চৈত্রিকা পর্ব ৬

চৈত্রিকা পর্ব ৬
বোরহানা আক্তার রেশমী

কাল প্রহর আর চৈত্রিকার বিয়ে। জমিদার বাড়িতে হাজির হয়েছে চয়ন রেনওয়াজের ছোট ভাই শিমুল রেনওয়াজ, তার বউ শায়লা, মেয়ে অর্পিতা। যদিও তার দু মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন শ্বশুড়বাড়িতে। ছোট ছেলের বয়স কেবল ১২। নাম অয়ন। পিচ্চিটা বেশ দুষ্টু। প্রহরের বিয়েটা বেশ জমজমাট ভাবে না হলেও চয়ন রেনওয়াজ তার ভাইয়ের পরিবারকেও বাড়িতে এনেছেন।

শায়লা বরাবরই চয়ন, পল্লবীর থেকে দুরে থাকতে পছন্দ করে। এবারও বেশ গায়গুয় করে তবেই এসেছে৷ জমিদারের ছোট পুত্র চিত্র রেনওয়াজও শহর থেকে বাড়ি ফিরেছে। ৩ মাস আগে যখন মহুয়ার মৃ’ত দেহ উদ্ধার করা হয় তখনই শেষবারের মতো জমিদার বাড়িতে পা পড়েছিলো তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরুণ তার খুব একটা আসা যাওয়া হয় না। চিত্র লাগেজ হাতে বাড়িতে ঢুকতেই পল্লবী ছুটে এসেছে। ছোট ছেলেকে কাছে পেয়েই সে অস্থির হয়ে পড়েছে। হলরুমে তখন সবাই বসে ছিলো। অর্থি চিত্রকে দেখেই ছুটে আসে। ভাইয়ের সামনে হাত বাড়িয়ে বেশ গদগদ স্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমার জন্য কিছু আনোনি ছোট ভাইজান?’
চিত্র ঠোঁট এলিয়ে হাসে। বোকা সোকা বোনটার দিকে তাকায় মায়া ভরা দৃষ্টিতে। এই বাড়িতে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার ছোট্ট বোনটাকে। পল্লবীকে ছাপিয়ে অর্থির হাত ধরে এসে সোফায় বসে। ব্যাগের ভেতর থেকে চকলেট, নুপুর, চুড়ি বের করে দিলো বোনের হাতে। অর্থি খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। চুড়ি হাতে পড়তে পড়তে বলে,
‘এগুলো তুমি আমার জন্য আনছো ছোট ভাইজান? কত্ত সুন্দর।’

উল্টে পাল্টে নিজের হাতের চুড়ি দেখতেই পল্লবী এগিয়ে এসে বলে, ‘নিজের ঘরে গিয়ে এগুলো দেখ। ছেলেটা কেবল আসছে ওরে আগে বিশ্রাম নিতে দে!’
অর্থি কোনো কথা না বলে ছুটে চলে যায়। সে সময় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলো পিয়াস। অর্থির নিজের চুড়ি, নুপুর, চকলেট নিয়ে মাতামাতি দেখে চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘এই সামান্য জিনিসের জন্য তুই এতো ঢঙ করছিস কেনো? এর থেকে দামী দামী জিনিস পায় জমিদার বাড়ির দাস-দাসীরা। তাই এতো ঢঙ না করে চুপচাপ নিজের ঘরে যা!’

অর্থি ভয়ে সিটিয়ে যায়৷ কোনোরকমে পিয়াসকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমে। পিয়াস নিচে নামলে চিত্র তাকে বলে, ‘বোনের সাথে এমন করে কথা বলো কেনো মেজো ভাই? মেয়েটা ছোট। বোকা, সহজ-সরল। ওর এই ছোট ছোট জিনিসেই খুশি৷ ওকে ওর মতো থাকতে দাও। ওর সাথে সবসময় এমন ব্যবহার করবে না।’
পিয়াস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সে দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে চিত্র চুপচাপ নিজের লাগেজ নিয়ে রুমের দিকে হাঁটা লাগায়। পেছন থেকে পল্লবী চেঁচিয়ে বলে, ‘হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয় চিত্র!’
চিত্র প্রতিত্তর করলো না। নিজের মতো চলে গেলো। পিয়াস সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বি’শ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বলে,

‘সব কয়টা আমার শ’ত্রু।’
চিত্র নিজের ঘরে এসে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। বাড়ির এতো শতো ঝামেলা থেকে সে বরাবরই একটু দুরে থাকে। মাধ্যমিক পর্যন্ত নিজের বাড়ির অবস্থা দেখে সে আর থাকেনি। শহরের কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়েছে। সেখানেই থেকে পড়ালেখা করে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের ওপর হাত দিয়ে শুয়ে থাকে। সে সময় খট করে দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে তাকায় চিত্র। সামনে অর্পিতাকে দেখে উঠে বসে। অর্পিতা কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে চিত্রের দিকে। তারপর হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘অনেকগুলো দিন পর তোমাকে দেখলাম চিত্র ভাই।’
চিত্র জবাব দিলো না। চুপচাপ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইলো। অর্পিতা কিছুক্ষণ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে আসে চিত্রের কাছে। চিত্রের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে সে নিজেও বসে পড়ে। মেঝেতে পায়ের আঙুল দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ অনেকক্ষণ নীরবতার পর চিত্র নিজেই বলে,

‘তোরা এবার আসলি যে! কাকিমা আসতে রাজি হয়েছিলো?’
অর্পিতা হেঁসে বলে, ‘আম্মা তো ওমনই! তুমি আসবে আমি জানতাম।’
চিত্র ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মেয়েটা একদমই বদলায়নি। ৪ বছর আগে যেমন দেখেছিলো ঠিক তেমনই আছে। গত ৪ বছরে তাদের দেখা খুব কমই হয়েছে। ধরা যায় দেখা-ই হয়নি। এতোগুলো দিন পর দুজনের কেউই নিজেদের মধ্যে কথা খুঁজে পেলো না। দুজনেই নীরব হয়ে বসে রইলো। একটা পর্যায়ে অর্পিতা কোনো কথা না বলে চুপচাপ উঠে দরজার কাছে যায়। পেছন থেকে চিত্র বলে,

‘বড় ভাইয়ের হবু বউকে দেখেছিস?’
অর্পিতা দুদিকে মাথা নাড়ায়। চিত্র বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘গিয়ে রেডি হ। একসাথে দেখতে যাবো।’
অর্পিতা চমকে পেছনে তাকায়। ততক্ষণে চিত্র নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে। অর্পিতা ঠোঁট কামড়ে সেদিকে তাকিয়ে মুহুর্তেই খুশি হয়ে যায়। ছুটে নিজের রুমে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পড়ে নেয়।

বিয়ে উপলক্ষে অর্থিকে নিবিড় শুধু দুদিন ছুটি দিয়েছে। এ নিয়ে অর্থি গাল ফুলিয়েছে বেশ ক’বার। তবুও নিবিড়ের মন গলেনি। বিয়েটা তো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে হচ্ছে না। হবে ঘরোয়া ভাবে তাহলে কেনো বেশি ছুটি দিবে? ক’দিন পরই তো ওর মাধ্যমিক অথচ মেয়েটা পড়ালেখায় এতো কেনো ফাঁকি দেয় এটাই ভেবে পায় না! অর্থির দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার নিজের মতো অর্থির খাতার দিকে তাকায়৷ অর্থি গাল ফুলিয়ে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনি এমন কেনো মাষ্টারমশাই? আপনি তো এমনিতে আমাকে ছুটিই দেন না আবার এখন বড় ভাইজানের বিয়ের উদ্দেশ্যে ছুটি দিচ্ছেন তাও কেবল দুদিন! এমন ছুটির কোনো মানে আছে?’

‘তাহলে কি ছুটি ক্যান্সেল করবো অর্থি? তুমি কি কাল আর কালকের পরেরদিনও পড়বে?’
অর্থি আঁতকে উঠে বুকে হাত দেয়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, ‘এটা কি বলেন মাষ্টারমশাই? আপনি আমাকে শুধুমাত্র দুদিন ছুটি দিয়েছেন তাও আবার বলছেন বাতিল করে দিবেন! আপনার মনে কি দয়া মায়া বলতে কিছু নেই? আমার মতো এটুকু একটা মেয়ের মনে আপনি এভাবে আঘাত করতে পারেন?’
‘তাহলে কিভাবে আঘাত করবো? তুমিই বলো!’
‘আঘাত কেনো করবেন? আপনি তো আমাকে ভালোবাসবেন মাষ্টারমশাই।’

নিবিড় ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। অর্থি তখনো নিবিড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কিছু শোনার আশায়। মেয়েটা কোন ভালোবাসার কথা বললো? এই মেয়ে নিশ্চয় ওইসব ভালোবাসার কথা বলবে না! তাহলে? নিবিড় ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে নিলেই হঠাৎ করে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসে। নিবিড় আর অর্থি একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দ্রুত পড়ার ঘর থেকে বের হয়।

দুতলা থেকে নিচে তাকাতেই দেখতে পায় পিয়াসের বিধ্বস্ত চেহারা। হাতে, পায়ে, মাথায় র’ক্তের দাগ। গায়ের শার্টেও র’ক্ত লেগে আছে। পল্লবী ‘হায় হায়’ করছে। নীরা দ্রুত কাপড় এনে পিয়াসের মাথায় চেপে ধরে। মেজো ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে অর্থি ভয়ে নিবিড়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। নিবিড়ও বেশ অবাক হয়েছে। হঠাৎ করে পিয়াসের এমন অবস্থা হলো কেমন করে? যেনো কেউ নিজের ক্ষো’ভ মিটিয়েছে হালকা করে!

সন্ধ্যার আগের সময়। সূর্য ডুবে গেছে প্রায়। চারদিকে তখনো হালকা আলো রয়েছেই৷ চৈত্রিকা আর সাথী বসে আছে তাদের বাড়ির সামনের দীঘির পাড়ে। চৈত্রিকা গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেও সাথী তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। বেশ অনেকটা সময় ওভাবে কাটলে সাথী মুখ খোলে। কণ্ঠস্বর নিচু রেখে বেশ ধীরেই বলে,
‘কি ভাবছিস চৈত্র? তখন থেকে দেখছি কিছু ভেবেই যাচ্ছিস! কিছু হয়েছে?’
চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাথীর মুখের দিকে তাকায়। তার চিন্তা ভাবনায় আসলেই কি চলছে তা সে জানে না। আসলেই কি জানে না? চৈত্রিকা সাথীর দিকে তাকিয়েই বলে,

‘তেমন কিছু ভাবছি না। কালই তো বিয়ে! এরপর জীবন নতুন করে, নতুন ভাবে শুরু হবে।’
‘তোর কি উচিত হচ্ছে বিয়েটা করা? জমিদারের ছেলে তো আর তোকে ছেড়ে দেবে না। ভেবে দেখেছিস সে কিন্তু তোর ওপর স্বামীর অধিকার ঠিকই দেখাবে!’
চৈত্রিকা ভেতর ভেতর চমকায় তবে বাহিরে তা প্রকাশ করে না। সে যে এসব ভাবেনি এমনটাও নয়। তবে বিয়েটা করা ছাড়াও তো কোনো উপায় নেই। পরপর বেশ কয়েক বার সে ফাঁকা ঢোক গিলে বড় করে শ্বাস নেয়। সাথী তখনো তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চৈত্রিকা কিছু বলার আগেই ছুটে আসে সনিয়া বেগম। অস্থির গলায় বলে,

‘চৈত্র জমিদারের ছোট ছেলে এসেছে তোর সাথে দেখা করতে!’
ভ্রু কুঁচকায় চৈত্রিকা। হঠাৎ ছোট ছেলে কেনো? মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তা ভাবনা নিয়েই সনিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তুমি যাও মামি! আমরা আসছি।’

সনিয়া বেগম মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। সাথীর হাত ধরে চৈত্রিকা বাড়ির ভেতরে আসে। সেখানেই চেয়ার পেতে বসে আছে চিত্র আর অর্পিতা। চিত্র চৈত্রিকা আর সাথীকে একসাথে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তবে চৈত্রিকার চোখ ধাঁধানো রুপে সে নিজ মনেই ভেবে নেয় হয়তো এটাই তার হবু ভাবীজান। সে শুনেছিলো অর্থির কাছে। তাদের হবু ভাবীজানের নাম চৈত্রিকা আর সে বেশ রূপবতী। চিত্র চৈত্রিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বললো,

‘ভাবীজান এতো ছোট! ভাইজান কি পাগল হলো নাকি! এই মেয়ে তো বয়সে আমার চেয়েও ছোট। এই মেয়েকে কেমন করে বড় ভাইজান বিয়ে করে!’
চিত্র বেশ অবাকই হয়। প্রহরের প্রথম বিয়ের সময় তার বয়স ছিলো ২৬। আর মহুয়ার বয়স ছিলো ২২। দুই বছরের সংসারের পর হুট করেই মা’রা যায় মহুয়া। এখন প্রহরের বয়স ২৮। পিয়াসের বয়স ২৫। প্রহরের বিয়ের এক বছরের মধ্যেই সে বিয়ে করে ফেলেছিলো তাই তার আর প্রহরের বিয়ের সময়কালটার তেমন একটা পার্থক্য নেই। এমনিতে তাদের বয়সের পার্থক্যও খুবই কম।

চিত্রর বয়স ২১, অর্থির ১৫, অর্পিতার ১৯ চলছে। অর্পিতাও বেশ অবাক হয়েছে চৈত্রিকা আর সাথীকে দেখে। সে বোঝেনি কে আসলে হবু বউ তবে দুজনের বয়সই তো একই মনে হয়েছে তার কাছে। তার মানে প্রহর ভাইজান এই ছোট মেয়েকে বিয়ে করবে! চিত্রর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘চিত্র ভাই! এই দুজনেরই তো বয়স কম। ষোলো বা সতেরো হবে! প্রহর ভাইজানের চেয়ে অন্তত ১১/১২ বছরের ছোট তো হবেই। এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করছে কেনো প্রহর ভাইজান?’

চিত্র চোখ মুখ গম্ভীর করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অর্পিতার দিকে। ততক্ষণে চৈত্রিকা আর সাথী কাছে এসে দাঁড়ায়। চৈত্রিকা বেশ নরম স্বরে সালাম দিয়ে বলে,
‘ডেকেছিলেন?’

চৈত্রিকা পর্ব ৫

চিত্র গলা পরিষ্কার করে হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘জ্বি! আসলে বড় ভাইয়ের সাথে কাল আপনার বিয়ে তো তাই ভাবলাম ভাবীজানকে দেখে আসি। আপনিই চৈত্রিকা?’
চৈত্রিকা মাথা নাড়ায়। অর্পিতা হা করে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার দিকে। মেয়েটা সুন্দরী। মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী। এজন্যই কি প্রহর ভাইজান এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে নাকি অন্য কোনো কারণ আছে এর পেছনে!

চৈত্রিকা পর্ব ৭