শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৭

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৭
তানিয়া মাহি

আজ শুভ্রতার বিয়ে। পার্লার থেকে দুইটা মেয়ে এসেছে তাকে সাজাতে। শুভ্রতা এমনিতেই এক কথায় শুভ্রপরী, বউসাজে তাকে অত্যাধিক সুন্দর লাগবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুভ্রতার মা মাঝে মাঝে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে মেয়েকে দেখে দেখে যাচ্ছেন। মেয়ের হাসিমাখা মুখ দেখ আনন্দে তার চোখও টলমল করছে। শুভ্রতার সাজ প্রায় কমপ্লিট, মেয়েকে দেখে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে ‘মাশাআল্লাহ’।

ইরা এদিক ওদিক ঘুরছে, নিহানকে সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। এই বিয়ের পরিবেশ তাকে কাটারঞ্জিত গোলাপের ন্যায় কষ্ট দিচ্ছে। নিজের মনের কথাগুলো বলতে না পেরে গ***লা কা***/টা মুরগির মতো ছটফট করছে। নিহান বাড়িতেই থাকার কথা। একটু পরেই হয়তো তৈরি হয়ে শুভ্রতাদের বাড়িতে যেতে হবে। বাড়ির সবাই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। সবার চোখ ফাঁকি সে নিহানের রুমে প্রবেশ করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুমটা ভীষণ পরিপাটি, ফুল দিয়ে সাজানোও হয়েছে। প্রিয় মানুষের বিয়ে, রুম সাজানো দেখে ইরার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অন্যদিকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে যে নিহানকে তার মনের কথা জানালে নিহান হয়তো এই বিয়ে করবে না। আজ কেমন স্বার্থপর লাগছে নিজেকে। লাগুক! নিজের ভালোর জন্য মাঝেমধ্যে একটু স্বার্থপর হতে হয়।

নিহান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় ইরাকে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়। ইরা বিছানায় হাত বুলিয়ে এদিক ওদিক দেখছে। নিহান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে সেটা সে খেয়াল করে নি। নিহান তাড়াতাড়ি করে টিশার্ট পরে নেয়। মাথাটা ভালো করে মুছতে মুছতে ইরার দিকে এগিয়ে এসে বলে,

” কি রে তুই এখান কি করছিস?”
নিহানের উপস্থিতিতে ইরা বেশ চমকে ওঠে। বিছানায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয় যেন কেউ বিরক্ত না করে কথার মাঝে। ইরার কান্ড দেখে আরেকবার অবাক হয় নিহান।
” দরজা কেন আটকাচ্ছিস তুই?”
ইরা চকিতে বলে উঠল, ” আমি আপনাকে ভালোবাসি নিহান ভাই।”

” হোয়াট! মাথা ঠিক আছে তোর? ইরা এসব কি হচ্ছে? দরজা খুলে দে, তুই এক্ষুণি রুম থেকে বেরিয়ে যা।”
” প্লিজ একটু শুনুন না।”
” ইরা তুই এখান থেকে বেরিয়ে যাবি এক মিনিটের মধ্যে, তোকে আমি এখানে দেখতে চাই না। দেখতে চাই না মানে দেখতে চাই না।”
ইরা ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে নিহানের দিকে তাকায়। ইরার চোখে পানি, নিহান অন্যদিকে নজর ফেলে। আরেকবার বলে, ” ইরা তুই এখান থেকে চলে যা, কেউ তোকে আর আমাকে একা রুমে দেখলে খারাপ ভাববে। যখন তখন যে কেউ চলে আসতে পারে।”

ইরা স্বল্পস্বরে চিৎকার দিয়ে বলে, ” আসুক। দেখুক সবাই, কাউকে ভালোবেসে কীভাবে কান্না করতে হয়। প্রিয় মানুষের বিয়েতে বুকে পাথর চেপে রেখে কীভাবে উপস্থিত থাকতে হয়৷ সবাই দেখুক ভালোবাসার কথা জানালে কীভাবে দূর দূর শুনতে হয়। ”

” পাগল হয়ে গেছিস তুই? ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিস? আমি আমার কৈশোর থেকে একটা মানুষকেই ভালোবেসে এসেছি। কয়েকটা দিন বা কয়েকটা মাস নয় একেবারে আট নয় বছর। তাকে আমি আজ পেতে চলেছি, আমি তাকে কিছুতেই হারাতে চাই না। সে আমার খুব কষ্টে পাওয়া নারী।”
ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” আমাকে কেন ভালোবাসলেন না নিহান ভাই? আপুর বদলে আমাকে ভালোবাসলে কি হতো? দুনিয়াতে কি যু***দ্ধ লেগে যেত নাকি মানুষ মা***রা যেত? আমাকে ভালোবাসলে কি এমন হতো? শুভ্রতা আপু অত্যাধিক সুন্দর জন্য তাকে ভালোবেসেছেন?”

” ভালোবাসা সবার জন্য আসে না ইরা, পাগলামি করিস না৷ ভালোবাসা জাত, বর্ণ, ধর্ম কিছুই দেখে না। যাকে যার নজরে ভালো লাগে তার প্রতি র*ক্ত কণিকা তৈরির মতো সেকেন্ডে ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়। ”
” আপনাকে অনেক ভালোবাসি নিহান ভাই।”
” ইরা অনেক হয়েছে এবার তুই আমার রুম থেকে চলে যা। তুই নিজে থেকে না গেলে আমি কিন্তু…”
” গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন?”
” প্রয়োজন হলে তাই করব। তুই এখন যা এখান থেকে আমার রেডি হতে হবে।”
” ভালোবাসার কথা জানাতে এসে সম্মান হারাবো এ কথা মাথায় আসেনি।”
” মানে?”

” কিছু না, আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা নিহান ভাই। আসছি..”
ইরা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিহান একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রেডি হতে চলে যায়।
শুভ্রতার মা প্লেটে করে খাবার নিয়ে মেয়ের রুমে আসে। শুভ্রতার সাজ কমপ্লিট, এখন একজন চুলটা বেধে দিচ্ছে। আরেকজন ফাউজিয়াকে একটু সাজিয়ে দিচ্ছে। ফাউজিয়াও প্রায় শুভ্রতার মতো ফর্সা, নীল রঙের গাউনে তাকে নীলপরির মতো দেখাচ্ছে। ফাউজিয়ার সাজও প্রায় শেষ।

আয়েশা বেগম খাবারের প্লেটটা নিয়ে শুভ্রতার পাশে বসলেন। শুভ্রতা মাকে দেখে বলে ওঠে, ” মা, বাবা কোথায়? সকালে দেখেছি এরপর আর একটুও দেখিনি৷ বাবা কি খুব ব্যস্ত? একটুও আসলো না যে এদিকে?”
” এখানে তোকে সাজানো হচ্ছে,এর মধ্যে পুরুষ মানুষ কীভাবে আসবে? তুই ক’টা খেয়ে নে আমি তোর বাবাকে পাঠিয়ে দিই। গলার এই হারটা কোথায় পেলি? এটা কি নেওয়া হয়েছিল?”
শুভ্রতা আমতা আমতা করতে থাকে৷ ফাউজিয়া পাশে থেকে বলে ওঠে, ” ওটা নিহান ভাইয়া ওকে গিফট করেছে আন্টি। এটা আপনারা কিনেন নি।”

আয়েশা বেগম মুখে হাসির রেখা টেনে মেয়ের চিবুকে হাত রেখে বলেন, ” খুব সুখী হ’ মা, খুব সুখী হ। ”
একটু থেমে পার্লারের মেয়েদের উদ্দেশ্যে আবার বলেন, ” তোমাদের সাজানো হলে দুজন যাও কিছু খেয়ে নাও। তোমাদের সাজানোর টাকা পেয়েছ তো নাকি?”
দুজনের মধ্যে একজন বলে ওঠে,” জি আন্টি পেয়েছি।”

শুভ্রতার মাথায় বউওরনা দিয়ে মুখের সামনে একটা আয়না ধরে বলে, ” দেখুন তো ম্যাম, কেমন লাগছে আপনাকে?”
শুভ্রতা আয়নায় নিজেকে দেখে। নিজের প্রতি নিজেরই যেন নজদ লেগে যাবে। একটা মেয়ের হয়তো বিয়ে করার চেয়ে বউ সাজার ইচ্ছেটা বেশি, শুভ্রতারও তেমন। আয়েশা বেগম আর ফাউজিয়া শুভ্রতার দিকে এক পলকে চেয়ে রয়েছে। শুভ্রতার সৌন্দর্য্যে কোন খুত যেন চোখে পড়ছে না। আগেও তো অনেক মেয়েকে বউ সাজে দেখেছে, কই এত সুন্দর তো লাগে নি!
পার্লারের মেয়ে দুইটা বেরিয়ে গেলে আয়েশা বেগম মেয়েকে খাইয়ে দিতে থাকেন। ফাউজিয়াকেও ডেকে নেন খাইয়ে দিতে এমন সময় শাকিরা আসে। ওদের দুজনকে খাইয়ে দিতে দেখে শাকিরা কোমরে দুইহাত দিয়ে রাগীভঙ্গিতে দাঁড়ায়, ” কি ব্যাপার কাকী, তুমি আমাকে ভুলে গেলে?”

আয়েশা বেগম হাসতে হাসতে শাকিরাকে ডেকে হাত বাড়ায়।
নেহা ঘড়ি আর ফোন হাতে নিয়ে নিহানের রুমে চলে যায়। নিহান তখন পাঞ্জাবীতে আতর মাখছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। নেহা গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ঘড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে, ” ভাইয়া এই নাও তোমার ঘড়ি, তোমার হবু বউ দিয়েছে।”
নিহান ঘড়িটা নিয়ে হাতে পরতে পরতে বলে, ” যা এখন।”

” যাব কেন? তোমাকে তোমার বউ দেখাতে এলাম।”
” মানে? শুভ্রা এখানে এসেছে?”
” আরে নাহ, আমি স্নিগ্ধার ফোনে ভিডিয়ো কল দিচ্ছি তুমি দেখো কি সুন্দর লাগছে শুভ্রতা আপুকে। এত সুন্দর বউ আমি কখনো দেখি নি।”
” এখন দেখব না যা, বউকে বিয়ে করতে যেয়েই দেখব। আমার এখন তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে, মা তাড়া দিয়ে গেছে একবার। সবাই বসে আছে আমার জন্য।”
” ঠিক আছে, যাচ্ছি। তবে ভালো একটা জিনিস মিস করলা ভাইয়া।”
” গেলি তুই!”

নেহা চলে গেলে নিহান আলমারি থেকে শুভ্রতার জন্য কিনে রাখা রিং এর বক্সটা পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে নেয়। রাতে রুমে অনেকেই হয়তো থাকবে তাদের সামনে বা শুভ্রতার সামনে গিফট বের করা উচিৎ হবে না।
নিহান রুম থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় বিছানার ওপর রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। নিহান বুঝতে পারে ভুলে ফোন রেখে যাচ্ছিল সে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৬

বিছানার কাছে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে৷ ওপাশ থেকে কেউ কিছু বললে নিহান বলে ওঠে, ” আচ্ছা সমস্যা নেই ওকে দেখে রেখো, আমি চাচ্ছি না আজকের দিনে কোন সমস্যা সৃষ্টি হোক। এই দিনটা এগিয়ে নিয়ে আসতে অনেক কাঠখড় পো**ড়া*তে হয়েছে আমার। ও কোনভাবেই যেন নজরের বাহিরে না যায়। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৮