শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৯

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৯
তানিয়া মাহি

শুভ্রতাকে কোলে নিয়েই নিজের বাড়িতে ঢুকে নিহান। পিছন পিছন আবিরা আর নেহাও চলে এসেছে। শুভ্রতা ভয় আর লজ্জায় তখনও চোখ বন্ধ করে আছে। রাবেয়া বেগম এগিয়ে এসে বলেন, ” সিড়ি আছে সামনে, মেয়েটাকে নামিয়ে দে। দেখা যাবে দুজনই পড়ে বসে থাকবি।”

নিহান না থেমে হাটতে হাটতেই বলে, ” মা কত মাস ট্রেনিং নিয়েছি জানো? কত কি করেছি আর তুমি কি না সিড়ি নিয়ে চিন্তায় আছো? তোমার ছেলে এত দূর্বল না। চিন্তা করো না।”
শুভ্রতা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ” বড়মা তোমার ছেলেকে বলো না প্লিজ আমাকে নামিয়ে দিতে। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এই নিহান….”
রাবেয়া বেগমকে থামিয়ে দিয়ে নিহান বলে, ” আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো, পড়তে দেব না কোনভাবেই এটুকু বিশ্বাস নেই আমার ওপর?” শুভ্রতা আর কিছু বলে না রাবেয়া বেগম ও নিজের রুমের দিকে চলে যান। আবিরা আর নেহাও মায়ের সাথে হাসতে হাসতে চলে যায়।

নিজের রুমে নিয়ে এসে বিছানার সামনে শুভ্রতাকে নামিয়ে দেয় নিহান। নিহান নয় শুভ্রতা যেন এবার হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এতক্ষণ পরে সে চোখটা খুলল সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
শুভ্রতার অবস্থা দেখে নিহান এগিয়ে এসে বলে, ” কোলে করে নিয়ে আসলাম আমি, আমার হাঁপানোর কথা অথচ তুমি হাঁপাচ্ছো?”
শুভ্রতা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিহান কোন উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ” ভয় পাচ্ছিলে?”

” হ্যাঁ, একটু।”
” পরে গেলেও তোমাকে কোন না কোনভাবে ঠিক রক্ষা করতাম। প্রাণ থাকতে ভালোবাসার মানুষের কষ্ট দেখতে পারতাম না। পৃথিবীর সব হাসি তোমার হোক তার বিনিময়ে যদি গোটা জীবন কষ্ট নামক সুচ বুকে বয়ে বেড়াতে হয় তবু আমি রাজি, শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।”
” কি সব বলছেন? আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাব না। যে মানুষটা আমাকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে তাকে কি করে ছেড়ে থাকব। আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি আপনার সঙ্গ চাই। থাকবেন না?”
” হুম, থাকব। ছেড়ে যেতে চাইলেও যেতে দেব না।”

রাবেয়া বেগম কিছু খাবার প্লেটে সাজিয়ে নেহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিহানের রুমে দিয়ে আসতে বলে। নেহা প্লেট নিয়ে এসে দরজায় নক করতেই শুভ্রতা এসে দরজা খুলে দেয়। নেহা ভেতরে এসে খাবারের প্লেট টি-টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করে, ” ভাইয়া কোথায়? তুমি দরজা খুলে দিলে যে? তুমি তো ফ্রেশ হচ্ছিলে?”

” আমার ফ্রেশ হওয়া হয়ে গিয়েছে। আয় বসবি।”
” না বউমণি এখন আর বসব না অনেক রাত হয়ে গেছে এখন আসি বরং।”
” এই তুই আমাকে বউমণি কেন বলছিস? লা*/ত্থি খাবি একদম। আমার সাথে এই ভাবি, ননদের সম্পর্ক গড়তে আসলে মে*/রে তক্তা বানিয়ে দেব বলে দিলাম।”
” এই তুমি না নতুন বউ। ”

” তো কি হয়েছে? তোদের সাথে আমার নতুন বউয়ের মত আচরণ করতে হবে? তাহলে তো আমি দূরে কোথাও বিয়ে করলেই পারতাম।”
” তুমি থাকো আমি আসছি।”

নেহা কথা না বাড়িয়ে চলে গেল, শুভ্রতা দরজা আটকাবে ঠিক তখনই নিহান এসে তার আগেই দরজা আটকে দিলো।
নিহান এতক্ষণে খেয়াল করল শুভ্রতা ঠিক তার নিজের মতোই শুভ্র রঙের শাড়ি পরেছে। আচ্ছা বিয়ের রাতে কেউ শুভ্ররঙা শাড়ি পরে কি? তার ঠিক জানা নেই। বিয়ের সাজ ধুয়ে হয়তো গোসলটাও করে নিয়েছে শুভ্রতা। হাটু অবধি চুলের আগা বেয়ে টুপটাপ পানি ঝরছে। কুচিগুলো বেশ এলোমেলো দেখাচ্ছে, নতুন শাড়ি ভাজ খুলে পরলে সেটার কুচি ঠিক করা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে তার ওপর যদি সেটা খসখসা টাইপ শাড়ি হয়ে থাকে তাহলে তো কোন কথাই নেই।

নিহান কোন কথা না বলে শুভ্রতার ওপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। বিয়ে হলে কি মেয়েদের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়? সেটাও নিহানের জানা নেই কিন্তু শুভ্রতা বিয়ের সাজের পর থেকে কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। সে আগে থেকে উজ্জ্বল রঙের অধিকারী, আজকে যেন আরও বেশি ফর্সা লাগছে। আচ্ছা এই মেয়েকে কি দুধে আলতা গায়ের রঙের মেয়ে বলা যায়? হয়তো বলা যায়,বললে খুব একটা ভুল হবে না। শুভ্রতা একভাবেই দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে, নিহান যেভাবে দেখছিল তাতে লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ সমীচীন। নিহান আস্তে করে মেঝেতে দুই পা গুটিয়ে বসে পড়ে। শুভ্রতার কুচিতে হাত দিবে এমন সময় শুভ্রতা এক পা পিছিয়ে যায়।

