এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৯+৩০

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৯+৩০
লেখিকা মালিহা খান

নদীর জলটা এখন রুপালি রংয়ের। চাঁদের আলোর সে কি তেজ! পুরো নদীটাকে রুপার অলংকারে ভরিয়ে দিয়েছে যেনো। ঝলমলে চাকচিক্যে জলের রুপ কয়েকসহস্র বেড়ে গেছে। সম্মোহন লেগে যায়। সন্ধ্যা থেকে বইখাতা গুছিয়ে আলমারি খুলে বসেছে রাত্রি। এতো শাড়ি কাপড় রাখবে কোথায়? নিভ্রানের জামাকাপড় সরাবে নাকি? তাকে ফ্যালফ্যাল করে আলমারির দিকে চেয়ে খাকতে দেখে ল্যাপটপ রেখে এগিয়ে এলো নিভ্রান। নিজের শার্টগুলো একদম কোঁণায় চাপিয়ে অনেকটা জায়গা বের করে দিলো। তারপর আবার চুপচাপ যেয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে পড়লো। রাত্রি হাসলো মনে মনে। একটা একটা করে শাড়ি নিয়ে সাজিয়ে সাজিয়ে রাখলো। হঠাৎই শার্ট দিয়ে ঢেকে যাওয়া নিচের জায়গাটা থেকে কিছু একটায় হাত লাগতেই ভ্রু কুচকে গেলো তার। একটু টান দিতেই দেখলো লাল রঙা বিয়ের বেনারসি। কি সুন্দর কাজ করা!
এই শাড়িটার কথাই তবে সেইদিন বলছিলো নিভ্রান। ওইযে নিশাদ নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলো। রাত্রি হাতে তুলে নিল। আলতো করে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো,

—“আপনি এটা কখন কিনেছেন?”
নিভ্রান তাকালো। ঘাড় বাকিয়ে রাত্রির হাতের শাড়িটা দেখে ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,”অনেক আগে।”
—“অনেক আগে মানে? কেনো কিনেছিলেন?”
নিভ্রান উঠে দাড়ালো। রাত্রির পিছে দাড়িয়ে আলমারির তাঁক এ একহাত ঠেস দিলো। পিঠের সাথে বুক ছুঁয়ে যেতেই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কুঁকরে গেলো রাত্রি। হাতটা একটু কাঁপলো। নিভ্রান তার কাঁপুনি তোয়াক্কা না করে কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো,”মনে আছে? তোমার সাথে যেদিন দ্বিতীয়বার দেখা হলো? তুমি কদম ফুল নামিয়ে দিতে বললে? আমি ভুলক্রমে একটু কাছাকাছি এসে যেতেই সেই যে তোমার গালদুটো লাল হয়ে উঠলো। সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম এই রাঙাবতী কেই আমার লাগবে। আমার দেয়া লাল বেনারসি শুধু এই মেয়েটাই গায়ে জড়াবে। আর কেউ না। সেদিন তোমার বাসা থেকে আসার সময় মার্কেট থেকে বিয়ের শাড়ি কিনে তবেই বাড়ি ফিরেছিলাম আমি। বুঝলে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাত্রি বাক্যহীন, শব্দহীন, স্তব্দ, বিমূঢ়। টুপ করে একফোঁটা পানি পড়লো শাড়ির উপর। কান্না কি তবে সুখেও আসে? আসেতো। একশবার আসে, হাজারবার আসে। নতুবা সে কেনো কাঁদলো? তার তো কোনো দু:খ নেই।
নিভ্রানের চাপা হাসি মিলিয়ে গেলো। কাঁধ থেকে থুতনি উঠিয়ে রাত্রিকে সামনে ঘুরালো সে। রাত্রি মাথা নুইয়ে রেখেছে। শব্দহীন অশ্রুপাত। গাল বেয়ে ঠোঁটের কাছে যেয়ে জমা হচ্ছে নোনা পানি। নিভ্রান গাল-ঠোঁট মুছিয়ে দিলো।
চিবুকে তর্জনী রেখে মাথা উঁচু করালো। গোলাপি অধরে নিষ্পলক চেয়ে থেকে নম্র গলায় বললো,
—“তুমি কি শুধু আমাকেই পাও কেঁদে কেটে ভস্ম করে দিতে? অন্য কারো সামনে তো কখনো কাঁদতে দেখি না। সবসময় বেঁছে বেঁছে একমাত্র আমাকেই কষ্ট দেয়া?”
রাত্রি ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,”আপনি এমন করেন কেনো?”
—আমি কি করলাম?”
—“সব তো আপনিই করেন।”
নিভ্রান হাসলো। হাসলে তার চোখের কোণে ভাঁজ পরে। কি যে সুন্দর দেখায়। রাত্রি নাক টেনে তপ্ত কন্ঠে বললো,”খবরদার! হাসবেন না।”
নিভ্রানের কপালে ভাঁজ পড়লো। হাসি থামার বদলে আরো প্রশস্ত হলো। চোখের কোণটা আরো সুন্দর হলো।
রাত্রি মুখ কুচকে সরে গেলো। শাড়িটা আগের জায়গায় রেখে নিভ্রানকে সরিয়ে আলমারি বন্ধ করলো।

রাতের খাবার খাওয়ার পর একটু বই নিয়ে বসেছিলো রাত্রি।
নিভ্রান তখন বাইরে গিয়েছিলো কেনো যেনো। দরজায় নক হতেই বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো সে। হাত থেকে বই রেখে দ্রুত যেয়ে দরজা খুলতেই দেখলো নওশাদ সাহেব দাড়িয়ে আছেন। বিনীত ভঙ্গিতে সরে দাড়িয়ে নওশাদ সাহেবকে ঢুকার জায়গা করে দিলো সে। নওশাদ সাহেব ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। মেয়েটার আচার- আচরণ, আদব- কায়দার মুগ্ধ না হয়ে পারেন না তিনি। একটু উশৃঙ্খলতা নই কোনোকিছুতে।
এমনিতে ছেলের কোনোকিছু পছন্দ না হলেও এই ব্যাপারে ছেলের পছন্দ বেশ পছন্দ হয়েছে তার।
রাত্রি আমতা আমতা করলো,”উনি তো বাইরে গিয়েছেন।”
নওশাদ সাহেব সোফায় বসে বললেন,

—“না না ওর কাছে আসিনি। তোমার সাথেই একটু কথা বলতে আসলাম মা। কাল সকালে তো চলেই যাবো। তোমার তো আবার ভার্সিটি আছে তখন, আর সময় পাবোনা। বসো।”
রাত্রি পাশে বসলো। নামানো কন্ঠে বললো,
—“কাল চলে যাবেন কেনো?”
—“আমরা তো এখানে থাকি না মা। চলে তো যেতেই হবে। পারলে তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতাম। কিন্তু…আচ্ছা, বাদ দাও। খাওয়াদাওয়া ঠি ক মতো হয়েছে?”
রাত্রি মাথা নাড়ালো। নওশাদ সাহেব লম্বা শ্বাস ফেললেন। মেয়েটা খুব চুপচাপ স্বভাবের। অযথা কথা বলে না একদম। ছেলের রাগ সম্পর্কে জানেন তিনি। রাগ উঠলে কোনোদিকে হুঁশ থাকেনা। ছোট থেকেই এমন। এই মেয়েটাকে একা রেখে যাবে যদি রাগের বশে কিছু হয়ে যায়? সংসারে তো কতকিছু নিয়েই ঝগড়া বাঁধে।
তিনি হাল্কা গলায় বললেন,
—“শোনো মা, নিভ্রান তোমাকে বিয়ে করেছে ঠি ক। কিন্তু যদি কখনো ও তোমার সাথে অন্যায় আচরন করে। কক্ষণো যদি তোমার গায়ে হাত তুলে তুমি কিন্তু চুপ করে থাকবে না। তোমার বাবা নেই। আমিই তোমার বাবা। আমাকেই বাবা ডাকবে। তোমার বাবা থাকলেও নিশ্চয় এই কথাগুলোই বলতেন। আমরা চলে যাবার পর তোমার গায়ে একটা ফুলের টোঁকা পড়লেও তুমি হয় আমাকে জানাবে নয়তো নাহিদা কে জানাবে।
ঠি কাছে? কোনো ভয় পাবে না।”
রাত্রি অসহায় চোখে চেয়ে রয়েছে। মানুষ এতো ভালো হয়? এই পরিবারটাকে না দেখলে হয়তো জানাই হতোনা। কিন্তু নিভ্রান আর তার বাবার মাঝে এতো দুরত্ব কেনো? একটু ভালো করে কথা বলেনা দুজন। একটু বিশ্বাস নেই। মাথা নিচু করে মিনমিন করলো সে,

