো। একটু ঝুঁকে কানের পিছে চুল গুঁজে দিতে দিতে মোলায়েম স্বরে বললো,
—“এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা রাত। বসো,আমি খাবার নিয়ে আসি। কিছু খাওনি। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।”
—“কিন্তু…”
—“চুপ,বসো। কি খাবা? আমি নিয়ে আসি।”
রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। মানুষটা কিভাবে পারে?
নিভ্রান হাসলো। ফিচেল গলায় বললো,
—“আচ্ছা বলা লাগবেনা। আর হসপিটালের বাদবাকি সব বিল দিয়ে দিয়েছি। শুধু তোমার মামার টাকাটা দিয়ে দিও। উনার চাহনীটা আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।”
রাত্রি চোখ পাকিয়ে তাকালো।লোকটা এমন একটা অবস্থায়ও মজা করছে?কিভাবে পারে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুবিনার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ মেলে মেয়েকে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখে যেনো আত্না জুড়িয়ে গেলো তার।
মা কে চোখ খুলতে দেখে মুখে হাসির ঝলক খেলে গেলো রাত্রির। ফ্যাকাশে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রাতভর নির্ঘুম থাকার ক্লান্তি যেনো নিমিষেই কেটে গেলো। ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হাতেই রাত্রির মাথা টেনে কপালে চুমু খেলো সে। রাত্রি মিষ্টি করে হাসলো।
—“এখন ভালো লাগছে মা?
রুবিনা নিষ্প্রান স্বরে বললো,
—“তুই কখন আসলি? তোর মামা ফোন দিয়েছিলো?”
—“হু,উনার তো আছেই এককথা।টাকা টাকা টাকা।”
—“এভাবে বলেনা মা..”
রুবিনা আরো কিছু বলবে তার আগেই নিভ্রান ঢুকলো। হাতে খাবারের প্যাকেট। রুবিনাকে সজাগ দেখে বিনয়ী স্বরে সালাম দিলো সে। রুবিনা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলো। রাত্রি একপলক নিভ্রানের দিকে তাকালো। অত:পর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
—“আমার বন্ধু।”
রুবিনা ভ্রু কুঁচকালো। চোখের মনি সরু। ঠোঁটের আগায় গভীর প্রশ্ন। এত বড় ছেলেটা তার মেয়ের বন্ধু?রাত্রি তো এর থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে।

মায়ের না বলা সন্দেহপ্রবণ প্রশ্নগুলো সহজেই বুঝলো রাত্রি। গলা ঝাড়লো সে,”খুব ভালো বন্ধু মা। রাতের বেলা যখন তোমার খবর পেলাম তখন বাস পাইনি তাই উনি গাড়ি করে নিয়ে এসেছেন।”
রুবিনার মনের প্রশ্ন পরিষ্কার না হলেও থেমে গেলেন উনি। মেয়ের ওপর যথেষ্ট ভরসা আছে। আবেগ অনুভূতিতে গা ভাসিয়ে দেয়ার মতো মনমানসিকতা তার মেয়ের কোনোকালেই ছিলোনা।
নিভ্রান নিজেই এগিয়ে এলো এবার। প্যাকেট গুলো রাত্রির হাতে ধরিয়ে অমায়িক হেসে বললো,
—“এখন কেমন আছেন আন্টি?”
জবাবে রুবিনাও হাসলেন। ছেলেটার হাসিটা খুব আন্তরিক। হাবভাবে প্রাপ্তবয়স্কের একটা গভীর ছাপ আছে। মায়া কন্ঠে তিনি উওর দিলেন,
—“ভালো বাবা।”
রাত্রি তখনো খাবারের প্যাকেট খুলেনি দেখে নিভ্রান নিজেই টেনে নিলো। পলিথিন থেকে ভেজিটেবল রোলের প্যাকেট বের করলো। মোড়ানো কাগজ খুলে মুখের সামনে ধরে বললো,”হা করো।”
রাত্রি হা করলোনা। খানিক আপত্তি করতেই নিরবে চোখ রাঙালো সে।অর্থ,”এখন হা না করলে আমি ধমকাতে বাধ্য হবো।”
রাত্রি মুখ খুললো। এককামড় খেয়ে চিবাতে চিবাতেই রুবিনার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“আপনার মেয়ে একদম নিজের খেয়াল রাখে না আন্টি।”
রুবিনা আবারো হাসলো। একরাশ প্রশান্তি নিয়ে চেয়ে রইলো সুন্দর মূহুর্তটায়। ছেলেটার এভাবে যত্নের সহীত খাইয়ে দেয়া, একটুপর পর কপালের চুল সরিয়ে দেয়া, থুতনির নিচে হাত পেতে পরে যাওয়া খাবার মুখে তুলে দেয়া সব কি শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে?

মামির দিকে তীক্ষ্ণ চাহনীতে চেয়ে রয়েছে রাত্রি। চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ,শাণিত। সেই ধারেই যেনো সামনের মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। রাত্রির মামি লিমা। মধ্যবয়স্ক মহিলা। পেঁচানো মস্তিষ্কের অধিকারীনী।
রুবিনা তখন বেডসাইডে হেলান দিয়ে নতবদনে চেয়ে রয়েছে। তার পাশেই রাত্রি। মেয়ের স্বভাব চরিত্র চেনা আছে। এত সহজে সে লিমা কে ছেড়ে দিবেনা কখনোই। নিভ্রান তার কাছ ঘেঁষেই দাড়িয়ে আছে। রাত্রি প্রশ্ন ছুড়লো,
—“ডাক্তার বলেছে আপনারা যখন মাকে এনেছেন তখন মায়ের মাথায় গুরুতর আঘাত ছিলো। রক্তক্ষরণের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারতো। আমার প্রশ্ন সেই আঘাতটা মা পেলো কিভাবে?”
লিমার দৃষ্টি অস্থির। চোর ধরা পরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। অগোছালো স্বরে বললেন তিনি,
—“কলপারে পরে গেসিলো। অসাবধানতায়…”
—“ধাক্কাটা নিশ্চয়ই আপনিই দিয়েছিলেন মামি?”

রাত্রির সরাসরি প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো লিমা। আমতা আমতা করে বললো,”আমি কেনো দিমু?”
হুঁশ হারিয়ে ফেললো রাত্রি। বসা থেকে দাড়িয়ে সজোরে চিৎকার করে উঠলো,
—“আপনারা কি মানুষ? একজন বয়স্ক মহিলা নিরুপায় হয়ে আপনাদের বাসায় থাকে। কিভাবে পারেন এমন আচরণ করতে? যদি মার কিছু হয়ে যেতো? আপনার তো আপন বোন মামা। আপনি কিভাবে পারেন? একটু মায়া হয়না?”
রুবিনা মৃদু স্বরে তার হাতে টান দিলো,”রাত মা, চুপ কর।”
—“কেনো চুপ করবো মা? এরকম চলতে থাকলে তো উনারা তোমাকে একদিন মেরেই ফেলবে। তারপর বলবে ভুলে মেরে ফেলেছি। আর আপনারা, মা তো আপনাদের কাছে বিনা পয়সায় থাকেনা মামা। আমাদের বাসা বিক্রির টাকা দিয়ে বাবার ঋন শোধ করার পর বাদবাকি টাকা তো ব্যাংকে আছে। মাসে মাসে সেখান থেকে তো টাকা পান আপনারা। সেটা দিয়েই তো মায়ের প্রয়োজন মিলে যায়। বাড়তি প্রয়োজন হলে আমি পাঠিয়ে দেই। শুধু বাসায় থাকে বলে এতো সমস্যা আপনাদের? আমি তো বলেছি ভার্সিটি টা শেষ হলেই মাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো। ততদিন পর্যন্তও একটু অপেক্ষা করতে পারবেন না? এত পাষাণ কেনো আপনারা? কেনো এতো বিবেকহীন?”
লিমা যেনো সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো।সুযোগ বুঝেই সে বললো,
—“তোমার মা রে আমরা আর রাখতে পারুমনা। আমাদের ই ঝামেলার শেষ নেই। উনার দুইদিন পরপর অসুখ আর পোহানোর ক্ষমতা নাই আমার।মা রে পারলে এহনই নিয়া যাওগা।”

