খাঁচার ভেতর অচিন পাখি গল্পের লিংক || আভা ইসলাম রাত্রি

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১
আভা ইসলাম রাত্রি

‘তোর মুখ পুড়ল রে, অলক্ষ্মী! বরের পরিবার বিয়েতে আসার পথে সপরিবারে গাড়ি চাপা পরে মইরা গেল রে, মইরা গেল। এখন এই মুখপুড়িরে কেডা বিয়া করব? কি হইব এই নওজোয়ান মাইয়ার? ঘরে রাখব কে এরে? আল্লাহ! মেয়েটার কপাল পুড়ল রে!’

ক্ষণিকের মধ্যে চিত্রার বিয়ে বাড়ি শোক বাড়িতে পরিণত হল। চিত্রার হবু স্বামী দিদারের লাশ বয়ে আনা হল বিয়ে বাড়ি। বাকিদের লাশ দিদারের পাশে একে একে রাখা হল। এতক্ষণ সবাই ফিসফিস করে চিত্রার দোষ খুঁজতে ব্যস্ত ছিল,তারা এখন কান্নায় বিলাপ জপছে। চিত্রা পাথরের মত বসে আছে মাটিতে। শাড়ির আঁচল ছড়িয়ে রাখা নোংরা মেঝেময়। চিত্রার ঠোঁটের টকটকে লাল লিপস্টিক ঠোঁটের আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কাজল লেপ্টে চোখ দেখতে বিভীষিকাময়। চিত্রা আনমনে দিদারের লাশের দিকে চেয়ে আছে। একসময় চিত্রার ডান চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরল গরম নোনা জল। চিত্রা হামাগুড়ি দিয়ে দিদারের লাশের পাশে এসে বসল। দিদারের মুখ হা করে রাখা। মুখ ভয়াবহ থেতলে চেনার উপায় নেই। চিত্রা নিজের হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল দিদারের চোখ মুখ। একের পর এক গরম জলের ফোঁটা গড়িয়ে পরছে দিদারের মুখে।

দিদারের সঙ্গে চিত্রার পরিচয় সবে কয়েকদিনের। বিয়ে ঠিক হবার পর মোটে তিনবার দেখা হয়েছে তাদের। দিদার সন্ধ্যা বেলায় কাজ থেকে ফেরার পথে লুকিয়ে চিত্রার বাড়ির পেছনে আসত। চিত্রার জানালার কাছে এসে চিঠি দিয়ে যেত। কিশোরী চিত্রার কাছে এসব অনুভূতি সম্পূর্ন নতুন। আবেগে ভেসে যায় সে এসবে। দিদারের সঙ্গে অল্পক্ষণের আলাপে দিদারের সঙ্গে ভাব জমে যায় তার।

আচমকা দিদারের এমন মৃত অবস্থায় দেখতে চিত্রার বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠছে বারবার। কাঁধে লাঙল, লুঙ্গি এবং ফতুয়া পড়া দিদারের লুকিয়ে লুকিয়ে হাসি বারবার চোখে ভাসছে। চিত্রা হাত বাড়িয়ে দিদারের খোলা দু চোখ বন্ধ করে দিল। পাশে বসে সূরা যা শিখেছে, পরল। চোখ বেয়ে নোনাজলের বহমান দেখে বাড়ির কারো কটু কথা থেমে থাকল না। বরং সবাই চিত্রার বাড়িকে একঘরে করে দেবার কথা ভাবছে। চিত্রা শুনছে সব, অথছ কি ভীষন নিশ্চুপ সে।

চিত্রার বাবা সবার পায়ে পরে যাচ্ছেন। একঘরে করে দিলে বাঁচবেন কি করে তারা। সমাজ ছেড়ে দিলে টিকে থাকবেন কিভাবে? সবাই চিত্রার বাবার আহাজারি অদেখা করে যাচ্ছে। যে যারযার মত অপবাদ ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত ভীষন।
‘কন্যারে সহমরণ দাও। তাইলে এই সমাজে জায়গা হইব তোমার চিত্রার বাপ। নাহলে এমন অলক্ষ্মী মেয়ে লইয়া তুমি বাঁচবার পারো, তয় আমরা না।’

