ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ১৯

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ১৯
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

তন্নির মুখোমুখি হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না তানিশার।যে বান্ধুবী নিজের মুখে বলে দেয় তুই আর কোনোদিন আমাদের বাসায় আসবি না, আর কখনোই আমাদের সাথে যোগাযোগ করবি না তাকে আসলে বান্ধুবী বলা যায় না।কিন্তু তানিশা সবসময় তন্নিকে তার বেস্ট ফ্রেন্ড ভেবেই এসেছে।তন্নির খুশির জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষ কে তার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।তানিশা কল্পনাই করে নি তন্নি এইভাবে তাদের বন্ধুত্বের মর্যাদা দেবে?

কিন্তু যাকে পাওয়ার জন্য তন্নি এতোকিছু করলো সে কোথায়?তানিশার আর তর সইছে না।নোমানের কথা জানার জন্য সে একদম ছটফট করতে লাগলো।একবার ভাবছে সে সামনে যাবে তো দুইবার পিছিয়ে যাচ্ছে তানিশা।
অনেক ভেবেচিন্তে তানিশা তার এসিস্ট্যান্ট কে বললো ৩০১ নাম্বার রুমের পেশেন্টেরর গার্ডিয়ান কে ডেকো আনো।এই বলে তানিশা তার চেম্বারে প্রবেশ করলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তানিশা অপেক্ষা করছে ইকবালের জন্য,কিন্তু ইকবালের পরিবর্তে মিসেস সায়রা বেগম মানে ইকবালের মা আসলো।
তানিশা ভাবলো এনার সাথেই কথা বলা যাক।শুরুতেই তানিশা জিজ্ঞেস করলো ছেলের বিয়ে কতবছর আগে হয়েছে?মিসেস সায়রা বেগম বললো এই তো দুইবছরের মতো হলো।
–দুইবছর?মাত্র দুইবছর?তানিশা একদম চমকে উঠলো।কারণ তন্নির বড় মেয়েররই তো বয়স পাঁঁচ বছর হতে চলেছে।এখন সে কিভাবে জিজ্ঞেস করে এটা বুঝতে পারছিলো না।তবুও সকল সংকোচ দূরে ঠেলে তানিশা জিজ্ঞেস করলো কিছু মনে না করলে পার্সোনাল একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?

–হ্যাঁ ম্যাডাম।বলুন।
তানিশা তখন বললো তখন চেম্বারে যে মেয়েটা এসেছিলো সে তাহলে কে?
মিসেস সায়রা বেগম কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন।তিনি হয়তো বলতে চাচ্ছেন না কিছু।তানিশাও আর জোর করতে পারছিলো না।
হঠাৎ সায়রা বেগম নিজেই বললো আসলে ম্যাডাম এটা খুবই পার্সোনাল কথা তো সেজন্য বলতে চাচ্ছিলাম না।এসব কথা আসলে বলা যায় না।তবুও আপনি যখন জিজ্ঞেস করছেন তাহলে বলেই ফেলি।ওই মেয়েটা হলো আমার ইকবালের প্রথম স্ত্রীর সন্তান।তারপর ওর স্ত্রী মারা গেলে এই মেয়েকে বিয়ে করে ইকবাল।
এবার তানিশার মাথা যেনো ৩৬০° কোনে ঘুরে গেলো।তার মনে এবার নতুন চিন্তার উদয় হলো।তন্নি জেনেবুঝে বিবাহিত ছেলেকে কেনো বিয়ে করলো?

তানিশা তখন সায়রা বেগমের সাথে ভাব জমানোর জন্য বললো, আপনার সাথে কথা বলে ভীষণ ভালো লাগলো।আপনি খুবই সহজ সরল একজন মানুষ।
মিসেস সায়রা বেগম সেই কথা শুনে হেসে উঠে বললেন,এই প্রথমবার কেউ এই কথা বললো ম্যাডাম।আমাকে তো সবাই ঝগড়ুটে মহিলা বলে ডাকে।আমার ছেলের বউ তো বলে আমি নাকি আস্ত একটা ডাইনি।জানেন ম্যাডাম!আমার না ওই আগের ছেলের বউ টাই ভালো ছিলো।এই মেয়ের সাথে আমার এক সেকেন্ড ও বনিবনা হয় না।আমার ছেলেটাও ওর হয়ে ঝগড়া করে আমার সাথে। মনে হয় তাবিজ করে বশ করেছে আমার ছেলেটাকে।আমিও কম যাই না।পুলিশ অফিসারের বউ আমি।আমার সাথে ওসব পাঙ্গা কিছুতেই চলবে না।

