এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৭+২৮

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৭+২৮
লেখিকা মালিহা খান

বৃষ্টি নেমে গেছে সময়মতো। প্রকৃতি ভিজছে। ভিজতে ভিজতে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে গাছের ডালে ডালে।অনিলের আক্রমনে তিরতির করে কাঁপছে চকচকে সবুজ পাতা। মেঘবালিকার অবশ্য কোনোদিকে খেয়াল নেই। সে তখন ঘুমে বিভোর। চলন্ত গাড়ির বেগে মাথাটা বারবার কাত হয়ে জানালায় ঠেকে যাচ্ছে। নিভ্রান একহাতে ড্রাইভ করছে। তার আরেকহাত ব্যস্ত স্ত্রীর পড়ে যাওয়া মাথা সোজা করে দিতে। জানালা খোলা। মেয়েটার মাথাটা সোজা থাকছেইনা। বারবার ঠুকে যাচ্ছে জানালায়। অবশ্য এতে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছেনা বলেই স্বস্তি। ঘুম ভাঙার কথাও না। নিভ্রান নিজহাতে রাতের খাবারের পর কয়েকটা ওষুধের ফাঁকে একটা আস্ত ঘুমের ট্যাবলেটও খাইয়ে দিয়েছিলো। এই ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল।

জানালার কাঁচ নামানো। তালমাতাল হাওয়া। পিছের সিটে বসে আছে নিশাদ। মুখের উপর জ্বলছে ফোনের আলো। রুবিনা, নাহিদা, নওশাদ সাহেব অন্য গাড়িতে আসছেন। এক গাড়িতে তো এত মানুষের জায়গা হবেনা। নিভ্রান অবশ্য রুবিনাকে এ গাড়িতেই আনতে চেয়েছিলো কিন্তু নওশাদ সাহেবের নাকি নিভ্রানের উপর একরত্তি বিশ্বাস নেই। সে নাকি রাত্রির খেয়াল রাখতে পারবেনা। মেয়েটার শরীর অসুস্থ। সে রাগের বশে কখন কি করে ঠি ক নেই। তাই নিশাদকে পাঠিয়েছে সাথে। উল্টোপাল্টা কিছু হলেও যেনো নিশাদ সামলাতে পারে। আর রুবিনার খেয়াল রাখার জন্য ওখানে নাহিদা আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাত্রির মাথাটা এবার বেশ জোরেসোরেই বারি খেলো। নিভ্রান টার্ন নিচ্ছিলো বিধায় খেয়াল করতে পারেনি।
নিশাদ গর্জে উঠলো,”বাবা তো ঠি ক ই বলেছে। ভাবির মাথা তো আজ ঠুকতে ঠুকতেই ফেটে যাবে। তুই তো বিয়ে করেই বউয়ের মাথা ফাটিয়ে রীতিমত হসপিটালে ভর্তি করবি। বুক নাই তোর? হ্যাঁ? বুক নাই? বুক ছাড়া মানুষ তুই?”
নিভ্রান ভ্রু কুঁচকালো। ঘাড় ফিরিয়ে নিশাদকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলো। নিশাদ তখনো কটমটে চোখে চেয়ে রয়েছে। রাত্রির দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েটা নেতিয়ে আছে। গাড়ির স্পিড স্লো করলো সে। হাত বাড়িয়ে আলতো করে মাথাটা টেনে নিলো বুকে। গায়ের ওড়না গুছিয়ে দিলো। ঘুমে অচেতন রাত্রিও কিভাবে যেনো টের পেলো প্রিয় মানুষটার উষ্ণতা। তন্দ্রাঘোরেও সে কেমন করে যেনো গুটিয়ে গেলো বুকের মাঝে।
নিশাদ চোখ নামালো। মিটিমিটি হেসে বললো,
—“তুই তো বেশ নির্লজ্জ হয়ে গেছিস ভাই। এবার আমাকেও নির্লজ্জ হওয়ার সুযোগ করে দে।”
নিভ্রান হাসলো। বাবার সাথে মাত্রাতিরিক্ত রেশারেশি হলেও ভাইয়ের সাথে তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। একেবারে অচেনা, ছেলেমানুষী রুপটা কেবল নিশাদের সামনেই প্রকাশ পায়।
রাত্রির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে ঠাট্টার সুরে বললো,

