তোলপাড় পর্ব ২০+২১+২২

তোলপাড় পর্ব ২০+২১+২২
শান্তনা আক্তার

রিমি অপার সাথে কথা শেষ করে রুমের ভেতরে গেল।আহসান বিছানায় বসে ফোন ঘাটছিলো তখন।রিমি মুখে হাসির রেখা টেনে আহসানের কাছে গিয়ে বলল,জানেন আমার জব হয়ে গেছে।
আহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,তাতে আমার কি?আমাকে না জানালেও চলবে।
-এভাবে বলছেন কেন?আমি কি কিছু ভুল বলেছি?
-না,কেউ কিছু ভুল বলেনি।আমি বলতে চেয়েছি তোমার কোনো বিষয়ে আমাকে না জড়ালেও চলবে।সেই কাজ করার জন্য অনেক মানুষ আছে।আহসান ফোনের দিকে চেয়েই কথা বলে যাচ্ছে।
রিমির মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল।আহসানের এমন আচরণের কারণ ওর জানা নেই।রিমি বলল,আপনার কথার আগা মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।কাইন্ডলি বলবেন কি হয়েছে?

এবার আহসানের মেজাজ সাত আসমান ছাড়িয়ে গেল।নিজের ফোনটা একটা আছাড় মারলো।দেয়ালের সাথে বারি খেয়ে সাথে সাথে ফোনটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল।রিমি ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছে।আহসান কিছু না বলে রাগ দেখিয়ে বাহিরে চলে গেল।এসব দেখে রিমির চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।রিমি এখনো দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।আহসান অনেকক্ষণ হয়েছে বেড়িয়েছে।রিমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অস্ফুট স্বরে বলল,আপনার কি হয়ে যায় মাঝে মাঝে?আপনার মন মানসিকতা কখন কিভাবে চেঞ্জ হয়ে যায় আমি সত্যিই বুঝতে পারি না।খুব অদ্ভুত আপনি!আচ্ছা আপনি কি অভিমান করেছেন?আমি আপনাকে আগে কেন বলিনি এটাই কি রাগের কারণ?নাকি জিসানের সাথে কথা বলাটাই মেইন কারণ।কোনটা আসল কারণ ক্লেয়ার করে বলবেন প্লিজ?বলে দেন আমাকে তাহলে আমি জিসানকে বলে দেই যেন আমার সাথে কথা না বলে।ওকে তো ভাইয়ের মতো দেখি আমি।এসব কথা যদি জিসান জানতে পারে তাহলে সেটা আমার জন্য কতটা লজ্জাজনক হবে তা আপনি বুঝবেন না।আমি জানি না আপনি ওকে আর আমাকে নিয়ে কি ভাবছেন।কিন্তু যাই ভাবুন না কেন খুবই ভুল ভাবছেন।আমি যে কি করবো?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাত হয়ে এসেছে কিন্তু এখনো আহসানের কোনো খোঁজ নেই।রিমি আর ওর বাবা মা খুব টেনশন করছে আহসান কে নিয়ে।ওরা সবাই নিচে মেইন গেটে দাঁড়িয়ে আহসানের জন্য পথ চেয়ে আছে।আহসানের কাছে ফোনও নেই যে কল করবে।সব মিলিয়ে রিমি ও তার বাবা মায়ের খুব বেশিই দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে।রিমির মাতো প্রথম থেকেই রিমিকে বকে যাচ্ছে।
– নিশ্চয়ই তুই কিছু বলেছিস জামাই কে,নইলে ছেলেটা এভাবে চলে যেত না।
-বিশ্বাস করো মা,আমি কিছুই বলিনি ওনাকে।
-কিছু না বললে তো এভাবে চলে যেত না ছেলেটা।ওদের বাড়ি যে কল করবো তাও তুই করতে দিচ্ছিস না।ছেলেটার গাড়িও দেখছি নেই এখানে।কি যে সাংঘাতিক বিপদের মুখে এসে পড়লাম।আল্লাহ তুমি ছেলেটাকে ভালোই ভালোই ফেরত নিয়ে আসো।আমি আর কিছুই চাইনা।

