তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৭

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৭
সুরাইয়া আয়াত

সকাল নয়টার দিকে ব্রেকফাস্ট করে হোটেল থেকে বালিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিল ওরা। সাথে অনেক লাগেজ থাকায় ক্যাব বুক করে নিয়েছে, নতুবা ট্যাক্সি নিয়ে তার পর ট্রেনে ওঠা এই অচেনা জায়গায় খানিকটা হলেও প্যারাদায়ক।
ক্যাবে করে ঘন্টা খানিকের মতো সময় লাগবে যেতে। নূর এখনও যানে না সে কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে আর আয়াশকে একটি বারের জন্য জিজ্ঞাসা ও করেনি সে।

আয়াশ নূরের দিকে তাকালো, নূরের চেহারা উদাসীন, কোন বিষয়ে তার মন খারাপ। আয়াশ নূরের মনের অবস্থা বোঝার জন্য একটু কাশি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘এহেম। কলকাতা শহর ভালো লাগছে না? ‘
নূর আয়াশের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তেমনটা ভাবার কোন কারন? ‘
‘উমম, মনে হচ্ছে। ‘

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নূর পুনরায় আর উত্তর দিল না, আয়াশের কথাতে জবাব দেওয়ার মতো মনমানসিকতা এই মুহূর্তে তার নেই। নিজের মা কে সে কখনো দেখেনি, তার বাবার কথা যদি সত্যি হয় তবে সত্যিই হয়তো একটা সুযোগ ছিল তার কাছে তার মায়ের সাথে দেখা করার। এখন আয়াশের সাথে ঘুরতে এসে খানিকটা আফসোস জাগছে তার মনে, ভাবছে এতোটা সময় সে কাজে লাগিয়ে তার মা কে খুঁজে বার করতে পারতো। কালকে রাত থেকেই কথাগুলো ভাবছে সে।

তারা এখন দক্ষিণ কলকাতার দিকে যাচ্ছে। আয়াশ তার নিজের ফোন নিয়ে ব্যাস্ত। প্রায় এক ঘন্টা অতিক্রম করার পর ক্যাব থামলো। আয়াশ গাড়ি থেকে নেমে লাগেজগুলো নিয়ে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালো।
কলকাতা তে আসার পর সিম চেন্জ করেছে। ফোনটা বার করে কাকে যেন সে একটা ফোন করলো। নূর এক হাতে ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল চুপচাপ।

আয়াশ ফোনে কথা বলছে, সম্ভবত কেউ তাদেরকে নিতে আসছে।
কাল রাতে বৃষ্টির পর আজ সকালে আকাশ মেঘলা, আর হালকা রোদ, যা নিয়ে এক ভ্যাপসা গরম, কোন কসরত ছাড়াই শরীর তরতর করে ঘেমে চলছে। এক পশলা বৃষ্টিই পারে মেঘেদের এই বিষন্নতা কে কাটাতে।
আয়াশ নূরকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
‘চলো। খানিকটা হেটে যেতে হবে। ‘

নূর মাথা নাড়ালো। আয়াশের সাথে সাথে সে হেটে হেটে যাচ্ছে। এতক্ষণ রাস্তার ধারে ফ্ল্যাট বাড়ি দেখেছে, তবে এই রাস্তায় ঢোকার পর রাস্তার পটচিত্রটা খানিকটা ভিন্ন। আলাদা আলাদা সব বাড়ি, আর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তাদের বাড়ি গুলোকে দেখলে মনে হবে এক বাড়ির মালকিন অন্য বাড়ির মালকিনের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আসলে মিথ্যা তো নয়, এ শহরে প্রয়োজন ছাড়া প্রিয়জন নেই।

দুই তিন মিনিট ধরে হাটার পর নূরের প্রশ্ন আয়াশের কর্নগোচর হলো,
‘আপনি কি আপনার মামার বাড়িতে যাচ্ছেন? ‘
‘হুম।সেখানেই যাচ্ছি, নাহলে এই এতো বড়ো কলকাতা শহরে আমর আর কে আছে বলো।’
‘আপনি এর আগে কখনো এখানে এসেছেন? ‘
‘হুম এসেছি, তিনবছর আগে। তবে সেবার আর ঘুরতে আসিনি, বিশেষ দরকারে এসেছিলাম।’
‘আচ্ছা। ‘

তাদের এতটুকু কথোপকথনের মাঝে একজন বৃদ্ধ বছর সত্তরের লোক হাটতেহাটতে এসে বললেন,
‘আয়াশ দাদুভাই, তোমাকে অনেকদিন পর দেখছি। বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? ‘
‘হ্যাঁ বাড়ির সবাই ভালো আছে। বাবার একটু শরীরটা খারাপ তাই হসপিটালে রয়েছেন। ‘
উনি চমকে বললেন,
‘আহারে, ওনার কথা মাঝেমাঝেই ছোট মনির থেকে শুনি। ‘