—“দিবো এক থাপ্পড়। সারাদিন তো বাবার আদেশে উঠানামা করতে করতেই তোর কোমড় বেঁকে যায়। বিয়ে করে বউকে কোলে নেয়ার আগে দেখবি বাবা তোকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,”ওরে, আমার একমাত্র সোনার টুকরো ছেলেটা। বাবার কোল ছেড়ে কোথাও যেওনা।”
নিশাদ হাসলো। তবে এই হাসিতে কেমন যেনো একটা মন খারাপের আভাস, তিক্ততার ছোঁয়া। নিভ্রান না বললেও সে বুঝে যে নিভ্রানের একটা চাপা অভিমান আছে বাবার উপর। সে ভাবে বাবা হয়তো তাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। সেবার ঝগড়াঝাটির রেশ ধরে বাবা যখন ব্যবসার সব দায়িত্ব নিশাদকে দিয়ে দিলো তখন থেকেই কেমন যেনো নিজেকে গুটিয়ে একা করে ফেললো সে। আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করলো। তারপর থেকে শুধু দুরত্ব আর দুরত্ব।

—“আমি বাবার একমাত্র ছেলে না ভাই। তুই কেনো বুঝিস না বাবা তোকেও সমান ভালোবাসে।”
—“তুই নিজেও জানিস তুই মিথ্যা বলছিস নিশাদ।”
নিভ্রানের কন্ঠটা এতোটাই গম্ভীর,ব্যাথাময় ছিলো যে বয়ে যাওয়া বাতাস গুলাও বুঝি থমকে গেলো। পরিবেশটাও কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো। নিভ্রান সহজেই ধরে ফেললো ব্যাপারটা। চন্চল নিশাদও তখন একদম চুপচাপ।
ড্রাইভ করতে করতেই নিভ্রান বুঝলো যতবার ভেজা দমকা হাওয়া শরীর ছুচ্ছে ঠি ক ততবারই রাত্রি থরথর করে কেঁপে উঠছে। তার সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। নিভ্রান নিজের পাশের কাঁচটা সুইচ টিপে উঠিয়ে দিলো। নরম গলায় ডাকলো,
—“নিশাদ।”
—“হুম?”
—“ওপাশের কাঁচটা একটু তুলে দে তো ভাই। ওর শীত করছে বোধহয়। কিভাবে কাঁপছে দেখ।”
নিশাদ হেসে ফেললো আবারো। সামনে ঝুঁকে জানালা লাগিয়ে দিলো,
—“তুই কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারবি,আমি কখনো ভাবিনি ভাই।”
নিভ্রান একনজর রাত্রির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে আবিষ্ট কন্ঠে উওর দিলো,”আমিও ভাবিনি।”