লিয়াকত হোসেন চুপচাপ দাড়িয়ে আছেন। তার নিরবতাই বলে দিচ্ছে স্ত্রীর সাথে সে শতভাগ সহমত।
রাত্রি ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো,”আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি দেখিনি মামী।”এরইমাঝে একজন ডাক্তার উঁকি দিলো কেবিনে।একনজর দেখে বললো,”এটা হাসপাতাল,চিৎকার চেঁচামেচির জায়গা নয়।অন্যদের সমস্যা হচ্ছে।”
উনি চলে যেতেই নিভ্রান মুখ খুললো এবার,
—“আপনাদের আর রাখতে হবেনা। আন্টিকে রিলিজ দিলেই আমরা তাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো। ফাইন?”
লিয়াকত হোসেন তাচ্ছিল্য করে বললেন,তোমার মাইয়া নতুন নাগর জুটাইছে বুবু। তার তাগদেইতো এতো দেমাগ ঝরতেছে।”
রাত্রি চোখ জ্বলে উঠলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠলো সে,”খবরদার মামা! উনাকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবেন না। আপনারা উনার..”অতিরিক্ত চাপ আর নিতে না পেরে কথা মাঝেই আটকে গেলো। মূর্ছা গেলো রাত্রি। শরীর অসাড় হয়ে লুটিয়ে পরলো রুবিনার কোলের উপর।
নিভ্রান একমূহুর্ত দেরি না করে আলতো করে তাকে উঠিয়ে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো।দু’হাতে আগলে ধরে মামা-মামীর দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“আর একটা কথা বললে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো আপনারা বয়সে কত বড় বা সম্পর্কে কি হন।”
ঘটা করে সন্ধ্যা নেমেছে। পৃথিবীর চরণে মাথা ঠেকিয়েছে সূর্য। ঘনালি অন্ধকার শূণ্য গগনে। পাখিরা নীড়ে ফিরে গেছে। স্তব্দ পৃথিবীর নিস্তব্ধ আড়ালে কেউ হয়তো মত্ত হয়ে প্রহর গুনছে তোমাকে কাছে পাওয়ার।

ঘরটা অন্ধকার। বাতি নিভানো। হাসপাতালের চিরচেনা স্যাভলনের গন্ধ ছাপিয়ে কৃত্রিম এয়ার কন্ডিশনারের মিষ্টি ফুলেল ঘ্রান। রাত্রি আবছা অল্প চোখ মেললো। পিটপিট করলো। ঘন গুমোট ছাড়া কিছুই কালো কর্ণিয়ায় দৃষ্টিগোচর হলোনা। অতিদীর্ঘ ঘুমের রেশটা কাটতে বেশ সময় লাগলো। নড়চড়হীন পার হলো দু-তিনমিনিট। একটু সজাগ হয়ে উঠতেই টনক নড়লো। থতমত খেয়ে গেলো সে। অনুভব করতে পারছে। তার কাঁধের পাশের বালিশে মুখ গুঁজে তার উপরই উপুর হয়ে শুয়ে আছে একজন। মানুষটার হাতের গাঢ় চাপেই নরম বিছানার সাথে লেপ্টানো বামহাতটা। আর ডানহাতটা এতক্ষণ ঘুমের মধ্যেও মানুষটার বিশাল পিঠের মাঝখানটায় খুব যত্নে আঁকড়ে ধরেছে রয়েছে। কয়েকসেকেন্ড অতিবাহিত হলো একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুভূতিতে। রাত্রি মাথা কাত করার চেষ্টা করলো। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে লেগে জ্বলে উঠলো তুলতুলে গাল। মুখ দিয়ে বের হলো চাপা আর্তনাদ,”উহ্।”
নিভ্রান দ্রুত মুখ তুললো। নামমাত্র দুরত্ব। দু’নাকের ডগা ছুঁইছুঁই। চোখে চোখ পড়েছে কিনা স্পষ্ট নয়। স্তুপাকার তীব্র অন্ধকারে একটা ফোঁটা বিন্দুও দৃশ্যমান না।
নিভ্রান আবারো মুখ ডুবালো কাঁধে। দেহ নি:সাড়।
পিঠের হাতটা সরিয়ে ঘাড়ের ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের উপর রাখলো রাত্রি। যত্নমেখে বললো,

