ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ২৪+২৫

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ২৪+২৫
মৌমি দত্ত

তাহজিব আর আসিফ নিজেদের গাড়িতে আর তারই পাশে স্পন্দন,, কামাল ও আফিম এক গাড়িতে। পিছনে তাহজিব ও স্পন্দনের গার্ডস মিলে মোট ১৪ টা জীপ আসছে। তারা শহরের শেষ মাথার দিকের পোড়াবাড়িটায় যাচ্ছে। যেখানে বর্তমানে রুহি আর ইনায়াত আছে। তাহজিব আড়চোখে একবার আফিমদের গাড়ির দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো,,
– এই ছেলের মধ্যে এমন কি আছে যে ইনায়াত তার হলো না??

পরমুহুর্তেই নিজেকে নিজে গালাগাল দিলো। ইনায়াতকে নিয়ে যে সে জেদ করছে তা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। নাহয় ইনায়াতের কথা বলে বিপদে রুহিকে নিয়ে আগে চিন্তা এলো কেন মাথায়?? আসিফ গাড়ি চালাতে চালাতে তাহজিবের এমন মুখ দেখে মনে মনে খুশীই হলো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো যেন আজকে সব ঠিক হয়। এরপর তাহজিব রুহিও যেন এক হয়।
স্পন্দনদের গাড়ি চালাচ্ছে কামাল। স্পন্দন আর আফিম ব্যাকসিটে বসা। আফিম একটুপর পর হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। আফিমের চোখ মারাত্মক রকমের লাল হয়ে গেছে। যেন এক্ষুনি ঝড়ঝড় করে রক্ত বইবে আফিমের চোখ থেকে।
পোড়াবাড়ি থেকে অনেকটা দূরেই গাড়ি পার্ক করে শেষবারের মতো প্ল্যান করে নিচ্ছে সবাই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইনায়াত মুর্তির মতো বসে ছিলো। তখনই দুটো গার্ড হঠাৎ রুমে এসে রুহিকে ধরলো। টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো বাইরে। রুহি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত পা ছুঁড়ছে,, চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ইনায়াতও গার্ডসদের থেকে রুহিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। লাভ হলো না কোন। রুহিকে বের করে কোথায় যেন নিয়ে গেলো গার্ডসগুলো। ইনায়াত রুহির জন্য দরজা থেকে বের হতে যাবে। তখনই রুমের সামনে হুইলচেয়ারে বসা ইরশাদকে দেখতে পেলো হাসিমুখে বসে থাকতে। রুহির বলা এক একটা কথা ইনায়াতের মাথায় আঘাত করছে। রুহি বলেছিলো ইনায়াতকে যে রুহিকে একসময় না একসময় আলাদা করে দেওয়া হবে। তাই ইনায়াতকে মোবাইলটা দিয়ে গেছিলো নিজের। ইরশাদ আর যাই হোক রুহিকে রুমে রাখবে না কথা বলবার সময় তা রুহির জানা। ইনায়াতকে রুহি বলে গেছে তখন,,

– আপি!! একসময় না একসময় ওরা আমাদের আলাদা করে দেবেই। কেননা ইরশাদ মির্জা ভালোই জানে আমাকে রেখে কথা বলা তোমার সাথে সম্ভব না ওর জন্য। তাই এই নাও আমার মোবাইল। গার্ডস আমার জন্য আসলেই তুমি মোবাইলটার পাওয়ার বাটনে তিনবার পরপর ক্লিক করবে। এতে করে তাহজিবের কাছে কল চলে যাবে মোবাইল থেকে আপনাআপনি। আর হ্যাঁ!! ইরশাদ মির্জার সবটা যে তুমি জেনে গেছো তা তাকে বুঝতে দেবে না। তাহজিবরা না এসে পৌছানো পর্যন্ত ইরশাদ মির্জাকে রাগানোর রিস্ক নেওয়া সম্ভব না। আর হ্যাঁ!! প্লিজ!! আমার কথা বিশ্বাস করে কাজগুলো করো। দেখে নিও ইরশাদ এসে তোমার সাথে একপর্যায়ে খুব আদুরি হয়ে কথা বলবে। আর ভালোবাসার দোহায়ও দেবে।
ইনায়াত হাত পিছনে নিয়ে জামার ভেতর থেকে মোবাইল বের করে তিনবার ক্লিক করলো দ্রুত। তাহজিবের কাছে আপনা আপনিই কল চলে গেলো। প্ল্যান নিয়ে কথা বলছিলো সবাই তখন। হঠাৎই তাহজিবের মোবাইল বেজে উঠায় তাহজিব ভ্রু কুঁচকে মোবাইল বের করে দেখলো রুহির নাম্বার থেকে কল। তাহজিব দ্রুত তা রিসিভ করে লাউডে দিলো।

