তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৫

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৫
Lutful Mehijabin (লেখা)

ঘড়ির কাঁটা রাত্রি বারোর প্রহরে গিয়ে ঠেকেছে।
রাত্রির আঁধারে আবৃত রয়েছে প্রকৃতি। কিঞ্চিৎ গরমে হাঁফিয়ে উঠেছে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ কৃত ব্যাক্তি গন। ইতিমধ্যে দীর্ঘ ছয় ঘন্টা জার্নি করে ঢাকায় পৌঁছেছেন জারা এবং ইসরাত বেগম। বর্তমানে ২১৩ নম্বর কেবিন হতে গুমোট ক্রন্দনের আওয়াজ ভেসে আসছে। ছেলে কে আহত অবস্থায় সহ্য করতে না পেরে ইসরাত বেগমের ক্রন্দনের যেন থামার নয়! মায়ের কান্না থামাতে ব্যর্থ সমুদ্র এবং বাকি সবাই।

ইসরাত বেগমের কান্না দেখে রীতিমতো মেহেরের চোখ যুগল দুর্বোধ্য রহস্যে ভরে উঠেছে। এই বুঝি মেয়েটা কখন যেন স্বামী শোকে কেঁদে আকুল হয়ে উঠবে! তাদের সান্নিধ্যে অবস্থান রত জারার চোখ জোড়া সজল হয়ে এসেছে। মেয়েটা হৃদয় বুঝি পাষাণভার! বর্ষণের স্মৃতি মুছে ফেলতে নিজেকে পাথরে রূপান্তরিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে জারা। সত্যিই অনুভূতি হীন নির্বাক হয়ে গেছে মেয়েটা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিজের অশান্ত, বিষাদগ্রস্ত, পীড়িত হৃদয় গহীন শান্ত রাখতে বেছে নিয়েছে শান্তির শহর। যার সুবাদে সে একজন বইয়ের চাষি হয়ে উঠে। দিবা, রাত্রি প্রতিটি প্রহর নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে শুধু করে বইয়ের পাতায়। পৃথিবীতে বই যে একমাত্র নিশ্বার্থ সঙ্গী তা জারার চেয়ে ভালো কেউ যানে না। ডিপরেশন থেকে থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, নিজের উল্লসিত, পুলকিত রাখার একমাত্র অবলম্বন বইয়ের চাষ।

কিন্তু বহুত দিন পর আজ মেয়েটার বুকের ভেতর অদ্ভুত কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কাউকে নয়ন ভরে দেখার জন্য তার আঁখি জোড়া সজল হয়ে উঠেছে। তীর্থের কাকের ন্যায় একপলক ইয়াদকে দেখার অভিপ্রায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে জারা।
মায়ের মুখশ্রীতে অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করে রয়েছে সমুদ্র।

মায়ের ক্রন্দন দৃষ্টিপাত করতে তার হৃদয় ব্যর্থ। ইসরাত বেগম সেই কখন থেকে কেঁদে চলেছেন অনবরত! এতোদিন পর ছেলেকে অসুস্থ অবস্থায় দেখার প্রত্যাশা করেন নি তিনি। মায়ের মন তো সন্তানদের বিপদ আপদ তারা আঁচ করতে পারেন। ইসরাত বেগমের ক্ষেত্রেও একই পটভূমি পরিলক্ষিত হয়েছে। নাড়ির টানে বড়ো ছেলের দুর্বোধ্য অবস্থা দিন কয়েক পূর্বেই অনুমান করতে পেরেছিলেন।

জারা শাশুড়ি মাকে হসপিটালে আনতে চাইনি প্রথমে। কিন্তু সমুদ্রের ফাঁকা বাসায় গিয়ে হঠাৎ উপস্থিত হওয়া, তার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে। জারা মস্তিষ্ক বলেছে, বাসায় গিয়ে ছেলের অনুপস্থিত ইসরাত বেগমকে অধিক উত্তেজিত করে তুলবে। অবশেষে নানান পরিকল্পনা করে ইয়াদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী তারা হসপিটালে এসেছে। হসপিটালের ভেতর ঢোকার পূর্ব হতে অবলা শিশুর ন্যায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ইসরাত বেগম।

