দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩২

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩২
তাসফিয়া হাসান তুরফা

তালুকদার বাড়িতে আমেজ লেগেছে। ছেলের প্রথম সাফল্যে আসমা বেগম অত্যাধিক খুশি, রাতের খাবারে ছেলের পছন্দ অনুযায়ী টুকটাক রান্না করছেন। যদিও আয়মান তালুকদার একবার বলেছিলেন এসবের দরকার নেই উনি বাইরে থেকে অর্ডার করবেন কিন্তু মায়ের মন নিজ হাতে সন্তানের জন্য রান্নায় তৃপ্তি পায়। তাই উনি সেটাই করছেন।

এরই মাঝে নিশীথ বাসায় চলে আসে। ওর ফ্রেশ হওয়ার মাঝেই কাজের মেয়েরা সব খাবার টেবিলে খাবার দিয়ে যায়। আসমা বেগম সবাইকে ডাকতেই ডাইনিং টেবিলে আসর জমে। সাধারণত, নিশীথের চাচারা উপরতলায় নিজেদের ফ্ল্যাটে খাওয়াদাওয়া করলেও আজ আসমা বেগমের কথামতো উনারা সকলেও নিচে নেমে এসেছেন। ফলে নিশীথদের বাসায় আজ মানুষে-মানুষে জমজমাট পরিবেশ!
খাওয়া শুরু হয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ অতিবাহিত হওয়ার পর নিশীথের চাচি ওকে অভিনন্দন জানান। নিশীথ হেসে ধন্যবাদ জানাতেই ওর চাচা আরেফিন সাহেব বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আমি তো আগে থেকেই ভাইকে বলেছিলাম নিশীথ যত পরিশ্রম করছে এরপর ডিল সাইন না হয়ে যাবেই না কোথাও! সেদিন কথাবার্তা ঠিকঠাক না বলেই চলে গিয়েছিলো ওনারা সবাই। কিন্তু খন্দকার সাহেব অভিজ্ঞ মানুষ। দেখলে তো উনি ঠিকই হতে হতে না হওয়া ডিল সাইন করে দিলেন!
—খন্দকার সাহেব আসলেই জ্ঞানী মানুষ। তবে উনার পিএ অনেক এরোগ্যান্ট। ওকে আমার শুরু থেকেই পছন্দ হচ্ছিলোনা!

আয়মান সাহেবের কথায় নিশীথ বাকা চোখে চায়। মূলত উনি সেই পিএ-র কথা বলছেন যার কারণে ডিল ওইদিন ফাইনাল হয়নি। খন্দকার সাহেবের ডান হাত, মূলত তখন থেকেই ওই লোকটাকে আয়মান সাহেব দেখতে পারেন না। নিশীথ জানে বাবার ব্যবসায় লস হবে এমন কিছুতে জড়িত কাউকে তিনি মোটেও পছন্দ করেন না। তাই পিএ-র ব্যাপারে আয়মান সাহেবের এমন কথা শুনেও সে খুব একটা বিস্মিত হলো না! চুপচাপ নিজের খাওয়ায় মন দিলো।

এদিকে নিশীথের দাদু ইউনুস তালুকদার বেজায় খুশি নিজের নাতির জন্য। এতদিন ওকে ঠেলতে ঠেলতে অফিস পাঠানোর কিছু তো লাভ হলো, উনি ভাবলেন। তাই নিজের খুশি ঢেকে না রেখে চড়া গলায় নাতির প্রশংসায় বললেন,
—ওসব বাদ দে! আসল কথা হচ্ছে, আমি বলেছিলাম না আমার নাতি একবার কাজে ঢুকলে তোদের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলবে? এবার দেখলি তো তোদের বাপের কথা কতটুকু সত্যি! আমার নিশীথ স…

—আহহা দাদু, থামো তো! কেবল তো সব শুরু হলো। তাতেই কিসব শুরু করেছো তোমরা? আমার আর শুনতে ভালো লাগছেনা! অন্যকিছু বলো!
নিশীথ মাঝখান দিয়ে বলে। কেননা, নিজের এত বেশি প্রশংসা শুনার অভ্যাস ওর কখনোই নেই। তাই আজ হঠাৎ এসব শুনতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছে!
এরই মাঝে দাদু ওর পিঠ চাপড়ে বললেন,

