জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৫

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৫
ইফা আমহৃদ

“স্যার, তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে আরু হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। ছিলে গেছে অনেকটা, রক্ত-ও বের হচ্ছে। সেটাই দেখছিলাম।”

স্যার এগিয়ে এলেন। ‘সত্যি-মিথ্যা’ পরখ করতে এলেন বোধহয়। হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “টিচার্স রুমে গিয়ে ফাস্ট এইড বক্স চাইবে। কিছু বললে, বলবে আমি পাঠিয়েছি। সাইন্সের স্টুডেন্ট তোমরা, কীভাবে ড্রেসিং করতে হয় নিশ্চয় জানা আছে। দ্রুত যাও। ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি ধীর গলায় বললাম, “পরে করে নিবো।”
“যেতে বলেছি। এতদিন আসোনি, আজকে একটা ক্লাস মিস্ গেলে কিছু হবেনা। ফ্রেন্ডদের থেকে নোটস্ নিয়ে নিবো।”
আমি আর তুর স্যারের কথা মেনে অফিস রুমে গেলাম। তিনি এমনই, ‘এই নরম এই শক্ত‌।’ সবাই-কে প্রচণ্ড ভালোভাবে। ব্যান্ডেজ সেরে ক্লাসে এসে বসলাম। বাকি ক্লাসগুলো মন দিয়ে করলাম।

টিফিন সময় এলো। সবাই খাচ্ছে। তুর বাড়ি থেকে স্যান্ডুইছ এনেছে। আমি বসে আছি। কিছু নিয়ে আসিনি। টাকাও নেই যে কিনে খাবো। ক্ষুধা লেগেছে। তুর টিফিন বক্স এগিয়ে দিয়ে বলে, “আরু একটু খেয়ে নে, ভাই দেখবে না।”

“না-রে। আমি খাবো না। ভালো লাগছে না।”
“ভাইয়া-কে ভয় পাচ্ছিস?”
“না নিজেকে ভিতু ভাবছি।”
আমি ব্যাগের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিলাম। এখন থেকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।

মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। আমি হাই তুলে তাকালাম। এক নাগাড়ে এতক্ষণ চোখ বন্ধ থাকার ফলে ঘুমের রেশ ধরেছে। অপূর্ব ভাই-কে দেখে শান্ত মন অশান্ত হল। ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন রয়ে গেল একে অপরের থেকে। কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে সামনে রাখলেন।

উপরের ঢাকনা সরাতেই নুডুলস দেখতে পেলাম। চামচ দিয়ে একটু ‘হা’ করা রাখা মুখে তুলে দিলেন। হুঁশে ফিরলাম। চিবুতে চিবুতে আধো আধো স্বরে বললাম, “আপনি এখানে?”
“হ্যাঁ, তোর জন্য নুডুলস করে এনেছি। সবাই খাবে আর তুই বসে থাকবি। ব্যাপারটা ভালো দেখায় না।”
চমকে উঠে বললাম, “নুডুলস আপনি করেছেন?”

“হ্যাঁ, কেন?” সন্দিহান গলায়।
“আপনি খুব ভালো নুডুলস বানাতে পারেন, আমি পারিনা।”
অপূর্ব ভাই তুরের দিকে নুডুলস এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে, খেয়ে নে।”

তুর ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান গলায় বলে, “নুডুলস কি বউয়ের বান্ধুবীকে নিজে হাতে খাওয়াতে চাইছেন, না-কি বোন-কে?”
অপূর্ব ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে, “ইচ্ছে হলে নে, না-হলে চুপ করে থাক।”
তুর মুচকি হাসল। না, করল না। মুখে নিয়ে চিবুতে লাগল। আমি চামচ নিয়ে খেতে ব্যস্ত হলাম। খাওয়া প্রায় শেষের দেখি। অপূর্ব ভাই কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুই কি স্কুলে ভেতরে কোথাও হোঁচট খেয়ে পড়েছিলি? ব্যথা পেয়েছিস?”

মাথা তুলে দ্রুত তাকালাম। তিনি জানলেন কীভাবে? ক্লাসের ভেতরেই বলেছিলাম। তুর আমাকে উপেক্ষা করে নিজেই মুখ খুলে, “হ্যাঁ, শুকনো জায়গায় উবুত হয়ে পড়েছি। একটু দেখে শুনে হাঁটবে না, বলো?”

আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ওষ্ঠের তৈলাক্ততা মুছে নিলাম। তিনি বললেন, “বাই এনি চান্স, এটা কি তন্বি কাজ?”
মাত্রাতিরিক্ত এবার চমকালাম। ‘পড়ে গেছি’ তিনি জেনেছেন ঠিক আছে, কিন্তু ‘তন্বি-র কাজ’ সেটা জানলেন কীভাবে? কাঁচুমাচু মুখ করে বসে থাকলাম। অপূর্ব ভাই তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে দ্বিতীয়বার একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। নতজানু হয়ে বললাম, “জানি না।”

“জানো না, না-কি বাঁচাতে চাইছ? বুঝতে পারছ এই অবস্থায় হোঁচট খেলে কী হতে পারে?”
অপূর্ব ভাই আমার হাত ধরলেন। মৃদু স্বরে আর্তনাদ করলাম। হকচকিয়ে গেলেন তিনি। হাতের করতল মেলে পরখ করে বললেন, “লাল কেন? কীভাবে লাল হয়েছে?”

“ভাইয়া, স্যার মে’রে-ছে।”
“কেন?” সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন।
“স্কুল ড্রেসের জন্য। তুমি তো ওকে ও-বাড়ির ড্রেস পড়তে দিবে না আর স্কুল ড্রেস ছাড়া স্যার মা’রে।”

অপূর্ব ভাই আমার হাত শক্ত করে ধরলেন। ক্লাস থেকে বের হতে হতে আমাকেও তার পিছু পিছু যেতে বললেন। তিনি অফিস রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চোখের ইশারায় জানতে চাইলেন ‘কোন স্যার?’ আমিও চোখের ইশারায় স্যার-কে দেখিয়ে দিলাম।

অপূর্ব ভাই আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে গেলেন। স্যারের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। একটু পর হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমি গেলাম। নতজানু হয়ে পায়ে দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, “এই কথাটা আমাকে বলতে পারতে। শুধু শুধু তোমাকে মা’র-লাম।”

মনে-মনে ভাবলাম, কোন কথা? অপূর্ব ভাই আমার ভাবনার ফোড়ন দিয়ে বললেন, “আমি একটা অভিযোগ করতে চাই, ওদের ক্লাসমেট তন্বির নামে। আসার সময় তন্বি ওকে ফেলে দিয়েছে।”
স্যার হা হুতাশ করে বললেন, “ওরা তো খুব ভালো বন্ধু।”

“আগে ছিল, এখন নেই। আমি যখন ওদের ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলাম তখন কমন রুমে তন্বির সাথে দুই-তিন জন মেয়ে ছিল। ওরাই বলছিল, ‘পায়ের সাথে ল্যাং দিয়ে আরু-কে ফেলেছি। আরু দেখেছে কিন্তু কিছু বলেনি।’ আমার এখন ভয় করে ওকে এখানে রাখতে।”

স্যার গুরুত্বর ভঙ্গিতে ভাবলেন। অতঃপর অভয় দিয়ে বললেন, “আমি ব্যাপারটা দেখব। আপাতত তুমি ওকে বাড়িতে নিয়ে যাও। চাইলে তুর-কেও নিয়ে যেতে পারো। একজন-কে ছাড়া অন্যজন ক্লাস করতে চায় না।”

রোদ্দুর ঝিলমিল বিকেল। সূর্যের রশ্মি নরম হয়ে গেছে। তেজহীন আলো। আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যান্ডেজ পরখ করার পাশাপাশি গুনগুন করে গান গাইছি। শত চেষ্টা করার সত্বেও ঠিক ভিজে গেছে। সাদা ব্যান্ডেজ ময়লায় কালো হয়েছে‌। ভেজা চুলগুলো হাত খোঁপা করে রেখেছি অনেক কষ্টে।

তবুও চুল থেকে বিন্দু বিন্দু পানি ঝরে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তাতে‌ আমার ভাবাবেগ নেই। আমি আয়না-কে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত। পড়নে অপূর্ব ভাইয়ের এনে দেওয়া লং টপস্। পেছনে আছে চেন। ভেজা হাতে লাগানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু ব্যর্থ। কনুই ছুলে যাওয়ার কারণে পারছিনা।

তুর-কে ডাকব, তারও উপায় নেই। চিরুনিটা হাত থেকে খসে মেঝেতে পড়ল। আমি তুলতে ঝুঁকে গেলাম। দরজা নক করার শব্দ হল। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলাম। এই সময়েই আসতে হল। আমি চেন টেনে লাগানোর চেষ্টা করলাম। বাইরে থেকে বেশ কয়েকবার শব্দ শোনা গেল। অপূর্ব ভাই চিৎকার করে বললেন, “আমি কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব আরুর বাচ্চা। দ্রুত দরজা খোল বলছি।”

আমি হাত চালাতে চালাতে বললাম, “জাস্ট পাঁচ মিনিট অপূর্ব ভাই। এখনি খুলছি।”
“মামা বাড়ির আবদার না-কি? কালকে বললি, পাঁচ মিনিট সময় দিন এখুনি ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছি, এখন বলছিস পাঁচ মিনিট সময় দিন এখুনি দরজা খুলছিস। দুদিন পর বলবি, পাঁচ মিনিট সময় দিন, এখুনি বাচ্চা চলে আসবে। তাড়াতাড়ি দরজা খোল বলছি। না-হলে‌ কিন্তু ভেঙে ভেতরে ঢুকব।”

উপায়হীন হয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে উল্টো দিকে পা বাড়ালাম। ভেজা চুলের পানিগুলো একবার আমাকে ফাঁ’সিয়ে দিল। ধপাস করে পড়লাম পানিতে। কী ব্যথা! সবকিছু হয়েছে তার জন্য। মাথা একটু উঁচু করতেই অপূর্ব ভাই-কে পেলাম। খোলা চেনের কথা মনে পড়ল। অতিদ্রুত নিচ থেকে উঠে গেলাম।

দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পিঠ ঢাকা গেছে, এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। অপূর্ব ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে তখনই। চেন খোলা থাকার ফলে কাঁধের দিয়ে দৃশ্যমান অনেকটা। আমি উপরের দিকে টানতে লাগলাম। হাত খোঁপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিলাম। সামনে এনে নিজেকে ঠিক করলাম।

অপূর্ব ভাই ঠিক আমার দিকে চেয়ে নেই। আমার পাশের দিকে চেয়ে আছেন। আমি আড়চোখে তাকাতেই থমকে গেলাম। পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। পেছনে আয়না। আয়নাতে পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকাতে গিয়ে ভুলবশত আয়নাতে ঠেকিয়েছি। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। দুহাত দিয়ে আয়না ঢাকার চেষ্টা করলাম।

অপূর্ব ভাই তাকিয়ে দেখছেন আমার পা’গলা’মি। আমি সোজা হয়ে দুহাত দিয়ে আগলে দাঁড়ালাম। হুট করে একটা মাতাল কণ্ঠস্বর আমার টনক নাড়িয়ে দিল, “বাহ্ আরু, তোর পিঠের তিলটা একদম লালচে। দেখলেই চুমু খেতে ইচ্ছে করে।”

আয়নার ভেতর থেকে অপূর্ব ভাই-কে দেখতে থাকলাম। তার ভঙ্গিমা পূর্বের মতো। লজ্জায় আমার অবস্থা শোচনীয়। আমার পিঠের লালচে তিলটা এতদিন আমার নজরে ছিল। আজ অন্যকারো নজরেও চলে গেল। চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৪

আমি হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে কেঁদে দিলাম। অপূর্ব ভাই, কেন এসেছেন এখানে?
তিনি আবার বললেন, “এভাবে না কেঁদে, চেন লাগানোর চেষ্টা করলেই তো হয়।”

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৬