কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২১

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২১
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

“কুয়াশা, আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
সাফওয়ানের মুখে এমন কথা শুনে কুয়াশা চকিত দৃষ্টে তাকায় তার দিকে। ছেলেটার কথার সুর বোধগম্য হতেই সে কম্পিত স্বরে বলে ওঠে,
“তুমি আমার অতীত, বর্তমান সবই জানো। তবুও এমন কথা কেন বলছ?”

“তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে আজ এখানে এসেছ। তুমি লড়াকু একজন মেয়ে। সেই তুমি কেন অতীত নিয়ে ভাবছ? আমরা কি নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারি না?”
“এক মেয়ের জীবন কয়জন পুরুষ আসতে পারে সাফওয়ান? আমার জীবনে একজন ব্যর্থ প্রেমিক, আরেকজন প্রতারক স্বামীর নাম জড়িয়ে আছে। আমি আরেকজন ছেলের নাম আমার জীবনের সাথে জড়াতে চাই না। নিজের কাছেই লজ্জা লাগে আমার। যে আমি সব সময় এক পুরুষে আসক্ত থাকতে চেয়েছি তার জীবনে তিনজন পুরুষ? অসম্ভব! আমার দ্বারা আর কোনো সম্পর্কে জড়ানো সম্পর্ক নয়।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কুয়াশা একটু ভেবে দেখতে তো ক্ষতি নেই তাই না? আমি তোমাকে খুব সুখে রাখব কথা দিচ্ছি।”
“সাফওয়ান আমার কী মনে হয় জানো? একজন ছেলে আর একজন মেয়ে কখনো একে-অপরের বন্ধু হতে পারে না। যেকোনো একজন দুর্বল হয়ে যায়। আমাদের ক্ষেত্রে সেই একজন হলে তুমি। সুতরাং আমাদের এই বন্ধুত্বের এখানেই ইতি টানা উচিত। নয়তো দেখা যাবে তুমি আমার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। আমি আর কারোর কষ্টের কারণ হতে চাই না। মাফ করে দিয়ো আমাকে। আজ এই মুহূর্ত থেকে আমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমাদের দু’জনের পথ সম্পূর্ণ আলাদা!”

কুয়াশার ডাকে ঘোর কাটে সাফওয়ানের। এতক্ষণ সে কল্পনায় এসব ভাবছিল। তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। তার কল্পনা যদি সত্যি হয় তাহলে সে কোনোদিনও কুয়াশাকে নিজের করে পাবে না। উল্টো বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। ভালোবেসে না হোক, অন্তত বন্ধু হয়ে সে কুয়াশার পাশে থাকতে চায় সারাজীবন।
“এই ছেলে এত কী ভাবছ তুমি? ঘুরতে এসেও কল্পনার জগতে হারিয়ে গেলে চলবে? এই দেখো সূর্যোদয় হচ্ছে। এই মুহূর্তটা উপভোগ করো। কল্পনা করার জন্য অনেক সময় পাবে। কিন্তু এত সুন্দর মুহূর্ত আর ফিরে পাবে না বুঝেছ?”
সাফওয়ান ছোট্ট করে উত্তর দেয়,

“হুম।”
‘হ্যা’ বোধক জবাব দিয়ে সাফওয়ান কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে এসেছে ঠিকই। তবে সে সূর্যোদয় দেখছে না। সে কুয়াশাকে দেখছে। মেয়েটার চোখ দু’টো বড্ড মায়াবী। বড়ো বড়ো চোখ দু’টো যেন মায়ায় ভরপুর। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মেয়েটার পুরো মুখ জুড়েই সৌন্দর্য ঘুরে বেড়ায়। গালের দুই পাশে কিছু ব্রণের দাগ, কপাল জুড়ে নতুন কিছু ব্রণের আবির্ভাব হয়েছে। ঠোঁটের উপরে থাকা ছোট তিলটাও যেন হাসে যখন মায়াবিনীর ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। সুদীর্ঘ কেশের অধিকারী এই মেয়ে। বাতাসের তালে তালে তার চুলগুলো যেন আপনমনে নেচে ওঠে। আচ্ছা, সৌন্দর্যের জন্য আর কি কিছুর প্রয়োজন আছে? যার মন সুন্দর, সে তো এমনিতেই সুন্দর। আর যে রূপে, গুণে সবদিক থেকে সেরা, সে তো অনন্য সুন্দর। ঠিক যেমন কুয়াশা!

“তুমি অনন্য সুন্দর কুয়াশা!”
হঠাৎ সাফওয়ানের কন্ঠে এমন কথা শুনে কুয়াশা হেসে উত্তর দেয়,
“মজা করো আমার সাথে?”
“মজা করব কেন?”
“আমার মত মেয়ে সুন্দর হয় কীভাবে? হ্যা, আমার চোখে আমিই সেরা। কিন্তু কোনো ছেলের চোখে আমি অনন্য সুন্দর এটা মানতে বেশ কষ্ট হয় আমার।”
“কেন?”
“ছেলেরা তো সাদা চামড়ার প্রেমে পড়ে বেশি। সেদিক থেকে আমি প্রেমে পড়ার মত সুন্দরী নই।”
“সবাই কী সমান হয়?”
“না।”

“আমার চোখে তুমি সত্যিই অনন্য সুন্দর। তোমার গালের দুই পাশে থাকা ব্রণের দাগ কিংবা কপালে থাকা ব্রণগুলো তোমাকে আরো সুন্দর হতে সাহায্য করেছে। তোমার চোখ দু’টো তোমার সৌন্দর্যের প্রতীক। তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি আর ঠোঁটের উপরে থাকা কালো তিল তোমার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এমন এলোকেশী কন্যাকে কার না ভালো লাগে? এরপরও বলবে তুমি সুন্দর নও?”

“আমি নিজেকে ভালোবাসতে জানি। সবার আগে নিজেকে ভালোবাসা প্রয়োজন। আমি যদি নিজেকে ভালোবাসতে না পারি তাহলে অন্যজনকে কীভাবে ভালোবাসবো? আমি নিজের ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে জানি। বারবার নিজের ছবি জুম করে দেখতে জানি। নিজের প্রেমে পড়তে জানি। নিজেকে নিজেই বলতে জানি, আমি সুন্দর। বাকি সবার থেকে আলাদা হওয়ার নতুনত্ব আমাকে আরো বেশি সুন্দর করে তোলে। আমি নিজেই নিজের প্রশংসা করতে জানি। নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় মুখ ঢেকে হাসতে জানি। কিন্তু, একজন ছেলের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হতে জানি না। কারণ, আমার ভালোবাসার মানুষ ব্যতিত আর কোনো ছেলে আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করুক তা আমার পছন্দ নয়।”

“তুমি এমন কেন?”
“আমি এমনই। জানো? আমার জীবনে ছেলে বন্ধুর সংখ্যা নেই বললেই চলে। প্রথমবার প্রেমে পড়েছিলাম রায়াদের উপর। তার আগে কিংবা পড়ে আমি অন্য কাউকে দেখে সেই অনুভূতি অনুভব করিনি যা রায়াদের প্রতি করতাম। রায়াদ ব্যতিত কোনো ছেলের সাথে কথা বলার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর তুরাব আসে আমার জীবনে আমার স্বামী হয়ে। তার প্রতি অনুভূতি জাগ্রত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।

কারণ তাকে আমি খুব গভীর থেকে দেখেছি। নিজের স্বামীর প্রতি অনুভূতি জন্ম নিতে আমার অনেক সময় লেগেছে। অদ্ভুতভাবে তার প্রতি পুরোপুরি অনুভূতি জন্মানোর আগেই তার সাথে আমার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। আর সর্বশেষ তুমি এলে। তোমাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ আমার সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে তুমি আমাকে সাহস জুগিয়েছ। বন্ধু হিসেবে তোমাকে পাশে পেয়ে আমি অনেক বেশিই খুশি। আমাকে বুঝতে পারো তুমি। যা অন্য আর কোনো ছেলে পারেনি। তুমি চলে গেলে আর কোনো ছেলে আমার জীবনে আসবে না এটুকু কথা দিতে পারি। এখন ছেলেদের প্রতি কোনো টান অনুভব করতে পারি না আমি। হয়তো বারবার ঠকে যাওয়ার ফলাফল এটা!”

কুয়াশার কথায় সাফওয়ানের কল্পনার কথাগুলো মনে পড়ে। সে আনমনে ভাবে,
“তবে কি আমার কল্পনায় সত্যি হবে?”
আর কিছু ভাবতে পারে না সে। ভালো লাগছে না এসব ভাবতে। তার থেকে সবকিছু যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক।
কিছুক্ষণ পর মল্লিকা আদ্রিতাকে সঙ্গে নিয়ে কুয়াশাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। কুয়াশা হাসিমুখে বলে,

“প্রেম করা হলো ম্যাম?”
“কাকে বললি?”
“কেন ম্যাম? আপনি প্রেম করেন না বুঝি? শুধু আদ্রিতাকে বলিনি। আপনাকেও বলেছি।”
“ওটাকে প্রেম বলে? সারাক্ষণ বেয়াদবটা আমার সাথে ঝগড়া করে। আদ্রিতাকে দেখ। কত সুন্দর হেসে হেসে দু’জন কথা বলে। আর আমাকে তো চিল্লাতে হয় সারাক্ষণ।”

“এই তোরা বিয়ে করবি কবে বল তো?”
“জানি না।”
“জানিস না মানে কী?”
“এই বিষয়ে কথা বলিনি এখনো।”
“আর কবে বলবি?”
“সত্যিই এবার ওকে বিয়ের কথা বলা উচিত আমার।”

“তাড়াতাড়ি বল। আর কতদিন দূরে দূরে থাকবি? এভাবে থাকলে ঝগড়া ছাড়া আর কিছু হবে না।”
“সম্পর্কের মাত্র আট মাস। এজন্য চাপ দিচ্ছি না। কিন্তু তুই যখন বলছিস তখন এই বিষয়ে আমি ওর সাথে কথা বলব।”
“এই যে মিস আদ্রিতা, আপনার কি বিয়ে করার ইচ্ছা নেই?”
কুয়াশার কথায় আদ্রিতা কিছুটা লজ্জা পেয়ে উত্তর দেয়,
“থাকবে না কেন? অবশ্যই ইচ্ছা আছে।”

“আমার বিয়ের আগে থেকে তোর সম্পর্ক শুরু হয়েছে। আমি বিয়ে করে কয়েক মাস সংসার করলাম। এরপর আমার বিয়ে ভেঙে পর্যন্ত গেল। অথচ তোর বিয়ের কোনো নামগন্ধ নেই।”
“ওর পরিবার থেকে আমাকে দেখতে আসবে কিছু দিন পর। এই নিয়েই এতক্ষণ কথা বললাম আমরা।”
“বাহ্ ভালো তো। এক কাজ কর। তুই আর মলি দু’জন একসাথে বিয়ের অনুষ্ঠান কর। দারুণ হবে।”
“আমাদের বিয়ে নিয়ে পরে কথা হবে। আগে বল তুই বিয়ে করবি কবে?”

মলির এমন প্রশ্নে কুয়াশা কোনো উত্তর দেয় না। চুপ করে সবার সামনে থেকে চলে যায়। সাফওয়ান অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে কুয়াশার যাওয়ার পানে।
“তোমাদের বান্ধবী কি আর বিয়ে করতে চায় না?”
“জানি না ভাইয়া।”

“কুয়াশা তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয় মলি। ওকে জিজ্ঞাসা করো। নতুন করে জীবন শুরু করতে চায় না সে?”
“কিছুটা সময় দরকার ওর। এসব নিয়ে এখনই এত প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। ওর সাথে যা যা হলো তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ওকে আরো কিছুটা সময় দেওয়া প্রয়োজন।”

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২০

বিঃদ্রঃ সবাইকে রমজানের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২২