ভোরের আলো যখন প্রায় ফুরিয়ে গেছে। আকাশ থেকে ঝিঁমানো মেঘ ছুটি নিয়ে তেজি সূর্যের আবির্ভাব ঘটছে। তখনই অবিরাম চলতে থাকা গাড়ির ঘূর্ণায়মান চাকাটা রেহাই পেলো। গাড়ি থামলো নিভ্রানের বাসার গেটে। সিটবেল্ট খুলতে খুলতেই নওশাদ সাহেবদের গাড়ি পেছনে এসে দাড়ালো। এতো তড়িঘড়ি করে ঢাকায় ফেরার কারণ হলো রুবিনাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছিলো সন্ধ্যার পরই। শুধু মাথার ক্ষতটায় ড্রেসিং করতে হবে রোজ আর কিছু ওষুধপত্র। ওখানে নিভ্রানের চেনা পরিচিত কেউ থাকেনা। আর রাত্রির মামার বাসায় থাকার তো প্রশ্নই উঠেনা। তাই হোটেল টোটেলের ঝামেলা না করে আজই ফিরে আসলো। নিভ্রান বলে দিয়েছে রুবিনা তার ফ্ল্যাটেই থাকবে রাত্রির সাথে। রাত্রি অবশ্য আপত্তি করেছিলো কিন্তু নিভ্রান তাকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছে তখন। বলেছে,”তার সাথেও এখন রুবিনার একটা সম্পর্ক আছে। রাত্রি যেনো নাক না গলায়।”

নিশাদ গাড়ি থেকে বেরোতেই নওশাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,” মেয়েটা ঠি ক আছেতো?” নিশাদ উওর দেবার আগেই নিভ্রান দরজা খুললো। নওশাদ সাহেব এগিয়ে গেলেন। রাত্রিকে নিভ্রানের বুকের মাঝে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। চাপা লজ্জা পেলো নিভ্রানও। তবে রাত্রিকে ছাড়লোনা। একপলক চোখাচোখি হলো। নিভ্রান দৃষ্টি নামিয়ে গাঢ় কন্ঠে বললো,”নামতে তো দিবেন?”
নওশাদ সাহেব সরলেন না। বরং রাত্রির কপালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে আৎকে উঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
—“গা টা গরম হয়ে আছে দেখছি। খালি তো পারো পাগলামি করতে। কে অসুস্থ কে সুস্থ সেটা দেখার তো সময় নেই। বলেছিলাম ঘুমের ওষুধ পুরোটা দিও না। ভেঙে দাও। একটা আস্ত পাওয়ারফুল ট্যাবলেট এইটুকুন মেয়েটার সহ্য হবে?”
নিভ্রান চোখ বুজলো। রাগ সংবরণ করলো। এই মানুষটা আর পারেই বা কি? ওর ভুল ধরতে পারা ছাড়া?
সে নিজের ইচ্ছায় রাতকে ওষুধ দিয়েছে? ডাক্তার ই তো বলেছে পুরোটা খাওয়াতে। রাত্রি যত স্ট্রেস ছাড়া আরামে ঘুমাবে ততই ভালো। তবে মুখে এসব কিছুই বলা হলোনা। শুধু বললো,

—“সরুন। নামতে দিন।”
নওশাদ সাহেব চেঁতে উঠলেন,পারো কি শুধু একরোখাপনা ছাড়া? সারাটাদিন পুরো ওলোট পালট করে বিয়ে করলে। মেয়েটার উপর দিয়ে এতো ধকল গেলো সেটার কোনো তোয়াক্কাই নেই। তোমার বাবা আমি। আর যেখানে যাই করো না কেনো। অন্যর মেয়েকে নিয়ে এমন উড়োস্বভাব আমি সহ্য করবোনা বলে দিলাম।
—“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন ও এখন আমার স্ত্রী। আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। অন্যর মেয়ে অন্যর মেয়ে বলাটা কি আদৌ সমীচিন?
—“বিয়ে করেছো বলে কি যা ইচ্ছে তাই করবে? মেয়েটা আমার মেয়ের মতো। ওর সাথে তো তোমাকে এভাবে অত্যাচার করতে দিবোনা আমি।”
নিভ্রান চিল্লিয়ে উঠলো এবার,
—“আপনার কোনদিন দিয়ে মনে হচ্ছে আমি ওর সাথে অত্যাচার করছি?”
নিশাদ এগিয়ে এলো। বাবার হাত টেনে সরিয়ে বললো,”বাবা, এখানে চিৎকার চেঁচামেচি করোনা। উপরে যাও। আমরা আসছি।”নওশাদ সাহেব গেলেননা। নাহিদা রুবিনাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে ততক্ষনে।
রাত্রিকে বুক থেকে সরিয়ে বেরিয়ে এলো নিভ্রান। ওপরপাশে যেয়ে দরজা খুলে বাবার সামনেই পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো তাকে। গেট পেরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে গলা বাড়িয়ে বললো,” গাড়ি টা পার্ক করে দিস নিশাদ।”