ইসরাত বেগমের কান্না দেখে সমুদ্র হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। হাজার হোক কোন সন্তানই মায়ের চোখের অশ্রু সহ্য করতে পারে না। ইয়াদ ডিনার করতে গিয়েছি কিন্তু এখন অবধি হসপিটাল আসে নি। নয়তো ইসরাত বেগমকে এভাবে কাঁদতে দিতো না সে। জারা তাকে কান্না করতে নিষেধ করছে। কিন্তু ইসরাত বেগম কাপড়ের আচল দিয়ে মুখ আবৃত করে কেঁদে চলছেন অবিরাম! মাকে কাঁদতে দেখে সমুদ্র বারংবার প্রচেষ্টা করছে ইসরাত বেগমের কান্না থামাতে। মলিন কন্ঠে বলছে,

— মা আমি ঠিক আছি তো। তুমি এভাবে কেঁদো না প্লিজ।
ইসরাত বেগম নিরব ভঙ্গিতে কেঁদে চলছেন। বাকশক্তিহীন হওয়ার ফলে ছেলেকে শাসন করতে পারছেন না তিনি। বারবারই দুই ছেলের পেশা অমত ছিলো ইসরাত বেগমের। তাই সমুদ্রের এই পরিস্থিতিতে তার অন্তরালে একরাশ ক্রোধের আবির্ভাব ঘটেছে! সমুদ্র মায়ের কান্না থামানোর প্রয়াস চালাচ্ছে বিরতি হীন।

— মা আই এম সরি। তুমি আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব। প্লিজ তাও তুমি কেঁদে না। তুমি কেন বুঝো না তোমার কান্নার প্রখরতা আমাকে দুর্বল করে ফেলছে। তুমি কি আমাকে দ্বিগুণ অসুস্থ করতে চাও আম্মু?
ছেলের মলিন কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই মুখের থেকে আচল সরিয়ে ফেললেন ইসরাত বেগম। অতঃপর ছেলের মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে কিছু বলার প্রচেষ্টা করলেন। কিন্তু শত প্রয়াস করেও বাগযন্ত্র হতেই কোন প্রকার শব্দ নির্গত করতে পারলেন না। মুহুর্তেই সমুদ্রকে পরিবেশ পরিস্থিতি সাপেক্ষে জারাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

— জারা।
— জী ভাইয়া।
— আম্মুকে বেডের উপর বসিয়ে দেও। আর ইয়াদ কল করো কুইক।
সমুদ্রের আদেশ পেয়ে ডানে বামে মাথা ঘুরিয়ে, ইসরাত বেগমকে সমুদ্রের বেডে বসিয়ে দিলো জারা। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়াদকে ফোন দেবার জন্যে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করলো।

অন্যদিকে বেডের এক কোনে দাঁড়িয়ে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে মেহের। লজ্জাবতি ললিতার চোখ জোড়া অশ্রু দ্বারা ভর্তি হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। এতো দিন বাদে নিজের বোনটাকে দেখে ভীষণ আনন্দিত সে। কিন্তু এখন অবধি কারো সঙ্গেই তেমন ভালো করে ভাব বিনিময় করতে পারি নি মেহের। তার বুকেও যে বিষাদ জমে অগুনিত তা সমুদ্র ব্যতীত পৃথিবীর প্রতিটি ব্যক্তির অজানা! মায়ের কান্না থামাতে সমুদ্র খানিকের জন্য মেহেরের পরিস্থিতি মস্তিষ্ক হতে ডিলেট করে ফেলছে। মেয়েটা যে দুর্বল শরীরে কেবিনের এক কোনে অবলা প্রাণীর ন্যায় ছলছল নয়নে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা তার ধারণার বাইরে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কেবিনে দ্রুত পদে উপস্থিত হলো ইয়াদ। জারার কল দেওয়া পূর্বেই উপস্থিত সে। কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেবিনে প্রবেশ করলো সে।
ইসরাত বেগমের বাহুতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো জারা। আকস্মিক কোন এক সুদর্শন যুবকের উপর তার দৃষ্টি নিবন্ধ হয়ে পড়ে। যার অপেক্ষায় সে চাতক পাখির হয়ে উঠেছিল সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দৃশ্যমান হতেই তার হৃদয় মনে তুমুল উত্তাল হয়ে উঠেছে। তার দৃষ্টি বেসামাল হয়ে এসেছে।

