হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১৬

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১৬
সাইয়ারা মম

সুখ জিনিসটা আসলে আপেক্ষিক। আমরা বর্তমানে কেমন আছি সেটা নির্ভর করে অতীতে কেমন ছিলাম তার ওপরে।এই যেমন অতীতে আমার যদি একশ টাকা খরচ করার সামর্থ্য থাকত আর বর্তমানে যদি সেটা কমে দশটাকায় দাঁড়ায় তাহল আমরা ভাবি আমাদের কষ্টের দিন এসেছে।আমাদের এখন আর সুখের দেখা মিলবে না।

কিন্তু যার অতীতে দশটাকাই ছিল খরচ করার সামর্থ্য তার যদি বর্তমানেও দশ টাকা খরচের সামর্থ্য হয় তাহলে সে ভাববে সে সুখেই আছে।আসলে এই সুখটা নির্ভর করে আমরা কিসের ওপর ভিত্তি করে সেটাকে পরিমাপ করছি
মিহু অতীতে কেমন ছিল জানেনা শুধু জানে এই দুদিনে সে অনেক সুন্দর একটা জীবন পেয়েছে।একটু আগে পিহু ফোন করে বলে দিয়েছে যে নেহালের একটা জরুরী কাজ পড়েছে তাই ওদের বাসায় যেতে হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নীলু একটু মন খারাপ করেছিল নেহাল ভাই ওর সাথে দেখা করতে আসেনি বলে।তবে মিহুর সাথে কথা বলতে বলতে খারাপ লাগাটা কেটে গিয়েছে।ওর হাই পাওয়ারে খাওয়া ওষুধ গুলোর কারণে সন্ধ্যার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।মিহু একটু কেবিনটার দিকে তাকিয়ে দেখে সারা জায়গায় এখানে ওখানে জামা কাপড় পড়ে আছে।ও একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে নিল।তারপর নীলুর কপালে হাত বুলিয়ে দিল।হাত বুলাতে বুলাতে মিহু নিজেও নীলুর পাশে ঘুমিয়ে পড়ল।

আরফান সব কাজ গুছিয়ে হাসপাতালে আসলো।এই কাজের ফলে ও নীলুকে বেশী সময় দিতে পারছে না।আর এখন তো আরো দায়িত্ব বেড়ে গেছে।ওর জীবনে মিহুও জড়িয়ে গিয়েছে।যতই হোক দায়িত্ব গুলো আরফান খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করে।এসব ভাবতে ভাবতেই কেবিনের দরজা খুলল।দরজা খোলার পরে ওর হৃদয়টা জুড়িয়ে গেল।নীলুর পাশেই মিহু ঘুমিয়ে আছে।ঘুমের মধ্যেই নীলুর মাথায় বার বার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

আরফান ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে গেল।মিহু যে পাশে ঘুমিয়ে আছে সেই পাশে গিয়ে হাটু মুড়ে বসল।নীলুর দিকে তাকিয়ে মিহুর দিকে তাকালো।এই মেয়েটার মুখে একধরনের মায়া কাজ করে যেটা আরফানকে ওর দিকে টানে।কয়েকটা চুল মিহুর কপালে এসে পড়েছিল। আরফান হাত দিয়ে ঐগুলো সরিয়ে দিল।তারপর ভালো করে খেয়াল করে দেখল যে মিহুর বাম পাশের চোখের নিচে একটা তিল রয়েছে।

আরফান মিহুর দিকে তাকিয়েই ছিল তখনই হঠাৎ করে মিহু পাশ ঘুরতে গিয়ে বেড থেকে পড়ে যেতে নিলেই আরফান মিহুকে ধরে ফেলে।মিহু গিয়ে পড়ে আরফানের কোলের মাঝে।আরফান এমন ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল।মিহু ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে গেল। চোখ খুলে নিজেকে আরফানের কোলে আবিষ্কার করে বিস্মিত হলো।দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল।হয়ত দুজনে এইভাবেই তাকিয়ে থাকত যদি না আরফানের ফোন আসত।ফোনের রিং শুনে আরফান মিহুকে নামিয়ে দিল। আর দ্রুত বাইরে চলে গেল।

মিহুর জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষকে এত কাছ থেকে দেখেছে।লজ্জায় মিহুর গাল দুটো লাল হয়ে গেলো।ও একবার নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখে নীলু একটু নড়ে চরে আবার ঘুমিয়ে গেল।আরফানের সামনে পড়লে এখন আর ও আরফানের দিকে তাকাতেই পারবেনা।ও উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল।