—আরে দাদুভাই, আমিও তো তাই বলছি। শুরুতেই তুই যে ফা’টিয়ে দিয়েছিস, কোম্পানির ব্যাপক লাভ হবে এই ডিলে। এবার থেকে দেখবি তোর সামনে সাফল্যের আরও পথ খুলে যাবে!
নিশীথ কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়ায়। পরিবারের লোকজনদের থামতে বলা আর দেয়ালে মাথা ঠুকানো একি জিনিস। এভাবেই চললো কতক্ষণ! খাবার শেষের দিকে নিশীথ উঠতে যাবে এমন সময় আয়মান সাহেব হঠাৎ বললেন,

—এতদিন ধরে বলার পর মাত্র অফিসে ঢুকেছো, কাজ করছো এটা অবশ্যই ভালো কথা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এখনো অফিস থেকে ফিরে আগেকার মতো রাত করে বাহিরে আড্ডা দেবে, বন্ধুদের সাথে অযথা হইহুল্লোড় করবে। এটা আমার পছন্দ না! পরেরদিন সকালেও অফিসে যেতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে ঘুম থেকে উঠবে দেরিতে, ক’দিন পর অফিসেও লেট করে যেতে শুরু করবে। নিজেদের কোম্পানি আর নিজের ছেলে বলে কিন্তু এসব আমি এলাউ করবোনা!

আয়মান সাহেবের কথায় নিশীথ এর চোখমুখ শক্ত হয়। শীতল দৃষ্টিতে বাবার দিক তাকিয়ে দেখে, উনি আগেকার ন্যায় নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে আছেন ওর দিকে। এটা নতুন নয়, বরাবরই নিশীথের বেশিরভাগ অভ্যাস কখনোই আয়মান সাহেবের পছন্দ ছিলোনা। নিশীথ স্বাধীনচেতা ছেলে, ও সবসময় নিজের ইচ্ছামতো চলে এজন্য বাপ-ছেলের মধ্যে মতবিরোধ আজন্ম বহাল ছিলো। দিনকে দিন তা কমার বদলে, উল্টো আরও বেড়েছে বৈকি!

আসমা বেগম পাশ থেকে ছেলের বাম হাত চেপে ধরলেন। নিশীথের আড়চোখে পাশে বসা মায়ের দিকে তাকালো। আসমা বেগম ইশারায় মানা করলেন ছেলেকে, পুরো পরিবার একসাথে খেতে বসেছে। তার উপর ছোট সুহাসও আছে এখানে। এমন অবস্থায় সবার সামনে কোনো বাকবিতন্ডা করা মোটেও ঠিক লাগবেনা! নিশীথ বুঝলো! ফোস করে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। প্লেট ঠেলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

—আমার জন্য আপনার কোম্পানির লাভ না হলেও অন্তত কোনো লস হবেনা এটুকু নিশ্চিত থাকবেন। আমি রাতে যত দেরি করেই বাসায় ফিরিনা কেন, পরেরদিন অফিস ঠিক টাইমেই চলে যাব। এসব নিয়ে আপনার চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই!
নিশীথ হাত ধুতে চলে গেলো। আয়মান সাহেব ও বাকিরা রোবটের ন্যায় সেদিকে চেয়ে রইলো। কিছুক্ষণ খাবার টেবিলে অঘোষিত এক নিরবতা চলার পর যে যার মতো খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।

নিশীথ নিজ রুমে বসে আছে দ্বিধায়। দোলনচাঁপাকে তো কথা দিয়ে এসেছে, বাসায় বিয়ের ব্যাপারে বলবে। কিন্তু আজকে বাবার কথায় মেজাজ এমনিতেও চড়া আছে কথা বলার ইচ্ছেটাও হচ্ছেনা! এখন কি করবে সে? কবে বলবে?
চিন্তাগ্রস্ত নিশীথ যেয়ে দাঁড়ায় বারান্দার কাছে। আবহাওয়া গরম না হলেও, ওর মন-মেজাজ ভীষণ গরম।

মনের উত্তাপ শরীরের মাঝেও ছেয়ে গেছে। গরম লাগছে ওর হঠাৎ! খোলা জায়গায় দাড়াতেই হুরহুর করে শীতল বাতাস এসে ছুয়ে দিলো ওকে! নিশীথ চোখ বুজে ফেলে। মন-মস্তিষ্ক ও শরীর ঠান্ডা করতে ব্যস্ত রাখে নিজেকে। এমনই সময় বাতাসে ভেসে আসে এক মিষ্টি সুবাস। এ সুবাস অপরিচিত নয় নিশীথের কাছে। বরং, এখন এ সুবাসই নিশীথের সবচেয়ে পরিচিত সুবাস, সবচেয়ে প্রিয় ঘ্রাণ! নিশীথের কাংক্ষিত দোলনচাঁপার সুবাস!