ইশ, লোকটা কেন এতো সৌন্দর্যের অধিকারী! তার কিঞ্চিৎ শুভ্র বর্ণের আঁখি জোড়া যেন এক অদ্ভুত কিরণ দিচ্ছে! ইয়াদের গম্ভীর মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট! সাদা শার্ট এবং কালো প্যান্টে বেশ মানিয়েছে ইয়াদকে। গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছে ব্লাক স্যান গ্লাস। এক হাতের সুট আঁকড়ে ধরছে অন্য হাত কানের নিকটবর্তী অর্থাৎ মুঠোফোন কানে ধরে রেখেছে সে। এতেই যেন কারো হুঁশ নেই! জারা লাগামহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পিপাসিত হয়ে উঠেছে তার হৃদয়। আজ তার এতো দিনের অপেক্ষা প্রহরে সমাপ্তি ঘটেছে। মুহূর্তেই জারা হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করে দিয়েছে। অশান্ত হয়ে উঠেছে জারা নিজস্ব পৃথিবী!

কেবিনে প্রবেশ করতেই ইয়াদের দৃষ্টি পরে তার মায়ের মুখশ্রীতে। সমুদ্রের মাথায় আলতো করে হাতড়িয়ে দিচ্ছিলেন ইসরাত বেগম। তার মুখশ্রী সিক্ত হয়ে উঠেছে বিন্দু বিন্দু জলে।‌ ক্রন্দনের ফলে ইসরাত বেগমের মুখশ্রী পাণ্ডর হয়ে! তৎক্ষণাৎ চিন্তার রেখা দেখা দিল ইয়াদের হৃদয়ে! সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে মায়ের নিকটবর্তী হাজির হলো সে। অতঃপর উত্তেজিত হয়ে নিম্ন কন্ঠে বলল,

— আম্মু,,,
ইসরাত বেগম ছেলেকে দেখেই এক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্যে বিসর্জন দিলেন। অতঃপর ইশারা করে নিজের সান্নিধ্যে আসতে আদেশ করলেন। মায়ের ডাকে দ্রুত পদে বেডের নিকট হাজির হলো। লহমায় ইয়াদের দৃশ্যমান হলো তার একমাত্র প্রিয়তা কে! যে কিনা তার অতীত এবং বর্তমানের হৃদয় স্পন্দনের অংশ।নিত্যদিনের ব্যাবহৃত থ্রি পিস পরিহিত জারা। পিঠ ভর্তি এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

তার চোখ যুগল লুকিয়ে রয়েছে মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে! এতেই যেন ইয়াদের হৃদয় অবাধ্য হয়ে উঠেছে। প্রিয়তা সৌন্দর্য তাকে আজ দ্বিগুণ আকৃষ্ট করছে! তার রূপে বরাবরই মুগ্ধ সে। জারাকে লক্ষ্য করতেই অন্মগ্লানি জাগ্রত হলো ইয়াদের অন্তরালে! মেয়েটার তো কোন দোষ নেই। প্রতারণা করছে সে, তার জেবুর সঙ্গে। আচ্ছা তার জেবু কী সবটা জানার পর তাকে ক্ষমা করে দিবে? নাকি বহুদূর চলে যাবে তাকে ছেড়ে? মুহুর্তেই প্রিয়তাকে হারানোর ভয়ে ইয়াদের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। নিজেকে শান্ত রাখার প্রয়াসে জারার মুখ পান হতে দৃষ্টি সরিয়ে, ইসরাত বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— আমার প্রিন্সেস এভাবে বিষন্ন থাকলে আমার কিন্তু মোটেও ভালো লাগে না। প্রিন্সেসটা কি বুঝে না, তার চোখের জল তার ছেলেরা সহ্য করতে পারে না। বলো প্রিন্সেস কী চাই তোমার? তোমার ছেলে তা এক্ষুনি এনে দিবে। তবুও তুমি কেঁদো না।

বরাবরই ইসরাত বেগমের মন উৎফুল্ল করতে ইয়াদ তাকে প্রিন্সেস বলে সম্বোধন করে। আজ ও ব্যতিক্রম নয়। ছেলের বাচ্চাসুলভ স্বভাব দেখে কান্না থামাতে বাধ্য হলেন তিনি। দ্রুত জড়িত ধরলেন ছেলেকে। অতঃপর মুচকি হেসে ছেলের ললাটে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলেন।

ইয়াদ এবং সমুদ্রের ব্যাবহার দেখে ইতিমধ্যে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে জারা। ইয়াদের বাচ্চা সুলভ রূপ দেখে প্রশান্তিতে ভরে উঠছে তার অন্তর। জারা গভীর নয়নে ইয়াদের মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। পরিবেশ পরিস্থিতির ফলে নিজের বোনের অবস্থা আন্দাজ করতে পারে নি জারা। শাশুড়ি মায়ের উত্তেজিত অবস্থা ঠিক করার লক্ষ্যে মেহেরের দুর্বল শরীরের কথা তার মস্তিষ্ক হতে বিদায় নিয়েছে। যার ফলে মেহেরের সমাচার জিজ্ঞেস করে নি সে।

লহমায় সমুদ্রের কেবিনে প্রবেশ করলেন শোয়াইব খান এবং আকাশ। শোয়াইব খান নিজের ওয়েট বজায় রেখে সোফায় গিয়ে বসলেন। মায়ের আদুরে স্পর্শ পেয়ে প্রশান্তিতে চোখ যুগল বুঁজে ছিল সমুদ্র। হঠাৎ শোয়াইব খানের আওয়াজ ভেসে উঠলো তার কর্ণকুহরে।

— ইয়াদ! তোমার মাকে এবং সবার আমার বাসায় আসার নিমন্ত্রণ রইল। রাত গভীর হয়েছে অনেক। জার্নি করে এসেছেন তারা। তাদের রেস্ট এর প্রয়োজন।
শোয়াইব খানের প্রত্যুত্তরে ইয়াদ তার সামনে গিয়ে অবাকের সহিত বলল,
— হাউ আর ইউ স্যার? আমার কথা মনে আছে আপনার!
শোয়াইব খান বিনয়ী স্বরে বললেন,

— ইয়াস বয়। ইউ আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াদ! এম আই রাইট?
— ইয়েস স্যার।
বছর দুয়েক পূর্বে চাকরির সুবাদে ইয়াদের সঙ্গে শোয়াইব খানের সাক্ষাৎ হয়। অবশ্য শোয়াইব খান জানতেন না সমুদ্রের ছোট ভাই ইয়াদ। মেহেরের তথ্য কালেক্ট করতে গিয়ে বিষয়টা জ্ঞাত হয় তার। মুহুর্তেই সমুদ্র চোখ উম্মুক্ত করে বলে উঠলো,

— জারা, আম্মু ডিনার করেছে?
— জী ভাইয়া আমারা গাড়িতে ডিনার করেছি। কিন্তু আম্মু পরিমাণ মতো খাইনি।
জারার কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
— ইয়াদ, তোরা এবার হসপিটাল থেকে যা। জারা ,আম্মু অনেক ক্লান্ত। আম্মু কে কিছু খাইয়ে দিস।
সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে ইয়াদ বলল,

— তোকে এখানে রেখে যাবো না ভাইয়া। আকাশ ভাই বরং আম্মু কে আর জারাকে তোর ফ্লাটে দিয়ে আসুক।
ইয়াদের কথার মাঝে শোয়াইব খান বলল,
— আমার বাসায় চলো। সমুদ্রের ফ্লাটে গিয়ে রান্না বান্না করে পুনরায় বিনার করতে অসুবিধা হবে তোমাদের।
শোয়াইব খানের কথা ইয়াদের কর্ণপাত হতেই জারা মুখ পানে দৃষ্টিপাত ফেলল সে। অতঃপর জারার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে উঠলো,

— ধন্যবাদ স্যার তবে আমার ওয়াইফ আছে ও সবটা সামলে নিবে। তাছাড়া কালকে ভাইয়া হসপিটালে থাকবে না তাই বাসায় ভাইয়ার যাবতীয় সব ব্যবস্থা করতে হবে।
ইয়াদের কথা শুনে দমে গেলেন শোয়াইব খান। মেয়েকে নিজের বাসায় রাখতে ইয়াদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন তিনি।‌ কিন্তু তারা রাজি না হওয়াতে তিনি ক্ষুন্ন মনে বলে উঠলেন,
— ওকে তোমাদের যেটা বেটার মনে হয় তাই করো। কিন্তু মেহেরকে হসপিটালে থাকতে দিন না। দুর্বল শরীর নিয়ে ওর এখানে অবস্থান করা একদমই অনুচিত।

