খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩
আভা ইসলাম রাত্রি

বসার ঘর থেকে উচ্চস্বরে ঝগড়ার শব্দ ভেসে আসছে। মাঝেমাঝে শেহজাদের দু একটা উচু গলার কথা শোনা গেলেও, শেষের দিকে তার কথাবার্তা শোনা গেল না। একসময় পুরো বাড়ি থমথমে হল। নিস্তব্দতা আকড়ে ধরেছে আয়ুষ্মান মহলে। কোলাহলপূর্ন এমন পরিবেশ চিত্রার বিয়ের জন্যেই তৈরি হয়েছে, তা আর ঘটা করে বলে দিতে হল না চিত্রাকে। চিত্রা এসব শুনেই গেল কেবল।

চিত্রার সঙ্গে পাকের ঘরে কাজ করা কাজের মহিলারা সবাই লজ্জিত চোখে বারবার চোখ ঘুরিয়ে চিত্রার দিকে তাকাচ্ছে। চিত্রা শাড়ির আঁচলে নিজেকে আড়াল করে চোখ মুছে। চিত্রা চেষ্টা করে নিজের কান্না লুকিয়ে রাখার, নিজের মন খারাপ আড়াল করে রাখার। সবসময বুঝি সে সম্ভব হয়না। না চাইতেও চোখের বাঁধ ভাঙে, বুকের ভেতরের কষ্ট কান্না নামে উপচে পরে।
চিত্রা চা কাপে ঢেলে পেছনে চেয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘শুনো, চা হইয়ে গেছে। উনাদের চা-গুলো দিয়ে আহো না।’
চিত্রার কথায় সবার অস্বস্থি কিছুটা ভাঙল বটে। নিরবতা ভেঙে একজন উত্তর দিল,
‘এ বাড়ির পুরুষগণের সামনে আমাগো যাওয়া নিষেধ ভাবিজান। বড় খালাম্মার মানা আছে। আপনি দিয়ে আসেন। উনারা খুশি হইবেন।’

কেমন খুশি হবেন তা বোঝা এখন অব্দি বেশ ভালোই হয়েছে চিত্রার। চিত্রা ভেবে পাচ্ছে না, সে তো নিজে যেচে এ বাড়ি বউ হয়ে আসেনি। এসেছে শেহজাদ আয়ুষ্মানের ইচ্ছেতে। সবাই তাকে না মানুক, ছেলের কথাও কি মানে না? চিত্রা আলগোছে মাথায় আঁচল টেনে নিল। শ্যামলা গড়নের মুখখানা আঁচলে সবটুকু ঢেকে নেবার প্রয়াস। চায়ের কাপ একটা বড় থালায় রেখে চলে বসার ঘরে।
বসার ঘরের দরজার সামনে যেতে শুনতে পেল নওশাদ আয়ুষ্মান বলেছেন,

‘বিয়ে নিজেই করেছ, ভালো। গ্রামের মানুষকেও আগামীকাল দাওয়াত করে এনে এই বিয়ের ঘোষণা নিজেই দিও তবে। আমাদের এসবে জড়াবে না। আর নিজের বিদেশে পরে থাকা ভাইকেও জানিয়ে দিও, তার ভাবি এসেছে ঘরে। এতে যদি সে অন্তত খুশি হয়। তোমার ভাই, খুশি না হয়ে কি হবে। আমাদের তো গা জ্বালা বাড়ছে বৈ কমছে না।’
শেহজাদ শুনল। সহসাই চোখ গেল দরজার দিকে। মেরুন রঙ্গা আঁচল বাতাসে উড়ছে। পরপরই আঁচল দেখা গেল না আর। সরে গেল দৃষ্টি সম্মুখ থেকে। শেহজাদের বুঝতে বাকি নেই, এ নারী কে ছিল? শেহজাদ বাবা-চাচার দিকে তাকাল। নিজের শেষ শর্ত তুলে ধরল,

‘আমি চাই, এ বাড়ির বউদের যেমন সম্মান দেওয়া হয়, ওকেও বাড়ির বউ হিসেবে যথাযথ সম্মান যেন দেওয়া হয়। তাহলে আমি আগামীকাল সম্মেলনে যাব। নচেৎ…’
শেহজাদের চাচা বড্ড রাগী। তাই এ কথাতে তিনি না রেগে পারলেন না। রেগে কটা কথা বলবেন, পাশে থেকে ইশারায় নওশাদ তাকে শান্ত থাকতে বললেন। ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,

‘সব শর্ত মেনে নিয়েছি যেহেতু এই শর্ত বাকি থাকবে কেন? ষোল আনা নাহয় পূর্ন করা হোক। তবে ওই মেয়েকে বলো, কোনোদিন যেন আমাদের বাড়ির সম্মানের পথে কাঁটাতার না বিছায়। তাহলে ওই মেয়েকে আমি বাড়িছাড়া করব।’
শেহজাদ গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল, ‘শিখিয়ে দিলে আশা করছি তেমন কিছু করবে না। আমাকে কদিন শেখানোর সময় দিন। তাকে আমি আমাদের বাড়ির যোগ্য বউ করে তুলব।’

