চৈত্রিকা পর্ব ১৯

চৈত্রিকা পর্ব ১৯
বোরহানা আক্তার রেশমী

অর্পিতার হাতের রক্ত কোনো মতে আটকানো গেলেও পুরোপুরি চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে শহরে যেতে হবে। শায়লা বিলাপ করে কাঁদছে। বড়রা সবাই চিন্তায় আছে। চৈত্রিকা তখনো চিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে নিজের ক্ষ’তি করতে হয়তো খুব বেশি ভাববে না৷ প্রহর আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েছে চৈত্রিকার দিকে। চিত্রর আশেপাশে তাকে ঘুরতে দেখে খুব বেশি সময় লাগেনি পুরোটা বুঝতে। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তবে মুখের গম্ভীর ভাবটা একটু সরায় না।

ডাক্তারের সাথে সব পরামর্শ শেষ করে ঠিক হয় প্রহরই যাবে অর্পিতাকে নিয়ে। সাথে যাবে শিমুল আর শায়লা। ছোট্ট অয়ন আর অর্থি এসব কিছু দেখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। তাদের আগলে রেখেছে পল্লবী। কথামতো কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রহর, শিমুল আর শায়লা অর্পিতাকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। চিত্র শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখে। মুখে কিছু বলতে পারে না। কি বলবে তা ভেবেও পায় না। তার জন্যই তো তার অর্পির আজ এমন অবস্থা তাহলে সে মুখে কি বলবে? চৈত্রিকা শুধু চিত্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একে একে সবাই ফিরে আসে অন্দরমহলের দিকে। চিত্র এলোমেলো পায়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে নিলে আটকে দেয় চৈত্রিকা। চিত্র পেছন ফিরে তাকায়। চৈত্রিকা হাসার চেষ্টা করে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আপনি একা ঘরে গিয়ে কি করবেন চিত্র ভাই? আপনি বরং এখানেই বসুন না!’
চিত্র হাসে। পুরো বাড়ির সকলে যখন অর্পিতাকে নিয়ে ব্যস্ত, তার মানসিক অবস্থাটা ভাবার মতো কেউ নেই তখন কয়েকদিন পরিচিত একটি মেয়ে তার কথা ভাবছে! সম্পর্কে তো মেয়েটি তো তার ভাবীজান হয়। বয়সে তার থেকে কয়েক বছরের ছোট অথচ কি সুন্দর বুঝ তার! চিত্র কিছুক্ষণ চৈত্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলে,
‘আমি অর্পি নই ভাবীজান। চিন্তা করবেন না। আমি তো ভীষণ স্বা’র্থপর তাই নিজের ক্ষ’তিটা করবো না৷’

চৈত্রিকা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। ঠিক ভরসা করে উঠতে পারে না। তবে মুখে কিছু বলেও না৷ চিত্র চলে যায়। হলরুমে পল্লবী, নীরা, অর্থি, অয়ন, স্মরণ, চয়ন, নাসিমা, সাদিক সবাই বসে আছে। পিয়াস এসবের ধারে কাছেও থাকে নাহ বরাবরই। চৈত্রিকা একবার সবার মুখের দিকে তাকাতেই স্মরণ ব্যস্ত গলায় বলে,
‘আমার মা কোথায়? অনেকক্ষণ থেকে তো মা’কে দেখিনি!’
চৈত্রিকা বাঁকা হাসে। সবার অগোচরে চুপচাপ অর্পিতার ঘরের দিকে যায়। সেখানে পাহাড়ায় থাকা একজন লোক চৈত্রিকাকে দেখে মাথা নিচু করে সালাম দেয়৷ চৈত্রিকা স্বর গম্ভীর করে বলে,