নিজের ঘরেই রাত্রিকে শুইয়ে দিয়েছে নিভ্রান। ঘরে এসি চলছে। মেয়েটা রীতিমত ব্ল্যাঙ্কেটের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই রুবিনাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে,”রাত্রি নাকি ছোট থেকেই ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারেনা। অল্পতেই দাঁত কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। মেয়েটা খুব উষ্ণপ্রিয়।”
নিভ্রান আনমনেই হাসলো। সে ছোট থেকে এসিতে অভ্যস্ত। বাসা থেকে বের হওয়ার পর সামান্য লিফ্ট দিয়ে নিচে নেমে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতেই ঘেমে একাকার হয়ে যায় শরীর। তারপর গাড়িতে এসি। অফিসেও সারাদিন এসির মধ্যে। আর মেয়েটা কিনা ঠান্ডা সহ্য করতে পারেনা? হাহ্!
বাইরে প্রায় সকাল হয়ে গেছে। রুবিনার শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছে সে। বাকি সবাইও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। কম খাটুনি তো হয়নি। একদিনে যেয়ে আবার একদিনে ফিরে আসা। যে সে ব্যাপার নয়।
ঘরের বাতি নিভিয়ে রাত্রির পাশেই শুয়ে পড়লো নিভ্রান। কনকনে ঠান্ডায় জমে আসা বিছানায় একটুখানি তপ্ত সংস্পর্শ পেয়ে সুড়সুড় করে নিভ্রানের অনেকটা কাছে চলে গেলো রাত্রি। নিভ্রান হঠাৎই হাসলো। এসির রিমোটের বাটন চেপে তাপমাত্রা কমিয়ে দিলো আরো কয়েক ডিগ্রি।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো চিকচিক করছে সাদা মেঝেতে। ঘর আলোকিত। রাত্রি চোখ মেললো। মনে হচ্ছে চোখদুটো কেউ চোখা পেন্সিল দিয়ে গুঁতিয়ে ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে। কি অসহ্য ভার মাথা! শরীরে একফোঁটা শক্তি পাচ্ছে না। দূর্বল লাগছে। দু’হাতে মোটা ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে ভেতর থেকে মাথা বের করলো সে। এটা নিভ্রানের রুম! রুমে অবশ্য নিভ্রান নেই। রাত্রি মাথা চেপে ধরলো। কালরাতে হাসপাতালের ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়ার পর মায়ের কাছে গেলো তারপর একসময় খুব ঘুম ঘুম পেলো… সে কি ঘুমিয়ে গেছিলো? অবশ্য রাতে তাদের রওনা দেয়ার কথাই ছিলো কিন্তু সেখান থেকে এখান অবধি চলে এলো.. টের পেলোনা? অদ্ভুত! এত গাঢ় ঘুম তো তার কোনোকালেই হয়না।
একটু একটু করে উঠে বসলো সে। অগোছালো চুল খোঁপা করতে করতেই হাল্কা করে দরজা ফাঁক করার শব্দ হলো। চকিতে মুখ তুলে তাকাতেই নিশাদ কে দেখা গেলো। একপলক চোখাচোখি হতেই মুখে খুশির ঝলক
খেলে গেলো নিশাদের। উচ্ছাসে ফেটে পড়লো সে,
—“ও আল্লাহ,অবশেষে ঘুম ভেঙেছে আপনার। ওদিকে তো বাবা ভাইয়ার মধ্য বিস্তর কথাযুদ্ধ লেগে যাচ্ছিলো।”
রাত্রি থতমত খেয়ে চেয়ে রইলো। অস্ফুট স্বরে বললো,
—“জি?”