-মা আমি জিসানকে কল করেছিলাম।ও বলেছে উনি নাকি ওখানেও নেই।
-সেকি তাহলে তো আহসানের বাবা মা খুব চিন্তা করছেন।আমাদের নামে কি ভাবছে বলতো এখন?আমাদের তো নাক কাটা গেল।সবাই যদি জানতে পারে জামাই আমাদের বাসায় প্রথম এসেই রাগ করে চলে গেছে।তাহলে কি হবে ভেবেছিস একবারও?তোর একটুও চিন্তা হচ্ছে না!রিমি এবার কেঁদেই দিল আম্বিয়ার কথায়।
-তুমি এভাবে মেয়েটাকে বোকো নাতো।আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখছি আহসান বাবাকে পাই কিনা।এই বলে নাজমুল পা বাড়ালো।নাজমুল প্রায় ৩ ঘন্টা পর হতাশা ভরা মুখ নিয়ে বাসায় ফিরলো।নাজমুলকে দেখে রিমি আর আম্বিয়া দৌঁড়ে তার কাছে গেল।
-কিগো আহসান কোথায়?তুমি একা এলে কেন?
-বাবা তুমি ওনাকে পাওনি?কোথায় উনি?

রিমি ও আম্বিয়া নাজমুলকে ঘিরে ধরেছে দুপাশ দিয়ে।নাজমুল একটা চেয়ারে গিয়ে বসল।তারপর বললো,আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ছিলো আমি আহসান বাবাকে খুঁজেছি।কিন্তু আমাদের সোসাইটি,আশে পাশের সোসাইটি সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু আহসানকে পেলাম না।
-বাবা তুমি এসব কি বলছো!উনি কোথায় যেতে পারে?(কান্নাজড়িত কন্ঠে)
-আমি জানি নারে মা।

-এখন কি হবে গো?মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন তো সব জেনেও গেছে।এবার আমাদের মেয়ের কপালে কি আছে ভেবেছো তুমি?
-মা আমি জিসানকে উনার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা ওই বাড়ির কাউকে জানাতে বারণ করেছিলাম।তারা কিছুই জানে না।
-শোনো মেয়ের কথা!আরে আজ না জানলে কালতো ঠিকই জেনে যাবে।আমার মাথা কাজ করছে না।খুব ভয় করছে আমার।মুখপুড়ি মেয়ে কি করলি তুই?সব সময় বরের কথা মতো চলতে হয়।তার উপর ছেলেটা বড়লোকের ছেলে।ওদের সাথে নম্র ভদ্র হয়ে শান্ত গলায় কথা বলতে হয়।আমি কতো চেষ্টা করলাম ছেলেটার মন ভালো রাখার।নিজ হাতে ছেলেটার পছন্দের খাবার রান্না করছি।সবসময় হাসি মুখে কথা বলছি।জামাই মানুষ সে।যথা সম্ভব আহসানের মন ভালো রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি তোর বাবা আর আমি।তুই কি এমন করলি যে ছেলেটা রাগ করে চলে গেল?

-আমি সত্যি কিছু করিনি মা।
-আচ্ছা আহসান হাসপাতালে যায়নি তো!দেখ খোঁজ করে।
-না মা উনি হাসপাতালে যায়নি।উনি তো ছুটিতে আছে।
-তাহলে কোথায় গেল ছেলেটা?এতো বড় শাস্তি কেন দিচ্ছে আল্লাহ আমাদের?কতো সাবধানে চলছিলাম আমরা।
-মা তুমি চিন্তা করোনা।তোমার হাটুর ব্যথা আছে খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও।
-আমি কিছুই খাবনা তুই আর তোর বাবা খেয়ে নিস এই বলে চলে যায় আম্বিয়া।

নাজমুল এখনো মাথা নিচু করে বসে আছে।সে আম্বিয়ার মতো মুখে প্রকাশ না করলেও তার চেহারাই বলে দিচ্ছে সে কতটা চিন্তিত।রিমি ওর বাবাকে বলল,বাবা তুমি কিছু মুখে দাও প্লিজ।আর মাকেও কিছু খাওয়াও।
-নারে মা আমি একটা দানাও খেতে পারবো না।তুই খেয়ে নিস।নাজমুল ও নিজ রুমের দিকে চলে গেলেন।রিমি কি আর করবে?রিমিও নিজের রুমে এসে কাঁদছে।এ ছাড়া আর কি করার আছে ওর?খাবার তো ওর গলা দিয়েও নামবে না।রাতটা যেন খুব বড় হয়ে গেছে রিমির জন্য।কোনো মতেই চোখের পাতা এক করতে পারছে না।চোখ মুখ ফুলে আছে।চোখের পানিও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে রিমির।ছটফট করতে করতে রাতটা পাড়ি দিয়ে দিল।

আল্লাহ তুমি যেখান থেকে পারো ওনাকে ফেরত নিয়ে আসো।আমি ওনার সব অপমান সহ্য করতে রাজি।তবুও তুমি ওনাকে ফিরিয়ে আনো।ওনাকে না পেলে যে আমি অপরাধী হয়ে যাব নিজের কাছে।ওনার মাকে কি জবাব দেব আমি?আমি কিছু চাইনা শুধু আহসানকে ফিরিয়ে আনুন।আমিন বলে মোনাজাত শেষ করে রিমি।এক রাতেই বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।শরীর হাত পা কাঁপছে কিছুক্ষণ পর পর।মাথাটাও বেশ ধরেছে ওর।তাতেও ওর যেন কিছু আসে যায়না।কারণ এখন ওর কাছে আহসানের চলে যাওয়াটা বেশি দুঃখজনক।শরীরের মায়া নেই।জায়নামাজের পাটিটা রেখে দু মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।প্রায় দু ঘন্টা পর রিমি চোখ খোলে কিছুর শব্দ পেয়ে।বিছানা ধরে ধিরে ধিরে উঠে দাঁড়ালো রিমি।যতটা জলদি চলা সম্ভব ততটা প্রচেষ্টা নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।সামনে যাকে দেখতে পেল তাকে দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে আবারও সেন্সলেস হয়ে গেল।এবার আর মাটিতে পড়েনি আহসান চট করে রিমিকে জড়িয়ে নিল।

রিমির জ্ঞান ফিরলে ও নিজেকে আম্বিয়ার কোলে আবিষ্কার করলো।আম্বিয়া রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।আহসান আর নাজমুল দাঁড়িয়ে ছিলো।আহসানের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় রিমি।তারপর মাথা উঁচিয়ে আম্বিয়াকে প্রশ্ন করলো,মা কি হয়েছে আমার?উনি কখন এসেছেন?
-তুই আহসান বাবার সাথে কথা বল আমি তোর জন্য খাবার দিয়ে যাচ্ছি।
-লাগবে না মা আমি ঠিক আছি।তুমি আর আব্বু খেয়েছো তো?

-আমরাও খেয়ে নিচ্ছি এখন চিন্তা করিস না।এই বলে চলে যায় আম্বিয়া।তার সাথে নাজমুল ও চলে গেলেন।তারা চলে গেলে আহসান রিমির পাশে গিয়ে বসে।তাই দেখে রিমি উঠতে নিচ্ছিলো কিন্তু আহসান রিমিকে উঠতে মানা করে দেয়।
-একদম ওঠার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।চুপচাপ শুয়ে থাকো।এখন খাবার খেয়ে আমি মেডিসিন আনিয়েছি সেটা নেবে।
-ঢং দেখতে এসেছেন আপনি?দেখতে এসেছেন আমি মরে গিয়েছি কিনা?
আহসান ভাবতে পারেনি রিমির কাছ থেকে এমন কিছু শুনবে।

-তোমার রাগের কারণ আমি জানি।তবে এখন রাগ দেখানোর সময় নয় তুমি খাবারটা খেয়ে নিবে চুপচাপ। তারপর একটা লম্বা রেস্ট নেবে।খুব বেশিই ট্রেস নিয়ে ফেলেছো তুমি।এক বিন্দুও শক্তি নেই তোমার শরীরে।
-আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন।নাহ সরি এর থেকে বেশি কিছু চেয়েছিলেন।আপনার মেইন টার্গেট ছিলো আমাকে মেরে ফেলার কিন্তু আফসোস আপনার প্লান সফল হয়নি।হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে চুপ হয়ে গেল রিমি।কে আসছে সেটা বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিল।আম্বিয়া খাবার গুলো দিয়ে চলে গেলে রিমি আবারো বলতে শুরু করলো,চলে যান আপনি।আপনার বাড়িতে চলে যান।আমিই পথের কাটা তাইতো?

আমি যখন পথের কাটা তখন আমি আর যাচ্ছি না আপনার সাথে।আমার জন্য আপনাকে অনেক ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়েছে।কিন্তু আর না আপনি চলে যেতে পারেন।মুক্তি দিলাম আপনাকে।ডিভোর্স পেপারে সাইন করে পাঠিয়ে দিয়েন আমি সাইন করে দেব।একনাগাড়ে বলে দিল সবকিছু।তবে আহসান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।আহসান শান্ত গলায় বললো,এখান থেকে কিছুটা দূরেই আমার এক বন্ধুর বাড়ি।তার মা হঠাৎই প্যারালাইজড হয়ে যায়।আমাদের হসপিটালেই admit করিয়েছে তাই আমাকে বলেছে হসপিটালে একবার যেতে।বন্ধুর সাথেই ফোনে চ্যাট হচ্ছিলো তখন তুমি এসে পড়েছিলে।আমি তখন খুব রেগে ছিলাম তাই কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম।সরি আমার জন্য তোমরা সবাই খুব চিন্তিত ছিলে।

রিমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,চিন্তিত হলেও আপনার তো কিছুই যায় আসেনা।আপনি যা মনে করেন তাই করে যান।আমরা তো সামান্য মানুষ।মিডিলক্লাস মানুষ।আমাদের চিন্তা হলে আপনাদের মতো বড়লোকদের কি বা এসে যাবে?আমরা তো তুচ্ছ নগন্য।নাহ আমাদের কিছুই হবেনা।আমাদের চামড়া মোটা তাইতো আমরা আপনাদের মতো হাইকোয়ালিটির না।
-সরি বলেছি তো!এতো কথা পেচানোর কি আছে?আমার কাছে ফোন ছিলোনা যে তোমাকে বলবো।হসপিটাল থেকে মমকে ফোন করে জানিয়েছিলাম যে তোমরা কল করলে যাতে বলে আমি হসপিটালে আছি।তাছাড়া আমার কাছে তোমার নাম্বার ছিলো না যে জানাবো।

-থাক আমি কিছুই শুনতে চাইনা।আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে না মিস্টার আহসান।আপনি আপনার খেয়াল মর্জি অনুযায়ী চলুন আমার তাতে কিছুই আসে যায়না।আর দোষটা বরাবরই আমার ছিলো।কথার মাঝে রিমির পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে।রিমি হাত দিয়ে পেট চেপে ধরেছে।রিমি চোখ অফ করে আছে ব্যথায়।
-দেখেছো না খেয়ে থাকার এক্সামপল!বেশি কথা না বলে খেয়ে নেও কুইক।কে বলেছে না খেয়ে থাকতে হুম?

রিমি ব্যথা চেপে বলে,আমি খাই বা না খাই তাতে আপনার কি?কিছুই না।আমাকে জোর না করলে বেশি খুশি হবো আমি।
-আমার কথা শোনো নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম!
-বলেছি তো খাবনা।
-আচ্ছা আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে হাত দিয়ে খেতে হবে না।
-আপনার হাতের মার খেতে পারি এটাই আমার ভাগ্য।খাবার খেয়ে আপনার হাত নোংরা করতে চাইনা।আমাদের খাইয়ে দিলে আপনাদের প্রেস্টিজ কমে যাবে।
-এবার খুব বেশি হচ্ছে বলে দিলাম?আমার কথা শোনো বলছি।