—“উনি কখনো আমার গায়ে হাত তুলবেন না বাবা।”
নওশাদ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—“সে আমি জানি। তবুও যদি কখনো এমন হয় তুমি সহ্য করে থাকবে না।”
রাত্রি “জি, আচ্ছা” বলে সম্মতি দিতেই দরজা খুলে গটগট করে নিভ্রান ঢুকলো। বাবাকে আড়চোখে দেখে নিয়ে থমথমে চেহারায় ব্যালকনির দিকে পা বাড়াতেই নওশাদ সাহেব ডেকে উঠলেন,”ওকে ওষুধগুলো খাইয়েছো?”
নিভ্রান দাড়িয়ে গেলো। ছোট্ট করে বললো,” খাওয়াবো, একটু পরে।”
—“পরে কেনো? রাতের খাবারের পর খাওয়াতে বলেছে না?”
—“আধঘন্টা পর দিতে বলেছে।”
নওশাদ লাগবে সাথেসাথেই বললেন,”আধঘন্টা হয়ে গেছে। ঘড়ি দেখো। আর ঘুমের ওষুধ দিয়োনা আজ।”
নিভ্রান আরো কিছু বলার আগেই রাত্রি তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়িয়ে বললো,”আমি খেয়ে নিচ্ছি।”
নিভ্রান এগিয়ে এলো। রাত্রিকে সরিয়ে ড্রয়ের খুলে প্রেসক্রিপসন মিলিয়ে ওষুধ বের করতে করতেই নওশাদ সাহেব কাছে এসে রাত্রির মাথায় হাত রেখে বললেন,”তাহলে আসি, সকালে হয়তোবা আর কথা হবেনা। একটু আগে আগেই বেরিয়ে পড়বো তো।”
রাত্রি মাথা কাত করলো। নওশাদ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। রাত্রি যেয়ে দরজাটা আটকালো।
—“বসো এখানে।”বিছানার দিকে ইশারা করলো নিভ্রান। হাতের চার- পাঁচটা ট্যাবলেট। রাত্রি বসলো। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলল,”ঘুমের ওষুধও আছে?”
—“উহুম। দেইনি। শরীর দূর্বল হয়ে যায় তোমার।”
রাত্রি চাপা হাসলো। লোকটা নিজের বাবার কথা মানে কিন্তু প্রকাশ করেনা। ঠান্ডা যুদ্ধ!

রাত্রি বসে আছে বিছানায় হেলান দিয়ে। গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টানা। নিভ্রান আবার ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে এসি ছেড়ে দিয়ে শাওয়ার নিতে গিয়েছে একটু আগে। তাকে অবশ্য ঘুমাতে বলে গিয়েছে কিন্তু ঠান্ডায়
টি কতে না পেরে সে উঠে বসেছে। বিছানায় রিমোটটাও খুঁজে পাচ্ছেনা। এত ঠান্ডায় থাকে কিভাবে মানুষ?
ইশশ… দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।
নিভ্রান বেরিয়ে এলো একটু পরেই। গায়ে আধভেজা ধূসর টি-শার্ট। কালো ট্রাউজার। গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে একহাতে চুল ঝাড়ছে। রাত্রিকে বসে বসে মাথার উপর ব্ল্যাঙ্কেট টেনে রাখতে দেখেই হেসে ফেললো সে,
—“এভাবে বসে আছো কেনো? ঘুম আসছেনা?।”
রাত্রি মাথা বের করলো। ফর্সা চেহারা ফ্যাকাশে সাদা। শুভ্র মেঘের টুকরো যেনো। শুকনো গলায় সে বললো,
—“আপনি এতো রাতে গোসল করেন কেনো? ঠান্ডা লাগে না?”
নিভ্রান গলা থেকে টাওয়ালটা নামিয়ে সোফায় রাখলো। রাত্রির কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
—” লাগবে কিভাবে?”
—“মানে?”
নিভ্রান বসে পড়লো পাশে। ব্ল্যাঙ্কেট টা টেনে নামিয়ে দিলো। কিছু একটা দেখে সন্দিহান কন্ঠে বললো,
—“ব্লাউজের সেফটিপিন খুলোনি? কেনো? ঘুমালে বিঁধে যাবেতো। দেখি।”বলেই ঝুঁকে গেলো সে। কাঁধের পাশ দিয়ে মাথা গলিয়ে পিঠের দিকে তাকালো। রাত্রি উষখুষ করছে। নিভ্রান হাসলো। সাবধানে সেফটিপিনের খুলে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,”এতো কাঁপাকাঁপি করো কেনো?”

রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা। নিভ্রান ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাশে শুয়ে পরতেই গুটিশুটি হয়ে গেলো সে।
লজ্জা করছে খুব। লোকটা হয়তো কালও পাশে শুয়েছে কিন্তু সে তো আর চেতনায় ছিলোনা।
নিভ্রান সহজেই বুঝলো তার দ্বিধা। বালিশের নিচ থেকে এসির রিমোটটা বের করে তাপমাত্রা কমিয়ে ঠান্ডা বাড়িয়ে দিলো সে। রাত্রি হত্ববিহল দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,” কি করেন? আমার শীত করে তো।”
নিভ্রান আবছা অন্ধকারেই চোখে চোখ রাখলো। কি কি যেনো বললো চোখে চোখে। রাত্রি বুঝলো নাকি না জানেনা কিন্তু খানিকবাদে নিজে থেকেই কিছুটা চেপে এলো নিভ্রানের দিকে। নিভ্রান মুচকি হাসলো। আদরমাখানো নরম হাতে তাকে কাছে টেনে নিতে নিতে বললো,

—“আমার নিরুত্তাপের শহরে একমাত্র উত্তাপ হয়ে এসেছো তুমি।…তুমিহীন আমি যে আবার তীব্র শীতলতায় কাবু হয়ে যাবো প্রিয়তমা। শৈত্যপ্রবাহে হিম হয়ে যাবে হৃদয়, তোমার উত্তাপ টা যে আমার ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন।”
ঘরে প্রকট নিরবতা। এয়ার কন্ডিশনারের ভনভনে ক্ষীণ একটা সুর শোনা যাচ্ছে। পর্দা টানা, আলো নেভানো। সূর্যের তেজ নেই আজ। পর্দা ফুড়ে কেমন আবছায়া সাদা। নিভ্রানের ঘুম ভাঙলো সাতটার দিকে। রাত্রি তখন তার শক্তশান্ত বাহুতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আলুথালু শরীরটা ঠান্ডায় চুপসে গেছে। এদিকে একটু উষ্ণতার ঠাঁই পেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়ে আছে সে। নিভ্রান হাই তুললো। ব্ল্যাঙ্কেট সরালো উপর থেকে। অপ্রস্তুত ভাবটা যেনো আচমকাই দলবল নিয়ে হানা দিলো মুখজুড়ে। রাত্রির শাড়ির আঁচল তার বুকের উপর লুঁটোপুঁটি খাচ্ছে। অনাবৃত নারী দেহের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ কেটে গেলো খুব নিভৃতে, অত্যন্ত অন্যচোখে। ভিন্ন অনুভূতিতে তপ্ত হয়ে উঠলো পুরুষালী মন। বিচলিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরালো নিভ্রান। চোখের পলক পড়ছে ঘনঘন। শ্বাসপ্রশ্বাস অতি তীব্র। বুকের উপর থেকে আচঁল সরিয়ে রাত্রির কাঁধে টেনে দিল সে। ঘুমের ঘোরে মেয়েটার খেয়াল হয়নি হয়তো। ঘুমন্ত তৈলাক্ত মুখটা কি আশ্চর্য সুন্দর! ফোলা ফোলা চোখের নিচে তাকালেও যেনো শান্তি মিলে।

