তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫১

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫১
Lutful Mehijabin (লেখা)

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই নয়টা। উন্মুক্ত বেলকনিত ভেদ করে একরাশ শুভ্র, স্বচ্ছ আলোক রশ্মির আগমন ঘটেছে মেহেরের ঘরে। সূর্যের প্রখর তাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অবস্থায় উষ্ণ চাদরে প্রলেপে ঢেকে রয়েছে মেহেরের আপাদমস্তক! ইতিমধ্যে গরমে মেহেরের নিদ্রা হাল্ক হয়ে এসেছে। একপর্যায়ে উষ্ণ চাদরে মুড়ি হতে নিজেকে উন্মুক্ত করে নিলো সে।

অতঃপর ধীর গতিতে চোখ জোড়া খোলার প্রয়াস চালানো। সেকেন্ড পাঁচেক বাদে চোখ যুগল উন্মুক্ত করে নড়েচড়ে উঠলো মেহের। অবশেষে ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠে বসতে প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হলো। মুহুর্তেই সে আন্দাজ করলো তার বা হাতটা বেশ অবস হয়ে এসেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহের অনুভব করতে পারছেনা তার বা হাত কোথায় অবস্থান করছে! তৎক্ষণাৎ মেহের হাতের বাহু অনুসরণ করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। সঙ্গে সঙ্গে মেহের স্তম্ভিত হয়ে উঠলো। কারন তার হাতের কব্জি অন্য কারো দখলে! মেহেরের হাত আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সমুদ্র।

কাল রাতে মেহেরকে ফেলে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ঘন্টা তিনেক শাওয়ারের নিচে ডুবে ছিলো সমুদ্র। প্রিয় মানুষটিকে হারানোর ভয় মারাত্মক ভাবে তাকে আহত করেছে। ক্রমশ উন্মাদ পাগলে পরিণত হচ্ছে সে। কাল রাতে নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতি দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। সমুদ্র এতোটাই নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছিল যে, সে কাল রাতে মেহেরের স্ব শরীরের উপস্থিতি অনুভব করতে পারি নি। ভীষণ মাথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল সমুদ্র। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে কয়েক ঘণ্টা অবিরাম শাওয়ার নিয়েছে।

নিজ হাতের নাজেহাল অবস্থা টের পেয়ে মেহের হাতটা সরিয়ে নেবার প্রয়াস চালালো। তৎক্ষণাৎ সমুদ্রের মুখশ্রীতে তার অবাধ্য চোখ জোড়া স্থির হয়ে এলো। কাল রাতের বেলা সমুদ্রের বলা প্রতিটি বাক্য মেহেরের কানে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। মুহুর্তেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। শুধু লজ্জা নয় সমুদ্রের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে তার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। এক অদ্ভুত অনুভুতির স্বীকার হলো সে।

কষ্ট, বিষাদ, আনন্দ, ভয়, লজ্জা সংমিশ্রণ তাকে ঘিরে ধরেছে! এক চিলতে আনন্দের মধ্যে কোথায় থেকে যেন একরাশ জল এসে রাজত্ব করলো তার চোখ যুগলে। তৎক্ষণাৎ মেহেরের ভারি নেত্র পল্লব ভিজিয়ে কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য বিসর্জন হলও ধরনীর বুকে । মেহের কি করবে, কীভাবে সমুদ্রের অস্থিরতা দূর করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারল না। দিশেহারা হয়ে সমুদ্রের মুখশ্রীতে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিক্ষেপ চোখ জল বিসর্জন দিতে লাগল কাল রাতের ন্যায় বিরতিহীন !

