খড়কুটোর বাসা পর্ব ২

খড়কুটোর বাসা পর্ব ২
Jhorna Islam

যুথি বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে। গ’ন্তব্য তার স্বামীর বাড়ি।
পিছন থেকে যুথির দাদি তাকে অনবরত ডাকতে থাকে। যুথি পাত্তাই দেয় না সে বড় বড় হাটা দিয়ে এগিয়ে চলল।
যুথি ওরে যুথি,,,,,বু ও বু যাইসনা আমার কথাডা শোন বু!

যুথি দাদির ডাক শুনে দাড়িয়ে যায়।তারপর ঘুরে দাদির দিকে তাকায়। তার দাদি প্রায় দৌড়ে এসে যুথির কাছে থামে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,,,,, এই বু’ই’ড়া বয়সেও তুই আমারে দৌড়ানি দেওয়াস বু।
উফফ দাদি দেখতে পাচ্ছো না একটা জায়গায় যাচ্ছি? তোমার পিছন ডাকতে হইলো? কি কইবা কও দেখি।
এমন কইরা যাইস না বু।মাইনষে কি কইবো? আমি নাত জামাইর সাথে কথা কই তুই যাইস না।
বাড়ি ফিরে যাও বুড়ি।আমাকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না আল্লাহ চাইলে বিকেলেই আমি শ্বশুর বাড়ি থাকবো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তর মাথাডা একেবারে গেছে ছে’রি যা করার কর কিছুই আমি আর বলমুনা। তারপর নিজের কাঁধ থেকে যুথির বোরখাটা নিয়ে যুথির হাতে দিয়ে চলে যেতে যেতে বলে এইবার যেইহানে যাওয়া যা তুই।
যুথি বোরখাটা দেখে জি’বে কামড় মারে। স্বামীর বাড়ি যাওয়ার তারায় বোরখা পরতে সে একদম ভুলে গেছে। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে রাস্তায়ও কোনো মানুষ আছে কিনা। রাস্তা এখন পুরাই ফাঁকা। তাই তারাতাড়ি বোরখাটা পরে ওড়না দিয়ে মুখে মুখোশ বেঁধে তারপর আবার হাটা দেয়।

যেতে যেতে দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলে,, বুড়ি তুমি ভালো থাইকো।তোমার নাত জামাইরে নিয়া খুব শীঘ্রই আসবো।
যুথির দাদি ছলছল চোখে যুথির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। মনে মনে ভাবে আজ যদি মেয়েটার বাবা মা জীবিত থাকতো কতো আয়োজন করে বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি পাঠাতো। মেয়েটার ভাগ্য আসলেই সেই সুখ টা নেই।তাইতো নিজের স্বামীর বাড়িতে এই প্রথম পা রাখবে সেটা ও আবার একা একাই।নিজে ও টাকা পয়সা না থাকার জন্য মেয়েটাকে কিছু দিয়ে পাঠাতে পারলো না। খালি হাতে দুইটা পুরাতন জামা নিয়ে যেতে হচ্ছে।

যুথির দাদি ছাড়া আর কেউ নেই। অনেক ছোট থাকতে বাবা মা পরপারে পাড়ি জমিয়েছে।দাদি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছে।
মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে টাকা রোজগার করে দুইজনের সংসার চালিয়ে নিয়ে গেছে। একদিন যুথির দাদি যেই বাসায় কাজ করে ঐ বাসার মহিলা যুথির জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ছেলের বাড়ি বড় লোক।ছেলে বিদেশ থাকে।অনেক টাকা পয়সার মালিক কিন্তু ওরা গরিব ঘরের মেয়ে চায়।

যুথির দাদি দুইদিন সময় নিয়ে ভেবে রাজি হয়ে যায়। মেয়েটা তো সারাজীবন কষ্টই করে গেলো এই বাড়িতে নিশ্চই সুখে থাকবে। যুথিও দাদির উপর কোনো কথা বলেনি। এই মানুষ টা এতো বছর ধরে যুথি কে বুকে আগলে রেখেছে। তাই যা করার ভালো কিছুই করবে তার জন্য।

যুথির দাদি পাশের বাড়ি থেকে আরো দুইজন লোক নিয়ে ইরহানের বাড়িতে যায়।উনারা জানায় ফোনে বিয়ে পরানো হবে। তারিখ দিয়ে দেয় ঐ তারিখে গিয়ে ওরা বিয়ে করাবে। পরে ছেলে দেশে আনলে দুই একজন গিয়ে উঠিয়ে আনবে।
তারপর বিয়ে টা ফোনেই হয়।বিয়ের দিন শুধু এক পলকের৷ জন্য যুথি ইরহান কে দেখেছে তার ভাই ইশানের ফোনে। তাও এক পলকের জন্য একটু।