– বাবা!! তুমি ঠিক আছো??
ইনায়াত ছুটে এসে ইরশাদের কাছে বসে বললো। রুহির কথা মতো কাজ করলেও ইরশাদকে দেখেই আবেগী হয়ে গেছে ইনায়াত। কি করবে সে?? মানুষটাকে যে সে বাবা বলেই ভালোবেসে আর চিনে এসেছে। ইরশাদ মুচকি হেসে বললো,,
– মেয়ের জন্য এটুকু আমার সয়ে যাবে। তুই ভালো আছিস তো মা??
– আমি কিভাবে ভালো থাকবো তোমাকে এভাবে দেখে?? কেন আমাকে সেদিন পালাতে বললে??
ইনায়াতের কান্না ন্যাকামো মনে হলো ইরশাদের। এখন সকাল ১১ টা। আজকে খুশী মনে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে সে। উঠার পর থেকেই উত্তেজনায় আর খুশীতে অস্থির অস্থির লাগছে তার। ভেবেছিলো এই রুমে আসার আগে,, এসে মাত্র দ্রুত মেয়েকে বলে পেপারসে সাইন করাবে। কিন্তু এখানে এই মেয়ে কান্না শুরু করেছে বলেই বিরক্ত ইরশাদ। বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললো,,

– উফফফ নাঁকি কান্না থামাও এবার কাজের কথা বলি।
ইনায়াত চমকে তাকালো ইরশাদের দিকে। ইরশাদ কি বলেছে তা শুনতে ভুল হয়নি ইনায়াতের। ইরশাদও বুঝলো সে কি ভুল বলে ফেলেছে। দ্রুত হেসে বললো,,
– তুই তো জানিসই মা!! তুই কাঁদলে আমার কতো মন পুড়ে। এবার কান্না থামা।
এই বলেই ইরশাদ নিজের হাত এগিয়ে ইনায়াতের চোখের জল মুছে দিলো। বেখেয়ালি ইনায়াত পাত্তা দিলো না। সে এখন খুব ভয়ে আছে। রুহির কথা সত্যি হয়ে যাবে বলে ভয়ে আছে ইনায়াত।
– বলছিলাম কি মা!! তুই তো তোর বাবাকে অনেক ভালোবাসিস। তাই না??
ইরশাদ মির্জা আদুরে গলায় গদগদ হয়ে প্রশ্ন করলো। ইনায়াত তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। রুহির কথা মিলে যাচ্ছে। সত্যিই ইরশাদ আদুরে স্বরে কথা বলছে আর ভালোবাসার দোহায় দিয়েই কথা শুরু করেছে। ইনায়াতের হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে অস্থির উত্তেজনায়।

– কি হলো?? চুপ করে আছিস কেন??
ইনায়াতকে আগে এই প্রশ্ন করলে ঝট করে উত্তর দিতো ইনায়াত। এখন দিচ্ছে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলো ইরশাদ।
– হুম বাবা!! অনেক ভালোবাসি।
ছলছল চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো ইনায়াত। ইরশাদ সাহেবের মুখে হাসি ফুঁটলো।
– ইনায়াত!! মা আমার,,, তাহলে আমি যা বলবো তাও নিশ্চয় তুই শুনবি। আর মেনে চলবি।
ইনায়াত অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো ইরশাদের দিকে। এর পরে ইরশাদ সাইনিং বা সম্পত্তি নিয়ে কথা বলবে তা নিয়ে দ্বিধা নেই ইনায়াতের। ইনায়াতের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনাজল। আর এদিকে ইনায়াত উত্তর দিচ্ছে না বলে অস্থির হয়ে আছে ইরশাদ।

ইনায়াত চোখের জল মুছে ইরশাদের চেয়ার ঠেলে বিছানার কাছে আনলো। তখনই কানে এলো রুহির গগনবিদারী চিৎকার। বুক কেঁপে উঠলো ইনায়াতের। রুহির সাথে কোন খারাপ কিছু ঘটছে না তো। ইনায়াত ইরশাদের হুইলচেয়ার খাটের কাছে আনলো। ইরশাদ বিরক্ত হয়ে বললো,,
– আজিব!! উত্তর না দিয়ে কি করছিস তুই??
ইনায়াত তাচ্ছিল্য ভরে বাঁকা হাসলো।
– সরি বাবা!! তোমার সন্তান হলেও একজন মেয়ে।
ইনায়াতের কথা ইরশাদ কিছুই বুঝলো না। ইনায়াত নীরবে বিছানার উপরে থাকা চাদরটা তুলে নিলো। ইরশাদ ভ্রু কুঁচকে ইনায়াতের কাজ দেখছে। ইনায়াত চাদরটা তুলেই লম্বা করে ধরে ইরশাদের পিছনে এলো।
– কি কর,,

পুরো কথা বলবার আগেই আচমকা ইয়া লম্বা চাদর দিয়ে ক্রমশ মুড়িয়ে যেতে লাগলো ইরশাদকে। হুইলচেয়ারের থেকে আলগা কিন্তু পুরো শরীর পেঁচানো অবস্থায় রয়ে গেলো ইরশাদ।একেবারে মমির মতো। ইনায়াতের আচমকা এমন কাজ সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। ইরশাদকে বিছানার চাদর দিয়ে বেঁধে ইনায়াত ইরশাদের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো জল ভরা চোখে।
– কেন বাবা?? কেন করলে এমন?? নিজের মেয়ের সাথে এমন শত্রুতা করতে কষ্ট হলো না তোমার?? সম্পত্তিই যদি চাইতে তাহলে বলে দিলেই পারতে। আমার তো তোমাকে দরকার ছিলো। কোন সম্পত্তির প্রয়োজন ছিলো না আমার।

ইনায়াত মুখ চেঁপে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো। ইরশাদ ছটফট করছে রীতিমতো। ইনায়াত কিছুক্ষন সেভাবেই কেঁদে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। রুহি বিপদে আছে মাথায় এলো তার। ইরশাদকে কোনমতে টেনে খাটের মাঝখানে ফেললো ইনায়াত খুব সাবধানে। নারী মনের এই একদোষ। হাজার আঘাত পেলেও সম্ভব হয় না ভালোবাসার মানুষটিকে আঘাত করা। ইনায়াত ইরশাদকে খাটের মাঝখানে রেখে হুইলচেয়ার ঠেলে ঘরের আরেক প্রান্তে পাঠিয়ে দিলো। খাটের আশেপাশের হালকাপাতলা সব আসবাব যেমন টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি থেকে শুরু করে সবটাই সড়িয়ে নিলো সাবধানে। বিষয়টা ইনায়াতের জন্য সিনেমা না। সে ইরশাদকে হুইলচেয়ারে বেঁধে চলে যাবে। ইরশাদ মোচড়ামুচড়ি করতে করতে কিছু একটা ফেলে দেবে যার বিকট আওয়াজে চলে আসবে গার্ডস আর ধরা পড়বে রুহি ও ইনায়াত। এমন নাটকীয় কিছু মোটেও আশা করছে না ইনায়াত। তাই এই আয়োজন। সবটা একবার দেখে নিয়ে ইরশাদের দিকে একবার করুন চোখে তাকালো ইনায়াত। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল। চোখ বন্ধ করে জোড়ে একটা শ্বাস নিয়ে দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে বাইরের অবস্থাটা দেখে নিলো। গার্ডস নেই আপাতত কোন। ইনায়াত দ্রুত জামার ভাঁজ থেকে ফোন বের করলো।

