কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে শেষ পর্ব 

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে শেষ পর্ব 
নুজাইফা নূন

-” অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে আবদ্ধ।তার সাথে রয়েছে গোটা পরিবার। কিছুক্ষণ আগে স্রোত কে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে। স্রোতের প্রেগনেন্সির সবে মাত্র নয় মাস পড়েছে । কিন্তু এর‌ই মধ্যে সিজার করতে হবে।

কনসিভ করার পর থেকেই স্রোত অনেক অসুস্থ্য , দুর্বল হয়ে পড়ে।আবদ্ধ প্রথম প্রথম রাগারাগী করলেও সর্ব অবস্থায় স্রোতের খেয়াল রেখেছে। বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখে নি।আবদ্ধ স্রোত কে রেখে কিচেনে গিয়েছিলো স্রোতের জন্য খাবার আনতে‌। কিন্তু আবদ্ধ রুমে এসে দেখে স্রোত নেই।স্রোত নেই দেখে আবদ্ধের যেন পাগল প্রায় অবস্থা হয়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজে আবদ্ধ ওয়াশরুমের দরজা ভেঙ্গে দেখে স্রোত ওয়াশরুমে সেন্সলেস হয়ে পড়ে রয়েছে । শুধু তাই নয়। স্রোতের ব্লিডিং শুরু হয়েছে। তৎক্ষণাৎ স্রোত কে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। হসপিটালে আসার পর থেকেই দুঃশ্চিন্তা,অস্থিরতায় শীতের মধ্যে ও ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে আবদ্ধ।আবদ্ধ এক পর্যায়ে গা থেকে জ্যাকেট খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে।আবদ্ধ কে ছটফট করতে দেখে সাইফুল ভূঁইয়া এসে আবদ্ধ কে বললো,

-” আপনি শান্ত হন আব্বা।”
-” আমি কিভাবে শান্ত হবো বাবা? ওটি তে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী রয়েছে।ডক্টর বলেছে স্রোতের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল।তারা যেকোন একজনকে বেছে নিতে বলেছে।হয় মা না হয় বাচ্চা।এটা তো আমরা আগে থেকেই জানতাম স্রোত মা হতে গেলে স্রোতের জীবনের রিস্ক থাকবে। তবুও মেয়েটা আমাকে বাবা হবার আনন্দ দিতে গিয়ে নিজেই নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

আমি ডক্টর কে বলেছি তারা যেন আমার স্রোত কে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু স্রোত ডক্টরের হাতে পায়ে ধরে বলেছে তারা যেন আমাদের বাচ্চা কে বাঁচায়।এমনকি স্রোত বন্ডে ও সাইন করে দিয়েছে।সে নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাদের সন্তান কে বেছে নিয়েছে।এসব পাগলামির কোনো মানে হয় বাবা?আমার সাথেই এমন হয় কেন বলুন তো বাবা?আমি যাদের কে ভালোবাসি তারাই স্বার্থপরের মতো আমাকে একা করে চলে যায় ।

স্রোত একবার ও ভাবলো না সে না আমি কি নিয়ে বাঁচবো ? এমনকি স্রোত কনসিভ করার পর ও আমাকে ব্যাপার টা জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি।যখন স্রোতের মধ্যে শারীরিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে তখন আমি ব্যাপার টা বুঝতে পারি। কিন্তু তখন কিছু করার ছিলো না।আমি ডক্টরের সাথে কথা বলেছিলাম। স্রোতের জন্য আমার অংশ কে আমি নিজের হাতে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু ডক্টর বলেছিলো এবারেশন করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।আর এখনো সেটাই হচ্ছে ।আমি এখন কি করবো বাবা বলে আবদ্ধ নিচে ফ্লোরে পড়ে।আবদ্ধ কে এতোটা ভেঙ্গে পড়তে দেখে নিলয় এগিয়ে এসে আবদ্ধ কে ফ্লোর থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

-” এতো ভেঙ্গে পড়িস না আবদ্ধ। স্রোতের কিছু হবে না।”
-” অন্যকে বোঝানো যতোটা সহজ। ঠিক ততোটাই কঠিন নিজেকে বোঝানো। তুই যে এখন আমাকে সান্তনা দিতে এসেছিস। তুই কি পেরেছিলি আরুর অপারেশনের সময় স্থির থাকতে? বারবার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি।আরু কে বাদ দিয়ে তোর জন্য টেনশন করতে হচ্ছিলো আমাদের।সেসব কথা কিন্তু আমি ভুলে যাই নি।”

-” আমি ও ভুলি নি‌।আর না কোনো দিন ভুলতে পারবো।আমার জীবনের সবথেকে বড় পাওয়া আরু‌।আজ থেকে চার বছর আগে আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আমি জীবনেও বিয়ে করবো না। কিন্তু তোরা আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে মা অসুস্থতার কথা বলে আমাকে বাড়ি নিয়ে আসে।আমি বাড়ি আসা মাত্রই আমার হাতে পাঞ্জাবি ধরিয়ে দিয়ে বলে,তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে নিলয়‌।আর যদি তুই বিয়েটা করতে না চাস।

