তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫২

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫২
Lutful Mehijabin (লেখা)

হাসপাতালের করিডোরে বসে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে মেহের। তার ক্রন্দনের গুমোট ধ্বনিতে সম্পূর্ণ কক্ষে বিষন্নতা আবির্ভাব ঘটেছে। ঘন্টা খানিক পূর্বে সমুদ্রের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হয়েছে সমুদ্রকে। গুলি নির্গত হয়নি সমুদ্রের দেহ হতে। তাই প্রচুর রক্তপাত ঘটেছে! তখন থেকেই উন্মাদের ন্যায় কেঁদে চলেছে মেহের। ভীষণ করুণ পরিণতি ঘটেছে মেয়েটি। সমুদ্রের টিমের মেম্বারগন মেহেরের পার্শ্ববতী হওয়া সত্ত্বেও মেহেরের কোন হেলদোল নেই! যে মেয়েটা সর্বদা নিজের অনুভূতি দমিয়ে রাখতে ব্যাস্ত থাকে, বর্তমানে সেই মেয়েটি বহু লোকের সম্মুখে কেঁদে চলছে অবিরাম!

মিনিট পাঁচেক পূর্বে নিজ কর্ম সেরে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন শোয়াইব খান। দরজার নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। মেয়েটার কান্না রত মুখ তাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে বারংবার! কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মেয়েটার এমন বেগতিক পরিস্থিতি মোটেও প্রত্যাশা করেন নি তিনি। মেহেরের মুখশ্রীতে ক্লান্তির গাঢ় ছাপ স্পষ্ট! চোখের জলে তার মুখশ্রী ভিজে উঠেছে। অতিরিক্ত ক্রন্দনের ফলে মেহেরের গাল যুগল কিঞ্চিৎ রক্তিম আভা ধারন করছে ইতিপূর্বে। মেয়েটার চোখের জল সহ্য করতে পারছেন না শোয়াইব খান।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহেরের দু পাশে বসে ছিলো আকাশ এবং রিয়া। মেহেরের শান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে তারা। কিন্তু মেয়েটাকে থামাতে ব্যর্থ তাঁরা। ধীর গতিতে মেহেরের পাশে গিয়ে বসলেন শোয়াইব খান। আচমকা মেহেরের হাত দুটো আঁকড়ে ধরলেন। অতঃপর আকাশকে উদ্দেশ্যে করে ধমক স্বরে বললেন,

— আকাশ! তোমার মধ্যে কি বিন্দু পরিমান কমনসেন্স নেই? তুমি এখানে বসে লুডু খেলছো? আশ্চর্য, আমার মেয়েটার শরীর নেতিয়ে পড়েছে তাও ওকে কেবিনে নিচ্ছো না! গো, দ্রুত একটা কেবিনের ব্যাবস্থা করো।
বিষন্ন হৃদয়ের ফলে শোয়াইব খানের কথা ঠিক মতো লক্ষ্য করে নি আকাশ। স্যারের অনুমতি পেয়ে এক মুহূর্তও নষ্ট করে নি সে। দ্রুত পদে রুম থেকে প্রস্থান করেছে কেবিন বুক করার উদ্দেশ্যে।

ইতিমধ্যে শোয়াইব খানকে সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সকলে। হঠাৎ স্যারের গর্জনে মুখ নিচু করে রয়েছে সবাই। শোয়াইব খান মেহেরের হাত আঁকড়ে ধরে মেয়েটার নিকটবর্তী বসে রয়েছেন। টিমের সকলের উপস্থিতি তাকে ভীষণ বিরক্ত করছে। ফলে অত্যধিক ফুসছেন তিনি! শান্ত পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও একপর্যায়ে তিনি সবাইকে উদ্দেশ্যে করে কর্কশ গলায় বলে উঠলেন,

— ইডিয়েস্ট! তোমরা এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? দেখছো মেয়েটা কাঁদছে, তাহলে অযথা রুমের মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করছো কেন?
শোয়াইব খানের কথার অর্থ বুঝতে পেরে এক মুহূর্তও দেরি করেন নি কেউ। শুধু মাত্র কক্ষ হতে বিদায় নেওয়ার পূর্বে রিয়া সাহস সঞ্চয় করে বলেছিল,