শোয়াইব খানের কথার ইয়াদ দ্রুত বলে উঠলো,
— ওকে, চলো মেহের। এখন তবে তোমাদের দিয়ে আসি।
ইয়াদের কথার ভিত্তিতে শোয়াইব খানের চোখ মুখে হাসি রেখে ফুটে উঠলো। সমুদ্র নির্বিকার হয়ে বসে রয়েছে। মেহেরকে যাবার অনুমতি দিচ্ছে না আবার থাকতে ও বলছে না। মেহের তৎক্ষণাৎ সমুদ্রের চোখ যুগলে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। সমুদ্রের আঁখি জোড়ার অসহায় দৃষ্টি মেহেরের বুকে তীরের ন্যায় বিধল। লোকটার চোখের ভাষা পড়তে মেয়েটা একটুও অসুবিধে হয় নি। তাই মেহের ইয়াদের কথার বিপরীতে বলল,

— ভাইয়া, আমি যাব না। আপনি আম্মুকে আর আপুকে নিয়ে বাসায় যান। উনাকে এ অবস্থায় রেখে আমি কিছুতেই যাব না।
মেহের কঠোর উত্তর পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে জারা! বোনের ব্যপক পরিবর্তন তার ধারণার বাইরে। ইয়াদ ও মেহেরের পরিস্থিতি দেখে অবাক না হয়ে পারে নি। অবশ্য বারবার শোয়াইব খান মেহেরের হসপিটাল প্রস্থান করতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু মেহের নাছোড় বান্দা। সে কিছুতেই যাবে না সমুদ্র কে ফেলে!

ইয়াদ, আকাশ, শোয়াইব খান এবং ইসরাত বেগম হসপিটাল ত্যাগ করেছেন কিৎক্ষণ পূর্বে। ইসরাত বেগম ছেলেকে রেখে যেতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু ইয়াদের সঙ্গে না পেরে অবশেষে বাসায় যেতে হয়েছে তাকে। অবশ্য ইয়াদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরাত বেগম এবং জারাকে সমুদ্রের ফ্লাটে ড্রভ করে সে পুনরায় হসপিটালে আসবে। মেহেরকে হসপিটাল থেকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা কম করেনি জারা। বোনের শরীরের কথা চিন্তা করে সেও থেকে তেতে চেয়েছিল। কিন্তু ইসরাত বেগমের জন্য তা আর বাস্তবে রূপান্তরিত হয় নি। যাওয়ার পূর্বে মেহের কে জড়িয়ে ধরে মিনিট খানিক অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে জারা! বোনকে এতটুকু আদর করে তার মন ভরেনি।

সবাই চলে গিয়েছি মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখনো কেবিনের এক কোণে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহের। তখন থেকেই মেহেরের দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে রয়েছে সমুদ্র। মেয়েটা কোন ধাতুর তৈরি তা ভেবে বিরক্ত সমুদ্র! মেয়েটার দৃষ্টি যেন কোথাও পলক হারিয়েছে। অর্থাৎ গভীর চিন্তায় মত্ত মেহের! অবশেষে ক্রোধ এসে জেকে বসলো সমুদ্র আঘাত প্রাপ্ত দেহে! একপায়ে ক্রোধ নিয়ন্ত্রনের ব্যর্থ হয়ে সমুদ্র ফুঁসতে ফুঁসতে মেহেরকে বলে উঠলো,

— হেই ম্যাম, প্লিজ হেভ ইউয়ার সিট‌ !
সমুদ্রের হঠাৎ কর্কশ আওয়াজ কর্ণপাত হতেই, মেহের স্বল্প কেঁপে উঠলো। অতঃপর সমুদ্র দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সমুদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

— নিজের খেয়াল রাখতে শিখ পুচকি! মনে রাখবে এই পৃথিবীতে সবাই যার যার নিজ কর্মে ব্যস্ত। এমন কেউ নেই যে তোমার সুবিধা অসুবিধা ভেবে তোমার সাহায্য করবে। ইচ্ছে থাকলেও ব্যস্ততার ফলে তোমাকে কেউ সহযোগিতা করতে সক্ষম হবে না। দেখলেই তো আম্মু কাঁদছে। আমারা সবাই এমনকি তুমি ও আম্মুর উপর মত্ত ছিলে। কিন্তু তাই বলে এভাবে স্টুপিডের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানেই হয়।
কথাগুলো বলেই হাঁফিয়ে উঠেছে সমুদ্র। তার দৃষ্টি এখন অবধি মেহেরের ভীত চোখে আবদ্ধ। স্বল্প বিরতি নিয়ে সমুদ্র ফির বলতে লাগলো,

— আমার ভুল হয়ে গিয়েছে ম্যাম। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার ওয়াইফ একটা বাচ্চা। সে তো ঠিক মতো দাঁড়াতে পর্যন্ত শিখে নি। দুঃখিত, এখন থেকে অত্যন্ত সচেতন হলাম। কিন্তু আমার টেনশন হচ্ছে ভবিষ্যতে নিয়ে। এই মেয়ে কীভাবে আমার সংসার সামলাবে!
বর্তমানে সমুদ্র কথা শুনে মেহেরের গাল যুগল রক্তিম কৃষ্ণচূড়া রুপ ধারণ করছে। বিষয়টা সমুদ্রের চোখের আড়াল হয় নি। বিষয়টা পরিলক্ষিত করে, সমুদ্র ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে গম্ভীর গলায় স্বল্প আওয়াজে বলে,

— এতো লজ্জা পাওয়ার কি রয়েছে? আশ্চর্য, এখন ও তো লজ্জা পাবার মতো কিছুই বলেছি আমি!
সমুদ্রের মিনমিন কন্ঠস্বর মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি। সমুদ্র এবার দ্বিগুন বিরক্তির সহিত বলে উঠলো,
— এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে না পুচকি। অনেক রাত হয়েছে। এখন দয়া করে শুয়ে পড়। আমার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। এখন যদি তুমি ডাগর ডাগর আঁখি মেলে কারো আয়েশের নিদ্রা ছিনিয়ে নিতে চাও তাহলে এর শাস্তি ভবিষ্যতে তোমাকে কড়াই গন্ডায় পেতে হবে। আন্ডারস্টান্ড?
সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে দ্রুত সোফায় উপর গিয়ে শুয়ে পড়ল মেহের। সে চাই না তার জন্য লোকটা অসুবিধে হোক।

নিস্তব্ধ চারপাশ। মাত্র চৈত্র মাসের তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকার পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে! উঁচু উঁচু দালানের বসবাস রত সাধারণ জনতার পরিস্থিতি বেগতিক! শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি বিদেয় নিয়েছে মাস খানিক ও হয় নি। অথচ চৈত্র মাসের খাঁ খাঁ তাপ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাব দেখেই এক পশলা বৃষ্টির কামনায় মত্ত সকলে।

এই অতিরিক্ত উষ্ণ পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সমুদ্র। বেলা ভর দুপুরে ঠেকেছে। সকাল দশটা নাগাদ সমুদ্র কে হসপিটালে হতে বাসায় নিয়ে এসেছে ইয়াদ। জারার চিন্তায় মগ্ন থেকে নির্ঘুমে হসপিটালের করিডোরে সারা রাত পার করেছে সে। শত ব্যস্ততার মাঝেও রাতের বেলায় প্রিয়তার কন্ঠস্বর কর্ণপাত করেছে সে। জারা অধিক জড়তার সঙ্গে ইয়াদের সমাচার জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু ভাগ্য ক্রমে তারা দীর্ঘ সময় এঁকে অপরের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সকালে ও ব্যস্ততার ফলে আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি তাদের।

বাসার এসেও এক ফোঁটা ও ঘুমোয় নি মেহের। সকালে জারা আদরের সহিত মেহের কে খাইয়ে দিয়েছে। দুপুরের রান্না ঘরে চাপতে দেয় নি মেহের কে। যার ফলে সমুদ্রের কক্ষে অবস্থান করছে সে। জীবনে প্রথম সমুদ্রের রুমে প্রবেশ করে খানিকটা অপ্রস্তুত! সমুদ্রের নিষেধ মতে বিয়ের পর একটি বারের জন্যও সে সমুদ্র কক্ষে প্রবেশ করে নি সে। দরজা পর্যন্ত অনেক বার এসেছে কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে নি। আজ আকস্মিক সমুদ্র রুমে প্রবেশ করতে পেরে পুলকিত তার হৃদয়! সমুদ্র অনুভূতি তার মস্তিষ্কে চেপে বসেছে ইতিমধ্যে।