‘ঘরেই আছে তো? কেউ এসেছিলো?’
লোকটি নীচু স্বরে ছোট্ট করে বলে, ‘জ্বি। ঘরেই আছে তবে কেউ আসেনি।’
চৈত্রিকা ‘আচ্ছা’ বলে তাকে যেতে বলে। লোকটা যেখানে বসে ছিলো সেখানে মোটা একটা রড আর একটা বেল্ট ছিলো। দুটোর দিকে এক নজর তাকিয়ে ঘরের দরজা খুলে দেয়। মেঝেতে হাত, পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে শিল্পা। যে লোকটি পাহাড়ার কাজে ছিলো সেই লোকটিই শিল্পাকে বেঁধে রেখেছিলো। চৈত্রিকা কোনো কথা না বলে চুপচাপ প্রথমে শিল্পার হাত পায়ের বাঁধন খুলতে থাকে। শিল্পা চৈত্রিকাকে দেখেই ছটফট শুরু করে। যেনো কিছু বলতে চায়! মুখটা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই শিল্পা বড় বড় শ্বাস নিয়ে খ্যাক করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘এটা তুই ঠিক করিসনি বড় বউ! আমার সাথে লাগতে এসে ভালো করলি না। পেছন থেকে বেঁধে রেখে আ’ঘাাত না করে সাহস থাকলে সামনাসামনি আ’ঘাত কর।’
চৈত্রিকা হেঁসে ওঠে। শিল্পার চুলের ভাজে হাত রেখে বলে, ‘আমি তো এখনো আপনাকে ফুলের টোকাও দেইনি শ্রদ্ধেয় খালাজান! আর চৈত্রিকা পেছন থেকে আ’ঘাত করে না। শ’ত্রুর সাথে সামনাসামনি লড়াই করার যথেষ্ট সাহস এই চৈত্রিকার আছে৷ ভীতুরা পেছন থেকে আ’ঘাত করে কিন্তু চৈত্রিকা বুক টান টান করে সামনে দাঁড়িয়ে একদম বুক বরাবর আ”ঘাত করে।’

চৈত্রিকার তেজী কন্ঠের কাছে শিল্পার গলা শুকায়। প্রথমবারের মতো শান্তশিষ্ট মেয়েটির এমন সাহসী রুপ হজম করতে সময় লাগে। কিন্তু চৈত্রিকার কাছে তো সে হার মানবে না। তাই কোনোরকমে নিজেকে শান্ত করে রু’ক্ষ স্বরে বলে,
‘একদম বড় বড় কথা বলবে না। দেবরের সাথে যে কি কি করে বেড়াও তা তো তখন দেখলামই! এমন চ”রিত্রহী’ন মেয়েদের মুখে এতো বড় বড় কথা মানায় না। একে তো মামাও একটা চ’রিত্রহী’ন তার ভাগ্নীর আবার চরিত্র কেমনে ঠিক হবে? চয়ন ভাই কেমনে যে ওইরকম বাড়ির মেয়েকে বউ করে আনলো কে জানে বাপু! বাপ মা’কে কেউ কখনো দেখেনি, চিনে না, জানে না। আদৌও বাপ মায়ের কোনো পরিচয় আছে কি না কে জানে! তোমার বাপ তোমারে এমন অসভ্যতা শিখাইছে হ্যাঁ? তোমার বাপ, মাও কি তোমার মতো চ’রিত্রহী’ন ছিলো নাকি?’

শিল্পার বলতে দেড়ি হলেও তার গালে থা’প্প’ড় পড়তে মিনিট খানেকও দেড়ি হলো না। পুরো ঘরে স্বশব্দে যেনো বেজে উঠলো থা’প্প’ড়টা। এতো জোড়ে একটা থা’প্প’ড় হজম করতে শিল্পার বেশ খানিক সময় লাগলো। অবাক চোখে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখে চৈত্রিকার চোখ, মুখ লাল হয়ে আছে। তবে এই চেহারাতে অন্য কিছু ছিলো যা শিল্পাকে ভয় পেতে বাধ্য করে। চৈত্রিকা চোয়াল শক্ত করে বলে,

‘আপনার নোং’রা মুখে আমার বাবাকে নিয়ে একটা টু শব্দও করলে আপনার জিভ টেনে ছি’ড়ে ফেলবো আমি। আমাার বাবা কি কি শিখিয়েছে তা যদি প্রয়োগ করি তাহলে আপনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা কেঁপে উঠবে। আমার চরিত্র কেমন তা আমি আপনার মতো নিচু মহিলার থেকে শুনবো না। আর এই ধরনের ভুল গুলো যেনো ২য় বার না হয় তার ব্যবস্থা করতেছি। চলেন!’

