তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৬

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৬
সুরাইয়া আয়াত

মধ্যরাতে এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায় আসা। আজকাল যোগাযোগ ব্যাবস্থা উন্নত, আগেকার দিনের মতো নয়। সেদিন আর নেই, যখন এক দেশ থেকে অন্যদেশ যাওয়ার জন্য কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করা লাগতো, যাওয়ার ধাপগুলি ছিল ধীরগতি সম্পন্ন। এখন তো বেশি অর্থ ব্যায় করে এমারজেন্সি টিকিট কেটেও দ্রুত পৌছানো যায়। সময় পাল্টাচ্ছে আর পালটাচ্ছে যুগ। এখন আসল নকল মানুষ বোঝা মুশকিল। সবাই ভালো মানুষের মুখোশধারী।

রাত ১২.৩০ টা নাগাদ আয়াশ ও নূর পৌছালো কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে দাঁড়াতেই বোঝা গেল বৃষ্টির বহর। ঢাকা থেকে যখন প্লেন ছেড়েছিল তখন আকাশের অবস্থা ছিল স্বাভাবিক। এ বঙ্গে বর্ষা নামবে নামবে তারই আগাম পূর্বাভাস।
আয়াশ ছাতা হাতে ট্রলি নিয়ে দাঁড়ালো। একই ছাতার নীচে দুজন কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে, লাগেজগুলো ভিজছে। নূর ভাবলো আয়াশ হয়তো সবরকম পরিকল্পনা করেই এখানে এসেছে, কিন্তু সামনে সারি সারি হলুদ ট্যাক্সি গুলোর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নূর প্রশ্ন করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমাদের গাড়ি কোথায়? আসতে কি লেট করছে? ‘
আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘গাড়ি মানে? এখানে আমাদের গাড়ি কোথায় পাবো? আমি কি এখানে গাড়ি কিনে রেখেছি নাকি? ‘
নূর অবাক হলো, আহাম্মক মতো আয়াশের দিকে চেয়ে রইলো বেশ অনেকক্ষণ, এই লোক কি তার সাথে মজা করছে! ঘুরতে এসেছে আর কোনরূপ কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। দাঁত কিড়কিড় করে বলল,

‘ তাহলে এভাবেই কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো? ‘
আয়াশ নূরের দিকে এক পলক তাকিয়ে, নূরের হাতে ছাতা ধরিয়ে এক হাতে ট্রলি আর এক হাত দিয়ে নূরকে ধরে রাস্তা পার করার জন্য উদ্যত হলো, এখানে যা গাড়িঘোড়া তাতে পার করা মুশকিল। রাস্তা পার করে একটা হলুদ রঙের ট্যাক্সির সামনে গিয়ে বলল,

‘Holiday Inn Kolkata Airport, an IHG Hotel যাবো। কতক্ষণ লাগবে? ‘
ট্যক্সি ড্রাইভার আধা বাঙালি আর আধা হিন্দুস্থানী তা ওনার কথাতেই বোঝা গেল। উনি আধ বাঙলায় বলল,
‘রাস্তে মে আগার জ্যাম হে তো ৪০ কি ৪৫ মিনিট লাগ সাকতা হে। ওর নাহিতো ১৫ মিনিট লাগবে। ‘
ট্যাক্সিতে উঠে এসির ঠান্ডা বাতাসে শরীরের ভীজে ভাবটা ক্রমান্বয়ে এক শীতল অনুভূতি দিতে লাগলো।
আয়াশ ট্যাক্সি ড্রাইভার টার সাথে কথা বলছে। সে এখানে আসার পূর্বে এখান কার জায়গা গুলো সম্বন্ধে বেশ খোঁজ খবর নিয়েছে তা আয়াশ আর ড্রাইভারের কথার আদান প্রদানে বেশ বুঝতে পারছে নূর।

বৃষ্টিভেজা জানালা দিয়ে বাইরের দিক তাকিয়ে তাকিয়ে শহরটাকে দেখতে লাগলো নূর। এর আগে কখনো দেশের বাইরে যাওয়া হয়নি তার, ঢাকার বাইরে ঠিকভাবে কোন জায়গায় ঘুরেছে কি সে তাও বলতে পারে না।
গাড়ি রাস্তায় মাঝে মাঝেই বেশ অনেক ক্ষনের জন্য থামছে। এতো রাতেও এতো মানুষের আনাগোনা। ঢাকা শহরের জ্যামের মতোই এখানকার জ্যাম তবে শহরটা একটু বেশিই জাকজমকপূর্ণ আর আধুনিকতায় ঢাকা।
এসব সহ আরও হাজারো বিষয় নিয়ে কল্পনা জল্পনা করতে নিলেই ঘুমের ভারে চোখ দুটো ঢলে আসতে চাইলেই আয়াশের ডাকে তন্দ্রাভাবটা কাটিয়ে উঠলো সে।