” কি করছেন?”
” কুচি এলোমেলো দেখাচ্ছে, ঠিক করলে একদম সব পারফেক্ট হত।”
শুভ্রতা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। নিহান কুচিতে হাত দিতেই শুভ্রতার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। পুরোনো স্মৃতি উঁকি দেয়। কেউ একজন এভাবে নিচে বসে তার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিত। শুভ্রতা মাথা ঝাঁকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। নাহ, অতীত ভাবা যাবে না। এমন সুন্দর বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীত ভাবা মহাপাপ, এত পাপ করলে যে প্রতিটা নিঃশ্বাস বিষা*/ক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। শুভ্রতা নিজেকে সামলে নিয়ে নিহানের দিকে তাকায়। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে, এতটা যত্ন করে কেউ স্ত্রীর শাড়ির কুচি ঠিক করে দেয়? পরিবেশটা কি আসলেই এত মনোমুগ্ধকর হয়!

নিহান উঠে দাঁড়ায়, শুভ্রতা ঠিক ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। নিহান শুভ্রতার দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলে, ” আমার চোখে তাকিয়ে দেখ তো কি দেখতে পাচ্ছ?”
” প্রেম।”
” কোন অবস্থানের?”
” গভীর।”
” আর কিছু দেখতে পাও না?”

শুভ্রতা চুপ করে থাকে, নিহান আবার বলে ওঠে, ” তৃষ্ণা দেখতে পাও? বুকে জড়িয়ে নেবার তৃষ্ণা! দেখতে পাও চোখের নিচের জমাট বাধা কালো দাগ? তোমার প্রতি যখন প্রেমের হলো শুরু আমার হয়েছিল সারা, বুঝতে পারো চোখ দেখে? কত কোটি সেকেন্ড, মিনিট তোমাকে নিজের ভেবে কাটিয়েছি, কল্পনায় সঙ্গ পেয়ে মুচকি হেসেছি। একটাবার ভালোবাসি শব্দটা তোমার কানে পৌঁছতে কতটা ব্যাকুল হয়েছি, সেই ব্যাকুলতা দেখতে পাও তুমি? তোমাকে নিজের করে পাওয়ার পরও তৃষ্ণা মিটছে না, এ জনমে মিটবে বলে মনে হয় তোমার? তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমার চোখে আজীবন থাকুক, তোমাকে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য আমার বুকটা সবসময় পু*ড়ু*ক, সেই পো*ড়া*র গন্ধে তুমি আমার কাছে আসলে সময় থেমে যাক। তোমার ব্যথায় আমার হৃদয় সর্বক্ষণ টনটন করুক আর আমি ছাড়া…… ”

” আপনি ছাড়া আমার একটা দিনও না আসুক।”
নিহান থেমে যায় মুহূর্তের মধ্যে, শুভ্রতার চোখ ছলছল করছে৷ চোখের পলক ফেললেই টুপ করে বৃষ্টিফোটা পড়বে। শুভ্রতা বিছানায় ধুপ করে বসে পড়ে। চোখের পানি গাল বেয়ে নেমেছে। নিহান গিয়ে শুভ্রতার পায়ের কাছে বসে।
” আপনি আমাকে ভালোবাসার কথা আগে কেন জানালেন না? জানালে হয়তো আমার জীবনের দ্বি…..”

শুভ্রতাকে কথা শেষ করতে দেয় না নিহান। শুভ্রতার কথার মাঝে বলে ওঠে, ” প্লিজ শুভ্রা, আমি তোর জীবনের শেষ পুরুষ হয়ে থাকতে চাই। আমার জীবনের প্রতিটা সেকেন্ড তোর সাথে কাটাতে চাই। তুই আমার জীবনের প্রথম নারী, প্রথম ভালোবাসা, তুই-ই আমার সবকিছুর শেষ৷ তোর আগে কেউ আসেনি, তোর পরেও কেউ আসবে না। আমি নিহান নিজেকে সিলমোহর দিয়ে আটকে দিলাম। আমি পুরোপুরি তোর হয়ে থাকতে চাই। তুই শুধু তোর অতীতটা প্লিজ সামনে আনবি না, আমি সহ্য করতে পারি না।”

নিহান মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়, বিয়ের পাঞ্জাবি সে এখনো পরে আছে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ছোট্টো কৌটা বের করে শুভ্রতার সামনে এগিয়ে দেয়। শুভ্রতা নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। নিহানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কি আছে এতে?”
” খুলেই দেখ।”
শুভ্রতা নিহানের হাত থেকে কৌটাটা নিয়ে খুলে দেখে সেখানে সুন্দর একটা রিং রয়েছে৷ শুভ্রতা কৌটা থেকে চোখ সরিয়ে বলে ওঠে, ” ডায়মন্ড!”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৮

” হুম। পছন্দ হয়েছে?”
” অনেক বেশি সুন্দর। ”
” তোমার থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ও বেশি নয়। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য তোমার কাছে তুচ্ছ।”
নিহানের কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে যায় শুভ্রতা। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকে। মেঝের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা মুখ নিয়ে বলে, ” আপনি না ভীষণ বাজে, কেমন কথায় কথায় লজ্জায় ফেলে দেন!”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪০