প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২৫

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২৫
তানজিলা খাতুন তানু

মিহানের কথাগুলো জিনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কখনোই ভাবতে পারেনি মিহান ওকে ভালোবেসে নয় পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিয়ে করেছে।
– এইসব তুমি কি বলছ মিহান।
– হ্যাঁ সব ঠিক বলছি। আমি কখনোই তোমাকে ভালোবাসি নি। আর বিয়েটা আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই করেছি।
– বাধ্য হয়ে মানে?
মিহান জিনিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,

– জিনিয়া আমাকে মাফ করে দিও। আর পাঁচটা স্বামী -স্ত্রীর মতো সম্পর্কটা আমি করতে পারব না।
– তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন?
– ওই যে বললাম পরিস্থিতি।
– কিসের পরিস্থিতি। যদি নাই বা ভালোবাসতে তাহলে কেন এত স্বপ্ন দেখিয়েছিলে, আমার জীবনটা এইভাবে নষ্ট করে দিলে কেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিহান কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে বসে আছে। জিনিয়া কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মিহানের সবকিছুই কিরকম বিরক্ত লাগছে, মনে হচ্ছে জিনিয়াও নাটক করছে। সহ্য হচ্ছে না কোনো কিছু। মিহান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জিনিয়া মিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল…
– কোন অপরাধের শাস্তি পাচ্ছি আমি। ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েও যে পেলাম না আমি।
মিহান যাবার মতো কোনো জায়গা পেল না তাই ছাদের উদ্দেশ্যেই রওনা দিলো। ছাদে উঠে দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর মেয়েটাকে অনেকটা অতসীর মতো লাগছে। মিহানের ভালো লাগছিল না,তাই পেছন ফিরে চলে যেতে যাবে তখনি অতসী বলে উঠল…

– আবার পালিয়ে যাচ্ছো মিহান।
মিহান পেছনে ঘুরে তাকালো না, ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। অতসী মিহানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো…
– জিনিয়াকে একে রেখে তুমি ছাদে কি করছ? আজকে তো তোমাদের বাসর রাত।
– যে বিয়েটাই মানি না তার আবার বাসর রাত।
তাচ্ছিল্যের হেসে উত্তর দিলো মিহান।
– পাগলামী করো‌ না মিহান। জিনিয়া তোমার স্ত্রী।
মিহান গর্জে উঠে বলে উঠল…
– মানি না আমি এই বিয়ে।
– মিহান।

অতসী চমকে উঠছে মিহানের এই রূপ দেখে। এতদিন মিহান কে চেনে তবে কোনো দিন মিহান কে এতটা রেগে যেতে দেখেনি। মিহান রাগে চোখ লাল করে অতসীর দুই কাঁধ ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল…
– আমিও মানুষ অতসী, আমিও মানুষ। আমারও কষ্ট হয়, বড্ড কষ্ট হয়। জীবনে যা যা চেয়েছি কখনোই সেটা পাইনি। নিজের প্রিয় মানুষগুলো সবসময়েই আমাকে ছেড়ে চলে যায়, আমি আর পারছি না আমার দমবন্ধ লাগছে অতসী।
– মিহান শান্ত হও। কি হয়েছে আমাকে সবটা বলো।
মিহান অতসী কে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল…

– রাত হয়েছে অনেক। তুমি ঘরে যাও।
মিহান ছাদের কিনারে গিয়ে সিগারেট ধরালো। যন্ত্রনাগুলো কখনোই পেছন ছাড়তেই চাই না। অতসীর কিছু একটা মনে পড়াতে তাড়াতাড়ি করে জিনিয়ার ঘরের দিকে রওনা দিলো।
জিনিয়া মেঝেতে বসে কেঁদে চলেছে, অতসী ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে ওর সামনে বসে বলল…
– এই জিনি কি হয়েছে কাদছিস কেন?
অতসীর কন্ঠস্বর শুনে জিনিয়া মাথা তুলে তাকিয়ে ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।‌ অতসী বুঝল, মিহানের কান্ডে জিনিয়া আঘাত পেয়েছে।
জিনিয়াকে শান্ত করে অতসী বলল…

– কি হয়েছে সবটা বল আমাকে।
জিনিয়া অতসী কে সবটা বলল। অতসী ঠাঁই বসে রইল, ভাবতেই পারেনি মিহান সরাসরি কথাগুলো জিনিয়াকে বলবে।
– আমি তোকে ঠকিয়ে মিহান কে কেড়ে নিয়েছিলাম তাই হয়তো আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমাকে মাফ করে দিস অতসী।
অতসী জিনিয়াকে আবারো জড়িয়ে ধরে বলল..

– তোর আর মিহানের প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেয়। আমি চাই তোরা দুজন একসাথে খুব ভালো থাক।
জিনিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অতসী ওকে শান্ত করে, ঘুম পাড়িয়ে দিলো। জিনিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অতসী চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগল, মিহানের কথাগুলো। অতসী ভালো করেই বুঝতে পারল, মিহান নিজে থেকে ওকে কিছুই বলবে না।

পরেরদিন…
জিনিয়ার প্রচন্ড মন খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। অতসী জিনিয়ার কাছে গিয়ে বলল…
– জিনি, তোর আর মিহানের ঝামেলার বিষয়ে কাউকে কিছু বুঝতে দিস না। বিষয়টি সবাই জানলে আরো ঝামেলার সৃষ্টি হবে।
– হুমম।
– নিজেকে স্বাভাবিক কর।

অতসীর কথা শুনে, সকলের কথা চিন্তা করে জিনিয়া স্বাভাবিক হলো। মুখের কোনে মেকি হাসি ফুটিয়ে তুললো। আজকে বৌভাতের অনুষ্ঠান, আগামীকালের থেকে বেশি লোকজন এসেছে। জিনিয়া স্টেজে পুতুলের মতো বসে আছে, কারোর সাথে কথা বলতে গেলে মেকি হাসি ফুটিয়ে তুলছে। যদিও বিষয়টি অতসী ছাড়া কেউই বুঝতে পারল না। অতসী জিনিয়ার মেকি হাসির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল..