তার বোকা বোকা হতভম্ব চাহনীতে নিশাদ হেসে ফেললো। নিভ্রান নাস্তার টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে। নিশাদ সরে দাড়ালো। নিভ্রান দরজা হা করে খুলে ভেতরে ঢুকলো। উদ্দেশ্য খাবার টেবিলে বসা নওশাদ সাহেবকে দেখানো যে রাত্রির কিছুই হয়নি। একটা ঘুমের ওষুধ খেলে মানুষ মরে যায়না!
নওশাদ সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে একবার বিছানায় বসা রাত্রিকে দেখে নিলেন। অত:পর চোখ ফিরিয়ে বেশ জোরে সরেই ঠান্ডা গলায় বললেন,”নাহিদা, তুমি যাও তো মেয়েটার কাছে। তোমার ছেলে দেখবে এখনই ধমকাধমকি শুরু করে দিবে। মাথা তো রাতদিন গরমই থাকে।”
নিভ্রান কথাটা শুনেও কোনোরকমে হজম করে নিলো। ফোন বাজছে। বাটন চেপে আওয়াজ বন্ধ করলো সে। রাত্রির গালে কপালে হাতের উল্টোপিঠ ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বললো,
—“ঠি ক আছো?”
রাত্রি নিচু গলায় উওর দিলো,”জি।”
নাহিদা হাতে নিজের শাড়ি নিয়ে এসেছেন। রাত্রির জামাকাপড় আনা হয়নি এখনো। নিভ্রান একটুপর যেয়ে তার বাসা থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে আসবে। নাহিদা শাড়িটা বিছানার উপর রাখলেন,
—” তোমার তো জামাকাপড় আনা হয়নি। আপাতত গোসল করে এই শাড়িটা পরে নাও, যাও।”
রাত্রি মাথা নাড়ালো। নিশাদ যেয়ে আবার খাওয়ার মন দিয়েছে। নওশাদ সাহেবও চুপচাপ খাচ্ছেন। মা কে দেখা যাচ্ছেনা ওখানে। নাহিদা চলে যেতেই রাত্রি আমতাআমতা করলো,
—“মা কোথায়?”

নিভ্রান ফোন কানে নিয়ে কথায় ব্যস্ত ছিলো। রুবিনার ড্রেসিং করার জন্য একটুপর ডাক্তার আসার কথা। সে জন্যই একটু কথা বলে নিলো। ঠি ক সময়ে যেনো চলে আসে। রাত্রি প্রশ্ন করতেই ফোন নামিয়ে মুচকি হাসলো সে।
—“আন্টি উনার ঘরে আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর নিয়ে যাচ্ছি।”
রাত্রি গোসল করলো খুব কম সময়ে। বেলা গড়িয়ে গেছে। আজ আর ভার্সিটিতে যাওয়া হবেনা। গতকালও যেতে পারেনি। ইম্পর্টেন্ট ক্লাসগুলো মিস হয়ে গেলো।
কনুইয়ে সাদা তোয়ালে ঝুলিয়ে সে যখন হাল্কা সবুজ রংয়ের সুতি শাড়ি পরে বেরোলো…নিভ্রান যেনো বিষম খেলো কয়েকবার। ভেজা চুলগুলো দেখে গলা মরুভূমির মতো শুকিয়ে গেলো যেন। আগা থেকে পানি গড়িয়ে পিঠের ব্লাউজ ভিজিয়ে দিয়েছে। নাহিদার ব্লাউজ রাত্রির এমনেই খুব ঢিলে হয়। কাঁধে থাকছেনা। এর আগের বারও এমনই হয়েছিলো।

