তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৪

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৪
সুরাইয়া আয়াত

আজকে নূরের ভার্সিটি যাওয়ার কথা, এ বাসায় খুবই অল্পবিস্তর কাজ করতে হয় তাকে, বাকি কাজ রাইমা খালা সামলে নেন। উনি খুব সকাল সকাল আসেন আর সব কাজ গুছিয়ে চলে যান আবার সন্ধ্যায় এসে রাতের খাবার বানিয়ে চলে যান। আয়াশের বাবার দেখাশোনা উনিই করেন, এই কদিন আয়াশের বাবা বাসায় না থাকায় উনি দ্রুত কাজ সেরে বাড়ি ফিরে যান। রাইমা খালার স্বামী অসুস্থ। শরীরের বাম দিক প্যারালাইজড, তাই স্বাভাবিক বেতনের থেকে খানিকটা বেশি বেতন আয়াশ ওনাকে দেন।

আজকে সকাল সকাল আকাশের অবস্থা করুন। আকাশটা ঘন আবছা মেঘে ঢাকা। এখন আর বৃষ্টি হলে আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে যায় না, চারিদিক গুমসে থাকে আর মেঘেদের মন খারাপের আস্তরণ চারিদিকে ছেয়ে যায়।
অনেকক্ষণ আগে লোডশেডিং হয়েছে, ইনভার্টার থাকলেও তা চালাইনি নূর, কারন অন্ধকার থাকলেই তার কাজে সুবিধা। নূর আয়াশের মায়ের লেখা সেই চিঠিগুলো খুঁজছে, আগেরদিন যে জায়গায় চিঠিটা আর বাকি সব কাগজ গুলো ছিল আজ তা সেখানে নেই, আয়াশ কোনভাবে সেগুলো নূরের হাতের নাগাল থেকে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেন?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভার্সিটি যাবে বলে সকাল সকাল নূর রেডি হয়ে বসে আছে, আয়াশ তাকে দিয়ে আসবে কিন্তু এদিকে আয়াশ সেই সকালে কোথায় বেরিয়েছে তার ঠিক নেই।
আর এই সুযোগে নূর কাগজ গুলো খুঁজতে লেগেছে।
অন্ধকার ঘরকে সামান্য আলোকিত করে চিঠিগুলো খোঁজার জন্য নূর ফোনের ফ্ল্যাশ জালালো, ওয়াড্রব টা হাতড়েও কিছু খুঁজে পাইনি তবে একটা ড্রয়ার আছে টেবিলে, সেটা লক করা, তার চাবি খুঁজছে নূর।

খোঁজার মাঝে নূরের ফোনে ফোন এলো, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আরাফাত সাহেবের নাম দেখেই শরীরে এক তীব্র জ্বালা অনুভূত হলো, এক ঘৃনা মিশ্রিত জ্বালা।
নূর ফোনটা ধরলো না, আপনা আপনিই কেটে গেল, এভাবে বেশ কয়েকবার ফোন আসলেও সে ধরলো না, বাধ্য হয়ে ফোনটা এরোপ্লেন মোড অন করে নিজের কাজ চালালো।

নূর এদিক ওদিক খুঁজতে আচমকা কিছুর সাথে ধাক্কা খেল, খানিকটা টলমল হয়ে গেল তার শরীর, নিজেকে সামলে পিছন ঘুরে তাকিয়ে ফ্ল্যাশ জ্বালাতেই দেখলো আয়াশ। মুখের ওপর একঝাক ফ্ল্যাশের আলো পড়ায় চোখ দুটো কুঁচকে বন্ধ করে আছে সে। নূর দ্রুত ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে সরে যেতে নিলেই আয়াশ অন্ধকারেই তার হাত ধরে আটকালো তাকে, নূর খানিকটা ভয়ার্ত কন্ঠে ডেকে উঠল,

‘অশান্তি আপনি। ‘
অশান্তি ডাকটা শোনার পর আয়াশ তার হাত ধরে তাকে বুকের মাঝে টেনে নিল নিমেষেই। নূরের হৃদস্পন্দন বাড়লো, ফোনের ফ্ল্যাশটা এখনও জ্বলছে মেঝের দিক বরাবর।
এই প্রথম এমন হলো যে এতোটা দ্রুত তার হৃদস্পন্দন চলছে তাও আবার এই অশান্তির এতোটা কাছে আসার পর।
আয়াশ হীমশিতল কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