হঠাৎ স্বল নড়েচড়ে উঠলো সমুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের হাতটা মুক্তি পেলো। মুহূর্তেই সমুদ্রের তিক্ত চোখের দৃষ্টি ভেসে উঠলো মেহেরের নয়নে। সমুদ্র হাত ছাড়ে দিয়েই ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়াল।‌ মেহেরের চোখ জল লক্ষ্য করেও মুখ দিয়ে টু শব্দ ও নির্গত করলো না সমুদ্র। তড়িঘড়ি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে মেহেরের দিকে কঠো দৃষ্টিপাত ফেললো। আজ দিনের আলোয় তার লক্ষ্য হলো তার পুচকির চোখে কোন ভয় নেই।‌ শুধু মাত্র জলে ছলছল করছে মেয়েটা সম্পূর্ণ গাল যুগলে। সমুদ্র মেহেরের কান্নার বস্তুত কারণ খুঁজে পেলো না! মেহেরের প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে দ্রুত রুম ত্যাগ করতে পা জোড়া বাড়াল সে।

— এই যে শুনছেন?
মেহেরের কম্পনিত কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের পা জোড়া আপনা আপনি থেমে গেলো। স্তব্ধ হয়ে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়লো সে। দু পকেট হাত যুগল রেখে ভাববিলাশীন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মেহেরের পরবর্তী বানী কর্ণপাত করতে।

সমুদ্রকে স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো মেহের। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, হাত ঘড়ি পরিহিত সুদর্শন পুরুষটার মুখশ্রীতে নিত্যদিনের ন্যায় গম্ভীর্য স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! রাতে শাওয়ার নেওয়ার রেশ এখনো অবধি কেটে উঠে নি। ফলে সমুদ্রের ছোট ছোট চুলগুলো সীমান্তে এসে এলোমেলো হয়ে পড়েছে। নিত্যদিনের চেয়েও সমুদ্রকে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় লাগছে মেহেরের নিকটবর্তী।

মুহুর্তেই রাতের ঘটনা ভেবে মেহেরের হৃদয় মন বিষন্ন হয়ে উঠলো। সে অবাক না হয়ে পাড়ল না। যে লোকটা রাতের বেলা উম্মাদ হয়ে উঠেছিল! গভীর রাতে যে লোকটা পরিপাটি হয়ে তার রুমে এসে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল! যে কিনা একটু আগ অবধি ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখে তার হাত যুগল আষ্টেপৃষ্টে ধরে ঘুমিয়ে ছিলো। সে লোকটা এখন কিনা তাকে দেখেও চিনতে পারছে না! অতঃপর মেহের নিজেকে শক্ত রেখে ফির বলে উঠলো,

— রাতে খেয়েছেন?
মেহেরের অধিকার মিশ্রিত বাক্য সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছতে তার ভ্রূ জোড়া কুঁচকে এলো। মুহূর্তেই কর্কশ কন্ঠ প্রত্যুত্তর করলো,
— আমার কথাও বুঝি আপনার স্মরণ হয়! আপনি তো সারাদিন আপানাতে মত্ত থাকেন।

সমুদ্রের ‘আপনি’ সম্বোধন যেন মেহেরের হৃদয়কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে উঠলো। ইতিপূর্বে এই আপনি সম্বোধন তার হৃদয়ে সুপ্ত অনুভূতি জাগ্রত করে তুলেছিল। যতবার সমুদ্র তাকে আপনি বলে সম্বোধন করেছে ঠিক ততোবার শীতল হাওয়াই ভরে উঠেছিল মেহেরের অন্তরাল। তাহলে এখন সহ্য করতে পারছে না কেন? মেহেরের অগোচরে তার চোখ জোড়া হতে অবিরাম বর্ষণ ঝরছে। চোখের জল উপলব্ধি করতে ব্যর্থ সে! মেহের দু হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো।পুনরায় বলে উঠলো,

— আপনি এমন কেন, হুম? কেন নিজের খেয়াল রাখতে চান না?
মেহেরের কান্নারত কন্ঠস্বর পেয়ে সমুদ্র থতমত হয়ে উঠলো। আজব তো! মেয়েটা কাঁদছে কেন? সে তো কান্না করার মতো কোন কথা বলে নি। মেহেরের কান্নার পেছনের রহস্য আন্দাজ করতে ব্যর্থ হলো সে। তৎক্ষণাৎ তার স্মরণ হলো রাতের ঘটনা। রাতে ভীষণ মাথা ব্যথা আক্রমণ করেছিল তাকে। শোয়াইব খাবার পদক্ষেপ বুঝে উঠতে পারছে না সমুদ্র। এতে বেশ দুশ্চিন্তা গ্রস্ত সে। মেহের যে কাল রাতে স্ব শরীরের বেলকনিতে উপস্থিত হয়েছিল তা এখন অবধি সমুদ্রের ধারণার বাইরে। সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

— আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনি শুধু মাত্র চিরকাল আমার সঙ্গে সু্ঃখ, দুঃখ নিবারণের জন্যে প্রস্তুত হোন। এখনো অবধি অনেক সময় বাকি।
বলেই সমুদ্র মেহেরের দিকে ফিরলো। পা জোড়া ধাবিত করে মেহেরের নিকটবর্তী এসে দাঁড়ালো। পকেট থেকে বা হাত বের করে মেহেরের মাথায় আলতো করে ছুয়ে ম্লান হাসির সহিত বলল,

— আপনি যদি আমাকে থেকে দূরে যাবার কথা মস্তিষ্কে এনে থাকেন। তাহলে একটা কথা শুনে রাখুন, আপনি আমার থেকে দূরে গিয়ে ও শান্তি পাবেন না। নয়ন তৃষ্ণায় ছটফট করবেন আমাকে দেখার জন্য। কিন্তু মনে রাখবেন ম্যাম আপনি একটিবার আমার থেকে দূরে সরে দেখুন। আপনি দূরে যাবার পূর্বেই আমি কোন এক নির্জনে হারিয়ে যাব। তখন চেষ্টা করেও আমাকে খুঁজে পাবেন না। আপনি দূরে যাওয়া পূর্বে আপনার সমুদ্র অজানা এক অজানা রাজ্যে পারি জমাবে।

কথাগুলো বলেই রুম থেকে প্রস্থান করলো সমুদ্র। মেহের বাক্যগুলোর অর্থ খুঁজে পেলো না। কোন সারমর্ম দেখা দিলো না তার মস্তিষ্ক। শুধু মাত্র সমুদ্রকে হারিয়ে ফেলার এক অস্থিরতা হানা দিলো তার অন্তরে।

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই বারো। ক্লাসের মধ্যে উদাসীন হয়ে বসে রয়েছে মেহের। আজ দিশানি এবং তিতাস কেউ আছে নি। এমনকি সমুদ্রের পিরিয়ড অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কিন্তু সমুদ্র ক্লাস নিতে আসে নি। এতে করে বেশ ব্যথিত সে। তাছাড়া স্টুডেন্টরা বলা বলি করছে আজ নাকি সমুদ্র স্যার আসেননি। কিন্তু সমুদ্র সকালে মেহেরকে খাইয়ে দাইয়ে স্কুলে নিয়ে এসেছিল। বর্তমানে মেহের চিন্তা করছে, সমুদ্র কি তাকে স্কুল থেকে নিতে আসবে! কারণ আজ স্কুল কর্তৃপক্ষ তাড়াতাড়ি ছুটি ঘোষণা দিয়েছে।

স্কুল ছুটি দিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। পুরো স্কুল জুড়ে শুলশান নিরবতা। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে মেহের। তার পাশ্ববর্তী স্কুলের কয়েক জন স্টাফ শক্ত চাহনি নিক্ষেপ করে বসে রয়েছে। বিষয়টা বেশ সন্দেহ জনক লাগছে মেহেরের নিকট! পুরো কক্ষ জুড়ে মেহের সহ সাত জন মানুষের উপস্থিত। সবাই স্তব্ধতা পালন করতে ব্যস্ত। এ পরিস্থিতিতে মেহেরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। তার মুখশ্রীতে ভীত ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে!

