দুঃখবিলাসী শেষ পর্ব

দুঃখবিলাসী শেষ পর্ব
তানিশা সুলতানা

নয় মাসের পেট নিয়ে মাইশার চলাফেরা করা কষ্টকর হয়ে গেছে। সাধারণত আর পাঁচটা প্রেগন্যান্ট মহিলার থেকে মাইশার পেটটা বেশিই উঁচু হয়েছে। আজকে রিয়াদ মাইশাকে নিয়ে গিয়েছে চেকআপ করাতে। প্রতি মাসে এক বার করে ডাক্তারের চেম্বারে যেতে হয় তাদের। মাইশার যাবতীয় দায়িত্ব রিয়াদ পালন করে আসছে। ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে মাঝরাতে পা ব্যাথা করলে পা মালিশ করে দেওয়া, ঠিক মতো ঔষধ এবং খাবার খাওয়ানো। সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এবং সেই সাথে অফিসটাও করে যাচ্ছে।

রেহেনা বেগম আমিনুল, আইরা সকলেই মাইশা ভীষণ আদুরে রাখে।
কথায় বলে না অসহায় মানুষ একটু ভালোবাসা পেলে আহ্লাদী হয়ে ওঠে। মাইশার অবস্থাও তেমন। মাইশা কখনো নেকা ছিলো না। কিন্তু ইদানীং নেকা হয়ে যাচ্ছে। কতো কষ্ট সয্য করেছে, কতো মাইর খেয়েছে। কখনো চোখের পানিটুকুও কেউ মুছিয়ে দেয় নি। তবে এখন একটু পেট ব্যাথা করলেই মাইশা কেঁদে ওঠে। আর তার কান্নায় অস্থির হয়ে পড়ে রিয়াদ রেহেনা আমিনুল এবং আয়রা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাইশার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়ালে তারা অস্থির হয়ে ওঠে। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও কখনো মানুষ মানুষকে এতোটা ভালোবাসে?
মাইশার পড়নে ঢিলেঢালা মেক্সি। পা দুটো আবারও ফুলে উঠেছে। সকালেই রিয়াদ তেল মালিশ করে দিয়েছে।
রিয়াদ মাইশাকে তৈরি হতে দিয়ে নিজে চেঞ্জ করতে গিয়েছে। মাইশা জামাটাই পাল্টেছে শুধু।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে যাচ্ছে। রোগা পাতলা মাইশা এখন মোটু হয়ে গিয়েছে। চাপা ভাঙা গাল দুটো গোলুমলু হয়ে উঠেছে।

পেটের জন্য পা দুটো দেখতেই পারে না মাইশা। নিচু হতে পারে না। উঁচু পেটটাতে হাত বুলায় মাইশা। আনমনে বলে ওঠে
“আমার সোনা
মা কখনো ভুলে যাস না।
রিয়াদ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঢুকে পড়ে
” টুনির মা হলো তোমার?
মাইশা রিয়াদের কন্ঠ পেয়ে তারাহুরো করে ওড়না খানা মাথায় চাপিয়ে নেয়।
“এই তো আমি রেডি।

রিয়াদ মুচকি হাসে। এগিয়ে আসে মাইশার দিকে। আয়নার দিকে ঘুরিয়ে দেয় মাইশাকে। মোড়া টেনে বসতে ইশারা করে। মাইশা বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়ে।।
ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে চিরুনিখানা তুলে নেয় রিয়াদ। আলতো হাতে আঁচড়াতে থাকে মাইশার চুল। আয়নায় রিয়াদকে দেখতে থাকে মাইশা।

আচমকা মাইশা প্রশ্ন করে
” আমায় খুব ভালোবাসো তাই না?
থমকে যায় রিয়াদ। হাত থেমে যায় তার। তাকায় মাইশার চোখের দিকে। ছোট করে জবাব দেয়
“হুমম

” আমার কিছু হয়ে গেলে তোমার টুনিকে তুমি ভালোবাসবে? আগলে রাখবে? শিহাবের হাতে তুলে দিবে না তো?
কলিজা কেঁপে ওঠে রিয়াদের। আতঙ্কিত হয় তার চোখ মুখ। মাইশা আবারও হাসে।
“মানুষের মৃত্যুর কথা তো বলা যায় না।
” দেখা যাবে তখন। ফিউচার ভাবতে হবে না তোমার।
“ইভাকে জেলে ঢোকালে তুমি। তাহলে আমার নাম কেনো দিলে?
রিয়াদ আবারও অবাক হয়। মাইশা জানলো কি করে?
হ্যাঁ রিয়াদ আর সোহেল ভিডিও করেছিলো সবটা। ইভার পিছু লেগেছিলো। শিরিন এর নারী পাচারও তারাই ফাঁস করেছে।

