গভীর গোপন পর্ব ৪

গভীর গোপন পর্ব ৪
অনন্য শফিক

এই কদিনে জেবার সঙ্গে আমার খুব মিষ্টি একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল।আমরা এখন চা করে বারান্দায় বসি একসাথে।চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প করি। আপনি থেকে এখন আমরা তুমিতে এসেছি।টুকি তখন খেলে বেড়ালের সঙ্গে।বেড়ালের সঙ্গে তার ভালো ভাব জমেছে ।

জেবা তার কষ্টের কথা বলে।শুনে আমার চোখ ভিজে উঠে। গতরাতে তার মা তাকে গোপনে ফোন করেছিলো। এই জন্য তার বাবা এই বুড়ো বয়সেও তার মায়ের গায়ে হাত তুলেছেন।এর কারণ একটাই।তার মেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে তাদের। এই মেয়ের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করলেন কোন সাহসে!
এরপর নাকি তার ভাই তার মায়ের ফোন কেড়ে নিয়েছে। তার মা তার এক চাচীর ফোন দিয়ে লুকিয়ে আজ সকালে এসব বলেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এরপর জেবা বললো,’ এরকম জীবন রেখে লাভ কি তুলি? এরচেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।দেখবে একদিন বি*ষ টি*ষ খেয়ে ফেলবো। তোমাদের ভয় নেই। এখানে খাবো না। তোমাদের ফাঁসাবো না।’
তুলি হাসলো।
আমি বললাম,’ ওরকম কথা আর বলো না। তোমাকে আল্লাহ একটা লক্ষ্মী মেয়ে দিয়েছেন।ওর দিকে তাকিয়ে হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে।হেরে গেলে চলবে না!’

জেবা হয়তো তখন ভরসা পায়। নতুন করে বাঁচতে শিখে।
সে জ্বলজ্বলে চোখের তারা নাচিয়ে বলে,’ আমি শেষমেষ জিতবোই জিতবো।’
আমার বড় ভালো লাগে শুনে।

জেবাকে এক রকম বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম আমি ‌। কিন্তু এই বিশ্বাসে কিছুটা চিঁড় ধরলো একটা ঘটনা ঘটার পর। আমার ঘুম এমনিতে খুবই হালকা হয়। শরীরে একটা পিঁপড়ে হাঁটলেও আমি সজাগ হয়ে পড়ি। কিন্তু ইদানিং আমার গাঢ় ঘুম হচ্ছে। সকাল সকাল ঘুম পেয়ে বসে। ওদিকে বেলা অনেক গড়ালে পরে আমার ঘুম ভাঙে।জেবাও নিজ থেকেই সংসারের রান্না বান্নার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

রোজ রোজ আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি আশফাক অফিসে চলে গেছে। ওকে খাবার দাবার করিয়েছে জেবাই। আমার গাঢ় ঘুমের কারণটা আমি ধরতে পারছিলাম না এই কদিন। ভাবলাম ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছে ওখানে কোন একটা হয়তো ওরকম।যা খেলে খুব ঘুম হয়। কিন্তু এই ভুল ভঙলো আরো পরে। আজ যখন জেবা চা করছে তখন আমি রান্না ঘরে যাচ্ছিলাম পানি খাওয়ার জন্য।

কিন্তু যাওয়ার আগেই দরজার কাছ থেকে ওকে কিছু একটা করতে দেখে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ি। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখি ও একটা কাপে কাগজ থেকে কিসের যেন পাউডার ঢেলে দিচ্ছে। তারপর আবার কাগজটা কোমরের কাছে গুঁজে রেখে দিলো। ততোক্ষণে ঘুমের বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠলো।আমি বুঝতে পারলাম আমার গাঢ় গভীর ঘুমটা আসলে কোথা থেকে আসে। আমার চায়ে মেডিসিন গলিয়ে দেয় জেবা।আমায় ঘুম পাড়িয়ে রাখে জেবা। কেন জেবা এরকম করে? কেন?

নিজের কাছেই নিজেকে আমার প্রচন্ড বোকা মনে হচ্ছে।সারা জীবন আমায় সবাই চালাক চতুর বলেছে।আমি নিজেও ভাবতাম আমি বড় চতুর। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে যে বোকা লোকটা,সে আমি। জেবাকে আমি সহজ সরল ভেবেছিলাম।
যতোটা সহজ সরল মনে সবকিছু হিসেব করে নিয়েছি জীবন আসলে ওরকম সহজ সরল না। আর সবকিছুই হিসেব মেনে চললেও জীবন হিসেব মেনে চলে না।
আমি ততোক্ষণে সরে পড়েছি ওখান থেকে। ইচ্ছে করলেই আমি তখন বলতে পারতাম জেবা কি করছো তুমি এখানে? কি মেশাচ্ছো চায়ের সঙ্গে?

আমি ইচ্ছে করলেই ওর কাছে যেতে পারতাম।গেলে জেবা হয়তো ধরা পড়ে যেতো।ধরা পড়লেই গল্প শেষ। কিন্তু অনেক রহস্য রয়ে যেতো। এই রহস্যের যে গভীর গোপন আছে তা জানার জন্যই চুপচাপ পিছিয়ে এলাম। নিজেকে শান্ত করে নিলাম।
জেবা চা করে এনে বললো ,’ তুলি, আজকের চায়ে মশলা দিয়েছি।খুব ভালো ফ্লেভার এসেছে।
নেও। ‘

সে আমার হাতে কাপটা বাড়িয়ে দিলো।আমি কি করবো আসলে বুঝতে পারছিলাম না।এই চা কিছুতেই খাওয়া যাবে না।চা খেলেই আবার ঘুম হবে। গভীর ঘুম।আমি ঘুমে তলিয়ে পড়লে এই বাড়িতে কি হয় এর কিছুই টের পাবো না আমি! কিন্তু চা না খেলেও তো ও বোঝে ফেলবে।আমি কি করবো আসলে বুঝতে পারছিলাম না!
এরিমধ্যে আমার ফোন বাজলো।চা হাতে করে দাঁড়িয়ে ওকে বললাম,’ জেবা, আমার ফোন বাজছে। ঘরে ফোন। গিয়ে দেখি কে ফোন করেছে।’

জেবা বললো,’ যাও।’
ওর সামনে ঠোঁটের কাছে কাপ নিয়ে চুমুক দেয়ার ভান করে ভেতরে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি মা ফোন করেছেন।মার কাছে জেবা প্রসঙ্গে এখন পর্যন্ত কিছুই বলিনি।বললে সর্বনাশ হবে! মা আগুন হয়ে উঠবেন। বলবেন,ঘরে সতীন পাড় করেছিস! মরবার শখ হয়েছে তোর?

মায়ের সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে কথা বললাম। এই সুযোগে চা ফেলে দিলাম বাইরে। কথা শেষ হলে ওর কাছে এসে বললাম,’ আল্লাহ! ভীষণ টেস্ট হয়েছে! মশলা চা তো খুব মজার হয়!’
জেবা হাসলো। এই হাসিটা কৃত্রিম। এভাবে কৃত্রিম হাসি হাসলো কেন জেবা? ওর তো বিজয়ের হাসি হাসবার কথা ছিল!
বিষয়টা আমার ভালো লাগলো না!

আশফাক ফিরলো নটার দিকে। ততোক্ষণে আমি শুয়ে পড়েছি। এই কদিন ঘুমাবার পর অভ্যেস হয়ে গেছে।আজ চা না খেলেও চোখ টানছে।ঘুম পাচ্ছে খুব। কষ্ট করে চোখের পাতা আলাদা করে রেখেছি।
আশফাক এসে ডাকলো।
বললো,’ তুলি ? এই তুলি?’
আমি ঘুমে জড়ানো গলায় বললাম,’ হু।’

ও বললো,’ আমি এসেছি। হাতমুখ ধুয়ে আসছি।ভাত দাও তো উঠে।’
আমি উঠলাম না।ঘুম কাতর গলায় বললাম,’ নিয়ে খেয়ে ফেলো না। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। উঠতে পারছি না। চোখের পাতাই খুলতে পারি না আমি!’
ও ঘর থেকে জেবা এগিয়ে এলো।বললো সে ভাত দিচ্ছে। আমাকে আর উঠতে হবে না।
জেবা এসে ভাত দিয়েছে।আশফাক কি যেন ওকে বললো। ধমকের গলায় বললো কি না আমি বুঝতে পারলাম না।চা না খাওয়ার পরেও কেন আমার এরকম হলো বুঝতে পারলাম না।আর জেগে থাকতে পারলাম না।ঘুমে তলিয়ে পড়লাম।ঘুম থেকে যখন জাগলাম তখন দেখি সকাল আটটা। আশফাক বেরিয়ে গেছে ততোক্ষণে।জেবা ওর ঘর থেকে গান ধরেছে। রবীন্দ্র সংগীত।

‘” আমার নিশিত রাতের বাদল ধারা
এসো হে
গোপনে। ”
টুকি খিটখিট করে হাসছে। কেন হাসছে কে জানে!
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মন ফুরফুরে থাকার কথা ছিল। রবীন্দ্র সংগীত আমার প্রিয়। তাছাড়া জেবার গলাতেও দরদ আছে। কিন্তু আজ আমার মেজাজটাই বিগড়ে গেলো।
এতো দিন তো সবকিছুই ঠিকমতো চলছিলো।জেবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।টুকিকে নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতাম। কিন্তু এখন আর ওদের মা মেয়ের সঙ্গে আমার মিশতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই রাগ আমি প্রকাশও করতে পারছি না।এর মতো অসহ্য যন্ত্রণা আর কিচ্ছু হয় না!

দুপুর বেলা হুট করে জুঁই এসে উপস্থিত।জেবা তখন বাসায় নেই।টুকিকে নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছে।বলেছে তার এক আন্টির সঙ্গে দেখা করবে। এখানে আর কতোদিন থাকবে। আমাদের বোঝা হয়ে নাকি আর থাকতে চায় না।
ও যাওয়ার খানিক পরেই জুঁই এলো। জুঁই এসে ও ঘরে জেবার কাপড় চোপড় ব্যাগ পত্র দেখে বললো,’ এসব কার ভাবি? ‘
আমি সব খুলে বললাম।’

জেবা শুনে বললো,’ ওকে এখানে জায়গা দিলে কেন? দুনিয়ায় কি ওর থাকার জায়গার অভাব ছিল নাকি?’
আমি বললাম,’ আমি কীভাবে জায়গা দিলাম? তোর ভাই -ই তো এনে তুললো। জায়গা দিলো। তাছাড়া জেবা ওর বন্ধু।সে তার বন্ধুকে বিপদের সময় আশ্রয় দিলে আমার কি বলার থাকে এখানে?’
জুঁই রাগ দেখিয়ে বললো,’ তোমাকে সুখে থাকতে ভূতে কিলায় তাই না? মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি! যত্তোসব।’
আমি চুপ করে রইলাম। চুপ করে না থেকে কি বলবো ওকে?
জুঁই বললো,’ এখন চুপ হয়ে গেলে কেন? কাকে বলবো তাহলে এসব?খাল কেটে তো ঘরে ঠিকই কুমির আনলে। এখন কামড় খেয়ে মজা শেখো!’

আমি মলিন মুখে ওকে বললাম,’ এসব আমাকে বলছিস কেন তুই? ‘
জুঁইয়ের রাগ আরো বাড়লো। সে বললো,’ তাহলে কাকে বলবো? জেবার কি মা নাই? বোন নাই? খালা নাই? চাচী নাই? সব আছে তাই না। এখন আমায় বলো তুমি, রক্তের সম্পর্কের সব মানুষ রেখে এখানে এসে উঠলো কেন সে?’
আমি বললাম,’ ওকে ওর কোন আত্মীয় স্বজন জায়গা দিচ্ছে না তাই উঠেছে।’
জুঁই বললো,’ বেশ ভালো কথা। জায়গা দিচ্ছে না। কিন্তু তার কি কোন মেয়ে বন্ধু ছিল না? মেয়ে বন্ধুর ওখানে গিয়ে উঠতে পারলো না? এখানে এসে আশফাক সাহেবকেই কেন বেছে নিতে হলো?’

আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। জুঁই সবকিছু খুলেও বলছে না।
আমি বললাম,’ জুঁই, জেবা সুবিধার না তাই না?’
জুঁই কিছু বললো না। রাগে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।
আমি আবার বললাম,’ তোর ভাইজানের সঙ্গে কি ওর অন্য রকম সম্পর্ক ছিল আগে থেকে? জেবার কি চরিত্রে সমস্যা? আমিও একটা ঘটনার জন্য ওকে সন্দেহ করি!’

গভীর গোপন পর্ব ৩

জুঁই বললো,’ এসবের কোন উত্তর তুমি আমার থেকে পাবে না। এমনিতেই ভাইজানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তিক্ত। আমি এই নিয়ে আরেকটা কথাও বলবো না। কিন্তু তোমাকে আমি অসম্ভব রকম পছন্দ করি। তোমার ভালোর জন্যই বলছি।জেবা আপু ভালো মেয়েই হোক কিংবা খারাপ মেয়ে হোক এটা তোমার ভাববার দরকার নাই। তুমি ওকে এখান থেকে বিদায় করার চেষ্টা করো।

গভীর গোপন পর্ব ৫