পাশ থেকে রিমোট নিয়ে এসি অফ করে দিলো নিভ্রান। গাল ছুঁয়ে দেখলো রাত্রির শরীর বরফ ঠান্ডা। শীতে কাবু খোদ তুষারকন্যা যেনো অগ্নিমানবের কাছে একটুখানি উত্তাপের আশ্রয়ে লেপ্টে রয়েছে।
নিভ্রান আবার হাই তুলল। আঙ্গুল দিয়ে চোখ ডললো। রাত্রি বাহুতে মাথা রেখেছে রাত দুটোর দিকে এরপর থেকে আর একরত্তি নড়েনি সে। রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে যায় যদি?
পিঠের হাড় ব্যাথা করছে। শরীরে মনে হচ্ছে জং ধরে গেছে। অফিসেও যেতে হবে আজ। বিয়ে, বাকি গোছগাছ করে নেওয়া সব মিলিয়ে এ’কদিন একদম কাজ থেকে দূরে ছিলো। কতকত মিটিং পেন্ডিং পড়ে আছে। আবার শুরু ব্যস্ততা।
একহাতে রাত্রির মাথাটা আলগা করে উঠিয়ে বাহু সরিয়ে নিলো নিভ্রান। খুব সাবধানে বালিশ নিচে নামিয়ে সেখানে শুইয়ে দিলো। একটুপর ডেকে দিবে। ভার্সিটি আছে। তার জন্য মেয়েটার পড়ালেখায় কোন সমস্যা হোক সে চায় না।
মুখ হাত ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দরজায় খটখট। এত সকালে কে এলো? মা- বাবার তো এতক্ষণে রওনা হয়ে যাওয়ার কথা। গলায় ঝুলানো টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দরজা খুললো সে। বাইরে নিশাদ। সাদা শার্ট আর বাদামী রংয়ের প্যান্ট পরা চওড়া কাঁধের সুপুরুষ যুবক।
নিভ্রান ভ্রু কুচকে বললো,

—“রওনা দিসনি এখনো?”
—“দিবোতো, ভাবির সাথে দেখা করতে আসলাম।”
নিভ্রান ঘাড় বাকিয়ে বিছানায় তাকালো। উঁকি দিলো নিশাদও। রাত্রি তখনো গভীর ঘুমে। নিশাদ সোজা হলো।
—“তুই কি সবসময় ঘুমই পাড়িয়ে রাখবি? বিয়ের দিন থেকে এই যে ঘুম পাড়াচ্ছিস। বিয়ের আগে ঘুম, বিয়ে করে ঘুম। এখানে এসেও ঘুম। ভাবী তো ভাববে সে জামাইবাড়ি এলো নাকি ঘুমের ওষুধের কারখানায়? জামাই ধরে ধরে তিনবেলা ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।”
নিশাদ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই নিভ্রান চোখ রাঙালো,
—“ও নিজেই ঘুমাচ্ছে। আমি কিছু করিনি।”
—“তা করবি কেনো? তুই শুধু ঘুমাতেই দে। বিয়ের অভাবে বাবা ডাক তো শুনতেই পাচ্ছিনা এখন তোর মতিগতি দেখে বোধ হচ্ছে চাচ্চু ডাকটা শোনার ভাগ্যও হবেনা।”
নিভ্রান বিস্ফোরিত কন্ঠে বললো,”বিয়ের মাত্র দুদিন হয়েছে।”
—“তোহ?”
নিভ্রান হেসে ফেললো। কাঁধে চাপড় মেরে বললো,”মা কোথায়? নিচে নেমে গেছে?”
—“হুম, ভেবেছে তোরা ঘুম তাই আর বিরক্ত করেনি। আসি তাহলে। দরজাটা আটকে দিয়ে যা।”
নিভ্রান মাথা নাড়ালো। দরজা আটকে দেয়ার আগমূহুর্তে নিশাদ চিরচেনা ঠাট্টা বাদ দিয়ে বিষন্ন কন্ঠে বললো,”তুই একদিন ভাবিকে নিয়ে বাসায় আসলেই পারিস ভাই।”
উওরে নিভ্রান মলিন হাসলো শুধু।

ঘুম থেকে উঠেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছোটখাটো একটা কান ফাটিয়ে দেয়া চিৎকার করে উঠলো রাত্রি। নিভ্রান সবে একটু শেভিং ফোম মেখেছে গালে। রেজার দিয়ে একটা টান দিতেই রাত্রির চিৎকারে হাত কেঁপে গেলো তার। কেটে গেলো অনেকখানি। গালের পাতলা চামড়া কেটে বেরিয়ে এলো রক্ত।সাদা শেভিং ফোমে লাল রক্ত মেখে একাকার। নিভ্রান হন্তদন্ত হয়ে রেজারটা নামিয়ে বেরোতে বেরোতে বললো,কি হয়েছে?”
রাত্রি তখন দ্রুত বিছানা থেকে নামছিলো। নিভ্রানের প্রশ্নের উওরে না তাকিয়েই সে বললো,”কিছু হয়নি, আপনি আমাকে…”
বলতে বলতেই তাকালো সে। নিভ্রানের রক্তমাখা গাল দেখে দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে উঠলো,”হায় আল্লাহ্! আপনার গাল। কি করেছেন? আল্লাহ্।” আতঙ্কে কন্ঠ কাঁপছে রাত্রির। কেমন একটা ব্যাথা, যন্ত্রনা, ভয়ের আভাস। যেনো কাঁটাটা তারই কেটেছে। নিভ্রান সে অবস্থায়ই ঠোঁট টেনে হাসলো। রক্ত গুলোকে ধন্যবাদ দিতে মন চাচ্ছে। তাদের জন্যেই তো প্রেয়সীর উৎকন্ঠা দেখার সৌভাগ্য হলো তার।
তাকে হাসতে দেখে মেজাজ চড়ে গেলো রাত্রির। নিভ্রানের হাত টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে যেয়ে বেসিনের কল ছেড়ে হাত ভেজালো সে। নরম করে গালের ফোম আর রক্ত মুছে দিতে দিতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো এতক্ষনের রুগ্নমূর্তি চেহারা,”বাচ্চা নাকি আপনি? একটু দেখে করবেন না। এমন করলে হয়?”

নিভ্রান হেসে ফেললো আবারো। এইযে রাতের কুঁচকে আসা চোখ, উপচে আসা কান্না, কান্না আটকে রাখার জন্য থরথর করে কাঁপা ওষ্ঠ। সবই তো তার ব্যাথায় ব্যাথিত হবার বহি:প্রকাশ।
নিভ্রান একটু ঝুঁকলো। গালের রাখা হাতের কব্জি ধরে চোখ মিলিয়ে বললো,”পুরো গালটা কেটে ফেলি? ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাক সব? আমার জখম দেখে তুমি আরো অস্থির হও। তোমার অস্থিরতায় আমিও একটু শান্তি পাই? ক্ষতটাও নাহয় এই নরম ছোঁয়ায়-ই সেড়ে উঠুক?
শেষের কথাটা শোনামাত্র হাত সরানোর চেষ্টা করলো রাত্রি। নিভ্রান ছাড়লোনা। রাত্রি চোখ নামিয়ে বললো,
—“আপনি সত্যি পাগল। পুরোদস্তর পাগল।”
নিভ্রান এলো চুল কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
—“চিৎকার করলে কেনো তখন?”
রাত্রি ছোট্ট গলায় বললো,
—“দেরি হয়ে গেছে, আমি কখনো এত দেরিতে উঠিনা। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে চল্লিশ মিনিট পর।”
নিভ্রান হেসে বললো,
—-“দেরি হবেনা। ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হও। ব্রেকফাস্ট করি। তারপর আমি পৌছে দিব সময়মতো।”
—“রাখেন আপনার ফ্রেশ হওয়া। আগে ব্যান্ডএইড লাগিয়ে দেই, চলুন”
শাড়ি বদলে থ্রিপিস পরে নিয়েছে রাত্রি। বেগুনী রংয়ের কামিজের সাথে বেগুনী ওড়না মাথায় মেয়েটা যেনো একটা সদ্য ফোঁটা রুয়েলিয়া ফুল। মন কাড়া বেগুনী রং!
রুবিনার সাথে দেখা করে, একসাথে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লো তারা। গাড়ির ভিতর বসে রাত্রি একমনে বললো,”জানেন, মা যে আমার সাথে থাকে। এই যে আমি সকালে উঠেই মাকে দেখতে পাই। হাত বাড়ালেই জড়িয়ে ধরতে পারি। আমার না বিশ্বাস হয় না। সত্যি বিশ্বাস হয়না।”

রাতে রাত্রির বেরোতে দেরি হলো। আটটার জায়গায় এখন আটটা পয়ত্রিশ। রাস্তার হলুদ হেডলাইটের আলোয় নিভ্রানকে দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে গাড়ি পার্ক করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে এদিকে ফিরে রয়েছে সে। কানে ফোন। রাস্তার এদিক ওদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে কথা বলছে। কপালের ভাঁজ আর মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফোনের ওপরপাশের মানুষটার সাথে তুমুল বাঁকবিতন্ডতা হচ্ছে।
নেভি ব্লু শার্টের ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গেছে। একহাত কনুই পর্যন্ত গুটানো আরেকটা ফুলহাতা। গালের ব্যান্ডএইড টা নেই। জায়গাটা লাল হয়ে আছে। রাত্রি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।
লোকটার মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। সে যে দেরি করেছে এখন কি তাকেও বকবে?
গেটের সামনে রাত্রিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ খারাপেও চেহারা ঠান্ডা হয়ে গেলো নিভ্রানের। ঠোঁটের কোঁণে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। রাত্রি ততক্ষনে রাস্তা পার হয়ে প্রায় এসে পরেছে। নিভ্রান সোজা হয়ে দাড়িয়ে একহাত বাড়িয়ে দিলো। রাত্রি কাছে আসতেই এককদম এগিয়ে ভরা রাস্তায়ই মাথা টেনে ছোট্ট করে চুমু খেলো কপালে। ক্লান্তিপাখি যেনো ফুড়ুৎ করে উড়াল দিলো। অতিক্ষুদ্র এই ভালবাসার প্রকাশেই স্তব্দ হয়ে গেলো রাত্রি। চোখের কোঁণে জমা হলো বিন্দুকণা। রাস্তার আলোতে চিকচিক কর উঠলো জল।
নিভ্রান তাকে একহাতে আগলে ধরে কথা বলছে। ফোনের মানুষটার সাথে সেই আগের মতোই। রূঢ় কন্ঠ, ধমকাধমকি। দু’তিনমিনিট সেভাবেই কেটে গেলো। রাত্রি চুপসে দাড়িয়ে আছে। নিভ্রান গম্ভীর গলায় বললো,
—“আই’ল কল ইউ লেটার।”
ফোনটা কেটে হাতঘড়িতে সময় দেখলো সে। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললো,”এতো দেরি হলো যে? কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছি।”
রাত্রি আমতা আমতা করলো। কোন রকমে বললো,”আমি আসলে..”
নিভ্রান অর্ধেক ঢুকে তার সিটবেল্ট বেঁধে দিলো। দরজা লক করে বললো,
—“ক্লান্ত দেখাচ্ছে রাত। বসো, আমি ঠান্ডা পানি কিনে আনি।”