বারংবার হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করছে মেহের। প্রায় আধ ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো সমুদ্রের আসার নাম গন্ধ নেই। মেহেরের হৃদয় মন অজানা আশঙ্কার আবির্ভাব ঘটেছে। বারবার প্রধান শিক্ষকের দিকে লক্ষ্য করছে সে। স্কুল ছুটির পর সমুদ্র নাকি অফিস রুমে তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে।

এই প্রস্তাব দিয়ে মেহেরকে টিচার্স রুমে নিয়ে এসেছিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক জামাল স্যার। একপ্রকার জোর করে শিক্ষকের মুখের সামনে বসে রয়েছে মেহের। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হওয়ার নাই নিচ্ছে না। তাই মেহের মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো একাই বাসার চলে যাবে। দরকার পড়লে বাসার ড্রোরের সামনে বসে থাকবে। কিন্তু এখানে থাকতে নারাজ! সিদ্ধান্ত অনুসারে ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে নিম্ন কন্ঠে স্যারের উদ্দেশ্যে মেহের বলে উঠলো,

— স্যার, আমি একেই যেতে পারবো। আপনি ফোন করে সমুদ্র স্যারকে একটু বলে দিবেন প্লিজ। আমি আসি স্যার।
কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো মেহের। পা জোড়া দু কদম এগিয়ে নিতেই, জামাল সাহেবের কর্কশ ধ্বনিতে স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। তৎক্ষণাৎ জামাল সাহেব মেহেরের নিকটবর্তী এসে পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করে মেহেরের কপালে ঠেকিয়ে কর্কশ উঠলো,

— এই মেয়ে, তোকে কি আমি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি। কি ভাবছিস তুই, তোকে আমি স্নেহ মমতা করে এখানে নিয়ে এসেছি?
জামাল সাহেবের এমন আচরণে চমকে উঠেছে মেহেরের। আচমকা কপালে শক্ত পদার্থের ছোঁয়া পেয়ে তার চোখ জোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এসেছে। তার সঙ্গে কি ঘটতে যাচ্ছে তা আন্দাজ করতে প্রায় মিনিট এক সময় অতিবাহিত হয়েছে! স্যারের পরিস্থিতি বোধগম্য করতে ব্যর্থ সে। প্রিয় একজন স‌্যারের নিকট হতে এমন ব্যবহারে পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে মেহের। অনুভব করছে তার কপালে বন্দুক ঠেকানো! ফলে থরথর করে কাঁপছে সে। আপ্রাণ চেষ্টা ফলে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মেহের কাঁপা কন্ঠে বলল,

— স্যার আপনি এমন বিহেভ করছেন কেন? আমি কি কোন ভুল করেছি?
মেহেরের কম্পমান কন্ঠেস্বর পেয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন জামাল সাহেব। মুহুর্তেই তার হাসির ঝংকার কক্ষ জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো। হাস্যরত অবস্থায় এক হাত‌ দ্বারা মেহেরের কপালে রিভালবার ঠেকিয়ে অন্য হাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো সে। কাউকে কল দিতেই এক সেকেন্ড কেউ ফোন রিসিভ করলো। অতঃপর ফোন লাউড স্পিকারে রেখে জামাল সাহেব বলতে আরম্ভ করলো,

— তুমি তো কোন অন্যায় করো নি মেহের বুড়ি। অন্যায় তো করেছে তোমার হাজব্যান্ড অর্থাৎ তোমার সমুদ্র স্যার।
আকস্মিক সমুদ্রের নামটা মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই তার চোখ জোড়া জলে ছলছল করে উঠলো। অজানা আশঙ্কা দ্বিগুণ হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে ঘিরে ধরলো তাকে। শুকনো ঢোক গিলে স্তব্ধ হয়ে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে তা বোধগম্য করতে প্রয়াস করলো।

জামাল সাহেব মেহেরের মুখশ্রীতে পৈশাচিক দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে ফির বলতে লাগলো,
— আরে বুড়ি। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? চিন্তা করো না তোমার স্বামী সমুদ্র খুব জলদি তোমাকে নিতে আসবে। তুমি শুধু অপেক্ষা করো।

বলেই পৈশাচিক আনন্দে ফেটে পড়লো জামাল সাহেব। লহমায় ফোনের বিপরীত পার্শ্ব হতে ভেসে উঠলো পুরুষালী ভারী কন্ঠস্বর। সমুদ্র উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো,

