তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ৪৫

তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ৪৫
তাহিরাহ্ ইরাজ

নিশুতি রাত। হিমাংশু’র দ্যুতি ছড়িয়ে ধরনীর বুকে। বিছানায় বসে দুয়া। হাতে বই। বইয়ের পাতায় ভাসমান শব্দগুচ্ছ উচ্চারিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। বাঁ কাঁধে মাথা এলিয়ে বসে মানুষটি। চক্ষু বদ্ধ করে অর্ধাঙ্গীর মুখনিঃসৃত বর্ণনা শুনছে। কক্ষের আলো নিভিয়ে রাখা। শুধু সাইড ল্যাম্পের আলো বিদ্যমান। সে আলোয় উজ্জ্বল বইয়ের পাতা। বিগত আধ ঘন্টা ধরে এমনটিই চলমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে তূর্ণ।

মাইরা’র এতটা সন্নিকটে সে। মেয়েলি সুবাস ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে কড়া নাড়ছে। হারিয়ে যেতে চাইছে মন ওই দীঘল কালো কেশের রাজ্যে। নে!শা ধরে যাচ্ছে তনুমনে। একটুখানি ছুঁয়ে দেয়ার জন্য আনচান করছে হৃদয়। কতদিনের তৃষ্ণার্ত চিত্ত আজ প্রেম তৃষ্ণা মেটাতে উদগ্রীব। নিজেকে সামাল দেয়া হয়ে উঠলো দুষ্কর। আস্তে আস্তে করে নড়ে উঠলো তূর্ণ। নাসিকা ছুঁয়ে দিতে লাগলো কাঁধের কোমল ত্বকে। আকস্মিক ছোঁয়ায় শিউরে উঠলো মেয়েটি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পড়ার তালে তালে নড়তে থাকা অধর থমকে গেল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো বই। তূর্ণ নড়েচড়ে আরাম করে বসলো। কাঁধে মুখ লুকানো অবস্থাতেই বাঁ হাতে কাঁধ হতে কেশ সরিয়ে দিলো। সেথায় অঙ্কন করতে লাগলো ওষ্ঠের আদুরে কিছু স্পর্শ। আবেশে মুদিত হয়ে এলো দুয়ার নেত্রপল্লব। অনাদরে বইটি পড়ে রইলো কোলে। ধীরজ গতিতে বাঁ হাতটি চলতে লাগলো। পৌঁছে গিয়ে স্থাপিত হলো স্বামীর পৃষ্ঠদেশে। হঠাৎ কাঁধের কোমল আবরণে দন্তের আলতো ছোঁয়ায় মৃদু কঁকিয়ে উঠলো মেয়েটি। নখ বিঁধে গেল স্বামীর পৃষ্ঠে।

মৃদু আর্ত পৌঁছালো তূর্ণ’র কর্ণ কুহরে। থেমে গেল মানুষটি। দন্ত আ.ক্রমণের শিকার লালচে স্থানে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। ক্ষমা চাইলো ফিসফিসিয়ে। দুয়া কোমল হাত বুলাতে লাগলো স্বামীর পৃষ্ঠে। বুঝিয়ে দিলো তার মনোভাব। ক্ষমা চাইতে হবে না। তূর্ণ’র অধরে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো। দুষ্টুমি করে পুনরায় কাঁধের ত্বকে দন্ত ছুঁয়ে দিলো। দুয়া মৃদু কঁকিয়ে অর্ধাঙ্গের পৃষ্ঠ ইচ্ছাকৃতভাবে খামচে ধরলো।

নিঃশব্দে হেসে উঠলো মানুষটি। আদুরে ছোঁয়ায় তার মাইরা’কে বাহুডোরে আগলে নিলো। শুইয়ে দিলো বালিশের বুকে। বিছানায় শুয়ে দুয়া। উপরিভাগে একান্ত জন। দু’জনের নয়নে মিলিত নয়ন। লাজে রাঙা মেয়েটি বেশিক্ষণ ওই নয়নে ডুবে থাকতে পারলো না। আসন্ন প্রেমময় অনুভূতির আবেশে আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে পড়লো কপোলদ্বয়ে। তূর্ণ বিমুগ্ধ চাহনিতে সে লাজুক আভা দর্শন করলো। পুলকিত হলো হৃদয়। নিজ ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে লালাভ আভায় ছেয়ে থাকা দু কপোলের মসৃণ আবরণে ওষ্ঠ চাপ বসালো। সম্মোহনী স্বরে আওড়ালো,
” আমার একান্ত মাইরা! ”