শিল্পা ভয় পেয়ে যায়। চৈত্রিকার রাগে তখনো মাথায় আগুন জ্ব’লছে। গটগট পায়ে ঘরের বাহিরে এসে বেল্ট তুলে নিয়ে এগোয় শিল্পার কাছে। শিল্পা কিছু বলার আগেই নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘা বসায় শিল্পার পিঠে। শিল্পা ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। চৈত্রিকা তখন উন্মাদ। হঠাৎ করে চৈত্রিকার এমন ভ’য়ং’কর রুপ দেখে, ব্যাথায় শিল্পা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। চৈত্রিকা হাত ধরে টেনে তোলে শিল্পাকে৷ নি’ষ্ঠুর গলায় বলে,

‘অর্পিতা আপুর সাথে অন্যায়ের শা’স্তি! চিত্র ভাইকে উ’স্কিয়ে খারাপ ভাবে অর্পিতা আপুর সম্মানে হাত দেওয়ার শাস্তি! উনি ভেতর থেকে যতটা কষ্ট পেয়েছে ততটাই কষ্ট পাবেন আপনি। আপু যতটা কষ্ট এখন পাচ্ছে সবকিছুর শাস্তি একসাথে পাবেন।’

শিল্পায় ব্যাথায় কিছু বলতে পারে না। চৈত্রিকা শিল্পাকে যেভাবে দাঁড় করিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই আবার মা’রতে থাকে। শিল্পা আঘাত সহ্য করতে না পেরে স্বাভাবিক ভাবেই ঘর থেকে বের হয়। চৈত্রিকার চুল ততক্ষণে খুলে গেছে তবে হাত থেমে নেই। তার চেঁচামেচিতে হলরুম থেকে সবাই ছুটে আসে। তবে চৈত্রিকা থামে না। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে শিল্পাকে যা তা বলতে থাকে আর মা’রতে থাকে৷ শিল্পা মেঝেতে শুয়ে পড়েছে সহ্য করতে না পেরে। স্মরণ কাছে আসতে নিলে দুয়েকটা আ’ঘাত সেও পায়। দুপাশ থেকে পল্লবী, নীরা, নাসিমা চৈত্রিকাকে থামানোর চেষ্টা করে। চয়ন, সাদিক গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ চেচামেচি শুনে চিত্রও আসে। চৈত্রিকার এমন উন্মাদ রুপ দেখে নিজেও ভড়কায়। চৈত্রিকাকে কোনো রকমে থামিয়ে পল্লবী রাগী সুরে বলে,

‘এগুলো কি ধরনের বেয়াদবি চৈত্রিকা? জমিদার বাড়ির মেহমানদের সাথে কেউ এমন করে? কি করেছে উনি? মা’রছো কেনো?’
চৈত্রিকা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কি করেছে তা ওই মহিলাকেই জিজ্ঞেস করুন! আজ অর্পিতা আপুর এই অবস্থা, চিত্র ভাইয়ের এমন অন্যায়ের পেছনে মূল মাথা কে? উনাকে জিজ্ঞেস করুন!’
সবাই অবাক হয়ে তাকায়। শিল্পাকে চুপ থাকতে দেখে চৈত্রিকা আবারও রেগে তেড়ে আসতে নিলে শিল্পা ব্যার্থার্ত অবস্থায় ভয়ে গড়গড় করে কোনোরকমে বলে,

‘সব আমি করেছি। আমিই চিত্রকে উ’স্কিয়েছি সব কিছু করার জন্য৷ ‘ও’ ভালোবাসা পাওয়ার লো’ভে অ’ন্ধ হয়ে গিয়ে আমার প্ল্যানে ফেঁসে গেছে। আমি করেছি সব। আমাকে আর মে’রো না চৈত্রিকা।’
সবাই অবাক হয়ে যায়। চৈত্রিকা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। চৈত্রিকার এই রুপে জমিদার বাড়ির মেয়েগুলো অবাক হলো। যে নীরা কখনো মাথা নিচু ছাড়া উচু করে কথা বলেনা সেই নীরাও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় রুদ্রানী রুপের চৈত্রিকার দিকে। অদ্ভুত ভাবে এই মেয়েটিকে এই রুপেই বেশি অপরুপ লাগে। নারী হবে সূর্যের মতো তেজী যার তেজই বলে দেবে তার কতটা মূল্য!

অর্পিতার ঘটনার পর থেকেই অর্থির মন খারাপ। নিবিড় কিছুই জানে না তাই সে আজও পড়াতে এসেছে। পল্লবী এতে কোনো রকম দ্বিরুক্তি না করে নিবিড়কে পড়াতে বলে নিজে চলে গেছে। নিবিড়ের বেশ অদ্ভুত লাগলেও পাত্তা দেয় না ঘটনাটা। স্বাভাবিক ভাবেই অর্থিকে বলে,
‘বই খাতা বের করো!’