পিহু অনেকক্ষণ ধরে দেয়ালে একটা পেইন্টিং লাগাতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।পেইন্টিং টা তিনটা অংশে বিভক্ত যদি উপরে ধরে লাগাতে যায় তাহলে নিচে থেকে সরে যায় আবার নিচ থেকে লাগাতে গেলে উপর থেকে সরে যায়। এটা নিয়ে এত ঝামেলা হচ্ছে বলার বাহিরে।নেহাল দরজায় ফুলগুলো লাগাচ্ছিল,হঠাৎ করে পিহুর দিকে তাকাতেই দেখতে পায় পেইন্টিং টা নিয়ে বহুত ঝামেলা করছে।তাই ও পিহুর কাছে গিয়ে ওর পেছন থেকেই পেইন্টিং টার উপরের দিক ধরে বসল আর পিহু এক এক করে এবার তিনটা খন্ডই লাগিয়ে ফেলল। এবার অনেক খুশি লাগছে।পেছন ফিরতে নেহালের দুই হাতের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।নেহাল ওর দুই হাত দিয়ে দেয়ালে পিহুকে আটকিয়ে ফেলেছে।নেহাল পিহুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।পিহু কিছু বলতে যাবে তার আগেই নেহাল পিহুর ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল

-হুস,কোনো কথা বলবে না।
তারপর পিহুর দিকে তাকিয়ে থাকল একটু সময় ধরে।পিহু অপেক্ষায় আছে নেহাল কি বলবে এর জন্য।কিন্তু নেহাল কিছু না বলে পিহুর দিকে তাকিয়েই আছে।
-ভাই এইভাবে ভাবির দিকে নজর দিস না।তোর নিজেরই বৌ।পরেও দেখতে পারবি।এখন আমার মতো সিঙ্গেলের সামনে বসে এত মহব্বত না করলেও পারিস।
দরজার সামনে বসে বলা পিয়াসের কথাগুলোর ফলে নেহালের মুডটা নষ্ট হয়ে গেল।নেহাল চোখ গুলো বড় বড় করে পিয়াসের দিকে তাকালো।পিহু মিটমিটিয়ে হাসল।নেহাল পিয়াসের দিকে তাকাতেই পিয়াস ক্লোজ আপ মার্কা হাসি দিয়ে বলল

-ভাই তোর চোখের ধার বিয়ের পরে কমে গেছে বিয়ের পরে এখন আর ধার দিলেও হবে না।আর তোর চোখকে এখন আর আমি ভয় ও পাই না
-তুই আসার আর টাইম পেলি না
-ভাই তুই নিজেই আমাকে ফোন দিয়ে ডেকেছিস। এখানে আমার কোনো দোষ নাই
বিদিশা গিয়েছিল পানি নিয়ে আসতে।এখানের ঘটনা না সম্পর্কে না জেনেই বলল
-হ্যালো হ্যালো গাইজ। এখানে কি হয়েছে আমাকে কেউ একটু বলবে?

বিদিশাকে দেখে পিয়াস ভূত দেখার মতো ভয় পাওয়ার অভিনয় করে এক লাফ দিয়ে সরে গেল।তারপর বলল
-আর জ্বীনের বাদশা বিদিশা আপনি এখনো বাসায় যান নি? আপনার মা বাবা তো আপনার জন্যে টেনশন করবে।আপনি মা বাবা ছাড়া থাকবেন কীভাবে?এত ছোট মানুষ।
বিদিশা ভ্রু কুচকে পিয়াসের দিকে তাকাল। পিয়াস কি ওকে অপমান করল না ওর মজা উড়ালো বুঝলো না।তারপর বলল

-আরে আপনি যে ষাঁড় তা বার বার প্রমাণ করতে হবে না। আমরা এমনিতেই জানি একথাটা
-আমি প্রমাণ করলাম কখন?
-এই যে একটু আগে ষাঁড়ের মতো লাফ দিলেন।
নেহাল কতক্ষণ এর দিকে তাকায় আবার কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকায়।তারপর একটা ধমক দিয়ে বলল
-চুপ করবি তোরা?বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছিস। এখন তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দে নাহলে সকালের মধ্যে শেষ করতে পারব না।

-কিন্তু ভাই নীলুর ঘর এতো ঘটা করে সাজানো হচ্ছে কেন? আমিতো বুঝতেই পারছি না
-ষাঁড়ের যে মাথায় ঘিলু নাই তা একে দেখলেই বোঝা যায়।বির বির করে বিদিশা বলল।বিদিশার বলা শুনে পিয়াস বলল
-কি বললেন একটু জোরে বলেন।শুনতে পাই নাই
-বলছি আপনার মাথায় সমস্যা যার কারণে কানে শুনতে পারছেন না।
-তোরা আবার শুরু করেছিস?
-কিন্তু আয়োজন টা কিসের?

-ভাইয়া আমি বলছি।নীলুর কালকে জন্মদিন আর তাছাড়াও নীলু এই দুদিন হাসপাতালে ছিল। তাই একটা সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করেছি?
-নীলুর জন্মদিন কবে?
-কালকে
পিয়াস বিদিশার কথা শুনে বলল- আচ্ছা আজকে কত তারিখ?
বিদিশা ক্যালেন্ডার এনে পিয়াসের চোখের সামনে ধরল।তারপর বলল- এই নিন দেখেন আজকে কত তারিখ।
-ভাই এটা সত্যিই ২৩ সালের ক্যালেন্ডার তো?