অসুস্থ মানুষটি সহধর্মিণী এবং পরিবারের সদস্যদের যত্নশীল আচরণ, দিনরাত প্রার্থনা, সর্বোপরি স্রষ্টার অশেষ রহমতে সুস্থ সবল হয়ে উঠলো। সম্পূর্ণ সুস্থ সবল হতে সময় লাগলো প্রায় দেড় মাস। সবল মানুষটি অবশেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে‌। আগের মতো ভার্সিটি, পরিবার, বন্ধুমহল এবং তার একান্ত মাইরা। দিনকাল বেশ কাটছিল।

বন্ধুরা মিলে আজ সিনেপ্লেক্স এসেছে। পরপর দুই সারির একই কলাম দখল করে বসেছে ওরা। দুয়া, তৃষা, পুষ্পি, বিন্দু বসে পাশাপাশি। ওদের ঠিক পেছনেই বিশাল। একাকী বসেছে বেচারা। পড়ুয়া তিয়াশ সঙ্গে আসেনি। ওরা এই মুহূর্তে দেখছে হৃত্বিক রোশন এবং টাইগার শ্রফ অভিনীত ‘ ওয়্যার ‘ মুভিটি। বরাবরের মতই ক্রাশ নামক বাঁশ খেয়ে চলেছে পুষ্পি। কখনো হৃত্বিক, কখনোবা টাইগার শ্রফ। কাকে রেখে কাকে মন দেবে কনফিউজড। দুয়া নাকমুখ কুঁচকে মৃদু স্বরে বললো,

” তোর মতো লুচি আমি এক পিসও দেখিনি। দিনের মধ্যে কত শতবার যে ক্রাশ খাস! অত বার তো খাবারও খাস না। ”
” মানে কি? তুই কি চাস? আমি অত বার খাবার খেয়ে জলহস্তী হয়ে যাই? আমার শখের ফিগার বরবাদ করি?” পুষ্পি অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে।
তৃষা বিদ্রুপ করে বললো,
” ইহ্! জিরো ফিগার ওয়ালা আসছেন! যেই না বডি! ভিতরে মাংস আছে টাছে? হুদা তো হাড্ডি। ”
পুষ্পি দুয়া’কে অতিক্রম করে তৃষার বাহুতে চাপড়ে দিলো।

” অ স ভ্য মাইয়া! আমারে কিনা বডি শেমিং করে! তোর নামে মামলা করমু। ”
” হ কর কর। আমি অগ্রীম জামিন করাইয়া রাখতেছি। ”
দুয়া দুই পাশে বসে থাকা দু’জনের হাত চেপে ধরলো। মৃদু স্বরে বললো,
” চুপ করবি তোরা? মুভি দেখতে এসে ঝগড়া করছিস? থাম। ”
পেছন থেকে বিশাল ফোঁড়ন কাটলো,
” এই হইলো বেডি মানুষ। যেহানে যায় খালি ঝামেলা। ”

চার ললনা ক্ষে.পে একসঙ্গে পিছু ঘুরে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। বিশাল আবহাওয়া গরম অনুধাবন করে বোকা হাসলো। স্বেচ্ছায় সারেন্ডার করলো। নইলে যে ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা আসন্ন। বোকা বোকা হেসে বললো,
” সামনে চা। তোগো ক্রাশ বাঘ পর্দায় আইছে। ”
বিন্দু তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললো,

” সম্মান দিয়ে কথা বল। হি ইজ টাইগার শ্রফ। নট বাঘ। ওকে? ”
” আরে একই তো হইলো। যাহা ইংলিশে টাইগার তাহাই আবার বাংলায় বাঘ। ভিন্নতা কি? ”
” খা টা শ। ”
বিন্দু বিরক্ত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তাকালো সমতল বৃহৎ পর্দায়। পুষ্পি যথারীতি টাইগারে ফিদা হলো। একটু পর হৃত্বিক এলে আবার তার ওপর ফিদা হবে। হায় রে ক্রাশ পার্টি!

মাস দুয়েক পরের কথা। দুয়া’দের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা চলছে। যথারীতি মাস্টার তূর্ণ তার সহধর্মিণী এবং বোনকে প্রপার গাইড করছে। ওরাও বাঁ!দরামি বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হলো। তূর্ণ বারবার করে বলে দিয়েছে,
” ভালোমতো প্রিপারেশন নে। এই পরীক্ষার পর ফাইনালের বেশি দেরি নেই। ফার্স্ট ক্লাস যেন নির্বিঘ্নে আসে। ওকে? ”
দুই সখী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দুয়া’র মনে পড়ে গেল সে পুরনো এক স্মৃতি।