অর্থি নিশ্চুপ। কোনো কথাও বলছে না, কাজও করছে না। বিষয়টা খেয়াল করে নিবিড় ভ্রু কুঁচকায়। ভেবেই নেয় অর্থি আজও পড়াতে ফাঁকি দেবে। মেয়েটার ওপর সে বড়ই বিরক্ত। কাল মা’র খাওয়ার পরও আজ কেমন ত্যাড়ার মতো কথা না শুনে বসে আছে! নিবিড় আবারও বেশ শান্ত গলায় বলে,
‘অর্থি! আমি তোমাকে বই, খাতা বের করতে বলেছি! অঙ্ক করো!’
অর্থি মাথা নিচু করে বলে, ‘আমি আজ পড়বো না মাষ্টারমশাই।’

নিবিড়ের রাগ হয়। নিজেকে দমানোর চেষ্টা করে বলে, ‘কেনো পড়বে না? কি সমস্যা?’
অর্থি কারণ না বলে চুপ করে থাকে। অর্পিতার বিষয়টা বলবে কি বলবে না তা বুঝে উঠতে পারে না। এর মধ্যেই নিবিড় আবারও প্রশ্ন করে, ‘কি সমস্যা? পড়বে না কেনো? চুপ করে আছো কেনো? কথা বলতে পারো না?’
অর্থি ফাঁকা ঢোক গিলে বলে, ‘অর্পিতা আপু অসুস্থ। তাই পড়বো না।’

নিবিড় বিষয়টা বোঝে না। উল্টো অর্থি মজা করছে বা পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছে ভেবে রাগে একটা বেতের বা’রি বসিয়ে দেয় অর্থির হাতের কনুইয়ের ওপর। অর্থি হুট করে মা’র খাওয়ায় বেশ ব্যাথা পায়। ব্যাথায় আর্তনাদ করে ভাসা ভাসা চোখে তাকায় নিবিড়ের দিকে। নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তোমাকে ফাঁকি দিতে নিষেধ করিনি? পড়ার ভয়ে এতো বাহানা কেনো তোমার? কি সমস্যা?’
কান্না গুলো গলায় গিলে নিয়ে চোখ ঝাপ্টায় অর্থি। অভিমানে ছোট্ট মুখটা কালো হয়ে যায়। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে কন্ঠে অদ্ভুত এক টান রেখে আওড়ায়,

‘আমি ফাঁকি দেওয়ার জন্য কিছু বলিনি মাষ্টারমশাই। আপনি সব সময় আমার বিষয়ে এমন কেনো ভাবেন? আমি মানছি আমি পড়ালেখা করি নাহ তাই বলে কি অর্পিতা আপুকে নিয়েও মিথ্যা বলবো? আপু সত্যিই অসুস্থ মাষ্টারমশাই। আপু হাত কে’টে ফেলেছিলো সেখান থেকে রক্ত পড়ে পুরো ঘর একদম রক্তে ভেসে গেছে। আপুকে নিয়ে বড় ভাইজান শহরে গেছে। আপুর এমন অবস্থাতে কি পড়তে ভালো লাগে মাষ্টারমশাই?’

নিবিড় নির্বাক হয়ে অর্থির অভিমানী গলার কথা শুনে। নিজেই কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে বেত রেখে কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে দেয় অর্থির কাছে। ছোট করে বলে,
‘সরি অর্থি! আসলে আমি!’
অর্থি শোনে না। নিবিড়ের হাত সরিয়ে দিয়ে চোখ মুছে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। নিবিড় হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিজের ওপর রাগও হয়। কেনো সে পুরোটা না শুনে মেয়েটাকে অযথা মা’রলো!

সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরে প্রহর, অর্পিতা, শিমুল, শায়লা। অর্পিতা এখন কিছুটা সুস্থ। শিমুল আর শায়লা শহরেই থেকে যাওয়ার জিদ করলেও প্রহরের কড়া গলার কাছে তারা টিকতে পারেনি। অর্পিতাকে কিছু বলেনি প্রহর। অর্পিতা নিজেও চুপচাপ। বাড়িতে এসে অর্পিতাকে তার ঘরে দিয়ে প্রহর প্রথমে যায় নিজেদের ঘরে। হলরুমে কমবেশি সবাই থাকলেও স্মরণ, শিল্পা, চিত্র আর চৈত্রিকাকে কোথাও দেখেনি প্রহর।

বাাড়ির পরিবেশটা বেশ নিস্তব্ধ মনে হলেও প্রহর কিছু বলেনি। তার বোঝা শেষ বাড়িতে কিছু হয়েছে। তাই দ্রুত নিজের ঘরে যায়। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিছানায় ঘুমন্ত চৈত্রিকাকে। অবেলায় এভাবে চৈত্রিকাকে ঘুমাতে দেখে বেশ অবাকই হয়। ধীর পায়ে চৈত্রিকার কাছে যেতে নিয়েও গোসলখানায় ঢুকে। একেবারে গোসল করে শুধু টাউজার পড়ে উদোম বুকেই বের হয়ে আসে। টি-শার্টটা কোনো রকম পড়তে পড়তে চৈত্রিকার কাছে গিয়ে বসে। আলগোছে কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর আছে কি না! কিন্তু প্রহরের স্পর্শেই জেগে ওঠে চৈত্রিকা। চোখের সামনে হুট করে প্রহরের মুখ ভেসে আসায় চমকে উঠে সরে যায়। মস্তিষ্ক কিছুক্ষণের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দেয়। প্রহর ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘সবসময় এমন লাফাও কেনো? কি সমস্যা? কপালেই তো হাত দিয়েছি শুধু। আর তুমি এই অবেলায় ঘুমাও কেনো?’
চৈত্রিকা কিছুক্ষণ ঝিম মে’রে বসে থাকে। তারপর অলস গলায় বলে, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে! অর্থি ডাকে নাই কেন আমাকে?’
প্রহর কিছু বলে না। চুপচাপ নিজের চুল মুছতে থাকে। চৈত্রিকা ফট করেই খাট থেকে নামে। শাড়ি ঠিক করতে করতে বলে, ‘অর্পিতা আপু এসেছে? কেমন আছে এখন? কোথায় আছে? ঠিক আছে তো? আপনারা কখন এসেছেন?’
‘ধীরে ধীরে প্রশ্ন করো! আমি পালিয়ে যাচ্ছি না বা যাবোও না। অর্পি ঠিক আছে। নিজের ঘরে আছে আর আমরা একটু আগেই এসেছি।’

চৈত্রিকা আর কোনো কথা না বলে দরজার দিকে হাঁটা লাগায়। পেছন থেকে প্রহর শান্ত গলায় শুধায়, ‘বাড়িতে কি হয়েছে আজ?’
চৈত্রিকা থেমে যায়। খানিকটা অবাক হয়। প্রহর তো আজ বাড়িতে ছিলো না। তবে জানলো কেমন করে যে বাড়িতে কিছু হয়েছে! পেছন ফিরে তাকায় চৈত্রিকা। প্রহর তখনো নিজের কাজে ব্যস্ত। চৈত্রিকাকে চুপ থাকতে দেখে সে নিজেই আবারও বলে, ‘এতো ভেবে কাজ নেই৷ আমি প্রহর রেনওয়াজ! সবার মুখ দেখেই বলে দিতে পারি কার মনে কি চলে! সেখানে সামান্য ঘটনাটুকু বুঝা আমার জন্য তেমন বড় কোনো ব্যাপার না।’

চৈত্রিকা পর্ব ১৮

চৈত্রিকা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসে। হাসিমুখেই বলে, ‘হবে না? জমিদার সাহেব বলে কথা! এমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি না হলে কি আর মানুষ মা’রা যায় জমিদার সাহেব?’
প্রহরের হাত থেমে যায়। তবে নিজের পক্ষে বা বিপক্ষে একটা টু শব্দও করে না। শুধু অদ্ভুত ভাবে হাসে। চৈত্রিকা ঘর থেকে বের হতে হতে বলে, ‘আজ একজনকে অন্যায়ের শা’স্তি দিয়েছি। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা অহরহ ঘটবে জমিদার সাহেব। তখন নিজ চোখে না হয় দেখে নিবেন!’
চৈত্রিকার যাওয়ার পথে প্রহর অবাক হয়ে তাকায়। চৈত্রিকা করেছে টা কি? আবার নিজের বিপদ নিজেই টেনে আনেনি তো!

চৈত্রিকা পর্ব ২০