শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৮

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৮
তানিয়া মাহি

বিয়ের আসরে বাড়ির সকলে উপস্থিত। বিয়ের আসরটা দুইবাড়ির সামনের বড় উঠোনটায় করা হয়েছে। আবিরা, স্নিগ্ধা, নেহা, শাকিরা, ফাউজিয়া সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিয়ে হয়ে গেলে কোথায় কীভাবে মজা করবে সেগুলো ঠিক করছে। ফাউজিয়া নতুন হিসেবে একটু অস্বাভাবিক লাগার কথা কিন্তু তাকে কেউ এখানে অন্যরকম অনুভব করতে দিচ্ছে না। আবিরা ইরাকে তাদের সাথে ডেকেছিল কিন্তু ইরা তাদের সাথে আসে নি।

সে তার মায়ের কাধে মাথা রেখে কোমর দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিহানের মা আর শুভ্রতার মা দুজনই শুভ্রতার কাছাকাছি রয়েছে। একপাশে নিহান এবং অন্যপাশে মা, হবু শাশুড়ী। কাজী সাহেব কবুল বলতে বলেছে মিনিট দুয়েক আগে কিন্তু শুভ্রতা মুখ থেকে টু শব্দটি বের করছে না। সামনের চেয়ার থেকে শাহাদাত সাহেব বলে উঠলেন, ” কবুল’টা তাড়াতাড়ি বলে দে মা, এত সময় নিচ্ছিস কেন? এত সময় নিতে হয় না মা। সৃষ্টিকর্তা তোর ভাগ্যে ভালো কিছু রেখেছে ইন শা আল্লাহ। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কারো কথাই যেন শুভ্রতার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। হয়তো তার এক হাত সামনে এসে কোনকিছুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। শুভ্রতা হাতের সাথে হাত ঘষে যাচ্ছে, এমন সময় নিহান শুভ্রতার হাতে হাত রাখে। শুভ্রতা নিহানের দিকে তাকাতেই নিহান চোখ হালকা বন্ধ করে সম্মতি দিতে বলে দেয়। শুভ্রতা নিহানের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কবুল বলে দেয়। সাথে সাথে সবাই আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে।

এবার নিহানের কবুল বলার পালা, সবাই নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরুষ এমনিতেও কবুল বলতে বেশি সময় নেয় না তারা তাড়াতাড়ি বউ নিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে। নিহানকে কবুল বলতে বললে নিহান সাথে সাথে মাথা নিচু করে কবুল বলে দেয়। নিহানের মুখ থেকে ‘কবুল’ উচ্চারণ হওয়ার সাথে সাথে ইরার চোখ থেকে বৃষ্টিফোটার মতো কষ্ট ঝরে পড়ে। ইরা তার মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইলে তার মা জোর করে রেখে দেয়। সাফিয়া বেগম মনে করেন ইরার সহ্য করতে হবে, পৃথিবীর সব পছন্দের জিনিস বা ভালোবাসার মানুষ আমাদের হবে না এটা ইরাকে বুঝতে হবে।

” বাবা, আমার কান্না পাচ্ছে। ”
শাহাদাত সাহেব রুমের এখানে ওখানে ইনহেলারটা খুঁজছিলেন। আজ কেমন যেন নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে। মেয়ের কথায় পিছনে ফিরে তাকান তিনি। মেয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ” কি হয়েছে মা? কান্না কেন পাবে তোর?”
” জানি না বাবা আমার কান্না পাচ্ছে৷ ওই রুমে সবাই কত মজা করছে কিন্তু আমার কিছু ভালো লাগছে না। কেমন যেন লাগছে, ভীষণ কান্না পাচ্ছে।”

” নতুন জীবনের সবকিছু পরিচিত হলেও সবকিছু নতুন। তুই তো এখানেই থাকবি তোর কোন চিন্তা নেই মা। ”
” তুমি কিছু খুঁজছিলে?”
” হ্যাঁ, আমার ইনহেলারটা কোথায় যে রেখেছি!”
” তোমার ব্যাগে আছে দেখো।”
শাহাদাত সাহেব এখানে ওখানে খোঁজাখুঁজি বাদ দিলেন। শুভ্রতা বলার পর মনে হলো সহজে যেন খুঁজে পাওয়া যায় তাই সেটা ব্যাগে রাখা হয়েছে। নিজের কাজ মিটিয়ে মেয়ের পাশে এসে বসলেন। টেবিলে রাখা একটা বই হাত বাড়িয়ে নিয়ে সেটা শুভ্রতার হাতে দিয়ে বললেন, ” এই বইটা তোর জন্য কিনেছিলাম। সময় পেলেই বইটা পড়বি অনেকে কিছু জানতে ও শিখতে পারবি। ”