নিশীথ চোখ মেলে। হঠাৎই ওর খুব করে দোলার কথা মনে পড়ে! কি করছে মেয়েটা? ফোন দিবে কি একবার? এইযে নিশীথের মনে এখন নানারকম চিন্তার উথাল-পাতাল চলছে, দোলা কাছে থাকলে কি এত খারাপ লাগতো নিশীথের? নাকি ওকে দেখেই সব অশান্তি, মন খারাপ দূর হয়ে যেতো ওর?

নিশীথের মাথার মধ্যে প্রশ্নেরা ঘুরপাক খায়। দোলাকে ফোন দিবে দিবে করেও দেয়না। কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা দোলার মুখশ্রীর দিকে একধ্যানে চেয়ে থাকে। যেন কিছু চিন্তাভাবনা করছে। অবশেষে নিশীথ সিদ্ধান্ত নেয়, ও বাবাকে দোলার কথা বলবে এবং তা আজকেই বলবে। এখনি বলবে! এ মুহুর্তে বাপ, চাচা, দাদা সবাই একত্রে বসে আছেন ড্রয়িংরুমে। সব গুরুজনের সামনে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য এর চেয়ে ভালো মুহুর্ত আর হতে পারেনা নিশ্চয়ই?

ভাবনানুযায়ী, নিশীথ দ্রুতপায়ে রুম থেকে বেরোয়। ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে! হ্যাঁ, ওর ধারণাই সঠিক। তিন বাপ-বেটা একত্রে বসে কথা বলছেন। এটাই সময় ওর বিয়ের কথা বলার। ধীরেসুস্থে বুঝিয়ে সবটা বলতে হবে ওকে। আয়মান সাহেব না বুঝলেও নিশীথের বিশ্বাস অন্তত চাচু আর দাদু ওর পক্ষে থাকবেন নিশ্চিত! তাই দৃঢ় মনোবল নিয়ে ও চুপচাপ ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে দাদুর পাশে বসে পড়ে। আয়মান সাহেব ও আরেফিন সাহেবের মাঝে কিছু সিরিয়াস কথা হচ্ছে নিশীথ বুঝতে পারে। মিনিট পাঁচেক বাদে দাদু বললেন,

—তোরা দুই ভাই মিলেই সব ঠিক করছিস? নিশীথও এখন কোম্পানির মেম্বার। ওর মতামত জানাটাও তো জরুরি তাইনা? ওকেও বল সবটা!
নিশীথ ভ্রু কুচকায়। কিসের কথা বলছে দাদু? এমন সময় আরেফিন সাহেব বললেন,
—তা তো অবশ্যই, আব্বা। নিশীথের জন্যই এসব হলো, ওকে না জানিয়ে যাবো কই?
—কিসের কথা বলছো, চাচু?
নিশীথ দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে শুধায়। আয়মান সাহেব বললেন,

—আমরা ভাবছিলাম একটা ডিনারের আয়োজন করবো পরশুদিন। আফটার অল, সবার বহু কাংক্ষিত এই ডিলটা যেহেতু ফাইনালি সাইন হয়েই গেলো, আমরা তালুকদার এন্ড খন্দকার গ্রুপের ইম্পর্ট্যান্ট মেম্বার্স দের নিয়ে একটা ইনফরমাল ডিনারের আয়োজন করতে চাইছি, কি বলো তুমি?

নিশীথ ভাবে, আইডিয়াটা খারাপ নয়। এতে বরং দুই গ্রুপের মধ্যে প্রফেশনালিজমের পাশাপাশি ইনফরমাল সম্পর্কটাও ভালো হবে। নিশীথও রাজি হয়। সবার সম্মতিতে কাল অফিস যেয়ে এ ব্যাপারে এনাউন্সমেন্ট দেওয়া হবে ঠিক করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক করেই খন্দকারদের ইনভাইটেশন পাঠানো হবে। সব কথা শেষ করে সবাই যখন উঠতে নিচ্ছিলো এমন সময় নিশীথ বলে উঠলো,

—আমাদের আপনাদের সবার সাথে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।
—কি ব্যাপারে?
আয়মান সাহেব প্রশ্ন করেন। নিশীথ ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মিনিটখানেকের মাঝে বলে,
—আমার লাইফ সম্পর্কে। আমার বিয়ের ব্যাপারে…
—মানে?
আয়মান সাহেব আঁতকে উঠেন। এসব কি বলছে ছেলে? এরই মাঝে নিশীথ স্পষ্ট কণ্ঠে জানায়,

—বলছিলাম…আমি বিয়ে করতে চাই।
—নিশীথ! এসব কি ধরনের ছেলেমানুষী কথা?
আয়মান সাহেব তেতে উঠলেন। ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
–ভুলে যেয়োনা মাত্রই বিজনেসে জয়েন করেছো তুমি। কোথায় এখন সব ধ্যান-জ্ঞান অফিসে দিবে তা না করে তুমি এগুলো বলছো? বলছি, লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছো নাকি? আমরা বড়রা যেখানে নিজেদের বিজনেস নিয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কথাবার্তা বলছি সেখানে তুমি কিনা নিজের বিয়ে নিয়ে কথা বলতে এসেছো? আর ইউ রিয়েলি সিরিয়াস?
নিশীথকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আয়মান সাহেব কথা বললেন। নিশীথ মাথা নাড়িয়ে কিছু বলবে তখন আরেফিন সাহেব বলেন,

—ভাই, আপনি এভাবে বলছেন কেন? হয়তো সত্যিই কিছু জরুরি কথা বলতে চায় নিশীথ। ছেলেটাকে কথা সম্পুর্ন তো করতে দেন? ও কেনই বা হঠাৎ এভাবে বিয়ের কথা বলবে?

—ও মাত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছে, আরিফ। এমনিতেই ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে। একটু একটু করে জীবনে ব্যালেন্সে আসছে। এ সময় যদি ও বিয়েশাদি করতে চায়, তবে ওর ক্যারিয়ারের কি হবে তা ভেবে দেখেছিস? আরে বিয়ের জন্য তো পুরো জীবন পড়ে আছে। বয়স কতই বা হলো ওর? এখনো নিশানেরই বিয়ে হয়নি। সেখানে ও ছোট ভাই হয়ে আগে বিয়ে করতে চাইছে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি ওর?
গজগজ করে বলে উঠেন আয়মান সাহেব। কিছুটা থেমে নিশীথের দিকে চেয়ে আরও বললেন,

—আর তুমি কি মনে করো নিজেকে? হ্যাঁ? সারাজীবন তো বাপ-দাদার টাকায় চলেছো। তুমি দুনিয়াদারির কি বুঝো? এখনি বউ ঘরে আনলে অফিস-সংসার দুটো ব্যালেন্স করতে পারবে একসাথে? তোমার তো বাসায় ফেরারই ঠিক-ঠিকানা নেই। আবার বিয়ে করতে চাইছো! কোন মুখে এসব কথা বলো?

রাগে, অপ’মানবোধে নিশীথের চোয়াল শক্ত হয়।পেশিবহুল হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। সে এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আজ নিশ্চিত ওর বাবাকে এমন কোনো কথা বলে ফেলবে যা বলতে ও শুনতে কারোই কখনো ভালো লাগবেনা! রা’গের শিখায় চোখদুটো লালচে হয়ে আসে ওর।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩১

এদিকে নিশীথের দাদু, ইউনুস সাহেব ভয়ার্ত মুখে ছেলে ও নাতির দিকে চেয়ে থাকেন! কেননা, শুধু উনিই জানেন নিশীথ কেন এখনই এভাবে বিয়ের কথা তুলছে। উনি ছাড়া আর কেউ জানেও না দোলনচাঁপার কথা! কিন্তু এ কথাটা তারা আয়মান সাহেবকে বুঝাবেন কি করে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৩