– আমরা প্রতিটা মানুষই কতই না নিখুঁত অভিনেতা। বুকের মাঝে যতই কষ্ট থাকুক না কেন আমরা কখনোই কাউকে বুঝতে দিইনা। এমন একটা ভাব করে যেন কতই না হ্যাপি আছি।
অতসীর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তবুও অভিনয় করে যেতেই হচ্ছে। কষ্টগুলো কখনোই কারোর সাথে শেয়ার করতে পারেনি, তাই তো গুমরে গুমরে ম’রে।
বৌভাতের অনুষ্ঠানে মিতুও এসেছে। মিতু অতসীর পাশে দাঁড়িয়ে বলল..

– কেমন আছো অতসী?
– হুম ভালো তুমি।
– হুম ভালো।
– মিষ্টিবুড়ি কেমন আছে?
– হুম আছে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।
– ওহ।
মিতু কিছু একটা বলবে বলে উশখুশ করে চলেছে, কিন্তু বলতে পারছে না। অতসী সেটা বুঝতে পেরে বলল…

– কিছু কি বলবে?
– হুম।
– বলো।
– একটা কথা তোমাকে জানানোর ছিল।
– কি কথা।
– দাদাভাইয়ের বিয়ের কথা চলছে। মা চাইছে দাদাভাইয়ের বিয়ে দিতে।
কথাটা শুনে অতসী একটা ধাক্কা খেল। তবুও মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল…
– ভালো খবর তো। মিষ্টিবুড়ি একটা মা পাবে।

অতসীর কথা শুনে মিতু আহত হলো। অতসীর কাছ থেকে অন্য কিছু কথা আশা করেছিল, কিন্তু সেটা না হওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অতসীর ডাক পড়াতে অতসী মিতুর কাছ থেকে চলে যায়। মিতু মনে মনে বলল…
– যেটার জন্য এতকিছু করলাম, সেটা কি আদৌও সম্ভব হবে!
অতসী জিনিয়ার কাছে যেতেই জিনিয়া করুন কন্ঠে বলল…

– অতসী আমি আর মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে থাকতে পারছি না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
– তাহলে আমি এতগুলো বছর কিভাবে আছি! (বিরবির করে)
– কিছু বললি ‌
– না। একটু সহ্য কর, আর কি করবি।
– হুম।
অতসী জিনিয়াকে বুঝিয়ে স্টেজ থেকে নামবে তখনি মিহানের সাথে দেখা হলো। উনি বাঁকা হেসে বললেন..

– শেষমেশ মিহান আর জিনিয়ার বিয়ে হয়েই গেল। তুমি কিছুই করতে পারলে না।
– করার ইচ্ছা থাকলে অনেককিছুই করতে পারতাম। আমি যদি একবার হ্যাঁ বলতাম,তাহলে মিহান কখনোই এই বিয়েটা করত না। কিন্তু আমি সেটা করিনি, আমি চেয়েছিলাম মিহান আর জিনিয়া ভালো থাকুক। তবে আপনি আপনার ছেলের জীবনটা নিজের হাতে শেষ করে দিচ্ছেন, সেটা কিন্তু আমি বুঝে গেছি।
অতসীর শেষ কথাটা শুনে মিহানের মা একটু ঘাবড়ে যায়।

– কি বলতে চাইছ তুমি।
– মিহানের হঠাৎ পরির্বতন হয়ে যাওয়ার কারনটা কিছুটা আমার কাছে পরিস্কার।
মিহানের মা বুঝতে পারেনি, মিহানের বিয়ে পরেও অতসী বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি করবে।
– এইসবের মধ্যে একদম আসতে যেয়ো না অতসী।
– আমি যে না চাইতেও সবটার সাথে জড়িয়ে গেছি, তাই এখন আর কিছুই করার নেই। সবটা না জানা পর্যন্ত আমি সরছি না।
– কি চাও তুমি।

– সত্যিটা জানতে।
– কত টাকা দিলে তুমি এইসব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে বলো।
– আমি আগেও বলেছি আবার এখনও বলছি আমাকে টাকার গরম দেখাবেন না একদম।
মিহানের মা আরো কিছু বলতে যাবে,তখনি পাশ থেকে একজন বলে উঠল…
– আরে মামনি তুই এইখানে?

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২৪

অতসী ও মিহানের মা দুজনেই ওনার দিকে তাকালো। মানুষটির চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় ও আনন্দের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। অপর দিকে অতসীর মুখ ভীত হয়ে আছে, নিজের অতীত সামনে আসার ভয় পাচ্ছে অতসী। আর মিহানের মা কিছুই না বুঝে দুজনেরই মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা বোঝার চেষ্টা করছে।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২৬