নওশাদ শেহজাদের কথা শুনে ততটা আশ্বস্ত না হতে পারলেও মুখে তেমন কিছু প্রকাশ করলেন না। চিত্রা এসব শুনছিল। তাদের কথোপকথন বন্ধ হয়ে যেতেই চিত্রার হুশ ফেরে। তখন মনে পরে, চা নিয়ে সে কবে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। চিত্রা চায়ের কাপের দিকে তাকাল। ঠাণ্ডা হয়েছে কি? চিত্রা ভাবল, আবার পাকের ঘরে গিয়ে গরম করে আনবে। কিন্তু পাকের ঘরে গেলে যে কাজের লোকেরা সন্দেহ করে বসবে। চিত্রা অগ্যতা দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে শেহজাদ উত্তর দিল,

‘অনুমতি আছে।’
চিত্রা আঁচলে মুখ ঢেকে দরজা ঠেলে বসার ঘরে ঢুকে। চিত্রাকে দেখে নওশাদ ভেতর ভেতর রাগান্বিত হলেও চেহারায় স্বাভাবিকের বেশ। চিত্রা সবাইকে নিভু নিভু স্বরে সালাম দিল। নওশাদ সালামের উত্তর দিলেন, শেহজাদও উত্তর দিল। শুধু দিলেন না শেহজাদের চাচা সৌরভ। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে নিজের চাচার দিকে চায়। পরপর নিজের গা ঝাড়া দেয়। কারণ সে জানে, তার চাচাজানের কিসের প্রতি এত রাগ! এ রাগ যে শুধুমাত্র বিয়ের কারণে নয় সেটা তার ভালোই আন্দাজে আছে। তাই সে বিষয়টা এড়িয়ে গেল। চিত্রা চায়ের কাপ সবার দিকে একে একে এগিয়ে দিল। নওশাদ চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। একটু ঠাণ্ডা, তবে বেশ সুস্বাদু পান করতে। নওশাদ তার মানিব্যাগ বের করে পাঁচশ টাকার নোট চিত্রার দিকে এগিয়ে দিলেন।

‘তোমার সালামি।’
চিত্রা টাকা নিবে কিনা চিন্তা করছে যখন তখন শেহজাদ ইশারা করল টাকাটা নিতে। চিত্রা আর ভাবল না। টাকা নিয়ে নিভু স্বরে বলল,
‘শুকরিয়া আফনার।’
চিত্রার মুখে অশুদ্ধ ভাষা শুনে নওশাদ বড়ই বিরক্ত হলেন। কিন্তু মুখে সে বিরক্ত প্রকাশ করলেন না। যেহেতু ছেলে বলেছে সব শিখিয়ে দেবে, তাই তিনি সে দিনের অপেক্ষায়। চিত্রার ডান হাতের কব্জিতে পুড়ে যাওয়ার দাগ সহজেই শেহজাদের নজরে এলো। শেহজাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সে দাগ দেখে। চিত্রার চোখে শেহজাদের এহেন দৃষ্টি পরে না। সবাইকে চা পরিবেশন করে পাকের ঘরে চলে আসে আবার সে।

রাতের খাবারের পর্ব শেষ করে চিত্রাকে নিজের ঘরে ডেকে নেন রেখা। নিজের আলমারি থেকে দু খানা ভারি বালা নিয়ে নিজ হাতে চিত্রাকে পরিয়ে দেন। নিজের গলা থেকে কারুকাজ করে মোটা হার নিয়ে চিত্রার গলায় পরিয়ে দেন। চিত্রা অবাক চোখে সেসব দেখে। সে আশ্চর্য্য হয় ভীষন। এসব ভারি ভারি গহনা সে বাড়িতে পরে থাকবে? চিত্রার মনে হচ্ছে, সে এক্ষুনি গয়নার ভারে হেলে পরছে। রেখা কানে ভারি দুল পরানোর সময় বললেন,

‘ভারি সোনার গয়না পরা এ বাড়ির ঐতিহ্য। আমরা নেতার পরিবার যদি কারুকাজ করা গয়না না পরি, তাহলে কে পরবে? গ্রামের মানুষ তো এসব চোখেই দেখে না। তুমিও বোধহয় দেখো নি কখনও। দেখবে কিভাবে? কি পরিবারে বড় হয়েছ সেটাও তো ভুলে গেলে চলবে না। আমরা হলাম নেতার বংশ। আমাদের শশুরবাড়ির বাপ-দাদা-পরদাদা সবাই এই গ্রামে ক্ষমতা দেখিয়ে এসেছে সবসময়। এসব গয়না.. এসব তো আমাদের হাতের ময়লা।’

চিত্রার ইচ্ছে হয়, তার কানে মোম গলে পড়ুক। গলে যাক কানের ভেতরের সকল কিছু। এমন হেয় করা কথা এ অব্দি সে শুনে নি যে কখনও। চিত্রার ইচ্ছে করে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। অথচ তার সব বন্দি অজানা এক বন্ধনে। চিত্রা পাথরের ন্যায় বসে থাকে। রেখা আপাদমস্তক চিত্রাকে সাজিয়ে দেন। চিত্রার হাতে আলতা দিয়ে দেন। নখে মেহেদি দিয়ে দেন। মনের মত করে নিজের প্রথম পুত্রবধূকে সাজিয়ে দেবার পর বললেন,

‘এত সাজিয়েও লাভ নেই। কালো রঙ তো আর ঢাকা যাবে না। কি আর করার? যাও এখন। খোকা অপেক্ষা করছে।’
চিত্রার বুকটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যেন। সে কালো নয়, সে শ্যামা। অবশ্য তাকে কালো এ প্রথম বলে নি, এর আগেও অনেক শুনেছে সে। প্রায় অভ্যস্ত সে এতে। চিত্রা হাতের পুতুলের মত শেহজাদের ঘরের দিকে চললো। চিত্রা ঘরে ঢুকে দেখে, কেউ নেই ঘরে। চিত্রা বারান্দায় নজর দিল। শেহজাদ সেখানে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। চিত্রা শুনে, শেহজাদ বলছে:

‘কবে আসবে দেশে?’
‘–‘
‘আমার বিয়েটা গুরুত্বপূর্ণ নয় দেশে আসার জন্যে?’
‘–‘
‘নিজের চলার পদ্ধতি বদলাও, মেহজাদ। তোমাকে আব্বাজানের মতের বিরুদ্ধে আমার বিদেশে পাঠানোটাই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তুমি উচ্ছন্নে গেছ।’
‘–‘
‘হাসছ কেন? আমি হাসির কথা বলেছি?’
‘–‘
‘আমি ওল্ড স্কুল টাইপ?’
‘–‘
‘তোমার সঙ্গে কথা বলাই বৃথা। সামনের মাসে আমি আসছি আমেরিকা। এসে নিয়ে যাব তোমায়। ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখো।’
‘–‘
‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। তোমার সিদ্ধান্ত এখন মানা যাবে না। কারণ তুমি বাচ্চাদের মত সিদ্ধান্ত নাও।’
‘–‘

‘কারণেই কঠোর হচ্ছি। রাত হচ্ছে আমাদের। ঘুমাতে যেতে হবে। রাখছি। ভালো থেকো, আর সুস্থ থেকো। মদে হাত দিবে না আর। স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো নয় এসব। মনে থাকে যেন। আল্লাহ্ হাফেজ।’
শেহজাদ কল কেটে বারান্দা থেকে ঘরে আসে। চিত্রা ঘরের এক কোণে শাড়ির আঁচলের এক কোণ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে। শেহজাদ চিত্রাকে দেখে বলল,
‘হাত পুড়িয়েছ কিভাবে?’

চিত্রা ভয় পেয়ে হাত দেখল। অনেকটা পুড়ে গেছে হাতের। খেয়াল নেই চিত্রার। চিত্রা মিনমিনিয়ে বলল,
‘চা বানানোর সময়।’
‘এসেছ এক দিনও হয়নি। এখনি হাত পা পুড়িয়ে ফেললে হবে? মলম আছে ড্রয়ারে। লাগিয়ে নাও।’
চিত্রা মলম লাগানোর প্রয়োজন বোধ করল না। এমন পুড়ে যাওয়া তার জন্যে চাট্টিখানি কথা। শেহজাদ বিছানায় শুয়েছে। বাম হাত কপালের উপর রেখে কপাল থেকে দু-চোখ অব্দি ঢাকা তার। চিত্রা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় ঘুমাবে, সে বুঝে উঠতে পারছে না। খানিক পর শেহজাদ চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল,

‘আমার পাশে জায়গা আছে। ঘুমিয়ে পরো। আগামীকাল বাড়িতে দাওয়াত আছে। পুরো গ্রামবাসী আসবে। অনেক ধকল যাবে।’
চিত্রা শুনল। একটু পর গায়ের গয়না সব খুলে কোথায় রাখবে ভেবে পেল না। এত মূল্যবান গয়না! হারিয়ে গেলে যে এ বাড়িতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বয়ে যাবে, তা বোঝা আছে চিত্রার। শেহজাদ পাশ থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় আবারও বলল,
‘গয়নাগুলো বিছানায় পাশের ড্রয়ারে রেখে দাও। তালা-চাবি লাগবে না। আমার ঘরে আমার অনুমতি ব্যতীত কেউ প্রবেশ করে না।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২

চিত্রা তাই করল। কিছুক্ষণ থমথমে হয়ে বসে থেকে কাচুমাচু করতে করতে শেহজাদের বিছানায় এক কোণের মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পরল। শেহজাদ ঘুমিয়ে পরল। অথচ চিত্রার দু চোখ বন্ধ নেই। জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছে তার অর্থদ্ধার করে করেই সারাটা রাত সজাগ থাকল তার দুই নয়ন। নয়ন জুড়ে ক্লান্তি নামল যখন, তখন সূর্য উদয় হবার পথে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