বর্তমানে সমুদ্র রুমের সোফায় বসে ধ্যানে মত্ত ছিলো মেহের। শাশুড়ি আম্মু তার অসুস্থ ছেলে পাশে এতোক্ষণ বসে ছিলেন। সমুদ্র কে খাইয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। অবশেষে রুম থেকে বিদায় নিয়েছে শাওয়ার নেওয়ার উদ্দেশ্যে! যাওয়ার পূর্বে সমুদ্রের খেয়াল রাখার দায়িত্ব শপে গিয়েছে। এমন অবস্থায় হঠাৎ মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছালো ইয়াদের কন্ঠ,

— ভাবি!
ইয়াদের মুখে ভাবি সম্বন্ধ শুনে চমকে উঠলো মেহের। বিষয়টা তার নিকট ভীষণ অপ্রত্যাশিত! তৎক্ষণাৎ নিজেকে পরিপাটি করে জড়তা সহিত ইয়াদকে বলে উঠলো,
— জিজু, আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন।
— না ভাবি। তুমি বয়সে আমার থেকে ছোট হলেও সম্পর্কে বড়।
— না জিজু, আমি তো তোমার শালি!
— নোপ মিষ্টি ভাবি।
— প্লিজ জিজু।

মেহের এবং সমুদ্রের কথার মাঝে ভেসে উঠলো গম্ভীর এক কন্ঠস্বর। সমুদ্র ঘুম মাখা শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
— নোনসেন্স! তোদের কথা জন্য আমার ঘুম ভেঙে গেলো। তোরা এসব নিয়ে পরে আলোচনা করিস। আমার অত্যধিক গরম লাগছে। আমি শাওয়ার নিতে চাই।

সমুদ্র কন্ঠস্বর পেয়ে ইয়াদ এবং মেহের তাদের আলোচনা বাদ দিয়ে সমুদ্রের দিকে মনোযোগ দিলো। মেহের সমুদ্রের আচরণ খানিকটা অসন্তুষ্ট হলো। আচ্ছা লোকটা কি ভালো ভাবে কথা বলতে পারে না? ঘুম থেকে উঠেই ধমক দেবার কোন যুক্তি নেই। তাছাড়া অসুস্থ শরীরে নিয়ে ও কেন এতো রুক্ষ তিনি! মেহের দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
সমুদ্রের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো ইয়াদ। গরমে হাঁফিয়ে উঠেছে সে! কিন্তু হঠাৎ করে অসুস্থ শরীর শাওয়ার নিতে চাওয়া সমুদ্রের প্রত্যাশার বাইরে! সঙ্গে সঙ্গে ইয়াদ সমুদ্রের নিকটবর্তী হাজির হলো। অতঃপর বলে উঠলো,

— ওকে ভাইয়া, তোর বোধহয় অতিরিক্ত গরম লাগছে! চলো আমি হেল্প করছি। এই অবস্থায় একা ওয়াসরুমে মেতে হবে না তোকে।
ইয়াদের কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্রের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! তৎক্ষণাৎ বিরক্তির সহিত মেহেরের মুখ পানে দৃষ্টিপাত ফেলল সমুদ্র। অতঃপর ঠোঁট কামড়ে ধরে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ হয়ে রইলো। হঠাৎ ঠোঁটের কোণে তীর্যক হাসির রেখা এঁকে অতি‌ শীতল কন্ঠে বলল,

— তোকে হেল্প করতে হবে । তুই বিদায় হ।
মুহুর্তেই ইয়াদ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
— ভাইয়া, তুই একা পারবি না।
ইয়াদের প্রত্যুত্তরে সমুদ্র স্বভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৪

— কে বলছে আমি একা করব? মেহের থাকতে তোর কোন প্রয়োজন নেই। ও হেল্প করবে। নাও গেট আউট!
সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই ইয়াদের ওষ্ঠো এবং অধর কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে আপনি আপনি!

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৬