তাহলে আমি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবো।আমি বাধ্য হয়েছিলাম বিয়েটা করতে। কিন্তু তখনো জানতাম না আমার ভালোবাসার মানুষটির সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে।বিয়ের পরে বাসর ঘরেই যেতে চাই নি।মা জোর করে আমাকে বাসর ঘরে পাঠিয়ে ছিলো।বাসর ঘরে আরুকে বধূরুপে দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।মনে হচ্ছিলো যেন আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি।যদি ও প্রথম প্রথম আমাকে মেনে নিতে আরুর একটু সমস্যা ছিলো।

কিন্তু কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যায়।১ বছর পর আমাদের ভালোবাসার ফসল আমার মেয়ে রশ্মি আমাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয়।মা হ‌ওয়া সহজ কথা নয়।আমি আরুর বিন্দুমাত্র কষ্ট সহ্য করতে পারি না।সেখানে আরু প্রসব বেদনা সহ্য করছে ভেবেই বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার আরু রশ্মি দুজনেই সুস্থ্য হয়ে আমার কাছে ফিরে আসে। তুই চিন্তা করিস না আবদ্ধ।স্রোতের কিছু হবে না।স্রোত সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।”

-” আবদ্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওটির দরজা খুলে ডক্টর বেরিয়ে আসে।ডক্টর কে দেখা মাত্রই আবদ্ধ এগিয়ে এসে ডক্টর কে বললো,
-” ডক্টর আমার ওয়াইফ কেমন আছে?”
-” আবদ্ধের কথায় ডক্টর বললো, কংগ্রেস মিস্টার মুনফাসিল আবদ্ধ।আপনি একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন।”

-” আর ওয়াইফ?”
-” ওয়াইফের কথা শুনে ডক্টর কোনো কথা বলছে না দেখে আবদ্ধ ডক্টরের দিকে তেড়ে গিয়ে ডক্টরের কলার চেপে ধরে বললো,আপনি কথা বলছেন না কেন ডক্টর? কি করেছেন আমার স্রোতের সাথে?”
-” নিলয় এসে আবদ্ধ কে ডক্টরের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, সরি ডক্টর। আবদ্ধের হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।ওর মাথার ঠিক নেই।স্রোত কে বড্ড ভালোবেসে ছেলেটা।আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

-” ইটস্ ওকে। মিসেস মুনফাসিল জীবিত থাকলে ও আমরা এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।তার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল।আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। প্রতিনিয়ত ভিডিও কনফারেন্সেরের মাধ্যমে বাইরের ডক্টরের থেকে পরামর্শ গ্ৰহন করছি। তাদেরকে সমস্ত রিপোর্ট দেখাচ্ছি।২৪ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে না এলে আমাদের আর করার কিছুই থাকবে না। বাকিটা উপরে যে আছেন তিনিই নির্ধারণ করবেন বলে ডক্টর বেরিয়ে গেলেন।তিনি যেতেই আবদ্ধ ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো। শারমিন ভূঁইয়া আবদ্ধের মেয়েকে সাদা টাওয়ালে জড়িয়ে আবদ্ধের কাছে নিয়ে আসলো। কিন্তু আবদ্ধ তার দিকে ফিরেও তাকিয়ে দেখলো না।গোটা পরিবারে বিষাদের কালো ছায়ায় ঢেকে গেলো।”

-” ২২ ঘন্টা পরে স্রোতের জ্ঞান ফিরে এলো‌।এই ২২ ঘন্টা আবদ্ধ একটা বারের জন্যও জায়নামাজ ছেড়ে উঠে নি।আর না এক ফোঁটা পানি মুখে দিয়েছে।আবদ্ধ তাহাজ্জুদ পড়ে হাজতের নামাজ পড়ে স্রোতের সুস্থ্যতার জন্য আল্লাহর কাছে চোখের পানি ছেড়ে দোয়া করেছে।তার দোয়া বিফলে যায় নি। স্রোতের জ্ঞান ফিরেছে শোনা মাত্রই আবদ্ধ আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে স্রোতের কাছে ছুটে এসে স্রোত কে জড়িয়ে ধরে চোখে মুখে অজস্র চুমু তে ভরিয়ে দিতে থাকে।আবদ্ধ কে দেখে পরিবারের সদস্যরা একে একে সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।স্রোত আবদ্ধ কে দেখে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,

-” আ’ম সরি স্যার।”
-” তুমি এতোটা স্বার্থপর কি করে হতে পারলে স্রোত।একটা বার আমার কথা ভেবে দেখলে না।তোমার যদি সত্যিই কিছু হয়ে যেতো ।আমি কি নিয়ে বাঁচতাম বলো?”
-” আমার মেয়ে রয়েছে তো স্যার। আপনার অংশ।

আমার মেয়েকে দেখার পর আমি আমার সব যন্ত্রনা কষ্ট ভুলে গিয়েছি স্যার।আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে স্যার।আপনার জন্য আমার মেয়ের জন্য আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে স্যার। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই।আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে।আমি বোধহয় আর বাঁচবো না স্যার। কিন্তু এতে আমার কোনো আফসোস নেই।আমি আপনাকে বাবা হবার আনন্দ দিতে পেরেছি।এর থেকে বড় পাওয়া আমার আর কিছুই নেই।”

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৩১

-” স্রোতের কথায় আবদ্ধ স্রোতের ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে বললো,আর একটা ও বাজে কথা বলবে না তুমি।তোমার কিছু হবে না। তুমি একদম সুস্থ্য হয়ে যাবে। আমাদের কে ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না।আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না।একদম আমার #কলিজার_ভেতর_গেঁথে_রাখবো_তোমারে।

সমাপ্ত