‘এতোটা অশান্তিতে তোমাকে ফেলে দিই আফুসোনা? হুম! ‘
কথাটা শোনার পর নূর আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না, আয়াশের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে বলল,
‘এতো কাছে আসবেন না। ‘
‘কেন? অধিকার নেই আমার। ‘

আচমকা আয়াশের এমন কথা শুনে নূর ঘাবড়ে গেল ভীষনরকম। আমতা আমতা করে বলল,
‘নাহ নেই। অধিকার নেই। আর এতো ভালোভাবে আমার সাথে কথা বলছেন কেন আপনি? আপনাকে এতো ভালো মানুষ হিসাবে মানায় না, কারন আপনি অশান্তি। আমার জীবনে আমি কোন অশান্তি কে চায় না। দূরে দূরে থাকুন। ‘

কথাটা বলে নূর জানালার পর্দা সরিয়ে দিল, আকাশে একরাশ মেঘ এর বহর, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি বিদ্যমান। আয়াশ আর লাইট জ্বালালো না, আর কিছু বললোও না। নূর ব্যালকনির ধার বরাবর গিয়ে দাঁড়ালো, একমনে মেঘ দেখছে সে। আকাশে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যস্থলে। আয়াশের ঘরের এই জায়গাটা নূরের প্রিয়।
আয়াশ নূরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, তা দেখে নূর চলে যেতে নিলেই আয়াশ তাকে আটকালো।

‘ চলে যাচ্ছো কেন? ‘
নূর রাগী রাগী ভাবে তাকালো,
‘আপনি আমার প্রিয় না হলেও আপনার ঘরের এই জায়গাটা আমার কাছে প্রিয়। ‘
কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই আয়াশ পিছন থেকে বলল,

‘আমার জন্য নিজের প্রিয় জায়গা ছেড়ে দিচ্ছ, কিন্তু চাইলেও আমাকে ছাড়তে পারবে না তুমি। ‘
নূর আজ আয়াশের এই আবেগপ্রবণ কথা আর মোহে অবাক হচ্ছে ভীষনরকম। এ যেন এক অন্য আয়াশ। কিন্তু আয়াশের এই ব্যাবহার গুলো যে খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী নয় তাই নূর বেশ ভালো ভাবেই জানে তাই সে আর আয়াশের সাথে নিজেকে জড়াতে চাই না, তাই আয়াশের থেকে এই দূরত্বই তার শ্রেয়।

বেশ কঠিন স্বরে নূরের জবাব এলো,
‘লেট হয়ে যাচ্ছে। ‘
‘আকাশের অবস্থা দেখেছো? ‘
এতটুকু কথায় নূরকে বোঝানোর জন্য যথেষ্ট যে আজকে তারা ভার্সিটি যাবে না।
নূর রাগ দেখিয়ে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

আয়াশ তা খেয়াল করে ব্যাগটা মেঝে থেকে তুলে সে নূরের সামনে গিয়ে মেঝেতে বসলো নূরের মাথার কাছে। সে যেতেই নূর অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো, আয়াশ তবুও সেখান থেকে সরলো না। আচমকা আয়াশ বলে উঠলো,
‘ আমার বাবার একটা ছোট্ট সংসার ছিল, যে সংসারের পরিবার ছিল, যেখানে ছিল আমার বাবা মা আর আমার বড়ো ভাই আর আমি।

তারপর সময় যেতে লাগলো বেশ। আমার বাবা একজন সায়েন্টিস্ট ছিলেন। নামকরা একজন। তার নাম যশ সবসময় তাকে উৎসাহিত করতো ভালো কিছু করার জন্য। উনি এমন এক উদ্ভাবনীয় কিছু আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন যাতে একটা মানুষের মস্তিষ্ক থেকে তার কোন খারাপ অথবা ভালো স্মৃতি যাতে চিরকালের জন্য মুছে যায় সেজন্য।
আমার বাবা প্রায়ই কাজে ব্যাস্ত থাকতেন, আমার মা আর বাবার সম্পর্কের মাঝের ভীতটা নষ্ট হয় এক তৃতীয় ব্যাক্তির টানাপোড়েনে। আমার বাবা প্রায়ই সন্দেহ করতেন আমার মা তৃতীয় ব্যাক্তির সাথে সম্পর্কে লিপ্ত। তারা দুইজন ছিলেন আলাদা ধর্মের। আমার মা ছিলেন ওপার বাংলার উচ্চবংশীয় মুখার্জী বংশের মেয়ে। ইন্দ্রাণী মুখার্জী।