-আপনি কানে শুনতে পান না?কানে কালা নাকি?আমি আপনাকে চলে যেতে বলেছি।চলে যান এখান থেকে।আপনি অনেক উপকার করে ফেলেছেন আমার।অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছেন আমায়।শরীরের অনেক রক্তক্ষয় করেছেন আমার।যদি চান আরও রক্ত বের করুন আমার।তবুও আমাকে মুক্তি দিন।আমি আর নিতে পারছি না।লোকলজ্জার ভয়ে আর বাবা মায়ের সন্মানের কথা ভেবে এতোদিন মুখ বুঝে আপনার সব আঘাত,শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সবই সয়েছি। সব হাসি মুখে মেনে নিয়েছি।বুঝতে দেইনি আমার ভেতরের অতৃপ্ত আত্মার আর্তনাদ।কারণ কি জানেন?কারণ শুধু একটাই,তা হলো আমার নিষ্পাপ বাবা মা।আমি অনেকবার চেয়েছি আপনাকে মুক্তি দিয়ে চলে আসি কিন্তু ওই কাজটা যে খুব কঠিন আমার জন্য।আপনি জানেন না গতকাল রাতে আম্মু আমাকে যা তা বলেছে আপনি চলে যাওয়ায়।আর যদি আমি একেবারে এখানে চলে আসতাম তাহলে তো কোনো কথাই ছিলো না।এই কারণ গুলোর জন্যই আপনাকে সহ্য করা।নইলে আপনার মতো নরপশুকে কবেই ছেড়ে চলে আসতাম।আপনি এক কথায় একটা মানুষ না অমানুষ।হ্যাঁ হ্যাঁ অমানুষ।

-ব্যাস অনেক হয়েছে।এনাফ ইজ এনাফ।আর শুনতে পারছি না আমি।অনেক বলে ফেলেছো তুমি আর না।আমি মানছি আমি মানুষ না।তবে আমাকে কি মানুষ বানানো যায়না?দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ তো এক হয়না।কেউ ভালো হয় আবার কেউ খারাপ।তাই বলে খারাপকে ভালো করা যায়না তা কিন্তু নয়।খারাপ যে চিরকাল খারাপই থাকবে সেটাও নয়।আমি বলছি না আমি ভালো কিন্তু আমার মাঝের খারাপের কি বিনাশ করা যায়না?যায়না খারাপকে বদলে ভালোর জায়গা তৈরি করা?বলো যায়না?আন্সার মি?

রিমি অবাক দৃষ্টিতে আহসানের দুটি চোখ দেখে যাচ্ছে।রিমি এই প্রথম আহসানের চোখে এক অদ্ভুত মায়া দেখতে পেল।যে মায়া ওর সব রাগ নিমিষেই শেষ করে দিল।রিমি খুব আস্তে বললো,আপনি কি চান বলুনতো?আহসান রিমির প্রশ্নে বেশ বিচলিত হয়ে গেল।আর মনে মনে বললো,সত্যি তো আমি আসলে কি চাই?আমি কি চাই সেটাই তো জানি না।তাহলে আমি এতটা কষ্ট কেন পাচ্ছি।কেন মনে হচ্ছে আমি যা চাই তা আমাকে চায়না।তাইতো নিজের চাওয়া টা এখনো অপূর্ণ আছে।আমি তো নিজের চাওয়া থেকেই অজ্ঞাত তাহলে আমি কিভাবে নিজের মনকে তার লক্ষ্য অবধি নিয়ে যাব?আহসানকে চুপ করে থাকতে দেখে রিমি আবার বললো,জবাব নেই আপনার কাছে।কারণ আপনি নিজেই জানেন না আপনি কি করেন বা কি করতে গিয়ে কি করে ফেলেন।আপনার মতিগতিরই ঠিক ঠিকানা নেই চাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার।