বাসায় এসে আবার জামা বদলে শাড়ি পরে নিয়েছে রাত্রি। খয়েরি রংয়ের একটা সুতি শাড়ি। গোসল থেকে বেরিয়ে আধভেজা চুলে সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে খাবার গরম করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকলো সে। বুয়া সব রান্না করেই যায়। এখন শুধু গরম করে খেতে হবে। সব তরকারি গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রুমে গেলো সে। নিভ্রান সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে। রাত্রি ঢুকতেই তার চোখ আটকালো নিষিদ্ধ জায়গায়। রাত্রি তোয়ালে খুলে চুল ঝাড়ছে। মোমের মতো মসৃন চেহারায় পানির ছিঁটাফোঁটা। শাড়ির আচঁল কোমড়ে গোঁজা। নিভ্রান ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। এই মেয়ের খামখেয়ালিপনা শেষ হবার নয়। তাকে অনূভুতির উত্তাল সাগরে চুবিয়ে চুবিয়ে মারবে তবু একবারে ডুবতে দিবেনা। কি অসহ্য! কি দূর্বিষহ!
—“রাতের খাবার খাবেন। উঠেন।”
নিভ্রানের ধ্যান ভাঙলো। মোহ কাটলো আবার কাটলো না। আবারো ফোনের দিকে দৃষ্টি স্হাপন করে সে বললো,
—“হুম?”
—“রাতে খাবেন না?”
—“খাবোতো।”
রাত্রি তোয়ালেটা ব্যালকনিতে শুকাতে দিয়ে ফিরে এলো। তাড়া দিয়ে বললো,”চলেন”।
নিভ্রান উঠে দাড়ালো। দৃষ্টি ঘুরাতে ঘুরাতে রাত্রির বাহু ধরে কাছে টেনে কোমড়ে গোঁজা আচঁল টা খুলে দিয়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,” “সামলে থাকোনা একটু”।
মূহুর্তেই বিহ্বল চোখে তাকালো রাত্রি। নিভ্রান তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে কানের কাছে ফিসফিস করলো,”আমি কিন্তু বেসামাল হবার পথেই আছি।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ২৭+২৮

খাবার শেষে ব্যালকনিতে এসে দাড়িয়েছে রাত্রি। নিভ্রান রুমে অফিসের কি সব কাগজপত্র নিয়ে বসেছে। তাই আর বিরক্ত করেনি। স্হির দৃষ্টি নিবন্ধিত কালো কুচকুচে পানিতে। নদীর পানিরও কত রূপ। একবার মন কাড়ে। একবার ভয় জাগায়। আজকে চাঁদ উঠেনি। উঠলে হয়তো এই বিভৎস্য রুপ হতোনা জলের। রুপালি সৌন্দর্যে স্নিগ্ধতা ছড়াতো সে।
কাঁধের দিকটায় গরম নিশ্বাস। রাত্রি চমকে উঠলো। পিছে ফিরার আগেই তার পিঠে বুক ঠেকিয়ে দু’পাশ দিয়ে রেলিংয়ে হাত রাখলো নিভ্রান। লম্বা হওয়ার রাত্রি তার বুক অবধি আসে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করেই নিভ্রান আচ্ছন্ন কন্ঠে বললো,
—“কি দেখছো এভাবে?”
রাত্রি আমতা আমতা করলো। মানুষটা একটু এভাবে কথা বললেই তার কন্ঠনালিতে শব্দজট বেঁধে যায় যেনো। গোছানো কথাও অগোছালো হয়ে যায়। সময় ও যেনো ধীরে ধীরে চলে। পার হতেই চায়না।
রাত্রির নিরবতা দেখে নিভ্রানই মুখ খুললো। ধীর কন্ঠে বললো,”আমি কাছে এলেই যত আমতাআমতা তোমার।”
রাত্রি ফট করে বললো,”নদী দেখছিলাম।”

—“হুম? নদী দেখছিলে? নদীতে কি আছে?”
—“আপনি যানতো, কাজ করেন। আপনার এখানে কি?”
নিভ্রান দুষ্টুমিমেখে বললো,
—“এখানেই তো আমার সব।”
রাত্রি উশখুশ করলো। লজ্জামাখানো অধৈর্য কন্ঠে বললো,
—“যাননা।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩১+৩২