— বিশ্বাস কর তোর জন্যে, আমার জান যদি একটু আঘাত প্রাপ্ত হয় রে জামাল। টাস্ট মি আই কিল্ড ইউ! তুই জানিস তুই কত্ত বড়ো অন্যায় করে ফেলেছিস? এই কাজ মস্তিষ্ক আনার পূর্বে তোর একবার ভেবে নেওয়া উচিত ছিলো তোর পরিস্থিতি কি হতে পারে। তুই তো জানিস না তুই কি নিয়ে খেলায় মত্ত হয়েছিস! তুই আবরার সমুদ্রের জান নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছিস। সময় থাকতে ভদ্র হয়ে যা।

সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে জামাল সাহেব দ্বিগুণ ক্রোধে ফেটে পড়লো। মেহেরের কপালে রিভলবারটা শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো। অতঃপর দাঁত দাঁত চেপে বলে উঠলো,

— দেখ সমুদ্র বেশি কথা বলবি না। তোর মুখে এমন কথা একদমই বেমানান। তুই তো এক নম্বরের বিশ্বাস ঘাতক। তুই আমাকে ধোঁকা দিয়েছিস। শিক্ষক হিসেবে আমার বিদ্যালয়ে জয়েন্ট করে অভিনয় করে গিয়েছিস তিন মাস। আমার তো মনে হয় তোর সিআইডি অফিসার না হয়ে অভিনেত্রী হিসেবে নিযুক্ত হওয়া উচিত ছিলো। সেদিন নিরবের অনুষ্ঠানে গেলে জানতে পারতাম না তুই গোয়েন্দা! শুধু তাই নয় তোর বউ যে আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাও জানতে পারতাম না।
বলেই পরপর দুটো ঢোক চেপে জামাল সাহেব বলতে লাগলো,

— এসব কথা বাদ দে সমুদ্র। আমি যা বলছি তাই কর। দ্রুত পেইনড্রাইভ নিয়ে আমার কাছে আয়। নয়তো তোর জানকে আমি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের জন্য বিদায় নিতে সাহায্য করবো। নাও জলদি কর।

মিনিট দশের মধ্যে অফিস রুমের কক্ষে হাঁফাতে হাঁফাতে উপস্থিত হলো সমুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে ছদ্মবেশী স্কুলের স্টাফ গুলো প্রত্যেকে রিভলভার বের করে সমুদ্রের দিকে তাক করলো। সমুদ্র প্রত্যেকে উপেক্ষা করে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত ফেললো। মেয়েটা ভয়ে চুপসে গিয়েছে। মেহেরের মুখশীতে গভীর দৃষ্টি আকর্ষন করতেই সমুদ্রের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। নিজের প্রেয়সীকে হারানোর এক ভয়ঙ্কর ভয় তার হৃদয় মনে জাগ্রত হয়ে উঠলো।

অন্যদিকে সমুদ্রের অসহায় দৃষ্টি লক্ষ্য করতে কু ডেকে উঠলো মেহেরের অন্তরাল! ইতিমধ্যে তার বক্ষ পিন্জরের হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে। ভয়ে তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে! সমুদ্রকে দেখা মাত্রই তার চোখ বেয়ে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। বিশেষ করে লোকগুলো যখন সমুদ্রের দিক রিভলভার তাক অরেছে ঠাক তার পর থেকেই মেহের ভেঙে পড়েছে। অতঃপর কান্না রত অবস্থায় মেহের সমুদ্রকে উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— আমি বাসায় যাব। আমার বড্ড ভয় করছে। আমাকে বাসায় নিয়ে চলুন।
মেহেরে কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্রে ম্লান হাসির সহিত বলে উঠলো,
— দূর পাগলী! ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি তো,,,
সমুদ্রের কথার মধ্যে জামেল সাহেব বলে উঠলো,

— তোদের প্রেম আলাপ পরে। আগে আমার পেইনড্রাইভ দে। নয়তো তোর বউকে তোর সামনে ছটফট করে মারবো। তোর জানের রক্তে রঞ্জিত করবো তোকে।
জামাল সাহেবের কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্রের একটা ছোট পেইন ড্রাইড জামেল সাহেবের সামনে ধরলো। ফির কাতার কন্ঠে বলে উঠলো,