-আমি চাই তুমি আমাকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করো।আমি চাই তুমি আমার মধ্যে থাকা দাম্ভিক মানুষ টাকে মেরে ফেল।মেরে ফেল অহংকার কে।উদয় করো মনুষ্যত্বের।কি পারবে না?
-আপনি সত্যি ভালো মানুষ হতে চান?(চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে)
-হুম চাই।সাহায্য করবে কি আমায়?
-আপনি যদি সত্যি ভালো মানুষ হতে চান তাহলে আমি আপনাকে সাহায্য করবো।তবে তার জন্য আপনাকে আমার সব কথা মেনে চলতে হবে।কথা দিন আমায়।
আহসান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,হুম কথা দিলাম।কিন্তু তুমি এখন আমার কথা শুনবে।
রিমি বুঝতে পারলো আহসান কি চায়।তাইতো খাবার প্লেটটা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলো।রিমিকে খেতে দেখে আহসানের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল।

দুপুরের হলুদ আভা কমে বিকেলের দিকে ঢলে পড়েছে।রিমি এখনো ঘুমিয়ে আছে।আহসান সেই সকাল থেকে রিমিকে পাহারা দিচ্ছে যাতে রিমির ঘুমে কোনো প্রকার বাধা না পড়ে।আহসান নতুন ফোন অর্ডার করেছিলো।কিছুক্ষণ আগে ডিলেভারিম্যান এসে দিয়ে যায়।আহসান এখন ওর নতুন ফোনে পুরনো সিম লাগাতে ব্যস্ত।এমন সময় রিমির ঘুম ভেঙে যায়।ভালো করে চোখ কোচলে উঠে পড়ে রিমি।আহসান রিমিকে উঠে যেতে দেখে বলল,কি করছো?আরেকটু রেস্ট নেও ভালো লাগবে শরীর।
রিমি দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,আপনার মাথা ঠিক আছে তো?বেলা ৫টা বাজে আর আপনি কিনা এখনো ঘুমিয়ে থাকতে বলছেন!আগে ডাকেননি কেন আমায়?

-তুমি সারারাত না ঘুমিয়ে খুব বেশি সিক হয়ে পড়েছো তাই ডাকিনি। এখনো পুরোপুরি ক্লান্তি কাটেনি তোমার।তাই কিপ রেস্ট।
-একদম ই না।আমি এখন খুব ভালো আছি।একটুও ক্লান্ত নই।দেখুন ভালো করে।(মুখটা এগিয়ে দিয়ে)
-আমি ডক্টর নাকি তুমি হুম?
-কেন, আপনি।
-তাহলে আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে।
-এমন করছেন কেন?আমার আর ভালো লাগছে না শুয়ে থাকতে।প্লিজ আমাকে আর ঘুমানোর শাস্তি দেবেন না।
-আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি তাহলে শাওয়ার নিয়ে নাও।সকাল থেকে ঘুমিয়েছো।তাই শাওয়ার নেওয়ার সুযোগ পাওনি।
-হুম ঠিক বলেছেন।

রিমি সদ্য গোসল করে বাহিরে বেরিয়েছে।মাথায় টাওয়াল পেচানো।টাওয়ালটা খুলে সেটাকে পাক দিয়ে চুলে বারি দিল।আর সাথে সাথে আহসান চিল্লিয়ে বলে,এই তুমি কি করলে এটা?ভিজিয়ে দিলে তো আমাকে!
-আমি কতটা দূরে দেখেছেন?এতো দূর থেকে আপনি ভিজবেন কি করে?যেভাবে বললেন মনে হচ্ছে আমার চুলের মধ্যে এক বালতি পানি আছে।যেই পানি আপনাকে কাঠ ভেজা ভিজিয়ে দিয়েছে।
-আমি ভিজিনি?দেখো আমার মুখ ভিজেছে কি ভিজেনি এই বলে রিমির কাছে তেড়ে গেল আহসান।