বউ হয়ে মেয়েটার ধংসাত্বক রুপ যেনো চোখে বেঁধে যাচ্ছে। রাত্রি চুল মুছছিলো। নিভ্রান হেঁটে তাকে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ের খুললো। সেফটিপিন বের করলো। পিছে দাড়িয়ে বললো,”দেখি চুল সরাও, ব্লাউজটা একটু টেনে আটকে দেই। নেমে যাবেনা আর।”
রাত্রি উওর দিলোনা। ইততস্ত ভঙ্গিতে আয়নার তাকালো। কাপড়টা কাঁধের থেকে সত্যিই নেমে যাচ্ছে বারবার। নিভ্রান তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। বিধায় চোখে চোখ পরে গেলো। রাত্রি তোয়ালে সরালো। চুল একপাশে আনলো।
নিভ্রান কয়েকসেকেন্ড স্হির চেয়ে থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে দু’পাশ থেকে বাড়তি কাপড় টেনে একসাথে করে সেফটিপিন আটকে দিলো। আঁটসাঁট হয়ে লেগে গেলো ব্লাউজটা। নিভ্রান সরে দাড়ালো,”হয়েছে?”

—“হু।”
—“চুল মুছে চলো। ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”
ডাক্তার এসেছে। ব্যান্ডেজ বদলে দিচ্ছে রুবিনার। রাত্রি বসে আছে পাশেই। হাতে খাবারের প্লেট। বাড়ির সবার খাওয়া শেষ শুধু সে-ই খায়নি। নিশাদ আর নিভ্রানও সেখানেই দাড়িয়ে আছে।
রুবিনার কপালে ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে নিভ্রান ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। নিচ পর্যন্ত দিয়ে আসবে হয়তো।
সে চলে যেতেই রাত্রি মুখ খুললো। এতক্ষণ নিভ্রানের ভয়ে কিছু বলোনি। যদি রাগারাগি করে।
নিশাদের দিকে চেয়ে খাবার চিবাতে চিবাতে বললো,
—“সকালে কি হয়েছিলো? আপনি তখন কি বলছিলেন?”
নিশাদ মুচকি হেসে উওর দিলো,
—“আপনার জামাই আর শ্বশুরের মধ্য সেইরকম লেগেছিলো ভাবি। ভাইয়া আপনাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলো কাল। তারপর তো আপনি সেই যে রাত দশটার দিকে ঘুমোলেন। সারা রাস্তা, সকাল গড়িয়ে গেলো তবুও আপনার ঘুম ভাঙলোনা। বাবা ভেবেছে ঘুমের ওষুধের জন্য আপনার শরীর খারাপ করেছে। আর ভাইয়া তো জানেনই একটু মেজাজ করে কথা বলে। সে নিয়েই আরকি..”
রাত্রি মনোযোগ দিয়ে শুনলো। এই ঘুমের ওষুধই তবে তার গভীর ঘুমের রহস্য। হায়! মানুষটা তার এতো যত্ন করে কেনো? ডাক্তার একটু বলেছে শরীর খারাপ তাতেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
তবে মনে এখনো শতশত প্রশ্ন কিলবিল করছে। নিশাদের দিকে মাথা নাড়িয়ে রুবিনাকে বললো সে,

—“আমি অজ্ঞান হবার পর মামা-মামী কই গেলো? তাদেরকে তো দেখলামই না আর।”
রুবিনা হাঁফ ছেড়ে বললেন,
—“ছেলেটা যেভাবে শাসিয়েছে..তোর মামা-মামী আর এজন্মে কিছু বলার সাহস পাবেনা। পুলিশেই দিয়ে দিতো। মামলা করবে। তোকে অন্য কেবিনে নিয়ে গেলো কোলে করে। তোর মামা আবার একটু বাজে কথা বলেছে। ব্যস, সে কি রাগ! আমিতো ভয় ই পেয়ে গিয়েছিলাম। অনেক বলে কয়ে তোর দোহাই দিয়ে শেষমেষ শান্ত করলাম। নয়তো তোর মামা-মামী এতক্ষণে জেলে থাকতো।”
রাত্রি থমথমে গলায় বললো,
—“শান্ত করলে কেনো? উনাদের জেলেই দেয়া উচিত ছিলো। নির্যাতন, হত্যাচেষ্টা মামলা দিলে সুড়সুড় করে ধরে নিয়ে যেতো।”
—“ধুর! ওরা আর কিছু করবেনা। মামলা টামলায় কত ঝামেলা হয়। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।”
রাত্রি উওর দিলোনা। মন ভাবছে লোকটার হঠাৎ বিয়ে করার ঝোঁক উঠলো কেনো কাল? নিশ্চিত মামা তাদেরকে জড়িয়েই কিছু বলেছিলো। তাই হয়তো এতো হুড়মুড় করে সব বৈধ করে নেয়া।
নিশাদ ফোনে কিছু করছিলো। রাত্রি জিজ্ঞেস করলো,
—“আচ্ছা, আপনারা ওখানে গেলেন কখন?”
নিশাদ ফোন থেকে মাথা তুলে বললো,
—“আমরা গেলাম বিকেলের দিকে। ভাইয়া সকালে ফোন করে বললো, যাই হোক, সেভাবেই হোক আমি যেনো সব কাগজপত্র রেডি করে বাবা- মা আর কাজি নিয়ে ঠি ক ঠি ক সন্ধ্যার আগে সেখানে পৌছে যাই। সে বিয়ে করবে। আর ভাইয়া যেটা একবার বলে সেটাই করে। তাই আমিও কোনরকম আপত্তি না করে মা- বাবাকে বগলদাবা করে তড়িঘড়ি করে ছুটলাম চট্রগ্রামে। বুঝলেন?”
—“হু..” রাত্রি থেমে গেলো। নিভ্রান চলে এসেছে। আর কিছু না বলাই শ্রেয়।

বিকেলের বিদেয় ঘন্টা বেজে গেছে। আকাশে গোলাপি আর নীলের সমারোহ। পশ্চিম দিকটা পুরো গোলাপি। যেনো একথোকা গোলাপ ফুল ভেসে রয়েছে নীলসাগরে। রাত্রি চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো ব্যালকনিতে। নিভ্রান, নিশাদ কেউ নেই বাড়িতে। দুপুরের পর দুজনে কোথায় যেনো বেরোলো তারপর আর ফিরেনি। নাহিদা আর নওশাদ সাহেব ঘুমাচ্ছেন। মাও নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছে। নাহিদা তাকেও রেস্ট নিতে বলে গিয়েছিলো। কিন্তু ঘুম আসছেনা কিছুতেই। দূরে একটা নদী দেখা যায় এখান থেকে। সচ্ছ পানি। রুপালি রোদ সোনার মতো ঝিলমিল করছে। নৌকা গুলো চলছে বোঝা যায়। কিন্তু স্পষ্ট নয়।
রাত্রি মনভরে শ্বাস নিলো। তার জীবনে কখনো এত ভালোবাসা আসবে এ যেনো কল্পনার মতো। বাবা মারা যাওয়ার পর সে পুরোদস্তর ভেবেই নিয়েছিলো জীবন থেকে সব রং ফিকে হয়ে গেছে। আর কখনো তার জীবন রঙিন হবেনা। অথচ সাদা কালো এই শহরে তার জন্য যে কেউ একমুঠো লাল আবির নিয়ে অপেক্ষা করছে…কখনো ভাবেনি। কক্ষণো না।
দরজা খোলার শব্দ। রাত্রি পিছে ফিরলো। কয়েককদম সামনে এগিয়ে রুমে উঁকি দিলো। নিভ্রান দাড়িয়ে আছে। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দেখলো বিছানা ভরা শপিং ব্যাগ দিয়ে। রাত্রি হকচকালো,

—“এগুলো কি?”
বাকিটা বলতে বলতেই নিশাদ ঢুকলো রুমে। দু’হাতে ব্যাগ। বেশ ভারি বোঝা যাচ্ছে। নিশাদ রাত্রির দিকে একঝলক তাকিয়ে শ্বাস আটকে বললো,
—“আপনি এতো পড়াশোনা করেন? বাপরে বাপ! আপনার পড়াশোনার ভারে আমিই নুইয়ে যাচ্ছি। ও আল্লাহ! আরে সর না। খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস কেনো?”
নিভ্রান সরে দাড়ালো। নিশাদ ব্যাগদুটো উঠিয়ে বিছানার উপর রাখলো। উপর থেকে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে বই-খাতা।
নিশাদ দু’হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,”এইযে এখানে, ভাইয়া মার্কেটের সব শাড়ি উঠিয়ে এনেছে। আপনার আগামী দশ-বারো বছরের মতো চলে যাবে।”
রাত্রি শব্দ করে হেসে ফেললো। মানুষটা সবসময় ঠাট্টা করে।
নিভ্রান আলতো করে চাঁটি মারলো নিশাদের মাথায়। নিশাদ হাসতে হাসতেই বেরিয়ে গেলো। নিভ্রান দরজা আটকে দিলো ভেতর থেকে।
রাত্রি ব্যাগগুলো একটু আধটু ফাঁক করে দেখলো। শাড়ি বোঝাই।
—“পাগল নাকি আপনি? এতো শাড়ি দিয়ে কি করবো আমি?”
নিভ্রান শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
—“ওই যে দশ বারো বছর পড়বে।”
রাত্রি হতাশ স্বরে বললো,

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৫+২৬

—“আমি শুধু শুধু টাকা নষ্ট করলেন। আমার তো জামা ছিলোই। সেগুলোও তো এনেছেন দেখছি। আর কি দরকার ছিলো?”
নিভ্রান শার্ট খুলে গেন্জি পরলো। একহাতে রাত্রিকে কাছে টেনে চুলের খোঁপা খুলে পিঠে ছড়িয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বললো,
—“দরকার ছিলো বলেই এনেছি। সালোয়ার, কামিজ…ওসব বাইরে গেলে পরবে। আমার সামনে শুধু শাড়ি পরবে। বুঝলে?”
রাত্রি দমে গেলো, হেরে গেলো। আলতো করে নিভ্রানের পিঠ জড়িয়ে বুকে মাথা রাখলো। বিষন্ন কন্ঠে বললো,
—“একটা কথা বলি?”
নিভ্রান ভ্রু কুঁচকালো। মাথার পিছে হাত রেখে বললো,”বলো।”
রাত্রি ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো। হাতের বন্ধন দৃঢ় করে বললো,

—“আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন এরমানে তো এটা নয় যে আমাকে সবসময়ই আপনার টাকায় চলতে হবে। আমি..আমি নিজের খরচ নিজে চালাতে একটা অন্যরকম শান্তি পাই। মাসশেষে যখন নিজের কষ্টের টাকা দিয়ে কিছু করি সত্যি বলছি আমার খুব খুব আনন্দ হয়। হ্যাঁ, আপনি হয়তো বলবেন আপনার সব তো আমারও। মানছি, তবু আমি যদি টি উশনি করি তারপর ভার্সিটি শেষ হলে জব করি আপনার কি কোনো বারণ আছে?”
নিভ্রান হাসলো। চুলে হাত বুলিয়ে কোমলকন্ঠে বললো,
—“ধুর পাগল মেয়ে, আমার বারণ থাকবে কেনো? তোমাকে বিয়ে করেছি…বন্দি করে ফেলিনি। তোমার আনন্দ তে আমি কেনো বাঁধা হবো? এসব নিয়ে চিন্তা করে কেউ? আমি তোমাকে কখনো জোর করবোনা রাত।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৯+৩০