— আগে মেহেরকে ছেড়ে দে। ওর কপাল থেকে গান সরা।
তৎক্ষণাৎ মেহেরের কপাল হতে রিভলভার সরিয়ে সমুদ্রের নিকটবর্তী হাজির হলো জামাল সাহেব। এক গাল হেসে সমুদ্রের হাত হতে পেইনড্রইভ নেওয়া জন্য হাত জোড়া প্রসারিত করতেই গুলির বর্ষণে কেঁপে উঠলো ধরনী! লহমায় মেহের কানে হাত দিয়ে সমুদ্রের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। ইতিমধ্যে সমুদ্রের টিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব যুদ্ধে মেতে উঠেছে জামেল সাহেব এবং তার দলবল! সমুদ্র রিক্স নিয়ে পুরো টিম সহ উপস্থিত হয়েছে। যা জামাল সাহেবের নিকট অজানা ছিলো।

চারপাশে গুলির শব্দে ভরে উঠেছে। সমুদ্র রিভলভার হাতে করে গুলি বর্ষণের সহিত মেহেরের উপর লক্ষ্য রাখলো। হঠাৎ মেহেরের অবস্থান পরিলক্ষিত করে সমুদ্র বলে উঠলো,
— হেই সস্টুপিড, এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন! বাইরে যাও। আই সেইড গেট আউট। প্লিজ পুচকি।
সমুদ্রের কথায় প্রত্যুত্তরে মেহের মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমি আপনাকে ছাড়া বের হবো না।

মেহেরের কথা শুনে মাথার চুলগুলো স্বল্প টেনে ধরলো সমুদ্র। কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে। মুহূর্তেই রিভলভার পকেটে ঢুকিয়ে জামাল সাহেবের দৃষ্টির অগোচরে মেহেরের নিকটবর্তী হাজির হলো। দ্রুত মেহেরের হাত আলতো স্পর্শে টেনে ধরলো। অবশেষে অতি দ্রুত মেহেরের হাত মুঠো বন্ধি করে পা জোড়া ধাবিত করলো সদর দরজার উদ্দেশ্য।

কিন্তু বিষয়টা জামাল সাহেবের চক্ষু এড়ালো না। কিছুদূর এগুতেই জামাল সাহেব চিৎকার করে বলে উঠলো,
— সমুদ্র স্টপ। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে। আমি মরলে মরবো তাও পৃথিবীতে তোর সবচাইতে দুর্বল স্থানে আঘাত না করে আমি কিছুতেই মরবো না।

বলেই জামাল সাহেব মেহেরের উদ্দেশ্য গুলি নিক্ষেপ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। গুলির পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পেরে তৎক্ষণাৎ মেহেরকে নিজের বুকের আড়ালে মেহেরকে আবদ্ধ করে ফেললো সমুদ্র।
সঙ্গে সঙ্গে একটা সুক্ষ্ম গুলি সমুদ্রের শার্ট ভেদ করে ছুঁয়ে দিলো তার দেহ। মুহূর্তেই সমুদ্রের শুভ্র, স্বচ্ছ শার্ট রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠলো। সমুদ্র তখনও স্থির দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে। রক্ত ভেজা সাদা শার্ট খাঁমচে ধরে সমুদ্র ব্যথিত কন্ঠে বলল,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫০

— ভয় পেয় না পুচকি। আই,, ম,,, ওকে,,
সমুদ্রের কন্ঠস্বর শুনেই মেহেরের হৃদয় গহীন ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠলো। লোকটা প্রতিটি বাক্যে ব্যথাতুর ভাব স্পষ্ট! মেহের সইতে পারলো সমুদ্ররে বলা শব্দগুচ্ছ। লোকটা বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে? কিৎক্ষণে সমুদ্রের রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকাতেই মেহেরের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। আকস্মিক এমন পরিস্থিতি স্তব্ধ হয়ে উঠেছে পরিবেশ। সমুদ্রের টিমের সবাই হতবম্ব হয়ে নিজ নিজ অবস্থান দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু মাত্র মেহের কান্না বেগ বৃদ্ধি করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সমুদ্রের উপর।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫২