ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৩০

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৩০
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

তানিশাদের গেস্ট রুমে বিয়ে পড়ানো হবে।মুরুব্বি রা সবাই বসে আছে।নোমানকে সোহান অনেক আগেই নিয়ে এসেছে।বাট তানিশাকে একটু দেরিতেই আনছে তানিয়া।মেয়ে মানুষ তো সব জায়গাতেই অপেক্ষা করে রাখে সবাইকে।কিন্তু এদিকে তো নোমানের আর তর সইছে না।সে শুধু বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে।কিন্তু তানিশার আর দেখা মিলছে না।

অনেক অপেক্ষা করার পর অবশেষে ডাক্তার ম্যাডামের দেখা মিললো।তবে আজ আর সে শুধু ডাক্তার ম্যাডাম নয় সাথে তার অন্য আরেকটা পরিচয় তৈরি হচ্ছে।ডাক্তার নোমান চৌধুরীর ওয়াইফ মিসেস তানিশা চৌধুরী।তানিশা তো অনেক বেশি এক্সসাইটেড, তার সাথে সাথে নোমান আরো বেশি এক্সসাইটেড।কিন্তু এতো বেশি এক্সসাইটেড হয়ে কোনো লাভ হলো না নোমানের।কারণ তানিশা যত বড় একটা ঘোমটা দিয়ে এসেছে সবার সামনে যে তাকে চেনাই যাচ্ছে না।কিন্তু নোমানের ভীষণ ইচ্ছা ছিলো বিয়ের আগেই একটু যদি দেখতে পেতো তাকে।কিন্তু সেই আশা আর পূরন হলো না নোমানের।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে তায়েব চৌধুরী ভীষণ টেনশনের মধ্যে আছেন।কারণ বিয়ে টা না হওয়া পর্যন্ত তিনি টেনশন মুক্ত হবেন না কিছুতেই।ওদিকে আমানকে বাহিরে রাখা হয়েছে।যাতে আজ বাহিরের কেউ বাসার মধ্যে ঢুকতে না পারে।কিন্তু তানিশার ফ্যামিলির কেউ জানে না এটা।আমান,তায়েব চৌধুরী খুব বেশি চেষ্টা করছেন বিয়েটা হওয়ার জন্য।কারণ এই বিয়ের সাথে তাদের মানসম্মান জড়িত আছে।তাছাড়া তানিশাকে না বিয়ে করতে পারলে নোমান ভীষণ কষ্ট পাবে।বেচারা অনেক বেশি কষ্ট করেছে।সেজন্য নোমান আর কষ্ট পাক সেটা কেউই চায় না।বিশেষ করে আমান আর তায়েব চৌধুরী।

তানিশাকে নোমানের থেকে একটু দূরেই বসানো হলো।বিয়ের পর তাদের একসাথে বসানো হবে।প্রথমেই রেজিস্ট্রি করা হলো।নোমান আর তানিশার থেকে আলাদা আলাদা ভাবে সিগনেচার ও নেওয়া হলো।রেজিস্ট্রি শেষেই বিয়ে পড়ানো শুরু করলো কাজী সাহেব।যখনই বলা হলো এখন বিয়ে পড়ানো হবে তানিশা আর নোমানের মনের উত্তেজনা যেনো দ্বিগুন গতিতে বাড়তে লাগলো।তারা আর অপেক্ষা করতে পারছিলো না।বিশেষ করে নোমানের মনের অবস্থা বেশি খারাপ ছিলো।সে শুধু অপেক্ষা করছে কখন কাজি সাহেব তাকে কবুল বলতে বলবে।

অবশেষে নোমানের অপেক্ষার পালা যেনো শেষ হলো।কারণ কাজি সাহেব প্রথমেই নোমান কে বললো,বলো বাবা, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।নোমান এক সেকেন্ড দেরী না করে বলে ফেললো কবুল।কবুল বলার সাথে সাথে তার মনে যেনো এক শান্তি ফিরে এলো।সে তার অনুভূতি কিছুতেই বোঝাতে পারছে না কাউকে।

এবার কাজি সাহেব তানিশার কাছে চলে গেলো।এবং তানিশাকেও কবুল বলতে বললো।তানিশা কিছুক্ষন সময় নিলো।কারণ সে কবুল বলার আগে মনে মনে কিছু দোয়া পড়ে নিলো,আর আল্লাহ কে বললো,জীবনে সে অনেক কষ্ট করেছে।আর যেনো তার জীবনে এতো বেশি কষ্ট না আসে।বাকি জীবন টা যেনো সে নোমানের সাথেই কাটাতে পারে।কিন্তু নোমান চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলো।সে বুঝতে পারছে না যে তানিশা কবুল কেনো বলছে না।তারপর কাজী সাহেব আরেকবার যখন বললো,মা কবুল বলো।তানিশা এবার দিয়ে বললো আলহামদুলিল্লাহ কবুল।কবুল বলার সাথে সাথে তার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।সে বুঝতে পারলো না কিসের জল এটা?তবে জল টা যে খুশির এটা সে নিশ্চিত।তানিশার বিশ্বাসই হচ্ছে না আজ থেকে নোমানকে সে সারাজীবনের জন্য পেয়ে গেলো।নোমানের প্রতি আর কারো কোনো অধিকার নাই।নোমান শুধু তার হলো।

বিয়ে পড়ানো শেষ হলে নোমান আর তানিশার জন্য সবাই হাত তুলে দোয়া করলো।তারপর সবার মাঝে কিছু মিষ্টি বিতরণ করা হলো।
এবার তায়েব চৌধুরী আর তহিদুল সাহেব দুইজন দুইজনার সাথে কোলাকুলি করে নিলো।শেষ মেষ তায়েব চৌধুরীর মনের আশা টা পূরন হলো।যদিও তিনি তানিশাকে বাড়ির বড় বউ করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু তানিশা হলো বাড়ির ছোটো বউ।অন্যদিকে আমান বিয়ে পড়ানো শেষ হলে তবেই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।তার কাঁধ থেকেও কিছুটা দায়িত্ব হালকা হলো।কারণ নোমানকে যে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে মিলিয়ে দিতে পারছে এটা তার কাছে অনেক বড় পাওয়া।বড় ভাই হিসেবে এটা তার একটা দায়িত্ব ছিলো।তবে নোমান যদি সব সংকোচ দূরে ঠেলে আরো আগে বলতো কথা টা তাহলো এতোটা স্ট্রাগল করতে হতো না তাকে।

এদিকে তানিয়া একটা মিষ্টি নোমান কে খেতে বললো।কিন্তু নোমান মিষ্টি কিছুতেই পছন্দ করে না।তখন তানিয়া বললো,খেতেই হবে মিষ্টিটা।তবে পুরো টা না,অর্ধেক টা খাবে শুধু।আর বাকি অর্ধেক তানিশা খাবে।
নোমান সেই কথা শুনে বললো,কেনো?অর্ধেক খেতে হবে কেনো?মিষ্টি কি শেষ হয়ে গেছে নাকি?
তানিয়া তখন হাসতে হাসতে বললো, না,না।মিষ্টি কেনো শেষ হবে?আরো অনেক মিষ্টি আছে।এই মিষ্টি টা খাওয়ানো হয় যাতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার মিল মহব্বত বেশি হয়।

নোমান সেই কথা শুনে বললো,তাহলে শুধু একটা মিষ্টির অর্ধেক কেনো খাবো?আরো নিয়ে আসেন।
তানিয়া নোমানের কথা শুনে হাসতে হাসতে একদম শেষ হয়ে গেলো। এদিকে নোমানের কথাশুনে বাকি সবাইও হাসছে।সোহান তখন মিষ্টির একটা প্যাকেট ই নিয়ে এলো।আর বললো,শালা বাবু খাও।যে কয় টা মন চায় খাও।যে করেই হোক মহব্বত বাড়াতেই হবে।।বাট মনে রাখবা পুরাটা যেনো না খাও।অর্ধেক অর্ধেক করে খাবে।
সোহানের কথা শুনে নোমান আর তানিশা দুইজনই হেসে উঠলো।আজ তাদের মুখের এই হাসি যেনো প্রকৃত সুখের হাসি।যে হাসির কোনো সঙ্গা নেই তাদের কাছে।

নোমান জোর করেই ১০ টার মতো মিষ্টি খাওয়া শেষ করলো।যে ছেলে একটা মিষ্টি খায় না,সে আজ দশটা অর্ধেক মিষ্টি এক নিমিষেই খেয়ে ফেললো।এবার সোহান তানিশার কাছে নিয়ে গেলো মিষ্টির প্যাকেট টা।আর বললো,এবার তোমার পালা শালিকা।সবগুলোই খেতে হবে কিন্তু।তা না হলে কিন্তু মহব্বত বাড়বে না।তানিশা পড়ে গেলো ভয়ের মধ্যে এতোগুলো মিষ্টি সে কি করে খাবে?তবুও বিসমিল্লাহ নাম নিয়ে চোখ বন্ধ করে খেয়ে ফেললো।স্বামী স্ত্রীর মহব্বত বলে কথা!কে চায় না স্বামী স্ত্রীর মাঝে মহব্বত তৈরি হোক।যদিও এসব একটা প্রচলিত কথা তবুও অনেকেই বিশ্বাস করে।
এক এক করে রুম থেকে সবাই চলে গেলো।শুধু তানিয়া,স্বর্না আর সোহান থাকলো রুমে।এবার তানিশা আর নোমানকে পাশাপাশি বসানো হলো।এখন পর্যন্ত নোমান তানিশার মুখ দেখে নি।যদিও তার মুখ সে অনেকবার দেখেছে তবুও কেনো জানি আজ দেখার জন্য ভীষণ ছটফট করছে মনটা।

সোহান তখন বললো,শালিকা এবার একটু ওঠাও ঘোমটা টা।তোমার বরের আর যে সহ্য হচ্ছে না।নোমান সেই কথা শুনে বললো মোটেও না দুলাভাই।আমি এতো বেশি অধৈর্য্য নই।তাছাড়া আমি কি ওকে আগে দেখি নি নাকি?
সোহান তখন বললো এতোদিন দেখা আর আজকের দেখার মধ্যে অনেক তফাত শালাবাবু।এতোদিন দেখেছো তানিশাকে কিন্তু আজ দেখবে নিজের বউকে।
তানিশা তার দুলাভাই এর কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।দুলাভাই এসব কি বলছে?
সোহান তখন বললো, লজ্জা পাও না তানিশা।একটু দেখাও নোমানকে মুখটা।

এদিকে তানিয়া একটা আয়না নিয়ে এসে বললো,না,না।আগেই না।বর আর কনে দুইজন দুইজনকে আগে আয়নাতে দেখবে।সবাই চোখ বন্ধ করো।এই বলে তানিয়া আয়নাটা নোমান আর তানিশার সামনে ধরলো।আর তানিশাকে বললো এখন ঘোমটা টা ওঠা।তানিশার ভীষণ লজ্জা লাগছিলো।সামনে আবার তার দুলাভাই আর ভাগ্নিও দাঁড়িয়ে আছে।তানিয়া তখন বললো, এ তুমি যাও তো ওদের সামনে থেকে।স্বর্না তুমিও যাও।সোহান সেই কথা শুনে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।কিন্তু স্বর্না বললো,আমি যাবো না।আমি খালামনির কাছে থাকবো।তানিশা স্বর্নার কথা শুনে তার ঘোমটা টা উপরে তুলে বললো, মামনি আমার কাছে এসো।
তানিয়া তখন বললো, আগে নোমান দেখুক তোকে আয়নাতে।এই নোমান? দেখো আয়নার দিকে।আর বলো কাকে দেখা যায় আয়নাতে?

তানিশা আয়নার দিকে তাকাতেই নোমান তার চশমাটা খুলে তানিশাকে আগে একটা চোখ মারলো।তা দেখে তানিশা লজ্জায় মুখ টিপে ধরে হাসতে লাগলো।আর মনে মনে ভাবলো,কখনো বুঝতেই পারি নি এই অহংকারী ছেলেটা এতো দুষ্টু হবে।
তানিয়া তখন বললো,বলো কাকে দেখা যায়?
নোমান তখন বললো,আমার লজ্জাবতী অপ্সরাকে দেখতে পাচ্ছি।
তানিয়া তখন তানিশাকে বললো,তুই কি দেখতে পারছিস?

তানিশা তখন বললো,আমার হারানো ভালোবাসাকে দেখতে পাচ্ছি।এই বলে সে তার চোখের পানি মুছলো।
নোমান তানিশার কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আর বললো, এখানে কাঁদার কি হলো?আজ তো আমাদের খুশির দিন।
তানিয়া তখন বললো,অনেক সুখী হ বইন।জীবন টাতে শুধু দুঃখই পাইছিস।তবুও মুখ ফুটে কাউকে বলিস নি।আমাদের কে বুঝতেও দেস নি।আর আমরাও কিছু বুঝতে পারি নি।এই বলে তানিয়া তানিশা আর নোমানের হাত দুটি মিলিয়ে দিলো।আর নোমানকে বললো,ভাই বোনটাকে আমার দেখে রাখিও।কখনো তাকে কষ্ট দিও না।দোয়া করি ভালোবাসায় তোমাদের সংসার টা যেনো ভরে যায়।এই বলে তানিয়া কাঁদতে কাঁদতে স্বর্নাকে সাথে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

তানিয়া চলে যাওয়ার পর নোমান তানিশার কপালে একটা কিস করে তার হাতে হাত রেখে বললো, আজ তোমার শরীরে আবেদন আছে বিধায় এতো বেশি আকৃষ্ট হচ্ছি আমি।বার বার ভালোবাসার কথা বলছি,সারাজীবন একসাথে থাকার অঙ্গীকার ও দিচ্ছি।কিন্তু যখন তুমি বৃদ্ধা হবে,তোমার শরীরে কোনো আবেদন থাকবে না,তখন আরেকটি বার তোমার কপালে কিস করে হাতে হাত রেখে ঠিক এইভাবেই বলতে চাই খুব ভালোবাসি প্রিয়া।কারণ আমি বোঝাতে চাই,ভালোবাসা শরীরে থাকে না,ভালোবাসা থাকে মনের মাঝে লুকানো,খুব গোপনীয় ভাবে।

সৃষ্টিকর্তা যেনো সেই দিন দেখার জন্য আমাদের দুইজনকে একসাথে বাঁচিয়ে রাখে।
তানিশা নোমানের কথা শুনে আরো বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো।সে তখন নোমানকে জড়িয়ে ধরে বললো,যদি আমার কখনো সুযোগ মেলে,তাহলে আমিও আপনাকে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তীব্র রকম ভালোবেসে বুঝিয়ে দিতে চাই আপনার জীবনে আমার থাকাটা দরকার ছিলো,খুব বেশি দরকার ছিলো।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ২৯

নোমান সেই কথা শুনে তানিশার মুখ টি উপরে তুলে বললো,আজ থেকে তোমার মুখে আমি আপনি শুনতে চাই না।তুমি বলে ডাকবে আমাকে।কারন আমরা দুইজন আজ থেকে শুধু স্বামী স্ত্রীই নই,আজ থেকে একে অপরের সুখ দুঃখ শেয়ার করার ভাগিদার হলাম।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৩১