দেশ ভাগের পর আমার মায়ের পরিবারের একাংশ বাংলাদেশ চলে আসেন আর কিছু মানুষ এখনও ওপার বাংলাতেই রয়েছেন। আমার মা খুবই উচ্চ বংশের মেয়ে ছিল, তাই সে সময় দাঁড়িয়ে শিক্ষার দিক থেকে পিছ পা হয়নি। পড়াশোনার পাশাপাশি আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, আমার মা খুব ভালো মাটির জিনিস বানাতেন আর তার ওপর কারুকার্য। তবে আমার বাবা মায়ের এই শখটাকে পূরন করতে দেননি কখনো। ‘
নূর খুব মনোযোগ দিয়ে আয়াশকে শুনতে লাগলো, আয়াশের চোখে মুখে এক অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করতে দেখলো নূর। হয়তো মা হারানোর।

আয়াশ পুনরায় বলল,
‘আমি জানি এসব রাইমা খালা তোমাকে বলেছেন। উনি অনেক বছর ধরে আমাদের বাসায় কাজ করেন, তাই জানেন অনেকটাই, যতোটা জানা দরকার। ‘
নূর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘নাহ, উনি এটা বলেননি যে আপনার মা ওপার বাংলার। ‘

‘উুম, বুঝলাম। আমার বাবা তারপর সন্দেহ করতেন আমার মা কে, যে উনি অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত আছেন। আমার বাবা কখনো মেনে নিতে পারেননি তা, তারপর থেকে শুরু হতে থাকে তাদের মাঝে ঝগড়া আর মনোমালিন্য। সন্দেহ টা শুরু হয় চিঠি থেকে, মায়ের কাছে অনবরত চিঠি আসতো এক ব্যাক্তির থেকে তা থেকেই সবটা শুরু হয়। ‘
আচমকা নূর বলে উঠলো,

‘আর সেই ব্যাক্তিটা কি আরাফাত নামের কোন একজন! ‘
আয়াশ মুচকি হাসলো, ‘চিঠি পড়েছো তাহলে? ‘
নূর সরাসরি জবাব দিল না। উত্তর দিল,
‘আর আপনি সেই চিঠি গুলো সরিয়ে রেখেছেন তাইতো? ‘
আয়াশও পাল্টা জবাব দিল,

‘আর এই অন্ধকারে তুমিই সেই চিঠিগুলো খু্জছিলে। কিন্তু খুঁজে পাওনি।’
নূর চুপ হয়ে গেল। আয়াশ তা কিভাবে জেনে গেল? তবুও আয়াশকে গুরত্ব না দিয়ে বলল,
‘আর সেই লোকটাকে কি আপনি চেনেন? ‘
‘কেন আরাফাত নাম শুনে নিজের বাবার কথা ভাবলে নাকি? ‘

কথাটা বলে আয়াশ হাসতে লাগলো, নিজের বাবাকে নিয়ে এমনটা সে না ভাবলেও শুনে খানিকটা খারাপ লাগলো তার।
নূর জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। খানিকটা নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আয়াশ বলল,
‘বউমা হয়ে শাশুড়ির পরকীয়ার গল্প না হয় না শুনলে। ‘

নূর মনে মনে ভাবতে লাগলো তার আয়াশকে জানানো উচিত যে তার বাবা কি করাতে চাইছেন তাকে দিয়ে, আর আয়াশের মুখ থেকে তার বাবার নামটা শোনার পর খানিকটা হলেও সন্দেহ জাগলো মনে, তবুও!

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৩

সে পাশ ফিরে আয়াশকে কিছু বলতে গেলেই দেখলো আয়াশ এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াশের এই দৃষ্টি উপেক্ষা করে নূর বলল,
‘আমাকে একটা সাহায্য করবেন? ‘

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৫