রিমি ভয় ভয় চোখে বলল,ক কি করবেন আপনি হুম?আ আমি মুছে দিচ্ছি আপনার মুখ।রিমি ওর ওড়না দিয়ে আহসানের মুখ মুছে দিতে লাগলো।রিমির এমন কাজে আহসানের রাগ উবে গেল।আহসান নেশাক্ত চোখে রিমির কপালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিল।রিমি আহসানের ভাব বুঝতে পেরে কিছুটা দূরে সরে এসে বলল,আমি আপনার জন্য কফি নিয়ে আসছি এই বলে দিল এক দৌঁড়।রিমির এরুপ কান্ড দেখে আহসান বাকা হেসে বললো,বড্ড বেশি পাগলী তুমি।ওপ্স অনেক কাজ জমে আছে আমার।হারি আপ আহসান এই বলে পুনরায় কাজে মন দিল।

বাহিরে বেরিয়ে রিমি আহসানকে আচ্ছা মতো ধোলাই করে যাচ্ছে।
-হুহ,ব্যাটা খচ্চর,খাট্টাশ, লুচু কোথাকার।উনি বদরাগী,দাম্ভিক সাথে লো ক্যারেক্টারের ও।পুরো ক্যারেক্টারলেস।কিছু বলিনা বলে মাথায় চড়ে বসেছে একদম।কথা নেই বাত্রা নেই এসব কি শুরু করে দেন উনি!ওনার মতলব মতিগতি সত্যি ভালো নেই।এখন থেকে দূরুত্ব বজায় রেখে চলতে হবে ওই ভ্যাম্পায়ারটার থেকে।

-কে ভ্যাম্পায়ার?
রিমি সামনে তাকিয়ে দেখলো আম্বিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
-কোথায় ভ্যাম্পায়ার?(রিমি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল)
-তুইতো বলছিলি ভ্যাম্পায়ার নিয়ে কিছু একটা।
-ওওওও আচ্ছা।ধুর বাদ দাও তো কি ভ্যাম্পায়ার ভ্যাম্পায়ার লাগিয়ে রেখেছো সেই থেকে।তুমি বলো খেয়েছিলে তো?
-হুম খেয়েছি।
-আর আব্বু?

-সে তেমন খেতে পারেনি রে।গ্রামে গিয়েছে সেই সকালেই।
-কিহ!গ্রামে কেন গিয়েছে?বলে যায়নি তো!
আম্বিয়া হতাশা নিয়ে বললেন,তোর চাচা খুব অসুস্থ রে।তোর বাবাকে দেখতে চাইলো তাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন।তোদের না জানিয়ে গিয়েছে।বলেছে তোদের বিরক্ত করার দরকার নেই।তাই বলে যায়নি।জামাই বাসায় এই জন্য যাওয়ার জন্য তার মন সায় দিচ্ছিলো না।কিন্তু কি করবে? ভাইকেও তো দেখতে হবে।
-ওও,চাচা কদিন পর পরই অসুস্থ হয়ে যান।কতো বলেছি মাঠে ঘাটে না দৌঁড়ে একটু আরাম করতে।যোয়ান মদ্দ তিনটা ছেলে তার তাও সারাদিন খেটেই যায়।যাই হোক তুমি বলো বাজারের ব্যাগ নিয়ে কি করছো?

-ওমা!বাজারের ব্যাগ নিয়ে কি করে তা তুই জানিস না নাকি?
-জানি তবে তোমার হাতে কেন?
-একটু বাজারে যাওয়ার কাজ ছিলো।তোর বাবা থাকলে তো সেই এনে দিত।
-হুম।কিন্তু তুমি এই হাটুর ব্যাথা নিয়ে সারা বাজার কিভাবে ঘুরবে?
-কিছু করার নেই রে মা।আজ যদি একটা ছেলে থাকতো তাহলে এতো কষ্ট করতে হতো না।(কথাটা বলতে গিয়ে আম্বিয়ার চোখ ছলছল করে এলো)
-কতবার বলেছি এই কথাটা বলবে না কখনো!ছেলে নেই তাতে কি?আমি তো আছি।আমি থাকতে তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।

-তুই আর কি করবি?আমি গেলাম আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে যেতে পারে বা রাত।
-তুমি এই ব্যাগটা আমাকে দাও বলে আম্বিয়ার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে নেয়।
-দেখ আমার কাছে কিন্তু সময় নেই।ব্যাগটা দিয়ে দে।
-না তুমি গিয়ে শুয়ে থাকো আমি বাজার করে আনছি।
-কি যা তা বলছিস!জামাই শুনলে বলবে কি?
-কিছুই বলবে না,আমি ওনাকে নিয়েই যাচ্ছি।
-ছিহ,লোকে কি বলবে?জামাই মেয়েকে বাজারে পাঠিয়ে দিলাম ছি ছি।
-এতে ছি ছি করার কিছুই নেই।তুমি তোমার রুমে যাও।নইলে ব্যাগ দেবনা বলে দিলাম।
-এমন করিস না মা!