— স্যার আমি কী থাকতে পারি। মেয়েটাকে তো কিছু খাইয়ে দিতে হবে। তাছাড়া আমি থাকলে ওর সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবো।
রিয়ার মলিন কন্ঠস্বর শুনেই গরম চাহনি নিক্ষেপ করেছেন শোয়াইব খান। বর্তমানে কাউকে সহ্য করতে পারছেন না তিনি। অবশেষে রিয়ার প্রত্যুত্তরে উপেক্ষা কৃত কন্ঠে বলে,

— তোমার সাহস হয় কি করে আমার সঙ্গে উঁচু গলায় অথা বলার! ওকে খাইয়ে দেবার জন্যে আমি আছি। তোমার চিন্তা করতে হবে না। এখন জাস্ট এক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘর ফাঁকা করো। নাহলে,,

শোয়াইব খানের সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার আগেই প্রস্থান করেছে রিয়া। পরক্ষণেই শোয়াইব খান হাফ ছেড়ে বেঁচেছে! তার মেয়েটা এখন অবধি মাথা কাত করে পলকহীন নয়নে বিরতিহীন কেঁদে যাচ্ছে। সন্তানের বিষাদগ্রস্ত চেহারা বোধহয় কোন পিতা সহ্য করতে পারেন না। শোয়াইব খানের ক্ষেত্রে ও ব্যাতিক্রম কিছু পরিলক্ষিত হয় নি। মেয়েটা এমন ক্লান্ত চেহারা তিনিও সহ্য করতে পারছেন না।

সমুদ্রের আহত হবার কথা শুনে ব্যাপক আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি। মনে মনে প্রার্থনা করেছিলেন সমুদ্রের মৃত্যুর সুসংবাদ কর্ণপাত করতে। এমনকি গাড়িতে পরিবহন রত অবস্থায়ও তিনি নিজ স্বার্থে তার প্রাণ প্রিয় অফিসার সমুদ্রের মৃত্যু কামনা করে এসেছেন। নির্দয় নির্মম পিতার ন্যায় নিজ মেয়েকে বিধবা রূপে দেখতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছেন। সমুদ্রের অনুপস্থিতিতে জামাল সাহেব এবং তার দলবলের সকালকে কারাগারে বন্দি করার দায়িত্ব তার উপর ভূষিত।

দীর্ঘ কয়েক বছর ব্যাপি চলমান কেস সমাধান করতে পেরে ভীষণ আনন্দিত ছিলেন শোয়াইব খান। সমুদ্রের কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে তারা জামাল সাহেবের ন্যায় নারী পাচারকারী এবং ড্রাগস ব্যবসায়ীকে আটক করতে পেরেছেন। প্রায় বছর পাঁচ যাবত এই অপরাধের নিযুক্ত ছিল জামাল সাহেব। একজন আদর্শ শিক্ষকের আড়ালে তার মুখোশ উন্মোচন করার ফলে এতোক্ষণে তা খবরে হেডলাইন স্থান নিয়েছে!

সমুদ্রের তথ্য মতে জানা গিয়েছে জামাল সাহেব এসব কর্মসূচি বিদ্যালয়ের সংঘটিত করতো। বেসরকারি বিদ্যালয় হওয়ার ফলে বিষয়টা সাধারণত জনতা আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এককথায় জামাল সাহেব শিক্ষক নামের কলঙ্ক! তিনি তার বিদ্যালয়ের অসহায়, নিম্ন শ্রেণীর পরিবারের ছাত্রীদের পাচার করতেও পিছু পা হন নি। কেসটা সমুদ্রের কাছে হস্তক্ষেপ হতেই সমুদ্র জামাল সাহেবের বিরুদ্ধে তথ্য কালেক্ট করতে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়। সমুদ্রের সন্দেহের পিছনের রহস্য হচ্ছে সকিনা বেগমের স্বামী। তার থেকেই জামাল সাহেবের সন্ধান পায় সে।

সকিনা বেগমের স্বামীও জামাল সাহেবের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একটা সময় তিনি কোন এক অজানা কারণে অনুতপ্ত হন। এরপর বিষয়টা সমুদ্রকে জানান এবং নিজ অপরাধ স্বীকার করে। স্বীকারোক্তির বিষয়টা জামাল সাহেব আন্দাজ করতে পেরে সকিনা বেগমের স্বামীকে পৃথিবী থেকে আজীবনের জন্য বিলুপ্ত করে দেন।

