রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ১২

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ১২
ফারজানা মুমু

রাত নয়টা। আকাশে চাঁদের দেখা নেই। তারা ফুটেছে শতশত। মৃদুমন্দা বাতাসের দোল। সাঁইসাঁই বাতাসের শব্দে মৃদু কাঁপছে চৈতি। ভয়ে তটস্থ শরীর। শরীর শিউরে উঠার মত সময়। অক্ষরকে দেখতে পেল বেশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সাহস পেল মনে। দ্রুত পা বাড়িয়ে চলল অক্ষরের সামনে। চৈতিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল অক্ষর, আপনি ঠিক আছেন তো?
-” আমরা এক্ষুনি বিয়ে করব।

অবিশ্বাস্য শব্দ কানে বাজতেই কপালে ভাঁজ পড়ল অক্ষরের। ঠোঁট চেপে ধরে বলল, আমি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছি।
মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে চৈতি জবাব দিল, ইয়ার্কি-মশকারি করার সময় নয়। আমাদের হাতে সময় কম। কাজী অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।
বিস্ময় দৃষ্টিতে প্রশ্ন করল অক্ষর, আপনার মাথা ঠিক আছে ম্যাম? হঠাৎ বিয়ে? আমরা সকালে কথা বলি?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” আপনি যদি এখন আমায় বিয়ে না করুন তাহলে আমি নিজেকে শে’ষ করে ফেলব বলে দিলাম।
ধারালো ব্লে’ড অক্ষরের সামনে ধরল চৈতি। আসার পথে দোকান থেকে কিনে এনেছে। সে জানে অক্ষর সহজে রাজি হবে না। পালিয়ে বিয়ে করার লোক নয় অক্ষর কিন্তু তাকে তো পালিয়ে বিয়ে করতেই হবে। চয়ন তাদের এক হতে দিবে না।
অক্ষর রা’গী গলায় ধমকে উঠল। চৈতির হাত থেকে ব্লে’ড নেওয়ার চেষ্টা করল। চৈতি পিছন দিকে পা বাড়িয়ে বলে উঠল, আমি মোটেও ন্যাকা টাইপের মেয়ে নই অক্ষর। আমি কেমন আপনি জানেন। ভয় দেখানোর কাজ আমি করি না। স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করি। আমাকে দেখে নিশ্চয় মনে হচ্ছে না আমি মজা করছি। আমি সিরিয়াস। হয় বিয়েতে রাজি হবেন নয়তো আমার মৃ’ত দে’হ দেখবেন।

বাম হাতের শি’রায় ব্লে’ড ধরল চৈতি। ভিতরে ভিতরে ভয়ে কাবু। হাত কা’টা’র মত ভুল সে করবে না কিন্তু অক্ষর? অক্ষর কী রাজি হবে? যদি না হয় তাহলে তো সত্যি সত্যিই কা’ট’তে হবে শি’রা। ভয়ে ঢোক গিলল। দু’আ দুরুদ পড়তে লাগল অক্ষরের মনে ভয় প্রবেশ করানোর জন্য। সৃষ্টি কর্তা সহায় হলো। অক্ষরের চোখে ভ’য়ের ছাপ। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে করুন চোখে তাকিয়ে জবাব দিল, আমি আপনাকে এক্ষুনি বিয়ে করব। প্লিজ ব্লে’ড ফেলুন।

-” সত্যি তো!
-” আমি মিথ্যা বলি না চৈতি। আমার ভয় হচ্ছে আপনি হাত থেকে ব্লে’ড নিচে ফেলুন।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চৈতি ব্লে’ড ফেলে দিল। একটুর জন্য মনে হলো প্রা’ণ পাখিটা বুঝি হা’রাতে চলেছে। মনেমনে ভয়কে জয় করে অক্ষরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এখন চলুন কাজী অফিস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল অক্ষর, লুকিয়ে বিয়ে করার মতো লোক আমি নই চৈতি কিন্তু আজ আমি দিশেহারা। আমিও আজ চয়নের মত অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।

-” আমি বেশি কথা শুনতে চাচ্ছি না। চলুন নয়তো এখন গাড়ির নি’চে লা’ফ দিবো।
-” ভাইবোন দুজনের ঘাড়ের র’গ ত্যারা।
চৈতি অক্ষরের কথা ধরল না। বাইকের পিছনে বসল। অক্ষর উপায়ন্তর না পেয়ে বাইক ছাড়ল। উদ্দেশ্য কাজী অফিস।
শুনশান নীরবতা। অক্ষর রাস্তায় একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। চৈতি তখন ঘোরের মধ্যে। ঠিক-বেঠিক চিন্তায় মগ্ন। এরই মাঝে কাজী অফিসের সামনে বাইক থামে। দুজনেই নেমে পরে।

কাজী অফিসের ভিতরে চলে আরেক ঝামেলা। সাক্ষী ছাড়া বিয়ে দিবে না কাজী। এখন সাক্ষী কোথায় পাবে চিন্তায় চৈতি। অক্ষরের মুখে বিরক্তির ছোঁয়া। রাগী দৃষ্টিতে দেখছে চৈতিকে কিন্তু চৈতি এমন একটা ভাব নিয়ে বসে আছে সাক্ষী থাকুক আর না থাকুক আজ তাকে বিয়ে করতেই হবে। অক্ষর কাজীর সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,

-” মিয়া-বিবি রাজি এখন আপনি সাক্ষী খোঁজছেন কেন? সংসার কে করবে আমরা নাকি সাক্ষী?
-” দেখুন স্যার, সাক্ষী ছাড়া বিয়ে হবে না। বিয়ের ডকুমেন্ট তৈরির করার জন্য সাক্ষীর সাক্ষর প্রয়োজন।
-” কেন আমি কী বউকে ছেড়ে চলে যাব? সাক্ষী-তাক্ষির দরকার নেই যদি সাক্ষীর প্রয়োজন বাধ্যতামূলক থাকে তাহলে আপনি নিজেই সাক্ষী হয়ে যান। আপনার সাক্ষীর উপর বড় সাক্ষী দুটো আছে?
অক্ষরের কথায় হকচকিয়ে উঠল কাজী। নেহাৎ পুলিশ সেজন্য কিছু বলছে না। তবে মনেমনে রাগে বো’ম। অক্ষরের সামনে শান্ত হেসে বলল, আমার সাক্ষী কাজে দিবে না স্যার। সাক্ষী ছাড়া বিয়ে হবে না। কষ্ট করে দুজন লোককে খোঁজে আনুন প্লিজ।

বাধ্য হয়ে জয়-বিজয়কে ফোন দিল অক্ষর। মিনিট দশেকের মধ্যে দু-ভাই আসলো। অক্ষরকে কাজী অফিসে দেখেই ভড়কে গেল। অবাক কণ্ঠে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না তুই ভেগে বিয়ে করতে আসছিস।
কাটকাট গলায় উত্তর দিল অক্ষর, ভেগে কী শব্দ? শুদ্ধ ভাষায় বল পালিয়ে।
জয় বলল, হঠাৎ পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত কেন?

হতাশ কণ্ঠে বলল অক্ষর, ম্যাডামের শখ পূরণ করতে হচ্ছে। ম্যাডাম এখন এই মুহূর্তে বিয়ে করবে।
বিজয় তখন অক্ষরের কানে ফিসফিস করে বলল, অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছিস না তো ? সুখবর আছে নাকি?
দাঁতে দাঁত চেপে বলল অক্ষর, তোদের মত আমাকে ভাবিস? প্রেমের অভিনয় করতে করতে এখন বিয়ে অব্দি গড়ালো। আমি না থাকলে বিয়েটা হতো? তাছাড়া আমি বুঝি না তোদের চরিত্র কেমন? শান্তা-কান্তাকে জানাবো?
দু’জনেই দম ছেড়ে বলল, শুভ কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেল। আমাদের তো আমার রুম সাজাতে হবে।

অক্ষর শব্দ করে হাসলো। চৈতি দুর থেকে দেখে চলল। তিনজন ছেলে হাসাহাসি করছে কিন্তু সামনে যাচ্ছে না। হাজার হোক লজ্জা পাচ্ছে সে। সফেদ মুখশ্রীতে লজ্জাদের হানা।
অবশেষে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হতে চলল। কাবিন নামায় স্বাক্ষর দেওয়ার সময় চোখ বেয়ে পড়ল অশ্রু বিন্দু। প্রথম অনুভব করল পরিবার ছাড়া থাকার অনুভুতি। চয়নের হাসি-হাসি মুখটা ভেসে উঠল। হৃদয় কেঁ’পে উঠল। ভিতর সত্তা জানান দিল, ভাইকে ঠকিয়ে সুখী হতে পারবি? সাথেই আরেকটি সত্তা প্রশ্ন ছুঁড়ল , অক্ষরকে ছাড়া বাঁ’চতে পারবি? দুটো প্রশ্নের উত্তর একটিই ‘ না ‘।

‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’ শব্দ দুটো বলার পর পরেই চৈতি হয়ে গেল অক্ষরের অর্ধাঙ্গিনী। শান্তি-অশান্তি দুটো শব্দের মাঝে আবিষ্কার করল নিজেকে। চয়ন যদি আজ তাদের মেনে নিত তাহলে শান্তিময় জীবনযাপন করতে পারতো কিন্তু আফসোস তারজন্য আরো সময় অপেক্ষা করতে হবে। বুঝাতে হবে প্রিয় ভাইকে……
জয়-বিজয় চলে গেল। চৈতি জানালো সে এখন বাসায় যাবে। অক্ষর তখন কপাল ভাঁজ করে প্রশ্ন করল, বাসর রাতের কী হবে? তাড়াহুড়ো বিয়ে করলাম কী একা থাকার জন্য?

-” কাগজে-কলমে আপনাকে আমার ব্যাক্তিগত পুরুষ বানালাম। কিন্তু ভাইয়া মেনে নেওয়ার পর দুজন ব্যাক্তিগত বাসায় থাকবো। বুঝেছেন স্বামী?
-” এটা কিন্তু ঠিক নয়। বিয়ের আগে একা থাকা যায় কিন্তু বিয়ের পর একা থাকা ঘোর অন্যায়। আপনি আমার সাথে অন্যায় করতে পারেন না শুভ্রপরী।
চৈতি বাঁকা হেসে বলল, তাড়াতাড়ি বাসায় চলুন ভাবি ফোন দিয়েছে। সে অপেক্ষা করছে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল অক্ষর, ঝুমুর জানে?

-” বুদ্ধিটা ওনারই। আর শুনুন ভাইয়া আমাদের কথা জেনে গেছে এখন আপনি আমাদের বাসায় থাকতে পারবেন না। নতুন ফ্ল্যাট দেখুন। ভাবি বিয়ের কথা জানাতে নিষেধ করেছে।
চৈতি সব ঘটনা বলল শুধু ঝগড়ার কথা বাদ দিয়ে। বোনের গা’য়ে হাত তুলেছে অক্ষর সেটা মেনে নিবে না। আবার ঝামেলা যেন না হয় তাই লুকিয়ে গেল। সবকিছু শুনে অক্ষর বিড়বিড় করল, তাহলে আমার সন্দেহই ঠিক। এই শা’লা আমাকে সন্দেহ করেছে। বড় শালা বাবু সন্দেহ করে কী হলো? বরং নিজে লোস করে আমার লাভ বাড়িয়ে দিলে। হাহাহা।

-” হাসছেন কেন?
-” শা’লা বাবুকে শায়েস্তা করার প্ল্যান খুঁজছি ম্যাম। এতদিন আমায় বহুত জ্বা’লিয়েছে এখন থেকে আমার সময় শুরু।
-” আপনারা দুজন হলেন টম এন্ড জেরি। একজন আরেকজনকে বাঁ’শ দেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজেন। নোবেল দেওয়া উচিৎ আপনাদের নীরবে ঝ’গড়া করার জন্য।

চৈতিকে বাসায় নামিয়ে অক্ষর চলে গেল। ঝুমুর সদর দরজার কাছেই ছিল। চৈতিকে নিজের রুমে পাঠিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে চলে গেল। বিছানায় শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে চয়ন। অপলক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত চয়নকে দেখে অজান্তেই আখি-পল্লবে ওষ্ঠ ডুবিয়ে মনেমনে বলল, আমায় ক্ষমা করে দিও চয়ন। এ ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে থাকার কষ্ট হয়তো আমি জানি না কিন্তু অনুভব করেছি আমি চাইনা আমার দাদাভাই এবং তোমার বোন কষ্ট পেয়ে হারিয়ে যাক। তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি তাদের এক করে দিলাম। আমায় তুমি ভুল বুঝ না।

ঘুমের মধ্যেই ঝুমুরকে বুকে জড়িয়ে ধরলো চয়ন। ঝুমুর মাথা রাখল প্রিয় মানুষটির বুকে। চোখ জোড়া বন্ধ করতেই ঘুম পাখিরা হানা দিল দু’চোখে। শান্তিময় ঘুম হারিয়ে দিল শত কষ্ট। প্রিয় মানুষের কষ্টগুলো হাওয়া মিঠাইয়ের মত মিলে গেল।
চৈতির ঘুম হলো না আজ। একটু পর-পর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অক্ষরের ভালোবাসার পরশগুলো মনে হতেই শিউরে উঠল। বাসায় নামানোর আগে নিজেদের মধ্যে একান্ত সময় উপভোগ করেছে দু’জন। অক্ষরের উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া কপালে ঠেকল। অনেকটা সময় নিয়ে অক্ষর চৈতির কপালে চুম্বন দিয়েছিল জানা নেই তবে সময়টা ছিল ক্ষণস্থায়ী। ফোন আসল চৈতি ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে অক্ষরের নামটা দেখে মুচকি হেসে রিসিভ করল। অপরপাশ থেকে অক্ষর বলল, কেমন আছেন বিবিজান? আপনায় বড্ড মিস করছি। আগামীকাল দেখা হবে তো?

-” আগামীকাল শপিং করতে যেতে হবে। শান্তা-কান্তা জানিয়েছে ওদের সাথে যেতে।
-” আপনিও আগামীকাল একটা বেনারসি কিনবেন বিবি। আপনাকে লাল বেনারসিতে দেখতে ভীষন ইচ্ছে করছে।
-” আপনি আসবেন আগামীকাল?
-” আপননি বললে আমি নিজের জী’বন দিতে রাজি। দেখা করাটা কী এমন ব্যাপার।
-” জী’বন দিতে হবে না। বরং বিকালে চলে আসুন শপিং মলে। ফোন দিয়ে জানিয়ে দিবো।
-” ভালোাবাসা বাগানের ঝরে যাওয়া ফুল,

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ১১

আর, ভালোবাসি মেঘলা নদীর কুল।
ভালোবাসি উড়ন্ত এক ঝাঁক পাখি,
আর, ভালোবাসি তোমার ওই দুই নয়নের আঁখি।”(কালেক্টেড)
কথাগুলো এক নিমিষে বলে ফোন কাটল অক্ষর।

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ১৩

1 COMMENT

Comments are closed.