-উফফ চুপ করো তো।রিমি আম্বিয়াকে রাজি করিয়েই ছাড়লো।তারপর নিজের রুমে এসে বোরকা পড়ে নিল।আহসান রিমিকে বোরখা পড়তে দেখে জিজ্ঞেস করে,তুমি এই সময়ে বোরকা পড়ে কোথায় যাচ্ছো?
-আমি একা যাচ্ছি না আপনি ও যাচ্ছেন।(হিজাব পড়তে পড়তে)
-মানে?আমি কোথায় যাচ্ছি?
-বাজারে।
-What nonsense!আমি কিনা বাজারে যাব?
-হুম তো?
-আমি বাজারে গিয়ে কি করবো?
-বাজারে গিয়ে মানুষ বাজারই তো করে।কখনো শুনেছেন বাজারে মানুষ লেখাপড়া করতে যায়?
আহসান অনামিকা আঙুল রিমির দিকে তাক করে বলে,Don’t talk rubbish..একদম উল্টো পালটা আন্সার্স দিবে না বলে দিলাম।

-উনি নাকি ভালো মানুষ হবেন হাহ!দু মিনিট রাগ সহ্য করতে পারে না আর উনি নাকি ভালো মানুষ হবেন।আমি ঠিক জানতাম উনি ভালো কেন ভালোর ভ ও হতে পারবে না।
-বাজারে গেলেই তো কেউ ভালো হয়ে যায়না।কিসের সাথে কি মেলাচ্ছো হুম?
-আমাকে আপনি কি বলেছিলেন?(আহসানের দিকে তেড়ে গিয়ে)
আহসান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি বলেছিলাম?

তোলপাড় পর্ব ১৭+১৮+১৯

-বাহ সুন্দর তো!এখন ভুলেই গেছেন কি বলেছিলেন।সব জানতাম আপনাদের মতো বড়লোকরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না।আপনাদের কথার কোনো ভেলুই নেই।আজ যদি আপনার জায়গায় একজন সাধারণ মানুষ থাকতো তাহলে সে ঠিকই বাজারে যেত।
-What! are you crazy?দেখ আমি ছুটিতে আছি তাতে কি?আমাকে হসপিটালের অনেক কাজ করতে হয় বুঝেছো?
-থাক হয়েছে।আর বাহানা বানাতে হবে না।আমি বেশ বুঝতে পারছি আপনাকে গরু ছাগল বানানো যাবে তবে ভালো মানুষ না।এটা আমার দ্বারা সম্ভব না।রিমি দেখলো আহসান চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

-এ এ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?আপনার ইচ্ছে না হলে যেয়েন না।আর আমাকে মাফ করবেন আমি আপনার মতো অবাধ্য ছাত্রকে ভালো বানাতে পারলাম না।সরি আমি একাই যাচ্ছি বাজারে এই বলে বেরিয়ে আসছিলো কি আহসানের কথায় থেমে যায়।
-দাঁড়াও,আমি যাচ্ছি তোমার সাথে।(বিরক্তি নিয়ে)
রিমি মিটিমিটি হেসে ঘুরে দাঁড়ালো।
-এইতো লাইনে এসেছেন।এবার চলুন।
আহসান ও রিমি নিচে নামলো।নিচে নেমেই আহসান ওর গাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।রিমির জন্য দরজা খুলে দিল কিন্তু রিমি উঠলো না সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো রাগী ফেস করে।

তোলপাড় পর্ব ২৩+২৪+২৫