দিনভর চিন্তায় চিন্তায় পাড় করলো দুই সখী। চিন্তা হবে না? আজ সন্ধ্যায় প্রথম বর্ষের রেজাল্ট প্রকাশিত হবে। কি থেকে যে কি হবে! নাওয়া-খাওয়া ভুলে দু’জনেই দুশ্চিন্তায় দিশেহারা। তূর্ণ তা দেখে বিরক্ত হলো।
” তোদের অবস্থা দেখে আমি সত্যিই অবাক। আরে ভাই পরীক্ষা তো একদা আমরাও দিয়ে এসেছি। তাই বলে নাওয়া খাওয়া ভুলে এমন করেছি? করিনি তো। কারণ এমন করে বিন্দুমাত্র লাভ নেই। পরীক্ষার খাতায় যা লিখে এসেছিস রেজাল্ট ঠিক তাই হবে। একটুও এদিক ওদিক হবে না। সো ভুংভাং টেনশন না করে খাবার খেয়ে নে। ”

” খাবো না। ” আপত্তি জানালো দুয়া।
তূর্ণ কিঞ্চিৎ কড়া কণ্ঠে বললো,
” দুয়া বেশি ফটরফটর করবি না। খেয়ে নে বলছি। পড়ে ফিট খেলে রেজাল্ট দেখবি কি করে? ”
” বাজে লোক একটা। খালি অলক্ষুনে কথা বলে। ”
অসন্তুষ্ট বদনে সেথা হতে প্রস্থান করলো মেয়েটা। তৃষা নখ খুঁটতে খুঁটতে একবার ভাবি আরেকবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। অতঃপর প্রস্থান করলো সেথা হতে। নইলে ভাইয়ের এক্সট্রা জ্ঞান শুনতে হবে। যা কান ও মস্তিষ্কের জন্য বেশ ক্ষতিকারক।

সেদিনটা বেশ চিন্তায় চিন্তায় অতিবাহিত হলো। অবশেষে এলো মাহেন্দ্রক্ষণ। সন্ধ্যার পর প্রকাশিত হলো প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল। খুশিতে চিৎকার করে উঠলো তৃষা। বসা থেকে দাঁড়িয়ে লাফাতে লাফাতে দু হাতে ওষ্ঠাধর লুকিয়ে বলতে লাগলো,
” ও মাই আল্লাহ্! ফার্স্ট ক্লাস ডান! থ্যাংকস আল্লাহ্। থ্যাংকস অ্যা লট! উফ্। ফেবুতে পোস্ট দিতে হবে। আমার মোবাইল? মোবাইল বোধহয় রুম। ওহ্ হো! ”

ঠে*লাগুতোঁ খেয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে তৃষা রানী। খুশিতে আত্মহারা। দৌড়ে কক্ষ ত্যাগ করলো। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে করতে হয়ে গেল ক্লান্ত। তবুও থেমে নেই। ওদিকে জাহিরাহ্ দুয়া? মেয়েটা ছলছল নয়নে ল্যাপটপের পর্দায় তাকিয়ে। সিজিপিএ ৩.৬৯ এসেছে। ফার্স্ট ক্লাস! আবেগে আপ্লুত হয়ে ডানে থাকা স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো দুয়া। তূর্ণ’র অধরে তৃপ্তির আভা। মুচকি হেসে অর্ধাঙ্গিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

সফল তারা। স্বার্থক তাদের পরিশ্রম। মনে মনে মহান স্রষ্টার শুকরিয়া আদায় করলো। নিশি খুশি খুশি কক্ষ হতে বেরিয়ে এলো। সুসংবাদ জানালো পরিবারের সকলের কাছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো ‘ ছায়াবিথী ‘। দুই পরিবারের সকলেই সন্তুষ্ট। বেশ খুশি। স্রষ্টার শুকরিয়া আদায় করলো তারা। নিজাম সাহেব ছোট ভাইকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন। খুশিতে ক্রয় করলেন সাত কেজি মিষ্টি। কয়েক পদের মিষ্টি রয়েছে তন্মধ্যে। সেদিনটা ছিল সকলের জন্য খুশির দিন। আনন্দঘন মুহূর্ত।

পুরনো স্মৃতি মনে করে আবেগী হয়ে পড়লো দুয়া। আগামীতে আরো ভালো ফলাফল করার স্পৃহা জন্মালো অন্তঃপুরে। ইনশাআল্লাহ্ দ্বিতীয় বর্ষে আরো ভালো ফলাফল হবে।

তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ৪৪

সুষ্ঠু রূপে পরীক্ষা শেষ হলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো দুয়া, তৃষা যুগল। আনন্দে কাটালো কয়েকদিন। এদিক ওদিক ঘুরতে গেল। ছোটখাটো পার্টি করলো। বন্ধুমহলের কত কি মুহূর্ত কাটলো। সময়ের পরিক্রমায় অতিবাহিত হলো আরো কতগুলো দিন। হঠাৎ একদিন এলো চমকপ্রদ মুহূর্ত। এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কেউ। ‘ ছায়াবিথী ‘তে এ কি বি*স্ফোরণ ঘটালো তূর্ণ! এতে যে পরিবারের সদস্যরা কতটা চমকিত হয়েছে সে কি জানে?

তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ৪৬