তাহজিব,, স্পন্দন,, আফিম,, কামাল ও আসিফ এতোক্ষন টান টান উত্তেজনা নিয়ে সবটা শুনছিলো। ইনায়াতের গলার স্বরে ” হ্যালো ” শুনে চমকালো সবাই।
– হ,,হ্যালো?? বোনু ঠিক আছিস তুই??
স্পন্দনের গলার আওয়াজ চিনতে কষ্ট হলো ইনায়াতের। অন্য স্বাভাবিক সময় হলে ইনায়াত চমকাতো। কিন্তু এখন নিজের বাবার এমন ক্রুর রূপ দেখে সব কেমন যেন স্বাভাবিক আর সম্ভব মনে হচ্ছে ইনায়াতের।
– স্পন্দন ভাইয়া!! বাপিকে আমি চাদর দিয়ে বেঁধে ফেলেছি। সাবধানে বেঁধে খাটের মাঝখানে রেখে দিয়েছি। হুইলচেয়ার ঘরের আরেক কোণায় রেখেছি যাতে পৌছাতে না পারে কোনভাবে চেয়ার পর্যন্ত। খাটের আশপাশের সব আসবাব সড়িয়ে ফেলেছি যা ধাক্কা খেয়ে পড়ে আওয়াজ করতে পারে। দরজা খুলে বাইরে চেক করেছি আমাকে যে রুমে রাখা হয়েছে সে রুমের বাইরে গার্ডস নেই। এখন আমি কি করবো?? এর মধ্যেই অলরেডি একবার রুহির চিৎকার শুনেছি। ও নিশ্চয় বড় কোন বিপদে আছে। আমি যাচ্ছি তোমরা দ্রুত এসো।

ইনায়াতের কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তিনজনেরই।
– না বোনু!! তুই যাস না। আমরা এখানেই আছি। আমরা আসছি।
স্পন্দন দ্রুত উত্তর দিলো। আফিমও একপ্রকার হুংকার দিয়ে বললো,,
– ইনায়াত!! ইটস মাই অর্ডার,, খবরদার সাহসিকতা দেখাতে যাবে না। তুমি রুমেই থাকো।
আফিমের গলা শুনে ইনায়াতের মনে ভরসার আলো ফুঁটলো। এর আগেও নিজের সত্যতা প্রকাশ পাওয়ার সময় এই মানুষটাকে ভরসা করে ঠকেনি সে। ইনায়াত উত্তরে কিছু বলতে যাবে তখনই তাহজিবের গলা শুনতে পেলো।
– চাঁদ,, আই বেগ অফ ইউ,, কিছু করো না। তোমাদেরকে আমরা সত্যিই বাঁচিয়ে নেবো। বিলিভ করো।
ইনায়াত “চাঁদ” সম্বোধন শুনেই বুঝলো তাহজিব খোদ নিজেও আছে। কিছু উত্তর দিবে বলে শ্বাস টেনে মুখ খুলবার আগেই কারোর পায়ের শব্দ শুনলো। দরজার কোণা থেকে দেখতে পেলো দুজন গার্ড এদিকেই আসতে আসতে কথা বলছে। এক গার্ড বলছে,,

– জন স্যারের তো আজকে মজাই মজা। খাসা দুইটা মাল পেয়েছে।
আরেকটি গার্ড বললো,,
– এর মধ্যেই একটা খাটে তো গেছে। আর এদিকে এতোক্ষনে এটারও নিশ্চয় দলিল সাইন করা হয়ে গেছে। তার জন্য এটাকেও নিতে পাঠালো।
আগের গার্ডটি বিচ্ছিরির হেসে বললো,,
– দুইটা হুর এক বিছানায়। উফফ!! স্যারের আজকে ভাগ্য খুলে গেলো।
– কাজ শেষে তো আমরাই দুটোকে রুম থেকে বাইরে আনবো। তখন নাহয় আমরাও চেখে দেখবো।
এটা বলেই দুই গার্ড হাসতে লাগলো ওখানেই দাঁড়িয়ে। ইনায়াত তো সবটা শুনলোই। তার সাথে ফোনের অপরপাশের পাঁচজন ও শুনলো। হঠাৎ সবার আগে কামালের খেয়াল হলো কল আর কানেক্টেড নেই। আতকে উঠলো কামাল।
– স্যার!! কল ডিসকানেক্টেড,,
কামালের এই ছোট্ট কথা যথেষ্ট ছিলো সবার মনের অবস্থা আরো খারাপ করে দিতে। আফিম দিশেহারা হয়ে গাড়ির টায়ারে জোড়ে লাথি লাগালো। স্পন্দন মাথার চুল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর রুহির কথা শুনে তাহজিব অস্ফুটে ” রুহি ” বলে চুপ হয়ে গেলো । শেষ রক্ষা কি তারা করতে পারলো না তবে???
কি হবে নেক্সট পার্টে?? আমি কি জানি ভাই?? জানতে হলে পড়তে হবে। সাথে থাকেন।