—“কি হয়েছে?”
নিভ্রান মুখ তুললোনা। কথা যেন কানে যায়নি। রাত্রি চিন্তিত ভঙ্গিতে চুলে হাত বুলাল,”কি হলো?”
নিভ্রান বিছানার চেপে রাখা হাতের জোর বাড়িতে দিলো। রাত্রি হকচকালো। কি হলো লোকটার? রেগে আছে নাকি?
নিভ্রান মুখ গুঁজেই ধীরকন্ঠে বললো,
—“মেন্টাল স্ট্রেস, খাওয়া দাওয়ায় চরম অনিয়ম, বিপি হাই ..এসবের মানে কি?”
রাত্রি গাল ঘুরালো। এবার দাড়িতে খোঁচা খেলেও শব্দ করেনি। মিনমিনে গলার স্বর,”জি?”
নিভ্রান মুখ তুললো। সরাসরি চোখে চোখ রাখলো বোধহয়। রাত্রি বুঝতে পারছে। একজোড়া নিমগ্ন চোখ হয়তো আকন্ঠ তৃষ্ণায় ডুবে স্হির চেয়ে রয়েছে। খুব খুব গভীর সেই দৃষ্টি, সেই গভীরতায় হয়তো ডুবা সম্ভব না। না তা পরিমাপ করা সম্ভব তার ছোট্ট মনের অপরিপক্ক স্কেলে।
নিভ্রান হঠাৎই কপালে কপাল ঠেকালো। অন্যরকম টানটান কন্ঠে বললো,
—“আমি যদি তোমাকে আজকেই বিয়ে করি তবে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে রাত?”
রাত্রি যেনো আচানক কথাটা সামলে উঠতে পারলোনা। কেমন চিনচিনে একটা অনুভূতি শিরায়- উপশিরায় ছিঁটকে পড়লো। মাথার ভোঁতা যন্ত্রনাটা চড়ে উঠলো। তবু কোথায় যেনো একটা খুব শান্তি। কোথায় যেনো এক আকাশ প্রশান্তি। হাতছানি দিয়ে ডাকছে আদরকন্যা। নিভ্রান চোখ বন্ধ করলো। আবার বললো,
—“আপত্তি আছে?” কন্ঠের টানটান ভাবটা এবার একটু মৃত। বুক চিড়ে আসা যন্ত্রনাটা বিদ্রুপ করলো হয়তোবা।
রাত্রি হাসলো। শব্দহীন। সব ছাপিয়ে আলতো করে হাত রাখলো নিভ্রানের দু’গালে। কপালে কপালের ঠেকানোটা আরো একটু দৃঢ় করে বললো,

—“আজই?”
—“এক্ষুণি।”
—“এক্ষুণি?”
—“হু।”
—“মা?”
—“জানে।”
—“বাকি সবাই?”
—“জানে।”
—“সবাই জানে?”
—“সবাই।”
রাত্রি হেসে ফেললো। হাসিতে কেমন যেনো ছন্নছাড়া ভাব। পিছুটান নেই। মুক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপটানোর আভাস। জীবনে তো কতো কিছুই হুটহাট হয়ে যায়। এবার নাহয় একটু স্বার্থপর হয়ে গেলো। অন্যসব চিন্তাভাবনা ক্ষণিকের জন্য ভুলিয়ে দিলো। নামহীন অনুভূতিকে নাম দিয়ে দিলো। কি হবে বড়জোড়? কি ই-বা হবে?
নিভ্রান অন্ধকারেই যেনো সেই হাসি ছুঁয়ে ফেললো। অনুভব করে নিলো। মনে মনে তাল মিলিয়ে হেসেও নিলো খুবক্ষণ। তবে মুখে বললো,”আছে আপত্তি?”
রাত্রি হাসি থামালো,”থাকলে?”

—“জোর করবোনা।”
—“কেন করবেননা?”
—“হু?”
রাত্রি চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। তম্রসারা কি যেনো করে গেলো। খুব নিরিবিলিতে কি যেনো একটা ঘটে গেলো হঠাৎই, খুব আকস্মিক। রাত্রি আদুরে গলায় উওর দিলো,
—“নেই।”
—“নেই?”
—“নেইতো।”
চেপে রাখা হাত ছেড়ে দিলো নিভ্রান। উঠে গেলো উপর থেকে। পাশের সুইচ টিপে লাইট জ্বেলে দিলো। রাত্রি সইতে না পেরে চোখ খিঁচে ফেললো। হাত দিয়ে দৃষ্টি আড়াল করলো। উঠে বসার শক্তি নেই শরীরে। কেমন কমজোর লাগছে। একহাতে চুল খামছে ধরলো সে,
—“আমাকে কি ইনজেকশন টি নজেকশন দিয়েছেন নাকি? এমন লাগছে কেনো? মাথা ধরে আছে। উফ!”
—“ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে ডক্টর। কতো দূর্বল তুমি জানো? খেয়াল তে থাকেনা কোনোদিকে।”বলতে বলতে তাকে দু’হাতে ধরে উঠিয়ে বেডসাইডে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো নিভ্রান। পাশের টেবিল থেকে ঘোলাটে স্যালাইন পানি তুলে নিলো হাতে। ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে বললো,”হা।”
—“আমি অসুস্থ না তো। এসব কেনো?”
—“অসুস্থ না তুমি? ডাক্তার তাহলে কাকে গাদা গাদা ওষুধ প্রেসক্রাইব করলো? আমাকে?”
—“ডাক্তাররা তো ওসব করেই। সব টাকার ধান্দা। আপনাকে দেখেছে বড়লোক মানুষ। চেহারা সুরতে আভিজাত্য,ব্যস ধরিয়ে দিয়েছে ওষুধপত্র।”
—“চুপ, হা করতে বলেছি।”
স্যালাইনটুকো একনিশ্বাসে শেষ করিয়ে গ্লাস নামালো নিভ্রান। ঠোঁট মুছিয়ে দিতেই রাত্রি বললো,
—“মা কোথায়?”
—“আছে।”
—“একা তো। ওখানে যাই।”