বৃদ্ধ লোকটির পরনে সাদা ধুতি আর গায়ে সাদা গেঞ্জি, ওনার সাজপোশাকে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। তার ধুতির রঙ খানিকটা ময়লা। তাকে দেখে খানিকটা আন্দাজ করতে পারলো যে উনি হয়তো সে বাড়ির কাজ করেন। আর অনেক বছর ধরেই সে বাড়িতে রয়েছেন সে বাড়ির একজন হয়ে। নূর কেবল তাদের কথা শুনতে লাগলো। তাদের ভাষার টান ভিন্ন, শুদ্ধ বাঙলা ভাষা, আর তাদের ভাষায় খানিকটা টান আছে।
বৃদ্ধের চোখ নূরের দিকে একবার যেতেই তিনই বললেন,
‘ইনি কে? এনাকে তো চিনলাম না। ‘

আয়াশ গলা পরিষ্কার করে নূরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ইনি হলেন আমার কর্তী। ‘
বৃদ্ধ হেসে বললেন,
‘আরে সেটা বলবে না আগে, আমি তো বুঝতে পারিনি। ‘
ওনার কথার পরিবর্তে নূর কেবল হাসলো, বুঝে উঠতে পারলো না এই মুহূর্তে তার ঠিক কি বলা উচিত।
আর দুই মিনিট হেটেই ওরা এলো এক বিরাট আদি দোতলা বাড়ির সামনে, সামনে এক বড়ো গেট, লোহায় পুরানো দিনের ডিজাইন।

বৃদ্ধ গেট খুললো, বাইরে থেকে দেখেই বোঝা গেল এ বাড়ি কোলাহল পূর্ণ। নূর আয়াশের দিকে তাকিয়ে রইলো, আয়াশ সেই বাড়ির দিকে চেয়ে রয়েছে হয়তো তার মায়ের অস্তিত্ব কে অনুভব করার চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে।
বৃদ্ধ আগে আগে ঢুকে একপ্রকার চেচিঁয়ে বললে,
‘বড়ো বৌদি দেখো তোমার নাতি এসেছে। ‘

আয়াশ নূরের হাতটা ধরে বাড়ির ভিতরে গেল, বাড়িতে পুরানো দিনের কারুকার্য, নকশা। উঠানের একপাশে পূজোর তুলশিমঞ্চ সেখানে একজন পুরোহিত বসে পূজো করেছেন। নূর এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখছে। আয়াশ হাত ধরার পর থেকে তার মাঝের জড়তা খানিকটা কেটেছে।
আয়াশ আর নূর বাড়ির ভিতর পৌঁছাতেই একজন মধ্য বয়সী মহিলা আয়াশকে জড়িয়ে ধরলেন। আয়াশ তাদের আদরের, কিন্তু সে আদরে আয়াশ নিজেই ভাগ বসাতে চাই না। মহিলার মাথায় মোটা করে দেওয়া সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, হাতে শাখা, আর গায়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি।

ওনার কথা শুনে বুঝলেন উনি আয়াশের মায়ের মা।
নূর আয়াশের একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে,
‘দাদুভাই তোমাকে দেখে অনেক খুশি হয়েছি। কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। ‘
আয়াশ ও ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন। নূরকে দেখিয়ে বললেন,

‘আমার উনি।’
উনি উচ্ছাসিত হয়ে বললেন,
‘ওহ তাহলে এটাই আমার আদরের নাতবৌ। ‘
কথাটা বলে উনি নূরকে নিয়ে আল্হাদে ফেটে পড়লেন।

একদম অন্যরকম পরিবেশে আগে কখনো নূর এসে পড়েনি তাই প্রথমে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করলেও মানুষগুলো মিশুকে।
বাড়ির কমবেশি সকলের সাথেই পরিচিত হয়েছে নূর, তা থেকে যা জানতে পেরেছে তাতে বুঝলো
আয়াশের মা একা নন, ওনার একজন বোন আছেন, যিনি সেক্টর ফাইভের কোন এক সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আর একটা ভাই আছে যিনি কলেজের প্রফেসর, এবং ওনার ছেলে আছে যে তা বউ নিয়ে চাকরিসূত্রে দিল্লী থাকে, বছরে দুইবার কি তিনবার বাড়িতে আসার চেষ্টা করে, পূজোর সময় আর নতুন বছরের শুরুতে পরিবারের সাথে থাকার চেষ্টা করে।
এত অল্প সময়ের মধ্যে এতটুকু নূর সাধ্যের মধ্যে জানতে পেরেছে।

বাড়িটা আকারে বৃহৎ তবে বাড়িতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কম।
নূরের আর আয়াশকে থাকতে দিলো দোতলার একটা বড়ো ঘরে। ঘরের আসবাবপত্র গুলো দেখলেই বোঝা যায় তা অনেক পুরোনো দিনের শাল কাঠের তৈরি।
বিছানায় বসে আছে নূর, বাইরের উঠান থেকে শঙ্খধ্বনি আর উলুর শব্দ কানে আসছে। এখনও পূজো হচ্ছে।
এটা একটা ব্রাহ্মণ বাড়ি, যিনি পূজো করছেন উনি আয়াশের দাদু।

নূর বিছানায় বসে আছে আর বাইরের দিকে দেখছে। বাড়িটা ভীষনরকম ভাবে পরিপাটি।
তবে আজ রবিবার, তাই সকলের আজ তাদের কর্মজীবন থেকে ছুটি, আজ সকলেই বাড়িতে।
নীচে খুব তোড়জোড় করে রান্না চলছে যার ঘ্রাণ নাকে এসে পৌচ্ছাচ্ছে। আর কানে গুনগুনস্বরে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে আর এক মহিলা কন্ঠস্বরও। সম্ভবত কেউ নাচ শিখছেন অথবা শেখাচ্ছেন। কিন্তু কে?

নূর তা দেখার জন্য গুটিগুটি পায়ে দরজা অবধি যেতেই আচমকা একজোড়া ঘুঙুর তার পায়ের সামনে এসে পড়লো যেন। নূর ভয় পেয়ে গেল, ভয়ে চিৎকার করে উঠতেই দু পা পিছিয়ে গেল, কোথা থেকে যেন আয়াশ ছুটে এলো ওর কাছে, ভয়াবহ নূরকে দেখে ওর গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কি হয়েছে আফুসোনা? চিৎকার করলে কেন? ‘

নূর ভয়ে আয়াশের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘আচমকা মুখের সামনে কি একটা পড়লো, আমি ভয় পেয়ে গেছি।’
‘কোথায়! ‘
আয়াশ খোঁজার জন্য দরজার সামনে যেতেই দেখলো একজোড়া ঘুঙুর পড়ে আছে সেখানে। নূরকে দেখাতেই পিছন থেকে একটা বছর সাতের বাচ্চা মেয়ে তার পিচ্চি স্বরে ডাকলো,

‘দাদাভাই, আমার ঘুঙুরটা। ‘
আয়াশ মুচকি হেসে ওর হাতে ঘুঙুর তুলে দিয়ে বলল,
‘নাম কি তোমার? ‘
‘চন্দ্রিমা। ‘
নূর দূর থেকে দেখছে, সে এখনো ভয়ার্ত। নূর গুটিগুটি পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল।
আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলো,
‘তুমি কি এ বাড়িতে থাকো? ‘
বাচ্চাটা মাথা নাড়ালো।

‘আমি তো নাচ শিখতে এসেছি। ‘
মেয়েটার কথার পর কারোর কন্ঠস্বর যেন তীব্রভাবে কানে এলো,
‘চন্দ্রিমা, দ্রুত এসো। ‘
চন্দ্রিমা আর দাঁড়ালো না, সে ছুটলো। আওয়াজের উৎস খুঁজতেই বুঝলো তা সিঁড়িঘরের দিক থেকে আসছে, সেদিকে তাকাতেই দেখলো, একজোড়া চোখের তীক্ষ দৃষ্টি তার ওপর থেকে সরে গেল, কেউ আড়ালে চলে গেল। নূর ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতেই আয়াশ বলল,

‘আসো খাবে চলো। আমি বুঝতে পারছি তোমার ক্ষিধে পেয়েছে। ‘
‘আচ্ছা ওখানে কে ছিল? কাউকে দেখলাম যেন! ‘
আয়াশ সিঁড়ির দিক তাকিয়ে বলল,

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৬

‘উনি আমার মায়ের বোন, অর্থাৎ আমার মাসি। ঘুঙুর মুখার্জী। আচ্ছা এবার চলো। ‘
কোনরকম জোর করে নূরকে নিয়ে গেল আয়াশ। তবুও নূর চাইলেও সে দৃষ্টি ভুলতে পারল না, কি মায়াবী কাজলটানা চোখ আর প্রখর দৃষ্টি। সে ভোলার মতো নয়।

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১৮