শুভ্রতা বইটা হাতে নিতেই স্নিগ্ধা রুমে এসে শুভ্রতার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ” আপু তোমাকে সবাই ডাকছে।”
” তুই যা আমি পরে আসছি। ”
শাহাদাত সাহেব মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ” যা মা, সবাই ডাকছে। সবার সাথে আনন্দ কর৷ তোর মাকে একটু পাঠিয়ে দিস এখানে।”
” ঠিক আছে বাবা।”

শুভ্রতা আর স্নিগ্ধা চলে গেলে শাহাদাত সাহেব বালিশটা ঠিক করে শুয়ে পড়েন৷ অনেকগুলো মাস পর একটু নিশ্চিন্ত লাগছে নিজেকে। অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে, আজ হয়তো একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন তিনি।
নিহান ফোনে কথা বলা শেষ করে পিছনে ফিরতেই দেখে ইরা দাঁড়িয়ে আছে। নিহান পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ঠিক তখনই ইরা বলে ওঠে, ” পরশু চলে যাচ্ছেন?”

” হ্যাঁ সেরকমই কথা হলো। ”
” নতুন বউ রেখে চলে যেতে কষ্ট হবে না?”
” ইরা, তুই আমার চাচাতো বোন, প্রাক্তনের মতো কথা বলবি না। এসব তোকে মানায় না।”
” আমার কথা আর আপনাকে শুনতে হবে না নিহান ভাই। আমি খুব জলদি বাহিরে চলে যাচ্ছি। আমি আর আপনার মুখোমুখি হতে পারব না, আমার সাহস নেই।”

” যেখানেই থাকিস, দোয়া করি সবসময় ভালো থাকিস।”
” যখন কবুল বলছিলেন সেই সময়ের মতো অসহায় নিজেকে কখনো লাগে নি৷ আপনার নিশ্চয়ই এমন লেগেছিল শুভ্রতা আপুর প্রথম বিয়েতে?”
” ইরা, তুই আমার সম্পর্কে ছোট বোন, সে হিসেবে থাকলে খুশি হব।”
নিহান ইরাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলে ইরা আবার বলে ওঠে, ” ভালোবাসি আপনাকে নিহান ভাই, খুব বেশি ভালোবাসি। ”

নিহান শুনেও যেন না শোনার অভিনয় করে, এক মুহুর্তের জন্য না দাঁড়িয়ে চলে যায়। সে এক নারীতে আ*সক্ত পুরুষ। কোন পুরুষ এক নারীতে আ*সক্ত হলে তার সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কোন নারীকে এনে দাঁড় করালেও সেই পুরুষের শখের নারীই তার চোখ শীতলকারিনী। নিহান শুভ্রতার কাছে যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নেয় ইরার মুখোমুখি আর হওয়া যাবে না, হলেও কঠোর থাকতে হবে নইলে মেয়েটা উল্টাপাল্টা কাজ করে বসবে।

সাহিল শেখ শুভ্রতাদের বাড়ির বাহিরে এসে ফাউজিয়াকে কল দিল। ফাউজিয়া মিনিট বিশেক আগে মায়ের কল পেয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে। শুভ্রতা অনেকবার বলেছে আজকে অন্তত থেকে যাওয়ার জন্য কিন্তু ফাউজিয়া থাকতে নারাজ। এমনিতেই একদিন থাকা হয়ে গিয়েছে, তার মায়ের শরীরটাও খারাপ। নিজের ব্যাগটা নিয়ে রুমের বাহিরের দিকেই বসে শাকিরার সাথে কথা বলছিল ফাউজিয়া। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় সে শুভ্রতাকে ডাক দিলে শুভ্রতা বাহিরে বেরিয়ে আসে।

” স্যার এসে গেছে?”
” হ্যাঁ কল দিয়েছেন দেখছি। আমি তবে এখন বের হই। তুই সাবধানে থাকিস, ফ্রি হলে কল দিস।”
” ঠিক আছে চল এগিয়ে দিয়ে আসছি।”
” আচ্ছা।”