বিদিশা ক্যালেন্ডারে ২০২৩ সাল লেখাটায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল- এই যে এখানে লেখা আছে।
পিয়াস মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।পিয়াসকে এরকম আপসেট হতে দেখে নেহাল জিজ্ঞেস করল
-কি হয়েছে?এভাবে বসে পড়লি কেন?
-ভাই আজকে আমার একটা জবের ইন্টারভিউ ছিল।মায়ের জোরাজুরিতে তার এক খালাতো বোনের অফিসে একটা জবের জন্য যেতে বলেছিল।তিনি বলেছিলেন আমি গেলেই নাকি আমার চাকরি কনফার্ম করে দিবেন।কিন্তু আমার মনেই ছিল না যে আজকে সকালে ইন্টারভিউ ছিল।

-তো এখন কি করবি?
-ভাই শুধু একটা উপকার করিস। আজকে একটু মাকে বলবি আমি কোথায় তা তুই জানো না।আর আমাকে আজকে এই বাসায় লুকিয়ে থাকতে দিস।মা আজকে আমাকে কাচা খেয়ে ফেলবে
ছাদে বসে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে মাহিন।কোনোদিন না খাওয়ার ফলে এখন কাশতে হচ্ছে। আসলে একটা কথা ঠিক ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’

মিহুর বিয়ের পরে ও বুঝতে পেরেছে যে ও কি মূল্যবান জিনিস হারিয়েছে যা ফেরত চাইলেও পাওয়া যাবে না।মিহুকে যে ও কতটা ভালোবাসতো সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।ও যদি মিহুকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেত তাহলে হয়তো সব সমস্যার সমাধান হতো।আর তাছাড়াও মিহু তো কাউকে ভালোবাসতো না যে ওকে বিয়ে করতে মানা করত।হঠাৎ করেই ও দেখতে পেল মিহু ওর দিকে এগিয়ে আসছে।এসে ওর হাতের সিগারেটটা ফেলে দিল।তারপর বলল

-মাহিন ভাই তুমি এটা কি করছো?এভাবে নিজেকে কেউ শেষ করে?
-মিহু শেষ তো ঐদিনই হয়েছি যেদিন তুই অন্যকারো বৈধ দলিল হয়ে গিয়েছিস।
-তাই বলে এখন নিজেকে শেষ করে লাভ আছে? সিগারেট মানুষের জন্য কতো ক্ষতিকর তা তুমি নিজেই ভালো করে জানো।

-নিকোটিনের ধোঁয়া মানসিক শান্তি দেয়
-কিন্তু সেটা সাময়িক। আর ঐটার ক্ষতিটা হলো চিরকালের জন্য
-এটার ক্ষতি ছাড় যে ক্ষতিটা বুকের এই বামপাশে হয়েছে সেটা কখনো পোষাতে পারবো?
-মাহিন ভাই ক্ষতি যতোই হোক সেটাকে পূরণ করার কিন্তু বিভিন্ন উপায় আছে
মাহিন মিহুর কথায় একটু থমকালো।তারপর কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল

-মিহু তুই তো আরফানকে ভালোবাসো না।আমি যদি বলি আমার কাছে চলে আয় তাহলে চলে আসবি?আমি তোকে নিয়ে দূরে চলে যাবো অনেক দূরে।যাবি আমার সাথে?
মিহু খিলখিল করে হেসে দিল।তারপর বলল
-মাহিন ভাই আমি জানতাম মদ খেলে মানুষ হুশে থাকে না।কিন্তু এখনতো দেখছি সিগারেট খেলেও হুশ উড়ে যায়।
-মিহু তুই উত্তর টা বল
মিহু মাহিনের দিকে তাকালো।তারপর হাসি হাসি মুখ করে বলল
-তুমি ছোট বেলায় আমাকে দেখে শুনে রাখতে।আমার সম্পর্কে তোমার এতটুকু ধারণা তো হয়েছে যে এই প্রশ্নের উত্তর কি হতে পারে?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১৫

-দেখ মিহু সো,,,,,,
মিহুকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাইলো কিন্তু মাহিন মিহুকে কোথাও দেখতে পেল না। আচ্ছা তাহলে এগুলো কি সব ভ্রম ছিল?মনের কল্পনা? কল্পনাই হবে না হলে এত রাতে মিহু এখানে কি করবে?তবুও এই প্রশ্নের উত্তরে মিহু কি বলল। কল্পনায় যা বলেছে মিহু বাস্তবেও কি সেটাই বলবে?আচ্ছা মিহুর কাছে কি ও জিজ্ঞেস করবে?মিহু কি সত্যিই ওর কাছে চলে আসবে?নাকি মিহু আরফানকে ভালোবেসে ফেলবে?তাহলে তো ও আর মিহুকে নিজের করতে পারবে না।ও মিহুকে যা বলার আরফানকে ভালোবাসার আগেই বলবে।তাতে যা হওয়ার হবে।

হৃদমাঝারে তুমি বোনাস পর্ব