সোহেল রিয়াদ এর বন্ধু।
” যাতে শিহাব তোমায় দুর্বল না ভাবে। সে যাতে বোঝে মাইশা প্রতিবাদী।
“জিজ্ঞেস করবে না আমি কিভাবে জানলাম?
“তুমি সোহেল এবং আমার কথা শুনে ফেলেছিলে। সেটাও আমি জানি।
রেহেনার থেকে বিদায় নিয়ে রিয়াদ মাইশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাইশা বায়না ধরেছে আজকে রিকশা করে যাবে। অগত্যা রিয়াদ রিকশা ডেকে নেয়। বাজার পেরুতেই রিকশা আটকে দাঁড়িয়ে যায় শিহাব। থেমে যায় রিকশা। আতঙ্কিত হয় মাইশা। রিয়াদের হাত খানা শক্ত করে ধরে ফেলে।

শিহাব আসলে এই এলাকাতে এসেছিলো বেড়াতে মুজিবুরকে নিয়ে। এখানে শিহাব এর দাদাবাড়ি। হঠাৎ করেই খেয়াল করে মাইশাকে। এক দৌড়ে চলে এসেছে।
শিহাব মাইশার হাত খানা ধরে ফেলে
” মাইশা কতো খুঁজেছি তোমায়। কোথায় ছিলে তুমি?
শিহাব এর চোখের কোণে পানি জমেছে। মাইশা শুকনো ঢোক গিলে। শিহাবের থেকে নিজের হাত খানা ছাড়াতে চায়।
রিয়াদ ক্ষেপে যায়। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় শিহাবকে।

“ওকে ছোঁয়ার সাহস হয় কি করে তোর?
শিহাবও রেগে যায়। সে তেড়ে এসে রিয়াদের কলার টেনে ধরে
” তোর সাহস হয় কি করে আমার বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার?
এভাবে দুজনের কথা বাড়তে থাকে হাতাহাতি বাড়তে থাকে। ছোট্ট রিকশাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। দুই হাতে দুই কান চেপে ধরে বসে থাকে মাইশা।

রিয়াদ এক লাফে রিকশা থেকে নেমে যায়। রিকশামামাও নেমে পড়েছে। শিহাব রিয়াদকে লাথি দিতে যায় রিয়াদ সরে যাওয়াতে লাথিটা রিকশায় লাগে এবং মাইশা সহ রিয়াদ উল্টে পড়ে যায়।
রিকশার খানিকটা ভর পড়ে মাইশার পেটে। চিৎকার করে ওঠে মাইশা। হুশশ ফেরে রিয়াদের।
রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে রাস্তা। দিশেহারা হয়ে ওঠে রিয়াদ। শিহাবও বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। রিকশা মামা চিৎকার করে ওঠে। মাইশাকে গিয়ে ধরতে যায়। মাইশা রক্ত মাখা হাত খানা উঁচু করে রিয়াদকে ডাকে।
রিয়াদ হাউমাউ মাইশার কাছে যায়। কোলে তুলে নেয় মাইশাকে। মাইশা চিৎকার করে কাঁদছে ছটফট করছে।
শিহাব গাড়ি থামায়।

হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে রিয়াদ। চোখ দুটো তার রক্তবর্ণ রূপ ধারণ করেছে।শিহাবও দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা দূরে।
আমিনুল সামলাচ্ছে রেহেনা বেগমকে। এতোগুলো দিন মেয়েটাকে রেখেছে ভালোবেসেছে। কতো খেলনা কিনেছে বাচ্চাটার জন্য।

মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে? নিজেকে সামলাতে পারছে না রেহেনা। তার আরও একটা চিন্তা মাইশার কিছু হয়ে গেলে তার ছেলেটার কি হবে? মরেই যাবে তার ছেলে।
একটু পরেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসে। কান্না থামে রেহেনার। সে দাঁড়িয়ে যায়। শিহাবও এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
রিয়াদ শুধু মাথা তুলছে না।

একটু পরেই সাদা তোয়ালে মোরানো ছোট্ট চাঁদকে নিয়ে বের হয় এক নার্স। মুখটা তার বিষন্ন।
শিহাব বাচ্চাটাকে ছুঁতে গেলেও নার্স ছুঁতে দেয় না। তিনি মাথা নিচু করে জবাব দেয়
“ম্যাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে বলে গিয়েছে বাচ্চাটাকে তার বাবার কাছে দিতে। এবং আপনাকে ছুঁতেও নিষেধ করে গিয়েছে।
বলতে বলতে নার্স রিয়াদের কোলে দেয় বাচ্চাটাকে। রিয়াদ দুহাতে আগলে নেয়। তবে কথা বলে না।
” শেষ নিঃশ্বাস মানে?