ফাউজিয়ার সাথে শাকিরা আর শুভ্রতা বাড়ির বাহিরের দিকে আসে। তিনজন বাহিরে এসে দেখে সাহিল স্যার উঠোনে বাইকের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই সেদিকে এগিয়ে গেল। শুভ্রতা দুজনের থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ” আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?”
সাহিল শেখ পিছনে ফিরে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ” নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা শুভ্রতা। প্রতিটা দিন আপনার ভালো কাটুক। ”

” স্যার ভেতরে চলুন না, এখান থেকে চলে গেলে বিষয়টা কেমন দেখায়!”
” না না দেরি করব না। আমাদের এখনই বের হতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক, নতুন বউয়ের এরকম বাহিরে বের হওয়া উচিৎ না।”
” জি স্যার। স্যার ভেতরে আসলে ভালো লাগতো।”
সাহিল শেখ কাঁপা কাঁপা হাতটাই শুভ্রতার মাথায় রাখেন। শুভ্রতা সাহিল শেখের দিকে তাকালে তিনি বলেন, ” অন্য একদিন আসব, আজ যেতে হবে৷ ভালো থাকবেন।”

শুভ্রতা চকিতে বলে ওঠে, ” স্যার আপনি কিন্তু আমার সাথে তুমি করে বলতেই পারেন আমি তো আপনার ছোট বোনের মতোই হব হয়তো।”
সাহিল শেখ ফাউজিয়ার দিকে তাকায়। ফাউজিয়া অন্যদিকে তাকায়, সাহিল শেখ বুঝতে পারে গতকালের কথাটা ফাউজিয়া বলে দিয়েছে। মেয়েদের পেটে আসলেও কথা জমে থাকতে চায় না, বেস্টফ্রেন্ডের কাছে তো একদমই নয়। সাহিল শেখ ফাউজিয়ার দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” ঠিক আছে, এখন যাও বাড়ির মধ্যে। অনেকরাত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বের হতে নেই।”

” ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন স্যার। ”
রাত দশটা-
শুভ্রতার বিছানায় সবাই বসে বসে গল্প করছে। আবিরা আর শাকিরা যেন গল্পের আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে। স্নিগ্ধা আর নেহা পূর্বের দিনগুলোর মতোই একসাথে। দুজন কোথাও গেলে সবসময় একসাথে থাকবে। সমবয়সী ভাই-বোনের মধ্যে অনেকটা দা-কুমড়ার সম্পর্ক থাকে কিন্তু তারা দুজন একদম বিপরীত। ইরা একপাশে বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে। বাড়ির বড়রা একেএকে সবাই নিজেদের বাড়ি, রুমে চলে গিয়েছেন। এখন শুধু বাড়ির মেয়েগুলো রয়েছে। রায়হান আর নিহান রুমে প্রবেশ করতেই শাকিরা বলে ওঠে, ” তোমাদের এতক্ষণে সময় হলো আসার?”

রায়হান এগিয়ে এসে বিছানার একপাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে, ” কেন?”
শাকিরা সোজা হয়ে বসে বলে, ” কেন আবার? কত রাত হয়ে যাচ্ছে দেখেছ? ওরা নিজেদের রুমে যাবে না?”
আবিরা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে ওঠে, ” ভাইয়াকে দেখে তো মনে হচ্ছে বাড়িতে বউ নিয়ে যাওয়ার কোন তাড়া নেই।”
ইরা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলে ওঠে, ” বউ আদৌ বরের ঘরে যাবে তো? বর এখন আসছে বউ নিতে।”
নিহান শুভ্রতার দিকে এগিয়ে এসে শুভ্রতাকে বলে, ” দাঁড়াও তো, আর কত এখানে বসে থাকবে? উঠে দাঁড়াও।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৭

রায়হান হাসতে হাসতে বলে, ” তুই কি এখন শুভ্রতাকে কোলে করে নিয়ে যাবি নাকি?”
” আমার বউ তার শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিন হেটে যাবে না। সে তার নিজের ঘর অবধি আমার কোলে উঠেই যাবে।”
নিহান শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ্রতা শক্ত করে পাঞ্জাবি আর পাঞ্জাবির মালিককে ধরে আছে। চোখ মুখ খিচে বারবার বলছে, “নামিয়ে দিন আমাকে, আমি পড়ে যাব। ”
কে শোনে কার কথা নিহান শুভ্রতাকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৯