অতঃপর দ্বিগুণ ক্ষোভ নিয়ে সমুদ্র চতুরতার সঙ্গে কেসটা তদন্ত করে। জামাল সাহেবের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ তথ্য কালেক্ট করে একটা পেইনড্রাইভে তা সংরক্ষণ করে। কেসটার শুরু থেকে শেষ অবধি সকল তথ্য পেইনড্রাইভের মধ্যে সংরক্ষিত ছিলো। জামাল সাহেব সমুদ্রের আসল পরিচয় না জানলেও পেইনড্রাইভের সম্পর্কে তথ্য ঠিকই পেয়ে যায়। অতঃপর নিজের লোক লাগিয়ে সিআইডি অফিসার সমুদ্রের বাসা থেকে পেইনড্রাইভ চুড়ি করতে উঠে পড়ে লাগে। এই কাজটা জামাল সাহেব তার নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের উপর অর্পিত করেন। তাই সিআইডি অফিসার সমুদ্র সম্পর্কে আগা গোড়া সম্পূর্ণ তথ্য তার অজানা ছিলো।

মেয়েকে এমন মূর্তি ধারণ কৃত অবস্থা দেখে ইতিমধ্যে শোয়াইব খানের হৃদয় হীন তোলপাড় আরম্ভ করে দিয়েছে। মেয়েটা যেন এক নির্বাক ম্লানিমার ছায়ায় পরিনত হয়েছে। চোখ যুগল বেয়ে ঠিকই জল বিসর্জন হচ্ছে কিন্তু মেয়েটার মুখে কোন টু শব্দ নেই! মেয়ের অশ্রুকণা শোয়াইব খান সহ্য করতে পারছেন না। তার বুকের বা পাশটা জ্বলে পুড়ে ছারখার!

শোয়াইব খান নিজেকে সংযত রেখ মেহেরের দু গালে হাত দ্বারা আবদ্ধ করে নিলেন। তখন অবধি মেহের নিরবে কেঁদে চলছে। শোয়াইব খান ধীর গতিতে মেয়ের অশ্রু মুছে যাচ্ছেন। কিন্তু আশ্চর্যে বিষয় হচ্ছে মেহের থামাতে নারাজ। অশ্রুকণার বিন্দু বিন্দু ফোঁটা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ন্যায় মেয়েটার গাল যুগল ভিজিয়ে চলছে বারংবার! একপর্যায়ে নিজেকে ধাতস্ত রেখে শোয়াইব খান নরম স্বরে বলে উঠলেন,

— ইশ, আমার লক্ষি আম্মুটা কাঁদছে কেন? ভয় পেয়েছো বুঝি?
শোয়াইব খানেক প্রত্যুত্তর মেহের নিরব ভঙ্গিমায় পূর্বের অবস্থায় রয়েছে। বিষয়টা পরিলক্ষিত করে এক গভীর,লম্বা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলে তিনি। অতঃপর মেহেরের থুতনি উঁচু করে বলে উঠলেন,

— আম্মু তাকাও আমার দিকে। তুমি তো ব্রেভ গ্যাল! তোমাকে এভাবে মানায় না আম্মু। দেখো, এই অবস্থায় তোমাকে দেখলে যে তোমার বাবার ভীষণ যন্ত্রণা হয়। কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো?
তখন মেহের নিশ্চুপ হয়ে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। উত্তর অপেক্ষায় শোয়াইব খান পুনরায় বললেন,
— তুমি বুঝি সমুদ্রের রক্তাক্ত দেহ দেখে ভয় পেয়েছো?

মুহূর্তেই মেহের শোয়াইব খানের মুখশ্রীতে সজল চোখের দৃষ্টিপাত ফেললো। অতঃপর ঠোঁট কামড়ে ধরে ক্রন্দন থামানোর প্রয়াস করলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে কান্না রত কন্ঠ অস্কুটস্বরে তুতলে তুতলে বলে উঠলো,
— স্যা র উননার কিছু হবেএ না তো? আমি কিন্তু উনাকে ছড়া এক মুহূর্তেই থাকতে পারব। আমার যে ভীষণ ভয় হচ্ছে। আমি একটিবার উনাকে দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে যাবেন তো!
মেয়ের প্রত্যুত্তরে শোয়াইব খান মুচকি হেসে বুকে পাথর চেপে বলে উঠলেন,

— টাস্ট মি আম্মু! সমুদ্রের কিছু হবে না। কিন্তু তুমি এভাবে কান্না করলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। এভাবে কেঁদো না মামুনি। এভাবে কী কেউ কাঁদে? কান্না থামাও বলছি।
মেহের ফির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অস্কুটস্বরে বলে উঠলো,