আমিনুল ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে ওঠে।
তখনই ডাক্তার বেরিয়ে আসে।
“সরি আমরা তাকে বাঁচাতে পারি নি। প্রচন্ড রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।
মাথা নিচু করে বলে ডাক্তার। রেহেনা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আমিনুলও শব্দ করে কেঁদে ওঠে। শিহাবও কাঁদছে। পানি নেই শুধু রিয়াদের চোখে। সে বাবুটার দিকে তাকিয়ে আছে।
কালো গোলাপ বাগানের ঠিক সামনে মাইশাকে খাটিয়াতে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। গোছল করানো শেষ। সাদা কাফনে মোরানো হয়ে গিয়েছে। মুখটা শুধু একটুখানি খোলা রাখা হয়েছে।

রেহেনা বেগম দুবার জ্ঞান হারিয়েছেন। আমিনুল পাথরের মতো বসে আছে।
বাড়ি ভর্তি মানুষের আনাগোনা। সকলেই শেষবার দেখতে এসেছে মাইশাকে। মাইশার ফুটফুটে মুখখানা দেখে সকলেই আফসোস করছে অকালে চলে যাওয়ার জন্য।
শিহাব গেইটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢোকার সাহস তার নেই।
রিয়াদ ছোট্ট টুনিকে নিয়ে মাইশার খাটিয়ার পাশে বসে পড়ে

” আমাকে বিয়ে করবে না বলে চলেই গেলে? আমি কথা রাখতে পারি নি বলে এভাবে একা করে দিলে? আমাকে ভালোবাসলে না কেনো মাইশা? আমার হলে না কেনো?
শেষের কথা চিৎকার করে বলে ওঠে রিয়াদ। ছুঁয়ে দেয় মাইশার মাথা। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। রিয়াদের চিৎকার করা কান্নায় উপস্থিত প্রতিটা মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠে। ছোট্ট বাবুটাও কেঁদে ওঠে। হয়ত সে বুঝতে পেরেছে এই দুনিয়ায় সে মায়ের আদর পাবে না। এক দুঃখবিলাসীর পেটে জন্ম তার।

“আমি তোমাকে ভালোবাসি মাইশা। খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমাকে পাওয়ার দাবি আমি মরার পরেও ছাড়বো না।
প্রিয় মানুষটাকে কবরে শুয়িয়ে রিয়াদ হাঁটু মুরে বসে পড়ে সেখানেই। হাতে তার এক গুচ্ছ কালো গোলাপ। বাড়ির ঠিক সামনে মসজিদের পাশে কবর দিয়েছে মাইশাকে।
গোলাপ গুলো কবরের পাশে রাখে রিয়াদ।

” ইচ্ছে ছিলো টুনিকে নিয়ে যেদিন আমার বাড়িতে প্রবেশ করবে। হাঁটু মুরে প্রপোজ করবো তোমায়। ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখি কি করে বলো?
আমাকে ভালোবাসতে মাইশা। সুন্দর একটা জীবন হতো আমাদের। স্বপ্নের মতো বাঁচতাম আমরা।
বলতে বলতে কবরের পাশে শুয়ে পড়ে রিয়াদ।

দুঃখবিলাসী পর্ব ১৬

“হোক না কল্পনা। তবুও তুমি শুধুই আমার। আজকে থেকে আমাদের নতুন জীবন শুরু। যেভাবে চাওয়া পাওয়ার হিসেব থাকবে না। শুধু থাকবে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। দুঃখবিলাসীর গল্পটা শেষ হলো আজ। শুরু হলো রিয়াদ মাইশা এবং রিশার গল্প। আমাদের মেয়ের নাম রিশা রেখে দিলাম। সুন্দর হলো না বলো মাইশা?
এখানেই আমাদের ঘর। এটাই আমাদের আসল ঠিকানা।

সমাপ্ত