ভালো করে সবার সামনে তাকিয়ে দেখতেও পারে নি। সেই সুদূর প্রবাসে থাকা লোকটাকে এক পলক দেখেই নিজের মনে জায়গা দিয়েছে। আর ইশান ও যুথির একটা ছবি ইরহান কে পাঠিয়ে ছিলো।
যুথির কাছে কোনো এন্ড্রয়েট ফোন নেই । একটা ছোট মোবাইল তার কাছে ঐটা দিয়েই ইরহানের সাথে কথা হতো। মন চাইতো ইরহান কে দেখতে কিন্তু কোনো উপায় ছিলো না।

প্রায় আধা ঘন্টা একটানা হাঁটার জন্য হাঁপিয়ে ওঠে যুথি।তাই একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দুই মিনিট জিরিয়ে নেয়।আরো পনেরো মিনিটের মতো হাঁটতে হবে। টাকা থাকলে অটো দিয়ে শুধু পনেরো মিনিটের ও কম সময়ে পৌছে যেতো। কিন্তু টাকা নেই টাকা থাকলেও যুথি আসতো না হেঁটেই আসতো। দুইটা টাকার ও যে কি মূল্য সেটা যুথি খুব ভালো করে জানে। বিকেলের দিকে রাস্তা ঘাটে মানুষের আনাগোনা বেশি হয় তাই দ্রুত পা চালায় সে।

মিনিট পনেরো পর যুথি তার গন্তব্যে এসে পৌছায়। বাড়ির সামনে এসে চোখ বুলায় পুরো বাড়িটা তে।
একদিন এই পথ দিয়ে শহরে যাওয়ার সময় যুথির দাদি বলেছিলো,,, ওরে যুথি এইটাই নাত জামাইর বাড়ি।যুথি তখন এক পলক বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলো।এখনো মনে আছে সেই দিনের কথা। এক পলকের দেখায় চিনে আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি যুথির।যুথির মাথা আবার খুব ভালো এক পলকের দেখায় অনেক কিছু সে মনে রাখতে পারে । যেমনটা সে এখন এই একতালা বিশিষ্ট চারিদিকে ইটের দেওয়াল দেওয়া বাড়িটা চিনে ফেলেছে।

টিনের গেইট পেরিয়ে যুথি ধীর গতিতে বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করে। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে বাড়িটা একটা ছাদ দেওয়া দালান ঘর ভিতরে কয়টা রুম আছে জানা নেই যুথির। তবে বেশ বড় সরোই বাড়িটা। গেইট দিয়ে ঢুকতে একটা ছোট ঘর ও চোখে পরলো।টিনের দো’চালা ঘর তবে বেশ পুরোনো । ধারণা করলো ভিতরে হয়তো দুইটা রুম।

আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে সামনের দিকে এগুলো যুথি।বাড়িটা অনেক জায়গা নিয়ে করা হয়েছে। চারপাশে অনেক গাছগাছালি আছে। ঝোঁকের বসে তো এসে পরলো এখন চিন্তায় আছে ঘরে ঢুকা নিয়ে। এমন সময় যুথির পাশ দিয়ে একটা বাচ্চা যেতে দেখলো হাতে বল। হয়তো খেলতে গিয়ে এসে পরেছে নিতে এসেছে। তাছাড়া যুথির জানা মতে এ বাড়িতে কোনো বাচ্চা নেই।

যুথি বাচ্চাটাকে কাছে ডাকে।বাচ্চা টা যুথির ডাকে থেমে যুথির দিকে তাকায়।
কিছু বলবেন খালা?
ছেলেটার খালা ডাকে যুথি আ’হা’ম্ম’ক হয়ে যায়। তারপর বলে আমি তোর কোন জনমের খালারে? আমার বয়স জানিস কতো?

নাহ্ জানিনা।দেখলে বলতে পারতাম ধারণা করে।কিন্তু আপনিতো মুখ ঢেকে রেখেছেন তাই বয়স বোঝা যায় না। দেখতে কেমন খালা খালা লাগছে।
ছেলেটাকে কয়েকটা কথা শোনাতে গিয়ে ও চুপ হয়ে যায় যুথি।এখন ঝামেলা করে লাভ নেই।যে জন্য ডেকেছে সেই কাজটা আগে সেরে নেওয়া যাক।
এই বাড়ির বড় ছেলে আছে না? ঐ যে বিদেশ থেকে যে দুই দিন আগে আসলো।উনাকে একটু ডেকে দে।
ইরহান ভাইয়ের কথা বলতেছেন?

যুথি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
উনিতো পুকুর পাড়ে বসে আছেন। ঐযে দেখা যাচ্ছে বলেই ছেলে টা হাত দিয়ে পুকুর পাড় দেখিয়ে দিল।
যুথি পুকুর পাড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ইরহানের পিঠটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। যুথি কাছাকাছি গিয়ে পিছন থেকে ইরহানকে ডেকে উঠে,,,,,,
“ওও বোকা পুরুষ। ”

ইরহানের ভাবনার মাঝে হঠাৎ করে কারো কন্ঠ স্বর শুনে কিছু টা হকচকায়। তারপর পিছনে ঘুরে তাকায়। একটা বোরখা পরা মেয়ে দাড়িয়ে আছে চোখ গুলো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ইরহান চেনার চেষ্টা করে। তারপর মাথায় আসে বোকা পুরুষ নামে একজন ই তাকে ডাকে সেটা হলো তার বউ যুথি।

ইরহান জানে না কেন তার বউ তাকে বোকা পুরুষ ডাকে।তবে মেয়েটার মুখে এই নাম টা শুনতে ও তার ভালো লাগে। ইরহানের আর বুঝতে বাকি নেই এটা যুথি।গলার স্বর শুনে ও চিনতে পারেনি কারণ ফোনের সাথে বাস্তবের গলার স্বর খুব একটা মিল পাওয়া যায় না।
যুথি?

যুথি মুখের মুখোশ টা খুলে ধপ করে ইরহানের পাশে গিয়ে বসে পরে। তারপর ইরহানের দিকে তাকিয়ে ইরহান কে দেখতে থাকে। ইরহান এতোটা স্বাস্থ্যবান ও না আবার এতোটা চিকন ও না একদম ঠিকঠাক। বসা অবস্থাতে বুঝতে পারলো লম্বা ও বেশ আছে। শ্যামবর্ণের পুরুষটির মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি কি যে ভালো লাগছে। হুট করে ইরহানের কথায় যুথির হুঁশ আসে।
তুমি এখন এখানে? দুপুরে না কথা হলো? জানালে না কেনো আসবে? একাই এসেছো? আমার না গিয়ে আনার কথা?
উফফ চুপ করেনতো বোকা পুরুষ। এতো প্রশ্ন একসাথে কেউ করে?

আর বিয়ে বসেছি কি বাপের বাড়ির ভাত খেতে? বাপের বাড়ির ভাত আর ভালো লাগছিলো না তাই জামাইর বাড়ি নিজে নিজে চলে এসেছি। আপনার অপেক্ষায় থাকলে এই জনমে আর সংসার করা হতো না।
কিন্ত,,,,,,,,,

কোনো কিন্তু নয়।পুরোটা রাস্তা হেঁটে এসেছি হাত পা ব্যাথা হয়ে গেছে। পরে না হয় সব বলবো আগে ঘরে নিয়ে চলুন।
ইরহান যুথির মুখের দিকে ভালো করে তাকায়।এই প্রথম সামনাসামনি দেখা।শুধু একটা ছবি ছিলো যুথির। প্রথম প্রথম ফোনে কথা বলতে কতো জড়তা কাজ করতো যুথির মাঝে। ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়েছে।অথচ এখন এমন ভাবে কথা বলছে যেনো সামনাসামনি কতোবার দেখা হয়েছে।

এইই বোকা পুরুষ সারাজীবন আমাকে দেখার সুযোগ পাবেন। এখন চলুন।
ইরহান আর কথা বাড়ায় না। সত্যি মেয়েটার মুখে ক্লান্তির ছাপ।পরে না হয় সব জেনে নিবে।তারপর যুথি কে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে ইরহান।সেখানে তাছলিমা বানু আর তার দুই পুত্র বধূ টিভি তে সিরিয়াল দেখছে।

খড়কুটোর বাসা পর্ব ১

হঠাৎ করেই যুথিকে দেখে সকলেই ভূ’ত দেখার মতো চমকায়।
যুথি মুখে হাসি ফুটিয়ে তাছলিমা বানুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারপর হাত দিয়ে সালাম করার ভঙ্গিতে বলে উঠে,,,,,,,,,
“আসসালামু আলাইকুম নকল শ্বাশুড়ি আম্মা ।”

খড়কুটোর বাসা পর্ব ৩