স্পন্দন,, তাহজিব ও আফিমের এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো আসিফ ও কামাল। আসিফ তাহজিবের পাশে গিয়ে বললো,,
– স্যার!! হুশ ফিরান নিজেদের। এখন ভেঙ্গে পড়বার সময় না
দ্রুত একশন নিতে হবে। দুজনেই বিপদে আছে কিন্তু।
তাহজিব মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বললো,,
– একদম নীরব। আগে ওদের গার্ডসদের ডাউন করতে হবে।
– জন এখন নিজের বিচ্ছিরি মনোভাব উপভোগ করবে বলে উত্তেজিত। তাই কোন স্টেপ ও নেবে না। নিতেই পারবে না। আর ইরশাদ এখন বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
আফিম বললো হালকা ভেবে। স্পন্দন তখন বলে উঠলো,,
– ওকে!!
গার্ডসদের নিয়ে পায়ে হেঁটেই এগিয়ে যেতে লাগলো পোড়াবাড়ির দিকে। আল্লাহকে ডাকছে সবাই। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে ইনায়াত ও রুহিকে।

ইনায়াতের হাতে এখন একটা মুর্তি আছে। জানলার পর্দা সে ইতোমধ্যেই খুলে নিয়েছে দুটো। গিট দিয়ে বেঁধে নিলো শক্ত করে একটার সাথে আরেকটা। এন্টিক দেখতে মুর্তিটা একটা খুবই ধারালো তলোয়ার ধরা। ইনায়াত ভেবে নিয়েছে সে কি করবে। এই জানোয়ার ধরনের মানুষগুলোকে যদি মারে তাহলে কোন গুনাহ হবে না তার। ইনায়াত ইচ্ছে করেই গার্ডস দুটোকে ভরকে দিয়ে দরজা খুলে দিলো লুকিয়ে থেকে। আপনা আপনি দরজা খুলে যেতে দেখেই বাইরের গার্ডস দুটো অবাক হলো। আরো অবাক হলো যখন অনেকটা সময় পর কেও বের হচ্ছে না দেখতে পেলো। গার্ডস দুটো ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলো অনেকটাই। খাটের মাঝখানে কাওকে বাঁধা অবস্থায় দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইনায়াত ঐ পর্দা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরলো দুজনের।

এরপর ঐ ভারী আসবাব দিয়ে দুটো করে আঘাত করলো গার্ডস গুলোর মাথায়। মূহুর্তেই পড়ে গেলো গার্ডস দুটো মাটিতে। ইনায়াত চেক করলো দ্রুত পালস আছে কিনা। বুঝলো পালস চলছে। ইনায়াত সেই পর্দার কাপড় দিয়েই বেঁধে দিলো দুজনকে। মেঝেতেই ফেলে রাখলো তাদের। একজনের মাথা থেকে রক্তপাত হচ্ছে। তা দেখে বুক কেঁপে উঠলো ইনায়াতের। বড় বড় ঢোক গিলে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো কোনভাবে। গার্ডসদের পকেট হাতড়ে দেখলো দুজনের কাছে দুটো বন্দুক আছে। ব্যবসায়িক শত্রুতা থাকার ভয়ে ইরশাদের কাছেও বন্দুক ছিলো। তাই বন্দুক সম্পর্কে মোটামুটি অনেকটা জ্ঞান আছে ইনায়াতের। একজনের বন্দুক সাইলেন্সার লাগানো। দুটো বন্দুকই নিয়ে নিলো ইনায়াত। তবে হাতে রাখলো সাইলেন্সার লাগানো বন্দুকটা। আরেকটা গুঁজে রাখলো ছোট্ট একটা কাপড় কনুইয়ের উপরে বেঁধে তাতে। বন্দুকটা নিয়েই বের হয়ে এলো দ্রুত রুম থেকে। এদিকটা খালি। ইনায়াত ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো করিডর ধরে।

তাহজিব,, স্পন্দন আর আফিম গান হাতে এগিয়ে যাচ্ছে পোড়াবাড়ির ভিতর। বাড়িটা দেখেই থমকে গেলো সবাই। এখানে মানুষ আসে তা অবিশ্বাসযোগ্য। তাহলে কি কোন ভুল হলো। স্পন্দন তখন অর্ডার দিলো,,
– পুরো জায়গা খুঁজে দেখো। সব জায়গা!!
গার্ডসরা খুঁজতে লাগলো। আফিম,, স্পন্দন আর তাহজিবও খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও কিছু পেলো না। তখনই বাড়ির একদম শেষের দিকে আফিমের চোখ পড়লো একটা ছোট্ট টেবিলে। মানুষজনের আসা যাওয়া নেই। তবে খুব দামী পরিষ্কার একটা খালি বোতল আছে মদের। আফিম ভ্রু কুঁচকে তা হাতে উঠিয়ে নিতে গিয়ে অবাক হলো। কেননা ওটা উঠাতে গেলেও পুরোটা উঠলো না আফিমের হাতে। কাঠের সাথে লেগে থাকা অবস্থাতেই খানিকটা উঠলো। এরপর কাছেই কোথাও বিপ বিপ করে দুবার আওয়াজ হয়ে বেসমেন্টের মতো একটা জায়গার দরজা খুলে গেলো যা এতোক্ষন খুব সাধারণ মেঝে মনে হচ্ছিলো সবার। স্পন্দনের মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। তাহজিব গার্ডসদের ইশারা করলো। সামনের দিকে তাহজিব,, স্পন্দন আর আফিম। এর পিছনে আসিফ ও কামাল। এরও পিছনে গার্ডস।

ইনায়াত করিডর দিয়ে হেঁটে আসতে না আসতেই দেখতে পেলো একটা সিড়ি বেয়ে নামছে স্পন্দন,, তাহজিব আর আফিম। ইনায়াতকে দেখেই তিনজন এগিয়ে এলো দ্রুত। স্পন্দন জড়িয়ে ধরলো আদরের বোনকে। ইনায়াতও জড়িয়ে ধরলো স্পন্দনকে। স্পন্দন ইনায়াতকে ছাড়তেই আফিম এগিয়ে এলো রাগী চোখে।
– হাতে এটা কি?? নিজেকে কি হাসিনা পার্কার ভেবেছো?? লেডি ডন হতে এসেছো?? নাহ?? ইউ আর ফায়ার্ড ইনায়াত। ইউ আর ফায়ার্ড।
আফিমের কথাগুলো শুনে মুচকি হাসলো ইনায়াত। আফিমের লাস্টের এই লাইনটা অনেকটা দীর্ঘ সময় শোনা হয়নি তার। তাহজিবকে দেখেই ঘাবড়ে গেলো ইনায়াত স্বভাববশত। খামচে ধরলো আফিমের কোটের হাতা। আফিম বিষয়টা বুঝতে পেরে জড়িয়ে ধরলো ইনায়াতকে। স্পন্দন রেগেমেগে তাকালো আফিমের দিকে। কিন্তু আফিমের সেদিকে খেয়াল নেই। তাহজিব বিষয়টা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে বললো,,,

– আমার রুহি কোথায় ইনায়াত??
ইনায়াত আস্তে করে ছেড়ে দিলো আফিমের কোটের হাতা। মনে পড়লো কিভাবে তাহজিব তাকে বাঁচাতেই সবার সাথে লড়েছিলো বলে বলেছে রুহি। ইনায়াতের মনে পড়ে গেলো ইরশাদের কথা। ইনায়াতের চোখে পানি জমলো। আফিম শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো ইনায়াতকে। ইনায়াত দ্রুত নিজেকে সামলে বললো,,
– আমি জানিনা। এই করিডোর ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। গার্ডস এখানে বেশি নেই বলে মনে হচ্ছে।
তাহজিব,, আফিম আর স্পন্দন এগিয়ে যেতে লাগলো করিডর ধরে। আসিফ আর কামালের পিছনে ইনায়াত। তাকে এখানে রেখে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরে তাকালো আফিম।

– ইনায়াত!! তুমি আসিফ আর কামালের সাথে এখানেই থাকো প্লিজ।
স্পন্দনও রাজি হলো এই কথায়। ইনায়াত শক্ত ভাবেই জবাব দিলো।
– না!! আমি যাবো। আর এটা নিয়ে কোন কথা না। কারণ আমি মানবো না স্যার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো সবাই। ইনায়াতও আসতে লাগলো। গার্ডস নেই ভেবেছিলো সবাই। কিন্তু বোকামি ছিলো তা। করিডরের এই প্রান্তে প্রতি এক হাত পরপর গার্ডস। তা জানা ছিলো না কারোর। স্পন্দনদের দেখে ভরকে যায় গার্ডস দুটো।
– শ্যুট!!

বলেই চিৎকার করে উঠে গার্ডস দুটো। উপস্থিত প্রায় ১২ জন গার্ডস একসাথে বন্দুক তাক করে এগিয়ে আসে। তাহজিব অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সামনের দরজা পেরোলেই তার রুহি আছে ঐ জনের সাথে। নাহয় এখানে এতোগুলো গার্ডস রাখতো না। তাহজিব হাত হালকা বাঁকিয়ে পিছনে নিয়ে ইশারা করলো আসিফ ও কামালের দিকে যাতে ওরা কেও শ্যুট না করে। ১২ জন গার্ডস এসে যেই ঘিরে ফেলেছে তখনই আচমকা পিছন থেকে এসে শ্যুট করে দিলো স্পন্দন্দের গার্ডসরা। আফিম,, তাহজিব আর স্পন্দন ইনায়াতকে নিয়ে বের হয়ে এলো দরজার কাছে। আসিফ আর কামাল ব্যাকআপ হিসেবে আসছে

তাদের সাথে খুব সাবধানে। ঐদিকে গোলাগুলি হচ্ছে বুঝতে কষ্ট হলো না তাদের। তাহজিব দ্রুত দৌড়ে গিয়ে দরজার লকে গুলি করলো ৩ টা। এরপর ঠেলে ঢুকে পড়লো রুমে। ভিতরে ঢুকে যা দেখলো তা দেখে কলিজা কেঁপে উঠলো তাহজিব সহ সকলের। খাটে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে রুহি। রুহির নাকে মুখে সব জায়গায় রক্ত। আর জন শোচনীয় অবস্থায় পড়ে আছে মাটিতে। ক্রমশ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তার পেটে আর হাঁটুতে গেঁথে আছে একটা করে কাঁটাচামচ। আরেক পায়ের পাতায় গেঁথে আছে নাইফ। আসিফ ও কামাল এগিয়ে গিয়ে বন্দুক তাক করলো জনের দিকে। তাহজিব এগিয়ে গেলো রুহির দিকে।

বুঝতে অসুবিধা হলো না যে রুহির আবার শরীর খারাপ করেছে। তাহজিব রুহির পাশে বসে পড়লো। রুহির জামাকাপড়ের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার সাথে প্রচুর জোড় জবরদস্তি করবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাহজিব রুহিকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে। মেয়েটাকে নিয়ে ডাক্তার এমনিও ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছে যেন দুই সপ্তাহের মাথায় হসপিটালাইজড করা হয়। আফিম ইনায়াতকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইনায়াত কান্না করছে। স্পন্দন এগিয়ে গেলো জনের দিকে। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়েছে জন।
– তাহলে এটা তোর কাজ জন??

জন ঘৃনা ভরা চোখে তাকালো স্পন্দনের দিকে।
– তোকে একমাত্র আমিই শেষ করবো এস.এ। তাই নিঃসন্দেহে এই কাজের সাহস শুধুই আমার।
স্পন্দন লাথি বসিয়ে দিলো জনের বুকে। জন পড়ে গেলো হঠাৎ লাথি খেয়ে মাটিতে। কঁকিয়ে উঠলো জনাথন।তাহজিব ততোক্ষনে রুহির জ্ঞান ফিরিয়েছে চোখে পানির ছিটা দিয়ে। বেডসাইড টেবিলে খাবারের ট্রে রাখা ছিলো। রুহি জ্ঞান ফিরতেই উঠে বসলো তাহজিবকে ধরে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তাকালো ইনায়াতের দিকে। ইনায়াত দ্রুত এলো রুহির কাছে।
– ঠিক আছো তুমি বোন??
রুহি হালকা মলিন হেসে বললো,,
– আমি ঠিক আছি আপি।
– জন তোমাকে স্পর্শ করেছে??
তাহজিবের শক্ত মুখ করে প্রশ্ন করা শুনে রুহি তাহজিবের দিকে তাকাতেই দেখলো,, তাহজিব রাগে বোম হয়ে তাকিয়ে আছে জনের দিকে। যে কিনা স্পন্দনের লাথি খেতে ব্যস্ত। রুহি তাহজিবের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। তাহজিব ফিরে তাকালো রুহির দিকে।

– উনি যাতে মারা না যায় এখন তাহজিব। তবে এমন অবস্থা করুন যেন মারা যাওয়ার আগে জাহান্নাম হয়ে যায় তার জীবন। মেয়েদের দিকে তাকানোর কথা দুঃস্বপ্ন মনে হবে ওর। এটা আমার একটা রিকুয়েস্ট ধরে নিন।
তাহজিব রুহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
– স্পন্দন,,, উনাকে আমার জন্য ছেড়ে দিন।
তাহজিবের গলার স্বর শুনে পিছু ফিরে তাকালো স্পন্দন। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে সড়ে এলো। রুহি আবারও মাথা চেপে ধরলো। তাহজিব অস্থির হয়ে পড়লো। আফিম বললো,,
– আমাদের এখন বের হওয়া উচিত। রুহির শরীর ভালো না। মাথায় আঘাত পেয়েছে হয়তো।
তাহজিব ততোক্ষনে রুহিকে নিয়ে বের হয়ে গেছে। আসিফ আফিমের কথা শুনে উত্তর দিলো।
– রুহি মাথায় আঘাত পায়নি। রুহির লিউকেমিয়া অর্থাৎ ব্লাড ক্যান্সার । আগামী ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে ওকে দ্রুত হাসপাতালে এডমিট করতে হবে। নাহয়,,,

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ২২+২৩

সবাই চমকে তাকালো আসিফের দিকে। আসিফ মলিন হেসে বের হয়ে এলো রুম থেকে। কিছু সেকেন্ড বাদে বের হয়ে এলো রুমে উপস্থিত সবাই।
জনের গার্ডসরা কেওই বেঁচে নেয়। স্পন্দন ও তাহজিবেরও কিছু গার্ডস ঘায়েল হয়েছে। স্পন্দন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললো কামালকে। আর সুস্থ কিছু গার্ডসদের বললো জন কে সড়িয়ে পুরো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে যেতে। ইনায়াতের বুক কেঁপে উঠলো।
– ভাইয়া!! আব্বু,,,
আফিম ইনায়াতের কথা আটকে বললো।

– তোমার আব্বুর ব্যবস্থা হচ্ছে।
স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই স্পন্দন কিছু গার্ডসদের বলে ইরশাদ মির্জাকে বাইরে আনলো। বাঁধা অবস্থাতেই তাকে গাড়ির ব্যাকসিটে ফেলা হলো। কামাল আহত গার্ডসদের নিয়ে গাড়িতে উঠলো। তাহজিব আর রুহিও গাড়িতে উঠলো। রুহি এর মধ্যেই আবারও সেন্স হারিয়ে ফেলেছে। সবাই এখন ফিরে যাবে।
ইনায়াত স্পন্দন ও ইরশাদের আসল পরিচয় পরের পর্বে জানবে। আফিম ইনায়াতের মিল এর পরের পর্ব থেকে হবে। রুহিও সুস্থ হবে। তাহজিব আর রুহিও মিলবে। সব হবে। কিন্তু……..

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ২৬+২৭