মুসলমানদের সহমরণ! চিত্রার বাবা এ শুনে আঁতকে উঠলেন। চিত্রার চোখের জল থেমে গেল। পাথরের ন্যায় চেয়ে দেখল সবাইকে। চিত্রার বাবা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
‘ লাশ গোছানোর বন্দোবস্ত করা হোক এক্ষুনি। ‘

গম্ভীর শ্বরের কথা শুনে বিয়ে বাড়ির এই শোক মাতম যেন এক মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল। সবার চোখ গেল সদর দরজার পানে। ‘শেহজাদ আয়ুষ্মান’ এসেছেন, চারপাশে কলরব ছড়িয়ে গেল। চিত্রা দ্রুত মাথার ঘোমটা টেনে দিল। ঘোমটার আড়ালে এখনও তার চোখ দিদারের মুখের দিকে। শেহজাদ আয়ুষ্মান গ্রামবাসির নিকট একদিকে আতঙ্কের নাম অন্যদিকে ভরসার স্থল। তিনি বিয়ে বাড়িতে আসবেন কল্পনা করতে পারেন নি চিত্রার বাবা। দ্রুত মেঝে থেকে উঠে চেয়ার নিয়ে গেলেন শেহজাদের দিকে। শেহজাদ চেয়ারে বসল। সাদা বসনে তাকে সত্যিকারের বীরপুরুষ মনে হচ্ছে। শেহজাদ আঙুল উচু করে তার সেবায় নিয়োজিত মানুষের বলল,

‘লাশ গোছাও! জানাজার ব্যবস্থা করো। এখানে উপস্থিত কেউ যেন জানাজা অংশ না নিয়ে বাড়ি না যায়। ‘
সবাই যার যার জায়গায় দাড়িয়ে আছে। সম্পূর্ন বিয়ে বাড়ি নিশ্চুপ গোহার ন্যায় লাগছে। লাশ গোছানো হল, জানাজা করা হল। জানাজা থেকে ফেরার পথে, শেহজাদ সবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল,
‘ এখানে উপস্থিত অবিবাহিত পুরুষদের মধ্যে যে আজকে চিত্রা সুভাষিণী মজুমদারকে বিয়ে করবে, তাকে আমার পক্ষ থেকে চাকরির বন্দোবস্ত করে দেওয়া হবে। ‘

আফসোস! কেউই এই লোভনীয় আবেদন গ্রহন করল না। সবার মধ্যে ফিসফিস আওয়াজ ছড়িয়ে গেল,
‘ অপয়া মেয়েকে বিয়া করলে, সমাজ আমারে ত্যাগ করব। তাইলে কি করমু এই ছাকরি দিয়া? মোর লাগব না এই ছাকরি।

শেহজাদ যা বোঝার বুঝে গেল। সবাইকে নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলে, নিজে কিছুটা দূর নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে অনেককিছু ভাবার চেষ্টা করল। তারপর চোখ লাল করে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল সে। সবার সামনে এসে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করল,

‘আজ এই খানে, আপনাদেরকে সাক্ষ্য রেখে আমি সজীব মজুমদারের মেয়ে চিত্রা সুভাষিণী মজুমদারকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আজকে আমাদের বিয়েতে আপনাদের উপস্থিতি কামনা করছি এবং এই বিষয় শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে করছি যে মেয়েরা অপয়া হয় না, মেয়েরা অলক্ষ্মী হয়না। মেয়েরা হয় জগতের সৌন্দর্য্য, চোখের শীতলতা, ঘরের লক্ষ্মী!”