নিভ্রান কিছু বলবে তার আগেই দরজায় খটখট। রাত্রি চমকে উঠলো। তাকালো দরজার দিকে। দরজা হাল্কা ফাঁক করে নিশাদ উঁকি দিলো। একপলক রাত্রিকে দেখেই সালাম দেয়ার ভঙ্গি করলো। রাত্রি হতভম্ব। চোখে হাজারখানেক প্রশ্ন। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি। নিশাদ ফিচেল গলায় হাসলো। নিভ্রানের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে ব্যাঙ্গ করে বললো,
—“তোর আজও আপুকে মানানো হবে নাকি আমি কাজি সাহেবকে নিয়ে চললাম।”
নিভ্রান আজ আর ধমকালোনা। বরং হাসি হাসি কন্ঠে বললো,
—“মেনে গেছে তোর আপু। আসছি যা।”
সে বিনাবাক্য চাপা হেসে দরজা ভিড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। রাত্রি হতবাকে কিৎকর্তব্যবিমূঢ়।
—“আপনি কি পাগল? ভাইয়া কোথা থেকে এলো? হসপিটালে কাজি,বিয়ে…কিভাবে?”
নিভ্রান হাসলো শুধু। রাত্রির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,”দাড়াতে পারবে? হাতটা ধরো।”
মায়ের কেবিনে যেতেই আরো একদফা অবাক হলো রাত্রি। একদফা বললে ভুল হবে বরং কয়েকদফা অবাক হলো এবং হতেই থাকলো অবিশ্রাম। নিশাদ, নাহিদা, নওশাদ সাহেব সবাই আছেন এই কেবিনে। কাজি সাহেব বসে আছেন প্রস্তুত হয়ে। মামা- মামিকে আশেপাশে দেখা গেলোনা। সবাইকে সালাম দিয়ে মায়ের কাছে যেয়ে বসলো সে। চোখের থমকানো ভাবটা কাটেনি এখন অবধি। নিভ্রান সজোরে চাঁটি মারলো নিশাদের মাথায়,

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৩+২৪

—“এই গাধাটাতে বলেছিলাম আমার কাবার্ডে রাখা বিয়ের শাড়িটা মনে করে নিয়ে আসতে। গাধাটা ভুলে বসে আছে।”
নিশাদ মাথা ডললো। তবে মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে বললো,”কথা দিচ্ছি আপু, আপনাকে আমি নিজে গুনে গুনে দশটা বিয়ের শাড়ি কিনে একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজদায়িত্বে দশবার বিয়ে দিবো। মানে ভাইয়ার সাথেই আরকি। এবার শুধু একটু এভাবেই ম্যানেজ করে নিন।”
রাত্রি ঠোঁট কোঁণ প্রসারিত করে হাসলো। মায়ের দিকে একবার তাকাতেই সে চোখের পাতা নামিয়ে সম্মতিসূচক বার্তা দিয়েছে। আর কোনো বাঁধা নেই বিধায় আপত্তি করার মতো কিছু পেলোনা। নাহিদার মুখে বিস্তর হাসি। যাক অবশেষে!
নওশাদ সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন,”শুরু করুক তাহলে। ডাক্তাররা এসে আবার কখন ঝামেলা করে।”
নিভ্রান চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,”করবেনা। ম্যানেজ করা আছে সবাইকে।”

রাত্রি তখন মাথা নিচু করে সবটা হজম করার চেষ্টায় অব্যাহত। গালে অজান্তেই লালাভ আভা। তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? সত্যি সত্যি?
বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যই। আচমকা, হুট করেই। কবুল বলার সময়েও রাত্রির মনে হচ্ছিলো এখনই বুঝি ঘুমটা ভেঙে যাবে। উঠে দেখবে চিরচেনা বিষাক্ত পৃথিবীর ছোবলে তার মধুর সপ্নটা রক্তাত্ব হয়ে গেছে। কিন্তু এরকম কিছুই হলোনা। সপ্নটা ভাঙলো না বরং জন্ম দিলো আরো হাজারখানেক নতুন সপ্নের।
আকাশে মেঘ ডাকছে তখন। গুড়ুম গুড়ুম। সাদা মেঘের গুচ্ছ হাততালি দিচ্ছে যেনো। প্রাণ উজার করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে। নিভ্রান খুব গোপনে রাত্রির কানের কাছে ফিসফিস করলো,
—“দেখো রাত, আজ বৃষ্টি নামবে।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৭+২৮