খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২
আভা ইসলাম রাত্রি

থাপ্পড়ের শব্দে বিকেলটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে রইল। চারপাশে কেমন তটস্থ ভাব। চিত্রা গালে হাত রেখে ঘোমটা টেনে শেহজাদের পেছনে চেপে দাঁড়ালো। শেহজাদের চোখে আগুনের রক্ত ঝরছে যেমন। সে নিজের চাচার সম্মুখে দাড়াল। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে শুনাল,

‘চাচাজান, বিয়েটা আমি নিজের ইচ্ছেই করেছি। কেউ আমাকে জোড় করেনি। বারবার কেন ভুলে যান আপনারা এই বিষয়? আব্বাজান আসছেন সন্ধ্যা পর। আমরা বসার ঘরে এই নিয়ে বাকি আলাপ করি? বাড়ির বাইরে এসব তামাশা করা আমাদের উচিত নয়।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শেহজাদের চাচা সোরভ আয়ুষ্মান রাগে থরথর কাঁপছেন। এ বাড়ির সকল পুরুষের রাগ আকাশচুম্বী। রাগ উঠলে তারা যেমন অমানুষে পরিণত হয়। শেহজাদের রাগও তবে কম নয়। বাপ চাচা পেরিয়ে তার রাগের ছোঁয়া। তবে শেহজাদের থেকেও রাগী এক পুরুষ আছে এ বাড়ি। বিদেশে থাকে। যখন দেশে আসে, বাড়িটা যেমন তুফানে লন্ডভন্ড করে দম ছাড়ে। শেহজাদ আরো দু কথা বলবে, শেহজাদের মা এসে চিত্রার কাঁধে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে টেনে নেন। ভাসুরের দিকে চেয়ে বললেন,

‘এ বাড়ির বৌদের গায়ে হাত তোলা নিষেধ,ভাইজান। আপনার ভাই শুনলে রাগ করবেন। তাছাড়া বিয়ে এখন হয়েই গেছে। এসব তামাশা করে লোক হাসিয়ে আর লাভটি নেই। যা হয়েছে মেনে নিলে আমাদেরই মঙ্গল। নাহলে অযথা গ্রামের লোকদের চুনকালি মুখে পরতে হবে।’

চিত্রা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এ অতীব ভরসার মহিলাকে ভীষন মনে লেগেছে। চিত্রা বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে গেছে শেহজাদের মায়ের গায়ের সঙ্গে। শেহজাদ চাচার দিকে রুক্ষ দৃষ্টি ছেড়ে মাকে ইশারা করল চিত্রাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে। ইশারা পেয়ে শেহজাদের মা রেখা এক মুহুর্ত দেরি না করে চিত্রাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন।
চিত্রা দরজার পাশে হেলান দিয়ে নত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

কি বলবে কিচ্ছু বুঝত পারছে না। এ বাড়ির সবাই কেমন অদ্ভুত! কে কেমন, কি চায়, কিছুই চিত্রা বুঝতে পারছে না। চিত্রার গাল জ্বলে যাচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর থাপ্পড় খেয়ে। নাকের পাশটায় রক্তের অস্তিত্ব অনুভব হচ্ছে। তবুও চিত্রা ঠায় দাঁড়িয়ে দরজার পাশে। রেখা আলমারি খুঁজে ঔষধের বাক্স বের করলেন। বাক্স থেকে মলম বের করে বিছানা থেকে চিত্রার দিকে ইশারা করলেন,

‘এই মেয়ে, এইখানে এসো।’
চিত্রা ভয়ে ভয়ে রেখার পাশে এসে দাঁড়ালো। রেখা বিছানায় বসতে ইশারা করল চিত্রা একটু দূরে আলগোছে বিছানায় বসল। কিছুটা আতঙ্কে আছে সে। তাই এমন দুরত্ব রেখে বসা। রেখা মলম চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘নাক থেকে রক্ত পরছে। মুছে মলম লাগিয়ে নিও। নাম কি?’
চিত্রা মলম হাতে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। চিত্রার হাতের ঘামে মলমের গা ভিজে চৌচির। মেয়েটা ভয়ে দিগ্বিদিক শূন্য আপাতত। চিত্রা খানিক থেমে নিভু স্বরে বলল,

‘চিত্রা সুভাষিণী মজুমদার।’
রেখা ভ্রূ কুঁচকে ফেলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘এতবড় নাম বলতে পারব না। ছোট্ট করে সুভা ডাকব,জবাব দিবে। চিত্রা এসব হিন্দু নাম। এসব নাম আমার মুখে বাঁধে।’
চিত্রার বলতে খুব ইচ্ছে করল, হিন্দু নাম মুখে বললে কি হয়? পোকায় ধরে? তাছাড়া চিত্রার নাম তার মারা যাওয়া মা ভীষন শখ করে রেখেছিলেন। মায়ের দেওয়া নাম মানুষ মুখে আনতে চায় না। চিত্রার ভীষন দুঃখ লাগল। তবে দুঃখগুলো গিলে ফেলার চেষ্টা করে সে উত্তর দিল,

‘আফনি যেইভাবে চান, ডাকুন।’
‘বাড়ি থেকে কিছু এনেছ? নাকি খালি হাতে এসেছ?’
চিত্রা এবার ভীষন লজ্জায় পরে গেল। বিয়েটা এমন পরিস্থিতিতে হয়েছে, কিছুই হাতে করে আনা হয়নি। তাছাড়া দিদারের পরিবারকে আগেই ত্রিশ হাজার টাকা যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। তাতেই চিত্রার বাবার হাতের ঘাম পায়ে ফেলার ন্যায় অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। নতুন করে কিছু দেওয়ার সামর্থ্য নেই আর তাদের। চিত্রার চোখ জলে টালমাটাল হয়ে উঠল। চিত্রা বুকে কষ্ট চেপে বলল,

‘কদিন সময় দেন। আব্বা টাকা যোগাড় কইরে কিন্না দিবেন সবকিছু।’
চিত্রার কথা বলার ধরণ দেখে রেখা এবার ভীষন বিরক্ত হলেন। মেয়েটা নূন্যতম কথাও বলতে জানে না। কেমন অশিক্ষিতদের মত করে কথা বলছে। এ মেয়েকে কথা-বার্তা, চাল-চলন শেখাতে শেখাতেই অর্ধেক জীবন যাবে রেখার। রেখা ভ্রূ কুচকে বললেন,

‘কিন্না আবার কি? বলবে কিনে। এ বাড়ির সবাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। এটা এ বাড়ির নিয়ম। আমাদের দেখেই তো গ্রামের মানুষ শিখবে। এ বাড়ির বড় ছেলের বৌ হয়ে তুমি এসব অশিক্ষিতদের মত করে কথা বললে আমাদের নাক কাটবে। তাই দ্রুত কথা বলা শিখে নিবে, এতে তোমারই ভালো।’
চিত্রা সম্মতি দিল। রেখা বিছানা ছাড়লেন। আলমারি থেকে মেরুন রঙের জামদানি শাড়ি বের করে চিত্রার দিকে এগিয়ে দিলেন।

‘বাড়ি থেকে কিছু আনো নাই, তাহলে কি আর করবে! আমার কাপড়ই পরো। ঘরে যাবে, গোছল করবে, দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে পাকের ঘরে যাবে। বাড়ির সবাই সন্ধ্যা পর চা খায়। সবার জন্যে চা বানাবে। গোসল করে নিজেদের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে না, মানা করলাম কিন্তু। স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসা করা ভালো, তবে বাড়ির মানুষের কথা ভুলে গেলে চলবে না। লজ্জাশরম নিয়ে চলবে এ বাড়ি।’

চিত্রাকে শেহজাদের ঘরে নিয়ে গেল বাড়ির এক কাজের লোক। ঘরের ভেতর চিত্রাকে প্রবেশ করিয়ে উনি বললেন,
‘ভাবিজান, এই ঘরে একমাত্র বড় ভাইজানের ঘরেই পায়খানা ঘর আছে। আর কারো ঘরে ছিল নাই। বড় ভাইজান নিজেই করসে এইটা। সবার পরথমে উনি শুরু করছেন, তার দেইখা বাকি সবাই নিজেদের ঘরে পায়খানা ঘর করছে। নেন, আফনি গোসল সাইরা নেন। এই আমি কাপড় কলের উপর দড়িতে রাখলাম। জলদি জলদি করেন। নাইলে বড় খালা গাল্লাইব।’

চিত্রা গোসল করে বের হয়ে দেখে ঘরে শেহজাদ কাপড় ছাড়ছে। পাঞ্জাবি খুলে ফতুয়া পরল। পেছনে চিত্রা ভেজা চুলে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। শেহজাদ চিত্রাকে দেখে বলল,
‘গালে মলম লাগিয়েছিলে?’

তাদের প্রথম কথোপকথন। চিত্রার মনে সে কথা শুনে কিছু একটা হল। কেমন অদ্ভুত কিছু!
চিত্রা মাথা নাড়ল। শেহজাদ কিছু বলল না আর। খুব ব্যস্ত সে। ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। মাঝেমধ্যে কপালে আঙুল চেপে বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। চিত্রা সব দেখছে, অথচ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। কি জিজ্ঞেস করবে সে, সদ্য ফোঁটা ঘাসফুলের ন্যায় সেও যে বড্ড নতুন এ বাড়িতে। শেহজাদ এবার আলমারি থেকে একটা ফাইল নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। চিত্রা শেহজাদ বেরিয়ে যেতে নিজেও বের হল পাকের ঘরে যাবার জন্য।

পাকের ঘরে হলুস্থুল কান্ড। রাতের খাবার তৈরি হচ্ছে। তরকারির গন্ধে চারপাশে সুরভিত। চিত্রা সেই কাজের লোককে পেয়ে কাছে গেল। চা করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, কাজের লোক সব দেখিয়ে দিল। জীবনে অনেকবার চা বানানো হলেও, এই প্রথম চিত্রার মনে হচ্ছে সে চা বানানো ভুলে গেছে। চিত্রার হাত কাপছে। গায়ে বল পাচ্ছে না ঠিকঠাক। মনে হচ্ছে এই মাথা ঘুরিয়ে পরল বলে। তবুও চিত্রা নিজেকে শান্ত করে চা বানানো মন দিল।
পেছন থেকে আরেক কাজের মহিলা বললেন,

‘এ কি বড় ভাবিজান, ভেজা চুল এমন খোলা রাখসেন ক্যান? পানিতে যে ব্লাউজ ভিজ্জা গেল। মাথার আঁচলও তো ভিজ্জা গেছে। ভেজা কাপড়ে ঠাণ্ডা লাগব না আফনার?’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১

চিত্রা টের পেল, তার সত্যি ঠাণ্ডা লাগছে ভীষন। তবে সে সেসব পরোয়া করল না। এমনিতে এ বাড়িতে এসে ভয়ে তার পরাণ এমনি ঠাণ্ডা হয়ে আছে। সবার এমন অদ্ভুত ব্যবহারে সে অভ্যস্ত নয় একটুও। তবুও তাকে এ বাড়িতে থাকতে হবে, এ বাড়ির মানুষের সঙ্গে চলতে হবে, সংসার করতে হবে সারাটাজীবন!

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