চিত্রার পাশে এসে বসল শেহজাদ। চিত্রা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে পাশে। বিয়ের বাকি নিয়ম পূরণ করা হল। শেহজাদকে কাজী কিছু একটা বলতে বললেন। শেহজাদ কাজীর শেখানো কথা সামনে চেয়ে অকপটে বলে নিল,
‘সবাইকে সাক্ষ্য রেখে আমি শেহজাদ আয়ুষ্মান চিত্রা সুভাষিণী মজুমদারকে পঞ্চাশ হাজার টাকার মোহরানা আদায়পূর্বক নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহন করলাম। কবুল, কবুল, কবুল।’
চিত্রা বাবার কান্না ভেজা মুখের দিকে চেয়ে নিজেই আনমনে বলল,

‘ কবুল, কবুল, কবুল। ‘
শেহজাদ বিয়ে করার পর তার বাবা নওশাদ আয়ুষ্মানকে কল করে বিয়ে বাড়িতে আসতে বলল। নওশাদ এখানে এসে তাজ্জব হয়ে গেলেন। ছেলের এই ছেলেমানুষী দেখে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন। শেহজাদ এগিয়ে গেল। বাবার কাঁধে হাত রেখে শুধু এটুকু বলল,

‘সবার শিক্ষার জন্য এই বিয়ে করা উচিত ছিল আমার। গ্রামের নেতা হয়ে মেয়েদের যোগ্য সম্মান দেওয়ার শুরুটা আমার পক্ষ থেকে সবাইকে শেখানো জরুরী ছিল আব্বাজান। অযথা চিৎকার করবেন না।’
নওশাদ রেগে এবার রক্তিম হয়ে গেলেন। ছেলের দিকে রক্তচক্ষে চেয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলেন। তার ছেলে একটা অপয়া মেয়েকে বিয়ে করেছে সেটা তিনি ভাবতেও পারছেন না। নওশাদের আগুন চোখ দেখেও শেহজাদের ভাবাবেগ হল না। নওশাদ ছেলের উপর প্রভাব না ফেলতে পেরে ব্যর্থ হয়ে তেড়ে গেলেন চিত্রার দিকে। চিত্রার গালে থাপ্পড় দেওয়ার জন্যে উদ্যত হলে, চিত্রার হাত ধরে টেনে নিজের পেছনে নিয়ে যায় শেহজাদ। শান্ত অথচ রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,

‘আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার অধিকার আপনাকে দেইনি আমি, আব্বাজান। আপনি আমার গায়ে হাত তুলুন। আমার স্ত্রীর গায়ে নয়।’
নওশাদ দাতে দাঁত লেগে চেয়ে থাকলেন ছেলের দিকে। ছেলে আজ অব্দি তার একটা কথাও শুনেনি। সুতরাং আজ শুনবে এটা আশা করাটা বোকামি। নওশাদ আর এক মুহুর্ত থাকলেন না এখানে। দ্রুত গাড়ি চেপে নিজের বাড়ি চলে গেলেন। চিত্রার ভয়ে বারবার কেপে কেপে উঠছে। শেহজাদ সেটা লক্ষ্য করে, সবাইকে আদেশ দেয় গাড়ির ব্যবস্থা করার। গাড়ির ব্যবস্থা করা হলে, চিত্রাকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে শেহজাদ। গাড়ি ছাড়ার আগে চিত্রার বাবা ফতুয়ার কাপড়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,

‘লাল কাপড়ে গেলি মা। সাদা কাপড় পড়ার আগে স্বামীর ঘর ছাইড়া বাইর হইস না। আব্বায় তোর কথা স্মরণ করমু। আইমু তোরে দেখতে রোজ। বালা জায়গায় বিয়া হইসে তোর, বালা থাকিস। সুখে শান্তিতে স্বামীর ঘর করিস মা। যা এহন।’
গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল। চিত্রা একবারও শেহজাদের দিকে তাকায় নি। আনমনে জানালার দিকে চেয়ে আছে। দমকা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে চিত্রার দেহখানা। গাড়িতে মৃদু কণ্ঠে গান বাজছে,

‘ আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে?
আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি, পরাণ বান্ধিবি কেমনে?’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২