তানিশা যখন দেখলো সায়রা বেগম অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে তখন তানিশা ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললো আসলেই আপনি সহজ সরল একজন মানুষ।ওনারা কেউ আপনাকে চিনতে পারে নি।
তা আপনার ছেলের বউকে কিভাবে বিবাহিত একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিলো তার পরিবার?
সায়রা বেগম সেই কথা শোনামাত্র সাথে সাথে বললো,ওরও অন্য জায়গায় বিয়ে হইছিলো।বনিবনা হয় নি দেখে ডিভোর্স হয়েছে।ভালো হলে কি আর ডিভোর্স হয়?সেই দজ্জাল আমার সংসারে এসে পড়েছে।

তানিশা এবার আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলো না।তাহলে সত্যি সত্যি কি নোমানের সাথে তন্নির বিয়ে হয়েছিলো?আবার ডিভোর্স ও হয়ে গেছে?আসলে কি হয়েছিলো এদের ফ্যামিলিতে?তানিশা আর চেম্বারে বসে থাকতে পারলো না।তানিশা তখন সায়েরা বেগমকে বললো আপনি একটু বসুন আমি আসছি।
তানিশা সেই কথা বলে সরাসরি ৩০১ নাম্বার রুমে চলে গেলো।তানিশার পিছু পিছু তার সহকারী মহিলা এসিস্ট্যান্ট দুইটিও চললো।তানিশা তাদের কে আসা দেখে বললো,তোমরা আমার চেম্বারেই বসে থাকো।এই বলে তানিশা তন্নির রুমে প্রবেশ করলো।

কিন্তু রুমে গিয়ে দেখে বাচ্চা আর মা দুইজনই ঘুমিয়ে আছে।
ইকবাল তন্নির পাশে বসে আছে আর তার মাথার চুল বুলিয়ে দিচ্ছে।
তানিশাকে দেখামাত্র ধড়ফড় করে উঠে বসলো ইকবাল।আর বললো ম্যাডাম আপনি?কোনো প্রবলেম?
তানিশা তখন বললো না কোনো প্রবলেম নেই।আপনার স্ত্রীর খোঁজখবর নিতে আসলাম।
হঠাৎ তন্নি তানিশার কন্ঠ শুনে চোখ মেলে তাকালো।সে কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।সেজন্য হাত দিয়ে চোখ টা একটু ঘষে নিলো। তারপর যখন দেখলো সত্যি সত্যি তানিশা সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে একদম রাগে লাল হয়ে গেলো।আর তার মুখ লুকানোর চেষ্টা করতে লাগলো।তার ইচ্ছে করছিলো দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে।কিন্তু তার যে সিজার হয়েছে।দুই তিন দিনের আগে তো কিছুতেই বেড থেকে উঠতে পারবে না।আসলে সে কখনোই আর তানিশার মুখোমুখি হতে চায় নি।

দুইজন দুইজনার দিকে তাকিয়ে আছে বাট কেউ কোনো কথা বলছে না।দুইজনার চোখই জলে ছলছল করছে।একজন রাগে আর অন্যজন অভিমানে।
ইকবাল তখন তন্নিকে বললো,ইনি হলেন ডাক্তার ম্যাডাম।তোমার সিজার এই ম্যাডামই করেছেন।
তন্নি তখন হাসতে হাসতে বললো যার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, যার মুখ দেখবো না বলে শপথ করেছি সেই আমার সিজার করেছে।বাহঃ আল্লাহ,আর কত খেল দেখাবা?এই বলে তন্নি উপরের দিকে তাকালো।
তানিশা এবার এগিয়ে আসলো তন্নির বেডে।আর ইকবালকে বললো আপনি একটু বাহিরে যান প্লিজ।আমার পেশেন্টের সাথে একাকি ভাবে কিছু কথা আছে।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো,না ইকবাল কোথাও যাবে না।ও এই রুমেই থাকবে।আর আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।

ইকবাল সেই কথা শুনে তন্নির উপর রাগ হলো।সে তন্নিকে ধমক দিয়ে বললো, কি বলছো তন্নি?ডাক্তার ম্যাডাম হয় তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলবে।এই বলে ইকবাল নিজেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
তানিশা তখন তন্নির হাত ধরে বললো, তোর উপর আমি রাগ দেখাবো,কিন্তু উলটো তুই আমার উপর রাগ দেখাচ্ছিস?
তন্নি তখন তানিশার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো কারন শুধুমাত্র তোর জন্য আমার জীবনটা এমন ওলট-পালট হয়েছে।তুই আমার জীবনে না আসলে কখনোই এমন হতো না আমার জীবন।তুই আমার জীবনের একমাত্র অভিশাপ।জানিনা আমার মেয়েটার কপালে এখন কি হবে?এই বলে তন্নি তার মেয়ের মাথায় হাত রাখলো।

তানিশা তন্নির কথাগুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না।তবুও তার রাগ আর অভিমান চেপে রেখে বললো,
নোমান কোথায়?নোমানের সাথে কি তোর বিয়ে হইছিলো?
তন্নি কোনো উত্তর দিলো না।
তানিশা আবার জিজ্ঞেস করলো কি হলো?উত্তর দেস না কেনো?
–এর উত্তর জানি না আমি। প্লিজ তুই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা।আমি তোকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।

তানিশা তখন বললো, ছিঃ তন্নি!তুই এতো জঘন্য একটা মেয়ে!আসলে তোর সাথে কথা বলতে আসাটাই অন্যায় হয়েছে আমার।শুধু নোমানের জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে আসতে হলো আমাকে।আবারো বলছি নোমান কোথায়?
–বললাম তো জানি না।একদম চিৎকার করে উঠলো তন্নি।
তানিশা তখন বললো আস্তে কথা বল।ভুলে যাস না তুই সিজারের রোগী।এতো জোরে চিৎকার করলে সেলাই ফেঁটে যাবে।
তন্নি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো,যাক ফেটে।সেলাই ফেটে যেনো আমার মৃত্যু হয়। আমি আর এ জীবন কিছুতেই চাই না।ভালো লাগে না কিছু আমার।

তানিশা এবার শান্ত হয়ে বললো,তন্নি দেখ কারো কপাল কেউ দিতেও পারে না আর কারো কপাল কেউ নিতেও পারে না।যার ভাগ্যে যেটা লেখা আছে তার ভাগ্যে ঠিক সেটাই হবে।
তন্নি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি কি এমন করেছি যে আমার ভাগ্যে দুইটা স্বামী লেখা ছিলো?মানুষের সামনে ঠিক করে মুখ দেখাতে পারি না।বার বার ইচ্ছা করে নিজের জীবন টা শেষ করতে।কিন্তু আবার ফিরে আসি।কোনোভাবে বেঁচে আছি আমি।

তানিশা তখন বললো কি হয়েছিলো তন্নি?কেনো তোর দু দুইটা স্বামী হলো?
তন্নি তখন বললো, নোমান ভাইয়া আমাকে বিয়ে করে নি।কিন্তু তায়েব মামার চাপে পড়ে রাজি হয়েছিলো।শেষমেশ বিয়ের দিন তিনি বাসা থেকে পালিয়ে যান।এদিকে বাসাভরা লোকের সামনে মামার নাক কান কাটা যাবে ভেবে তিনি তার এক বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দেন আমার।আমি কিছুতেই রাজি ছিলাম না।আমি তো নোমান ভাইয়ার পালানোর কথা শুনে সেন্স হারিয়েছিলাম।পরে কোনোভাবে আমাকে ঠিক করে বিয়েতে রাজি করানো হয়।আমার মায়ের একটাই কথা তার ভাই যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই হবে।তা না হলে এ বাসায় নাকি আমরা থাকতে পারবো না।তুই তো জানিস আমাদের যাওয়ার কোনো রাস্তা নাই।একদম অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম আমরা।কথাগুলো বলতেই একদম ফুঁপিয়ে উঠলো তন্নি।

তানিশা তন্নির কথা শুনে বললো তারপর কি হয়েছিলো তন্নি?
–কি আর হবে?বিয়েটা হলো আমার।ছেলেটা একজন ব্যবসায়ী ছিলো।বাট আমার মন সেখানে কিছুতেই টিকছিলো না।ওরা অনেক বড়লোক ছিলো বাট তাদের মনমানসিকতা এতো নিচু ছিলো যে কথায় কথায় আমাকে অপমান করতো।কোনোরকমে কয়েক মাস যাওয়ার পর আর আমি সেখানে থাকতে পারছিলাম না।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো ছেলেটা নেশা করতো।

নেশার ঘোরে আমাকে মারধরও করতো।শেষমেশ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেই।কিন্তু মামার কথা ভেবে মা আর সেটা প্রকাশ করতে দেয় না।মা বলে তোর মামা শুনলে কিছুতেই এটা মানবেন না।কিন্তু আমি তো সেখানে থাকতে পারছিলাম না।শেষমেষ একা একা ডিভোর্স দিয়ে মামার বাসায় চলে যাই।কিছুদিন মামার অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে।পরে আবার ঠিক হয়ে গেছিলো মামা।কিন্তু মা প্রতিদিন এ নিয়ে গালিগালাজ করে।আমাকে মরে যেতে বলে।

আমি নাকি তার পরিবারের বোঝা হয়ে আছি।শেষে আমি আত্নহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।ভেবেছিলাম দূরে কোথাও গিয়ে মারা যাবো।কিন্তু পারলাম না মরতে।আমি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম।কিন্তু ইকবালের বাবা আমাকে উদ্ধার করে।তিনি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ট্রিটমেন্ট ও করেন।পরে তিনি আমার থেকে পরিচয় নিয়ে মামাকে খবর দেন।সবাই আমাকে এ অবস্থায় দেখে কান্নায় ভেংগে পড়ে।কিন্তু ইকবালের বাবা আর আমান ভাইয়া আবার একই অফিসে চাকরি করে।সেজন্য দুইজন দুইজনার সাথে বেশ ভালো পরিচয়।

তিনি যখন সবকিছু শুনলেন তখন তিনি ইকবালের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দেন।প্রথমে কেউ রাজি ছিলো না।কারণ ইকবালের পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে।আমি তো মানতেই পারছিলাম না।কিন্তু মামা অনেক ভেবেচিন্তে রাজি হয়ে যান।কারণ ইকবাল অনেক ভালো ছেলে।সেও পুলিশের চাকরি করে।তাছাড়া আমান ভাইয়া ইকবালকেও চেনে।তিনি আমাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করান।শুধুমাত্র আমান ভাইয়ার কথা শুনে নিজের রাগ অভিমান চেপে রেখে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় আমাকে।তাছাড়া আর কোনো উপাইও ছিলো না।

কারণ মা দিনরাত শুধু বকতো।মায়ের বকুনির চেয়ে বিয়ে করাটাই ভালো অপশন ছিলো।আমি এবার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যত কষ্টই হোক আর স্বামীকে ডিভোর্স দিবো না।হয় নিজের জীবন শেষ করবো তবুও আর মায়ের কাছে ফিরবো না।এতোটা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম আমি।একজন ডিভোর্সি মেয়েকে যে চারপাশ থেকে কত কথা শুনতে হয় তা আমার ডিভোর্স না হলে কখনোই বুঝতাম না।চারপাশের মানুষ জন না হয় বোঝে না,তারা সবকিছু জানে না।কিন্তু আত্নীয়স্বজন কি করে এই নিয়ে খোঁটা দেয় বলতে পারিস?

তন্নির কথাগুলো শুনে তানিশার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।এতোকিছু হয়ে গেছে তন্নির জীবনে?সত্যি সে ভাবতে পারছে না।তানিশা তো ভেবেছিলো তন্নি আর নোমান সুখে শান্তিতে সংসার করছে।সেজন্য তাদের আর কোনো খোঁজ নাই।কেউ একটিবারের জন্য তানিশার খোঁজ করে নি।এমনকি নোমানও না।
তানিশা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো তাহলে তোর নোমান ভাইয়া কই?

–জানি না আমরা।সেদিনের পর থেকে উনি আর বাসায় আসেন নি।তাছাড়া নোমান ভাইয়া ভালো করেই জানে মামা কিছুতেই ওনাকে আর বাসায় উঠতে দেবেন না।
তানিশা একদম অবাক হয়ে গেলো।কি বলছিস এসব?ওনার খোঁজ কেউই করে নি?
–আমি বলতে পারছি না তানিশা।আমার জীবনে একের পর এক দূর্ঘটনা শুরু হয়েছে।তার মধ্যে আমি ওনার কি খবর নেবো?
তানিশা তখন বললো, মামা একবারের জন্যও খোঁজ করেন নি?
তন্নি তখন বললো মামা হয় তো জানে নোমান ভাইয়া কোথায় আছেন।এজন্যই খোঁজখবর নেন নি।তা না হলে খুঁজে খুঁজে একদম হয়রান হয়ে যেতেন।তবে নোমান ভাইয়া একদিনও আর সামনে আসেন নি আমার।এমনকি বাসাতেও আসেন নি।