— আমার যে খুবই কষ্ট হচ্ছে স্যার! আমার চোখের পাতায় বারবার তার রক্ত ভরপুর শরীর ভেসে ওঠছে। ক্রমশ আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আপনি তো জানেন না, উনি ব্যতীত এই পৃথিবীতে আমার যে আর কোন আপন মানুষ নেই। উনি যে আমার আশ্রয় স্থল, আমার সুখে থাকার একমাত্র রহস্য, আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমার শ্বসন ক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ যে তাকে ঘিরেই।

আমি যে তাকে হীনা বেঁচে থাকাতে পারবো না। সে তো আমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। জানেন স্যার আমার খুব কষ্ট হচ্ছে একদম হাঁপানি রোগীদের মতো।
কথাগুলো বলেই ব্যাপক পরিমাণে হেচকি তুলতে লাগলো মেহের। অতঃপর শোয়াইব খানের হাত খামচে ধরে পূর্বের ন্যায় বলে লাগলো,

— বিশ্বাস করুন, উনার কষ্ট আমি সইতে পারছি না। জানেন উনার সাদা শার্টটা একদম লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছিল! আচ্ছা উনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? স্যার বলুন তো গুলিটা কেন আমার দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে রক্তাক্ত দেয় নি? তখন কেন উনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন? উনি কী বুঝেন না উনার ব্যাথায় যে আমি ব্যথাতুর হয়ে উঠছি প্রতিনিয়ত!
শোয়াইব খান মেয়ের পরিস্থিতি দেখে অবাকের সপ্তম আকাশে! তিনি সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের মাথা নিজ বুকের মাঝে আবদ্ধ করে বলে উঠলেন,

— কিছু হবে না সমুদ্রের। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো মা। কিন্তু এভাবে বলো না। তুমিই যে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। তুমি মরে গেলে আমি বাঁচব কী করে বলো তো! তাই আর কখনোই এমন পচা কথা বলবে না। কেমন?
মেয়েটার কান অবধি শোয়াইব খানের বাগযন্ত্র হতে নির্গত অভিমান বাক্য গুলো পৌঁছিয়েছে কী সন্দেহ!

মেয়েটা শোয়াইব খানের বুকের উপর মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অনবরত! শুধু তাই হয় বারংবার আর্তনাদ তুলছে শেয়াইব খানকে জাপটে ধরে! মেয়েটার কেঁপে কেঁপে উঠা আর্তনাদ সহ্য করতে পারছে না তিনি। মিনিট পাঁচেক পরেই মেয়েটা শোয়াইব খানের বুকে অচেতন হয়ে ঢলে পড়ল। মেহেরের এমন পরিস্থিতির দেখে ইতিমধ্যে তার চোখ জোড়া সহজ হয়ে উঠেছে। তার অন্তরালে অতিরিক্ত জটিল প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটেছে।

মেয়েটা যে সমুদ্র হীনা কয়েক ঘণ্টায় অবরুদ্ধে হাঁফিয়ে উঠেছে। বন্দি খাঁচার পাখির ন্যায় সমুদ্র হীনা বেঁচে থাকার প্রতি অনিহা সৃষ্টি হয়েছে মেহেরের হৃদয় মনে! শোয়াইব খান গভীর প্রত্যাশায় ছিলেন মেয়েটাকে সমুদ্রের থেকে বিচ্ছেদ করতে। কিন্তু মেয়েটা যে সমুদ্র নামক প্রাণীর প্রতি আবেগে আপ্লুত। সমুদ্রের প্রতি সৃষ্টি কি মেহেরের বয়সের দোষ! নাকি পবিত্র বন্ধনের মায়াজাল?

কই কল্পনার সঙ্গেও তো শোয়াইব খান পবিত্র বন্ধনে গেঁথে ছিলো। সেও তো কল্পনাকে ছুঁয়ে দুজন একসঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু সেই মায়াজাল তো শোয়াইব খানের বুকে বিন্দু পরিমাণের অনুশোচনা সৃষ্টি করে নি। সে কল্পনা হীনা দিব্বি প্রশান্তিতে সময় অতিবাহিত করে এসেছে প্রতিনিয়ত। কই তার মনে তো কোনকালেই কোন অনুভূতি উদ্ভট হয় নি অর্ধাঙ্গিনীকে ঘিরে। কিন্তু তার মেয়েটা সম্পূর্ণ বিপরীত। মেহেরের অনুভূতি গুলো তো মিথ্যা নয়, বিষয়টা মেহেরের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে! এ যেন কৈশোরের দোষ নয়। মেহেরের হৃদয় গহীনে উৎপত্ত অদ্ভুত এক অনুভূতি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! মেয়েটা যে গভীর হতে গভীরতর ভাবে সমুদ্র নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে! যে অনুভূতি দমিয়ে রাখতে শুধু মাত্র তার সমুদ্রকে প্রয়োজন। শুধু মাত্র সমুদ্রকে!

ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছঁই ছয়। এই অবেলায় ইসরাত বেগমের কোলে মাথা রেখে চোখ যুগল বুঁজে শুয়ে রয়েছে জারা। ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট মেয়েটার মুখশ্রীতে! নিজ বিক্ষিপ্ত মনকে ব্যস্ত রাখার প্রয়াসে কয়েক দিন যাবত টিউশনি করাতে আরম্ভ করেছে সে। পাশের ফ্লাটের বসবাসরত তৃতীয় শ্রেণির দুটো ছেলেকে পড়াচ্ছে সে। বাচ্চা দুটির সঙ্গে সময় অবিবাহিত করে বেশ আনন্দিত জারা।

বর্ষণকে মস্তিষ্ক হতে চিরন্তন মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত অটল সে। বর্তমানে ইয়াদ নামক ব্যাক্তিকে দেখার অভিপ্রায় জেগেছে তার হৃদয় গহীনে। তার চোখ জোড়া ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে একটি বারের জন্য ইয়াদকে দেখাতে। ইতিপূর্বে জারার সঙ্গে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। দিন দুয়েক পূর্বে কোন এক অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে শত বারের অধিক তার মোবাইল ফোনে কল করেছিল! অজ্ঞাত ব্যক্তি বললে ভুল হবে জারার নিকট সেই ব্যক্তিটা বর্ষণ ছাড়া অন্য কেউ নয়! বারংবার কল করাতে একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ফোন বন্ধ করে দেই জারা। দুই দিন যাবত ফোন আর চালু করার প্রয়োজন বোধ করে নি সে।

কিন্তু ইসরাত বেগমের প্রতীক্ষার কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। বর্তমানে বন্ধ মুঠোফোন হাতে নিয়ে চালু করার উদ্দেশ্যে তা দু হাতের মধ্য বতী নিয়েছে জারা। আজ হয়তো খোলা হতো না। কিন্তু ইসরাত বেগমের বিষাদগ্রস্ত হৃদয় পুলকিত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নিয়েছে সে। ইসরাত বেগম কয়েক দিন যাবত তার বড়ো ছেলে সমুদ্রের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করতে পাগল হয়ে উঠেছেন! ছেলের জন্যে আজ নাকি তার হৃদয় অশান্ত হয়ে উঠেছে। বেকে বসছেন তিনি। আজ যে করেই হোক দু জন ছেলের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করেই ছাড়বেন। বিশেষ করে সমুদ্রের জন্য আজ তার অন্তরাল তোলপাড় আরম্ভ করে দিয়েছে! সমুদ্রের কথা চিন্তা করে বারংবার তার বুক কেঁপে উঠছেন তিনি। অদ্ভুত অস্থিরতা তাকে ঘিরে ধরছে। একেই বোধ হয় নাড়ের টান বলে। সন্তানের বিপদের আভাস পূর্বে থেকেই যায়ের মনে সজাগ হয়ে উঠে।

ফোন খুলতেই জারার লক্ষ্যে হলো ইয়াদ নামক ব্যক্তিটা বারবার কল করছে। এমনকি মিনিট পাঁচেক পূর্বে ও ইয়াদের নম্বর থেকে কল এসেছি। বিয়ের এতোদিন অতিক্রম হয়েছে কিন্তু এখন অবধি ইয়াদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয়নি জারা! তৎক্ষণাৎ পুনরায় ইয়াদের নম্বর থেকে কল এলো। ইতিমধ্যে জারার হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগ নিয়েছে! জারার পরিস্থিতি খানিকটা আচ করতে সক্ষম ইসরাত বেগম। অতঃপর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করলো জারা। মূহুর্তেই বিপরীত পার্শ্ববর্তী হতে ভেসে এক চিনা পরিচিত কন্ঠস্বর,

— জেবু!
লহমায় বিদ্যুৎ গতিতে চমকে উঠলো জারা। এই জেবু নামটা শুনে জারার অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুন হারে! কিন্তু জারা কিছু বুঝে উঠার পূর্বে ইয়াদ ফির বলে উঠলো,
— জেবু ভয়ের কিছু নেই! শোন, সমুদ্র ভাইয়া হাসপাতালে ভর্তি। ভাইয়ার গায়ে গুলি লেগেছে! তাই ভীষণ অসুস্থ সে। জানি না আমার ভাইয়াটা কেমন আছে?

কথাগুলো বলেই দলা পাকিয়ে কান্না আসলো ইয়াদের। শত প্রচেষ্টা করে নিজেকে ধাতস্ত রেখে ফির বলে উঠলো,
— আম্মু যেন বিষয়টা জানতে না পারে। তোমাকে একটা বড় দায়িত্ব দিচ্ছি, জেবু। খানিকের মধ্যে এপোটমেন্টের সামনে একটা গাড়ি আসবে। তুমি দেরি না করে আম্মুকে নিয়ে অতি জলদি ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে। আর হ্যাঁ, আম্মুকে ভুলেও ভাইয়ার কথাটা বলবে না।

কথাগুলো জারার কণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই স্তব্ধ হয়ে উঠলো সে। তৎক্ষণাৎ ছোট বোনের কথা ভেবেই অজানা আশঙ্কায় তার বুকটা কেঁপে উঠছে। জারা ইয়াদের প্রত্যুত্তরে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
— মেহের কোথায়? ও ঠিক আছে তো?
ইয়াদ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো,

— উহু! ভাইয়ার কলিগ ফোন দিয়েছিলো বলেছে মেহের নাকি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তুমি চিন্তা করো না। আমি এক্ষুনি পৌঁছে যাবো। তুমি শুধু মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে রেডি করো।
বলেই সেকেন্ড পাঁচেক নিরব থেকে ইয়ার বলে উঠলো,
— আই আম সরি। প্লিজ, জেবু আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করো।

বাক্যগুলো বলেই গটগট করে ইয়াদ ফোন কেটে দিলো। অনাকাঙ্খিত এমন ঘটনায় বেশ চিন্তিত জারা। সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে যে ইয়াদের মুখ হতে নির্গত জেবু ডাকটাও লক্ষ্য করেনি সে। লহমায় জারা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালো। ইশরাত বেগম অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এবং ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে কথা বলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ জারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে মিন মিন কন্ঠে মিথ্যা বুঝ দিলো ইসরাত বেগমকে,

— আম্মু তুমি চিন্তা করো না। মেহেরের কিছু হয় নি। সমুদ্র ভাইয়া ফোন করেছিল।
তাও যেন ইসরাত বেগম শান্ত হবার নাম নিচ্ছেন না। এক পর্যায়ে জারা তাকে শান্ত করতে ছলনাময়ী তীর্যক হাসির রেখা টেনে বলে উঠলো,

— তোমার বড়ো বউ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তাই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তুমি ও দেখেছো মেয়েটা খেতে চাই না। তাছাড়া জান না মা আমি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি! মনে হচ্ছে তোমার প্রত্যাশা পূরণ হবে খুবই শীঘ্রই। ভাইয়া বলেছে আমরা যেন আজ রওনা দেই। তার ফেন্ডের গাড়ির পাঠিয়ে দিবেন খানিকের মধ্যে। তাড়াতাড়ি রেডি হও মেহের থুক্কু বড়ো ভাবিকে দেখতে যাবো। আমি খুবই এক্সাইটেড!

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫১

জারার কথা শুনে মুচকি হাসির স্পষ্ট ফুটে উঠেলো ইসরাত বেগমের ঠোঁটের কোণে। জারা কথায় ব্যহিক আনন্দিত হলেও অন্তর থেকে আনন্দিত হতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। তার ভেতরে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার আশঙ্কার আবির্ভাব ঘটেছে। সমুদ্রের জন্য তার বুকের ভেতর দুমড়ে মোচড়ে উঠছে। ছেলেটাকে চিরন্তন হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে তার! অন্তরাল তাকে বলছে, ছেলের মুখ হতে নির্গত প্রশান্তি ময় ‘মা’ ডাকটা আর কোনদিনই শুনতে পাবেন না তিনি।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৩