প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১০

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১০
তানজিলা খাতুন তানু

অতসীর একটা টিউশনি চলে যাওয়াতে একটু সমস্যার মধ্যে যেতে হচ্ছে। তিনটে টিউশনি পড়িয়ে যে টাকাটা পেত, সেটা দিয়ে ওর জীবন মোটামুটি ভাবে চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু এখন কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, সবকিছু হিসাব করে চলতে হচ্ছে। হতাশ হয়ে রিককে টিউশনি পড়াতে গেল। মেজাজটা এমনিতেই অনেকটা খারাপ ছিল, তার উপরে রিক অঙ্কে ভুল করছিল, তাতে অতসীর মেজাজটা আরো খানিকটা খারাপ হয়ে গেল।

– এসব কি হচ্ছে রিক। এইরকম করলে পড়াশোনা করতে হবে না,পড়াশোনা কোনো ছেলেখেলা নয়।
অতসীর কাছে বকুনি খেয়ে রিকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। অতসী আগে কখনো এইরকম করেনি, ভুল হলে বুঝিয়ে বলেছে, ঠিক করে দিয়েছে। অতসীর এইরকম ব্যবহারে রিক প্রচন্ড কষ্ট পেল। রিকের মা অতসীর রাগান্বিত কন্ঠ শুনে ঘরের ভেতরে আসলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– রিক তোমাকে আজকে আর পড়তে হবে না,তুমি বাইরে যাও। তোমার ম্যামের সাথে আমার কিছু কথা আছে।
মায়ের আদেশ শুনে রিক অতসীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নীচু করে চলে গেল। অতসীর মেজাজটা এখনো প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। রিকের মা অতসীর সামনে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন, অতসী এক ঢোকে পানিটা শেষ করে হাঁপাতে লাগল।

– কি হয়েছে অতসী। তোমাকে আগে কখনো এইভাবে রিয়াক্ট করতে দেখিনি, কোনো সমস্যা?
– ভাবি তোমাকে তো বললাম, আমার একটা টিউশনি চলে গেছে। একটা টিউশনি চলে গেছে মানে, আমার অর্থে টান পড়ছে, আমার নিত্য দিন চালানো কষ্টকর হয়ে উঠছে। সবকিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলাম তাই রিকের উপরে একটু রিয়াক্ট করে ফেলেছি।

– আমি তোমার দিকটা বুঝতে পারছি না। আর তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।
– কি নিউজ।
– আমি একটা টিউশনের খোঁজ পেয়েছি। একটা মেয়েকে পড়াতে হবে। তুমি কি পড়াবে?
– হ্যাঁ। তুমি ঠিকানা বা ফোন নম্বরটা দাও।
– আজকে কি তোমার কোনো কাজ আছে?
– না।
– তাহলে আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি,তুমি গিয়ে দেখা করে আসো। যত তাড়াতাড়ি টিউশনিটা পাবে,ততই লাভ।
– হুমম।

রিকের মায়ের থেকে ঠিকানাটা নিয়ে অতসী বেড়িয়ে পড়ল। টিউশনিটা পেয়ে গেলে অতসীর খুব ভালো হতো। উপর ওয়ালাকে ডাকতে ডাকতে ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এতটাই সবকিছু নিয়ে চিন্তিত ছিল যে, ঠিকানাটা ভালো করে খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে হয়তো, যেত না।

বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থমকে গেল অতসী। বাড়িটা আর কারোর নয় আরোহীদের। অতসী মিতুকে নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছিল, আবার সেই বাড়িতেই যাবে। অতসী ফিরে যাবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু তারপরেই ভাবল টিউশনিটা খুব দরকার। এখন যদি নিজের জেদ দেখিয়ে না করে,তাহলে ক্ষতিটা ওরই হবে।
অতসী কলিং বেল বাজাতে মিতু এসে দরজা খুলে দিলো। অতসী কে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

– অতসী।
– হুমম। আরোহীর টিউশনি করাতে আমি রাজি।
– সত্যি।
– হুমম।
– আচ্ছা ভেতরে আসো তুমি। আরু শুনলে খুব খুশি হবে।
অতসী কে ভেতরে‌ বসিয়ে মিতু আরুকে ডেকে আনলো। আরু তো অতসী কে দেখে খুব খুশি হয়ে যায়,জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে।

– আন্টিকে পেয়ে মনিকে ভুলে যাচ্ছো কিন্তু আরু।
– না মনি আমি কাউকে ভুলিনি। আমি সবাইকে ভালোবাসি।
– তাই
– হুমম।
– আচ্ছা শোনো, তোমার অতসী আন্টি এবার থেকে তোমাকে টিউশনি পড়াবে। তুমি কিন্তু গুড গার্ল হয়ে পড়াশোনা করবে।

– আচ্ছা।
– মিষ্টিবুড়ি তুমি কি আজকে থেকেই পড়াশোনা করবে, না কালকে থেকে করবে।
– আজকেই করব।
– আচ্ছা।
মিতু অতসী আর আরুকে ঘরে নিয়ে গিয়ে,ওকে পড়াতে বলল। তারপর নিজে সোজা মায়ের ঘরে গেল।
– মা।
– হ্যাঁ মিতু মা বল।
– মা আমি অতসী কে আরুর টিউশন টিচার হিসেবে রেখেছি।
মিতুর মা একটু অবাক হলেন মেয়ের কথা শুনে।
– মা।
– হুমম। তোদের দুই ভাইবোনের উপরে আমার বিশ্বাস আছে। আমি তোদের কোনো সিদ্ধান্তকেই অস্বীকার করিনি। তবে যা করিস ভেবে চিন্তে করিস। মা ম*রা মেয়েটাকে একটা মা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোর দাদা তো রাজি হচ্ছে না কিছুতেই।
– হুমম।

বিষয়টা নিয়ে শুধু ওর্ মা নয় মিতুও চিন্তিত। মিতুর বিয়ে হয়ে যাবার পর যে আরু বড্ড একা হয়ে পড়বে। ওর দেখাশোনার জন্য তো একটা লোকের প্রয়োজন, মিতুর মা নিজে অসুস্থ কখন কি হবে কে জানে।
দিন নিজের গতিতে চলতে থাকে। অতসী প্রতিদিন আরুকে পড়াতে আসে, কলেজের পরীক্ষা হয়ে গেছে তাই আর কলেজ যায়নি। কয়েকদিন পর নতুন ক্লাসে এডমিশন,তারপরে আবার ক্লাস চালু হবে।
আদৃত এইসব কিছুর কিছু জানে না। একটা কাজে শহরের বাইরে গেছে, অতসীর আরুকে পড়ানোর বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানে না।

অতসী টিউশনি পড়াতে এসে ফেঁসে গেছে। মিতু আর আরু একটু মার্কেটে গেছে, বাড়িতে মিতুর মা একাই রয়েছেন। অতসীর সাথে উনি কথা বলছেন। তখনি কলিং বেলের শব্দ হলো।
– অতসী মা একটু দরজাটা খুলে দেবে। আমার হাঁটুতে সমস্যা উঠতে পারি না সহজে।
– আচ্ছা আন্টি।
অতসী উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে দেখল, আদৃত দাঁড়িয়ে আছে। আদৃত অতসীর দিকে একনজর তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। হঠাৎ করেই সবকিছুতে এই মেয়ের চলে আসাটা কিরকম একটা অদ্ভুত লাগছে আদৃতের কাছে।

– মা কেমন আছো।
আদৃতের কথা শুনে ওর মা মাথা তুলে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল…
– ঠিক আছি। তুই কেমন আছিস বাবা।
– ভালো। মিতু আর মিষ্টি কোথায়?
– একটু মার্কেটে গেছে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে,আমি তোর জন্য গরম কফি করছি।
– আচ্ছা।

আদৃত নিজের ঘরে চলে গেল। অতসী দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই খেয়াল করছিল। আদৃতের মা ছেলের জন্য কফি বানানোর জন্য সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু পা বাড়াতে পারলেন না। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছেন। অতসীর ভীষণ মায়া হলো।
– আন্টি আপনি বসুন। আমি কফি বানিয়ে দিচ্ছি।
– কিন্তু তুমি।
– আরে আন্টি আমি তো আপনার মেয়ের মতোই নাকি। এইটুকু করতে পারব না।

অতসীর কথার উপরে উনি আর কিছু বলতে পারলেন না। অতসী মিষ্টি করে হেসে ওনাকে সোফাতে বসিয়ে দিলেন।
– আর আপনি কি কিছু খাবেন।
– না মা। আদৃতের জন্য কিন্তু ব্ল্যাক কফি বানাবে।
– আচ্ছা।

অতসীকে উনি রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিলেন। অতসী রান্নাঘরে এসে দেখল, বাড়িটার মতোই রান্নাঘরটাও সুন্দর সাজানো,গোজানো। বোঝাই যাচ্ছে আদৃতের মা গোছানো প্রকৃতির মানুষ।
অতসীকে কফি করবার জন্য বেশি কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। সবটাই সামনেই ছিল, হয়তো আদৃতের মা ছেলের জন্য সবকিছু বের করেই রেখেছিলেন।

– একটা মানুষ ব্ল্যাক কফি কিভাবে খাই, তেঁতো।
ব্ল্যাক কফি খাবার কথা চিন্তা করে অতসীর মুখটা বি*কৃতি রুপ ধারণ করল। অতসী কফি বানিয়ে আদৃতের মায়ের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করল…
– আন্টি কফি।
– আর একটু কষ্ট করো মা। আদৃতের ঘর সোজা গিয়ে ডানদিকে। ওকে একটু দিয়ে আসো।
– আচ্ছা।

এতক্ষন সবটা হাসি মুখে করলেও এই কাজটাতে চরম বিরক্ত হলো অতসী। কারোর ঘরে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে, এই জিনিসটাতেই মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে অতসীর।
দরজার সামনে গিয়ে টোকা মারল। আদৃত সেইমাত্র ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। পরনে একটা ট্রাউজার, আর টি শার্ট, তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল…
– মা তুমি আবার কবে থেকে এত ফর্মাল মেনটেন করতে শুরু করলে।
অতসী হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বলল…

– আমি অতসী।
আদৃত একটু অবাক হলো। অতসীর হাতে কফির মগটা দেখে বলল..
– আপনি কফি নিয়ে আসলেন। মা কোথায়।
– আসলে আন্টির হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না।
– ওহ্। আপনি কফিটা ওইখানে রেখে দিন।
অতসী কফির মগটা রেখে দিয়ে বলল…
– একটা কথা বলবো।
– বলুন।

– আমি যতটা বুঝেছি, আপনাদের কোনো অভিব নেয়। যথেষ্ট সচ্ছল পরিবার। তাই বলছিলাম বাড়িতে যদি একটা সার্ভেন্ট রাখেন,তাহলে আন্টির একটু সুবিধা হয়।
অতসীর এইরকম কথা শুনে আদৃত ওর মুখের দিকে তাকাল। আদৃতের অদ্ভুত ভাবে তাকানোর কারনটা বুঝতে পেরে অতসী বলল…
– আসলে আন্টির হাঁটুর প্রবলেম। মিতুও বাড়িতে থাকে না সবসময়ে, সব কাজ আন্টিকেই করতে হয় তাই বলছিলাম। কিছু মনে করবেন না, আমি গেলাম।
অতসী কথাগুলো একদমে বলে দরজার দিকে চলে যায়। দরজার বাইরে বের হবার আগে একটু জোরেই বলল…

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৯

– আর একটা কথা, ওই কুখাদ্যটা কিভাবে খান আপনি?
কথাটা বলে উত্তরের আশা না করেই বেড়িয়ে গেল। আদৃত হা করে তাকিয়ে রইল ওর যাবার দিকে। শেষ কথাটার মানে বুঝতে পেরে আদৃতের ঠোঁটের কোনে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠল।
– অদ্ভুত মেয়ে তো।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১১