এদিকে মিসেস শিউলি বেগম অনবরত কল দিতেই আছে তানিশাকে।অপারেশন করার সময় ফোন সাইলেন্ট রেখেছিলো বিধায় চোখে পরে নি তানিশার।তানিশা তার ফোনের দিকে তাকাতেই দেখে অনেকগুলো মিসড কল। এতোগুলো কল দেখে সে সাথে সাথে তার মাকে ফোন দিলো।
কিন্তু তার মা রিসিভ করেই বললো,তোর কি রোগী দেখা শেষ হয় নাই?সারাদিন কি হাসপাতালেই পড়ে থাকবি?
তানিশা তার চোখ মুছে বললো,জ্বি হইছে মা।কিছুক্ষণের মধ্যেই যাচ্ছি।

মিসেস শিউলি বেগম সেই কথা শুনে বললো কিছুক্ষন পরে আসলে হবে না।এক্ষুনি আসতে হবে।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো,এতো তাড়া দিচ্ছো কেনো মা?আবার ঘটক সাহেব এসেছেন নাকি?আমি কিন্তু কোনো পাত্রপক্ষের সামনে যেতে পারবো না।
শিউলি বেগম সেই কথা শুনে বললো, স্বর্নারা এসেছে বাসায়।

–আপু এসেছে!কখন এসেছে?কিছুক্ষনের মধ্যেই যাচ্ছি আমি।এই বলে তানিশা কল কেটে দিলো।
স্বর্না হলো তানিশার একমাত্র ভাগনী।মানে তানিয়া আর সোহানের মেয়ে।
তানিশা এবার তন্নির আরো কাছে গিয়ে বসলো।আর তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো তন্নি যা হয়েছে সব ভুলে যা।এখন বর্তমানে যে অবস্থায় আছিস তার জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানা।কারণ এর থেকেও খারাপ অবস্থা হতে পারতো।ইকবাল কে দেখে অনেক ভালো ছেলে মনে হলো।তোর অনেক কেয়ার করে দেখলাম।।

তন্নি সেই কথা শুনে বললো,হ্যাঁ।ও অনেক ভালো ছেলে।কিন্তু ওর মা টা আবার সুবিধার লোক নয়।সারাদিন শুধু উল্টাপাল্টা কথা বলে।আমি নাকি খারাপ দেখে আমার প্রথম বিয়ে টেকে নি।কথায় কথায় শুধু সেই কথা বলে।
তানিশা তখন বললো,সব দিক দিয়ে আসলে সমান হয় না।ধৈর্য্য ধরে থাক তন্নি।দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
তন্নি তখন তার নিজের চোখ মুছিয়ে বললো তোর খবর কি?বিয়ে করেছিস?
তানিশা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,না।কাউকে পছন্দ হয় নি।

তন্নি সেই কথা শুনে বললো পছন্দ হবে কি করে?তুই তো মনে হয় এখনো নোমান ভাইয়ার অপেক্ষায় বসে আছিস।
–না,মোটেও না।আমি তো আর জানতাম না তোদের বিয়ে হয় নি।আসলে আমার কাউকে মনেই ধরে নি।মন থেকে সায় না দিলে কি করে বিয়ে করি?
তন্নি তখন বললো, সবার জীবনটা তোর জন্য এমন এলোমেলো হয়েছে।তুই যদি সেদিন নোমান ভাইয়াকে তোর ভালোবাসার কথা জানাতি তাহলে আজ আর এই দিনটা কাউকে দেখতে হতো না।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো,তুই আমাকে দোষারোপ করছিস?আমি কি ইচ্ছা করে এই কাজ টা করেছি? নোমানকে তোর জন্যই তো ছেড়ে দিয়েছিলাম।কারণ আমি জানতাম তুই ওকে প্রচন্ড ভালোবাসতিস।যদি আবার নোমানকে না পেয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করতিছ?

তন্নি তখন হাসতে হাসতে বললো,আমার জীবনে যা যা হয়েছে সব মনে হয় আমারই কর্মফল।আমি যদি সেদিন নিজে তোদের মিলিয়ে দিতাম তাহলে এই দিনটা কাউকে দেখতে হতো না।আমি শুধু আমার সুখের কথা চিন্তা করেছিলাম।শেষমেশ তোর মনটাও ভেংগে দিয়েছিলাম।কিন্তু ফলাফল হলো শূন্য।কেউই সুখী হতে পারলাম না।এই বলে তন্নি তানিশাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগলো।তানিশাও তন্নির কান্না দেখে মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু ভুলে গেলো।তার মনে জমে থাকা রাগ অভিমান দূরে ঠেলে দিয়ে সে উলটো তন্নিকে বোঝাতে লাগলো।

তবে তানিশার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে নোমান কোথায়?সে কেনো একটিবারের জন্যও তার খোঁজ করলো না।নোমান নিশ্চয় তার উপর ভীষণ মন খারাপ করেছে যার জন্য সে আর একদিনও তার সামনে আসে নি।
তানিশা ডাক্তার হওয়ার পর তার বাবা মা দাদীকে নিয়ে শহরে এসেছে।তারা সবাই মিলে এখন শহরেই থাকে।গ্রামে মাঝেমধ্যে তার বাবা মা গিয়ে ঘুরে আসে।মেয়ে ডাক্তার হওয়াই তহিদুল সাহেব আর মিসেস শিউলি বেগমের সম্মান যেনো বহুগুন বেড়ে গেছে।কেউ আর তাদের নাম ধরে ডাকে না।সবাই ডাক্তারের বাবা মা বলেই সম্বোধন করে।তানিশার অনেক ইচ্ছা সে গ্রামে একটা হাসপাতাল দিবে।বিনা টাকায় সবার চিকিৎসা করবে।

কিন্তু এরকম সামর্থ্য এখনো হই নি তার।মাত্র কিছুদিন হলো সে চাকরি টা পেয়েছে।এখনো তেমন পরিচিতি লাভ করে নি।তবে তার বিশ্বাস সে একদিন নাম করা গাইনিকোলজিষ্ট হবে।দেশে বিদেশে সে সুনাম অর্জন করবে।সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চললেও তানিশার বাবা মা একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।কারণ তারা এখন পর্যন্ত তানিশাকে ভালো কোনো ছেলের হাতে সমর্পণ করতে পারলো না।যেদিন তারা ভালো একটা ছেলের সাথে তানিশার বিয়ে দিতে পারবে সেই দিন তাদের মনোবাসনা পূরণ হবে।ডেইলি নতুন নতুন ঘর আসে তানিশার জন্য।

বাট তানিশার কোনো ছেলেই পছন্দ হয় না।সে যে বিয়ে করবে না সেটা কখনোই বলে নি।বাট যখনই কোনো সমন্ধ আসে সে পাত্র দেখার সাথে সাথে না করে দেয়।ডাইরেক্ট বলে দেয় তার পছন্দ হয় নি ছেলে।সেজন্য তানিশার বাবা মা ভীষণ চিন্তায় আছে।এদিকে তো বয়সও বাড়ছে তানিশার।যতই তানিশার যোগ্যতা থাক না কেনো বা সে নিজে ইনকাম করুক না কেনো তার তো একজন উপযুক্ত জীবন সঙ্গীর প্রয়োজন।একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর প্রয়োজন।যার হাত ধরে তানিশা তার বাকি জীবন টা পার করতে পারবে।সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।কারণ দিনশেষে সবারই একজন বন্ধুর মতো জীবনসঙ্গি প্রয়োজন।

তানিশা বাসায় প্রবেশ করতেই তার ভাগনি দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,খালামনি!এতো দেরি হলো কেনো?আমি সেই কখন এসেছি?
তানিশা স্বর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বললো,আম্মু আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম। এজন্য আসতে পারি নি।
তানিশা আসার সময় স্বর্ণার জন্য অনেকগুলো চকলেটের বক্স আর আইসক্রিম নিয়ে এসেছিলো।কারণ স্বর্ণা এসব খুবই পছন্দ করে।তানিশা নিজেও একসময় এসবের প্রতি আসক্ত ছিলো।বাট এখন আর তেমন আগ্রহ নেই এসবের প্রতি।

তানিশাকে দেখে তানিয়া আর সোহান ও এগিয়ে আসলো।আর সোহান এসেই বললো,তা ডাক্তার শালিকা কেমন পাত্র চাচ্ছো তুমি একবার একটু ক্লিয়ার করে বলবে আমায়?বিসিএস ক্যাডার,ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,পুলিশ,ব্যবসায়ী,
সরকারি চাকরিজীবী,কোনো পেশার ছেলেই তো বাদ রাখলাম না?
তানিশা তার দুলাভাই এর কথা শুনে মিটিমিটি করে হাসতে লাগলো।

তানিয়া তানিশাকে হাসা দেখে বললো,খবরদার হাসবি না।তোর দুলাভাই কিন্তু সিরিয়াস ভাবে বলছে কথাটা।তুই সত্যি করে একটা কথা বল তো?আদৌ কি বিয়ে করবি তুই?না সন্ন্যাসী হয়ে থাকবি সারাজীবন।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো আমি কখনো কি বলেছি যে আমি বিয়ে করবো না।বিয়ে অবশ্যই করবো।তবে ছেলেটাকে তো আমার মন মতো হতে হবে।ছেলে পছন্দ না হলে কি করে রাজি হই বলো তো?
তানিয়া তখন বললো,এবারের ছেলেটা নাকি খুবই নামকরা ডাক্তার।তুই যদি রাজি থাকিস তাহলে আসতে বলি ওদের।

–তোমাদের যা মন চায় করো।এই বলে তানিশা তার রুমে প্রবেশ করলো।তারপর হাতের ব্যাগ টা রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।তার এতই আলসেমি লাগছিলো যে ফ্রেশ না হয়েই আর গায়ের জামা চেন্স না করেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।আসলে তানিশার আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো।তার কিছুই ভালো লাগছিলো না।অনেকদিন পর চোখের সামনে আবার তার সেই পুরনো স্মৃতি ভেসে ওঠায় মন টা কেমন যেনো আনচান করছিলো তার।কেমন যেনো একটা অস্থিরতা কাজ করছে মনের ভিতরে।বিশেষ করে তন্নির জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো নিয়ে ভীষণ খারাপ লাগছে তার।যার সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিলো সে সেই তন্নি যে কিছুতেই তার সুখের নাগাল পেলো না।আসলে সৃষ্টিকর্তা না চাইলে জীবনেও কেউ সুখী হতে পারে না।

তানিশা কিছুক্ষনের জন্য চোখ দুটি বন্ধ করে থাকলো।কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বিন্দুমাত্র টের পাই নি সে।
হঠাৎ তানিশা কিছু একটা মেঝেতে পড়ার আওয়াজে থতমত করে উঠে বসলো।কিন্তু যখন তানিশা সামনের দিকে তাকালো তখন সে দেখলো তার ভাগ্নি এপ্রোন ওটি ড্রেস পড়ে আয়নাতে নিজেকে দেখছে।
স্বর্নাকে এই সাজে দেখে তানিশা চোখ ডলতে ডলতে বললো তুমি কি ডাক্তার হবা মামনি?এ ড্রেস পরেছো যে ?
–হ্যাঁ,খালামনি।

তানিশা সেই কথা শুনে বললো তাহলে অনেক পড়াশুনা করতে হবে তোমাকে। ডাক্তার হওয়া কিন্তু অনেক কঠিন।
স্বর্ণা সেই কথা শুনে বললো,খালামনি তুমি কিন্তু মিথ্যা কথা বলতেছো। ডাক্তার হওয়া তো অনেক সোজা। এই যে আমি এপ্রোন পড়েছি, আর ডাক্তার হয়ে গেছি।আর তুমি তো পড়াশোনা করো না,শুধু এপ্রোণ গায়ে দিয়ে বাসা থেকে চলে যাও।আর তাতেই সবাই তোমাকে ডাক্তার বলে ডাকে।তাহলে আমাকে কেনো পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে হবে?

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ১৮

তানিশা হাসতে হাসতে একদম শেষ হয়ে গেলো।তার হাসি আর কিছুতেই আটকাচ্ছে না।সে তখন তার বোন তানিয়াকে ডাকতে ডাকতে ডাইনিং রুমে চলে গেলো আর বলতে লাগলো এই আপু তোর মেয়ে তো অনেক পাকনা হয়ে গেছে।কি বলে শোন?
কিন্তু তানিশা ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখে বাসার সবাই নাস্তা রেডি করে করে টেবিলে রাখছে।
আসলে আজকেই তানিশাকে সেই ডাক্তার ছেলে দেখতে আসবে।সেইজন্যই তানিয়া আর সোহান আজ বাসায় এসেছে।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ২০