গাড়িটা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, ছাতা না নিলেও চলে।
সাড়ে চার কিলোমিটারে দুটি লোকের ভাড়া ১৭২ টাকার কাছাকাছি, এখানে প্রতি কিলোমিটার হিসেবে টাকা ধরা হয়, প্রথম দুই কিলোমিটার এ ২৫ টাকা, পরের প্রতি কিলোমিটারের ১২ টাকা।
ট্যাক্সি ওয়ালার সাথে কিছুক্ষণের জন্য বেশ ভাব জমে গেছে আয়াশের। চলে যাওয়ার আগে উনি বলল,
‘ভাইসাব, কলকাত্তা মে আপনাকে স্বাগতম। ভালো থাকবেন। ‘

আয়াশ বিনিময়ে ওনার দিকে বিদায় জানিয়ে হাত উঁচু করলো, নিমেষেই জ্যামের ভিড়ে থাকা, শতশত ট্যাক্সির মাঝে সেই ট্যাক্সিও বিলীন হলো।
নূর ওড়নাটা শরীরে ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলো, ঠান্ডা লাগছে তার।
আয়াশকে অনুসরন করে গেল নূর। আয়াশের কথা শুনে বুঝতে পারলো আজ রাতের জন্যই ঘরটা ভাড়া নিয়েছে তারা। আয়াশ আগে থেকেই হোটেলের একটা রুম বুক করে রেখেছিল, এক রাতের রেন্ট ৫৭১২টাকা, যা বাংলাদেশি টাকায় ৭৫২৮ টাকা।

চার তালার একটা ঘরে এসে উঠলো তারা। রুমের এসির ঠান্ডা বাতাসে নূরের শরীর খানিকটা কাঁপতে লাগলো, বিছানার ওপর থেকে রিমোট নিয়ে আয়াশ টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিল।
ট্রলিটা এক সাইডে রেখে দিতেই নূর কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,
‘সত্যি করে বলবেন আপনার এখানে আসার উদ্দেশ্যে টা কি? ‘
আয়াশ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,

‘উদ্দেশ্যে আবার কি! ঘুরতে এসেছি, ঘোরা হয়ে গেলে ফিরে যাবো। ‘
‘তা এভাবে কেউ কোন পরিকল্পনা ছাড়া ঘুরতে আসে? আপনি একদিনের জন্য ঘর ভাড়া নিয়েছেন, এরপর কোথায় যাবো, কাদের কাছে যাবো সেসব কিছুই জানি না। কি করতে চাইছেন আপনি? ‘
‘আফুসোনা আমার ওপর কি তোমার বিশ্বাস নেই? ‘
‘না নেই। আপনি নিজেই একটা অশান্তি। ভালো লাগছে না আমার। এতো বড়ো শহরে মনে হচ্ছে আমি যেন কোথাও হারিয়ে যাবো। আমি বাসায় যাবো। ‘

‘উহুম, সবে এলাম। এখনও অনেক কিছুই যে বাকি, কত জায়গা ঘোরা বাকি, কতকিছু জানা বাকি, কত মানুষের সাথে পরিচয় বাকি। ‘
নূর আর কথা বাড়ালো না, চেন্জ করতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আয়াশ শার্ট টা খুলে কাচের বড়ো জানালাটার দিকে তাকালো, বাইরে তাকিয়ে শহরটাকে দেখছে। ঢাকা শহরের থেকে ভিন্ন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আয়াশ। তার এখানে আসার উদ্দেশ্যে যে অন্য কিছু, সেটা তো সে নূর কে কখনোই বুঝতে দেবে না।

বেশ অনেকক্ষণ পর নূর বেরিয়ে এলো, একটা প্লেটে খাবার রয়েছে অনেক। সেটা সোফার সামনে টেবিলের ওপর রাখা। আয়াশ খাবার সামনে রেখে ফোন চালাচ্ছে। নূরের পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে যেন। সে আর দেরি না করে খাবারের সামনে বসে খাবারে হাত দিতে গেলেই আয়াশ জিজ্ঞাসা করল,
‘আফুসোনা তুমি কখনো তোমার মা কে দেখেছো? ‘
কথাটা শোনা মাত্রই নূর হাত সরিয়ে নিল, আয়াশের কথার উত্তর যে তার কাছে আছে কিন্তু আয়াশ কি তা শোনার অধিকার এখনও অর্জন করেছে?

নিজ এর মনে নিজেই প্রশ্নটা করলো নূর, পরক্ষণেই নিজের অন্তদৃষ্টি জানান দিলো যে আয়াশ আর যাই হোক তার স্বামী। তার ওপর এখন যদি কারোর সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকে তা হলো আয়াশের, তবুও আয়াশ কখনো তাকে জোর করেনি, কাছে এসেছে তবে নিজেকে দূরেও সরিয়ে নিয়েছে তাই এ কথাটা শোনার অধিকার হয়তো এতদিনে তার জন্মেছে।
‘নাহ। আমার জন্মের সময় আমার মা মারা যান। বলতে পারেন যে আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মা মারা যান। তার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। ‘

কথাটা বলতে বলতে নূরের চোখ থেকে নোনাজল গড়াতে লাগলো অনবরত, চোখ ফেটে কান্না বার হয়ে আসতে চাইছে তার। তবে আয়াশের সামনে নিজেকে কখনোই সে নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করতে চাই না তবে পরিস্থিতি আজ ওকে দূর্বল করে দিয়েছে।
নূর উঠে যেতে চাইলেই আয়াশ তার হাত ধরে আটকালো, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,

‘জন্ম-মৃত্যু আর বিয়ে, এই তিনটে জিনিস কখনোই আমাদের হাতে থাকে না। তাই ওনার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দোষী করা আমার মনে হয় তোমার সবচেয়ে বড়ো বোকামো। ওনার হায়াত যতদিন ছিল ততদিন ই উনি এই পৃথিবীতে ছিলেন। তাতে তোমার কোন দোষ নেই। ‘
নূর আয়াশের দিকে চেয়ে রইলো, এটা কি তার অশান্তি নামের আয়াশ নাকি অন্য একজন। নূর ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘তবে আমার বাবা কেন আমাকে দোষী করেন তার জন্য বলতে পারেন! কেন মনে করেন আমার জন্য উনি আর এই পৃথিবীতে নেই? ‘

নূরের এমন প্রশ্নের উত্তর আয়াশের কাছে নেই। সে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘আচ্ছা যদি কখনো এমন হয় যে তুমি তোমার মা কে ফিরে পেলে, উনি তোমার সামনে, তোমাকে নূর বলে ডাকছে, দু হাত বাড়িয়ে তোমাকে আগলে নিতে চাইছে তখন কেমন লাগবে তোমার? ‘
নূর এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,

‘আপনি বড্ড বাজে লোক, কেন এতো ভালোবাসা পাওয়ার আশা দেখান! ‘
আয়াশ হেসে উঠলো, নূরকে খানিকটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
‘এই জন্যই না আমি তোমার অশান্তি।’
সে আয়াশের একটু বেশিই কাছে চলে গেছে, দূরত্ব বজায় রাখতে সরে এসে চোখ মুছলো, চলে যেতেই নিলেই আয়াশ হাত ধরে বসিয়ে খাবার মুখের সামনে ধরে বলল,

‘ হা করো। ‘
নূর খেতে না চাইলে বলল,
‘এখানকার খাবার কিন্তু এক্সপেন্সিভ আর তোমার হাসবেন্ড এর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বলে কিছু নেই, গরিব। তাই যা পাচ্ছো খেয়ে নাও, ধরো এমন হলো যে এরপর না খেয়ে থাকতে হলো। ‘

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৫

আয়াশ তাকে বাচ্চাদের মতো ছলে বলে খাওয়াতে চাইছে দেখে নূরের হাসি পেলেও সে হাসলো না, কথা না বাড়িয়ে নিজেই খেতে আরম্ভ করলো, আয়াশের দিকে আর তাকালো না। খাওয়া শেষে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।
আয়াশ তখনও আগের জায়গায়।
নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কথা দিলাম, তোমার সেই সব সুখ এনে দেবো যেগুলো থেকে তুমি বঞ্চিত ছিলে। ‘

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৭