প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৩

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৩
তানিশা সুলতানা

সালটা ছিলো ২০০০। কানাডা থেকে সদ্য বাংলাদেশে পা রেখেছে ইফতিয়ার চৌধুরী। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফেরার পথে নজর আটকে গিয়েছিলো লম্বা চুলওয়ালা এক রমনীর ওপর। যার পরণে ছিলো নীল কামিজ এবং সাদা পাজামা ওড়না। শপিং ব্যাগে বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে বোধহয়। ভীষণ হাসি পেয়েছিলো ইফতিয়ারের। শপিং ব্যাগ এ কেউ বই নেয়?

গাড়ি থামিয়ে দীর্ঘক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেছিলো রমনীকে। লাভ এট ফাস্ট সাইড৷
মেয়েটা যখন লম্বা চুলের মোটা বিনুনিটা পেছনে ঠেলে পাশে থাকা সইয়ের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠেছিলো। ইফতিয়ারের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিলো। বুকের বা পাশে হাত চেপে রেখেছিলো সে।
তখন কন্যা কোন ক্লাসে পড়তো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সিক্স।
তারপর?
গোটা মানিকগঞ্জ শহর ঘুরে লম্বা বিনুনি ওয়ালা রমনীকে খুঁজে বের করেছিলো ইফতিয়ার। নজর রাখছিলো কন্যার ওপর।
দীর্ঘ তিন বছর মেয়েটাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে ইফতিয়ার।
হঠাৎ একদিন বাবার ব্যবসায়ের সুবিধার্থে তাকে পাড়ি জমাতে হয়েছিলো ঢাকার শহরে। পরিকল্পনা ছিলো ঢাকা থেকে ফিরে রমনীকে ঘরণী বানাবে। ধুমধাম করে হৃদয়হরণীকে বউ বানিয়ে আনবে।

আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে হেঁটে চলেছে অভি পূর্ণ। পূর্ণতা হাঁটছে আর আশেপাশের গাছের পাতা ছিঁড়তে। টকটকে লাল রংয়ের শাড়ি পড়নে, লম্বা চুল গুলো হাঁটু ছাড়িয়ে পড়েছে। ফর্সা গোলগাল মুখখানায় হাসির ঝিলিক। এক হাতে পেয়ারা। তাতে একটু পরপর কামড় বসাচ্ছে।
অভি মুগ্ধ হয়ে দেখছে পূর্ণতাকে।

অনেক মানুষের সাথে দেখা হচ্ছে সকলেই অভিকে সালাম জানাচ্ছে। অভিও আলতো হেসে সালাম ফেরাচ্ছে।
কাঁচা রাস্তায় উঠতেই অভি হাত ধরে পূর্ণতার। পূর্ণতা তাকায় অভির মুখপানে। অভিরাজের নাম অভিরাজ না হয়ে মায়ারাজ হওয়া উচিত ছিলো।
বিলাই চোখ দুটোর দিকে তাকালে পূর্ণতা দিশাহীন হয়ে যায়। ডুবে যায় অতল চোখে।
কি মায়া!

এই পুরুষটা কখনো অন্যায় করতে পারে? পারে না।
“চলো না পূর্ণ
আমরা দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কোনো পাপ থাকবে না, শত্রু থাকবে না।
অভির কন্ঠে আকুতি।

” ভয় পাচ্ছেন এমপি সাহেব?
পূর্ণতা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে। অভি চমকে ওঠে। কাচুমাচু হয়ে যায়। ঘামছে বোধহয়। বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে।
অভির আদলখানা দেখে পূর্ণতা খিলখিল করে হেসে ওঠে বলে
“আমাকে হারানোর ভয়ের কথা বলেছি।
শুকনো ঢোক গিলে অভি। পূর্ণতা পেয়ারায় শেষ কামড় দিয়ে বলে

” খুব ভালোবাসেন আমায়। আমাকে হারানোর ভয়ে আপনার কলিজা কাঁপে। আমাকে ছাড়া আপনি অসহায়। জীবন দিয়ে দিবেন তবুও আমার ক্ষতি হতে দিবেন না। তাই না এমপি সাহেব?
অভি জবাব দেয় না। রাস্তার পাশে বিশাল গাছে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুল। টকটকে লাল রংয়ে গাছটা সেজেছে নতুন রূপে। কৃষ্ণচূড়া ফুল বরাবরই পূর্ণতার ভীষণ পছন্দের। তাই রাস্তার পাশে পড়ে থাকা এক খানা ফুল তুলে নেয়। অভির সামনে হাঁটু মুরে বসে ফুল খানা অভির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে

“আপনাকে আমি অমৃত্যু ভালোবেসে যাবো। যদি বাঁচার জন্য আরও একটা জীবন পাই সেই জীবনেও আমি শুধু আপনাকেই ভালোবাসবো। পরপারে আমি আপনারই পিছু নিবো। হাশরের ময়দানে আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো।
অভি পূর্ণতার থেকে ফুলটা নেয়। হাত ধরে পূর্ণতাকে দাঁড় করিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে। কিন্তু কোনো জবাব দিতে পারে না।
পূর্ণতা অভির হাত জড়িয়ে হাঁটতে থাকে।

” আমি এতো সাহসী কেনো হলাম এমপি সাহেব? কেনো মানুষের মন পড়তে পারি? কেনো সব কিছু বুঝে যাই?
জানেন দিন শেষে প্রতিবাদী মেয়েরা ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে। তারা তাদের ভালো থাকা হারিয়ে ফেলে।
অভি যেনো মুখে কুলুপ এঁটেছে। একটা কথাও সে বলছে না। শুধু পূর্ণতার কথা শুনছে।

“আমার একটা সুন্দর জীবন হতো। হয়ত এতো অভিজাত্যের ছোঁয়া পেতাম না। তবে সুখী হতাম। আমার ছোট্ট একটা ঘর হতে পারতো, সুন্দর একটা সংসার হতো। যে সংসারে আমাকে সবাই ভালোবাসতো।
কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। আমার সংসার হলো ঠিকই তবে বালির সংসার।

সমুদ্রের পাড়ে বালি দিয়ে উঁচু অট্টালিকা বানিয়েছি আমি। সেই অট্টালিকায় আমার বসবাস। যে-কোনো মুহুর্তে সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আমার অট্টালিকা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
এটা কি আমার প্রাপ্য ছিলো?
শেষের কথাটা অভির মুখপানে তাকিয়ে বলে পূর্ণতা।
অভি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে

” এক জীবন সব পেয়ে গেলে আফসোস করতে কি নিয়ে? বালির সংসারকে আঁকড়ে ধরে রাখো পূর্ণতা। যখন ভেসে যাবে তখন নাহয় আফসোস করিও। দিন শেষে তবুও তো আফসোস করে বলতে পারবে “আমার একটা এমপি সাহেব ছিলো। যে আমাকে সুখ কিনে দিতে পারে নি”
পূর্ণতা হাসে।
“মেনে নিয়েছি আমি।

সেলিনা বেগম তিন সন্তানের জননী হলেও এখনো অঢেল সুন্দরী। মায়ের সৌন্দর্যের পুরোটা পেয়েছে পূর্ণতা। যাকে বলে মায়ের মতো সুন্দরী।
সালামের রিকশা গতকাল ভেঙে ফেলেছে জমিদারের মেঝো নাতী ইফাদ। একদম গুড়ো করে দিয়েছে। রিকশাই ছিলো সালাম এর জীবিকা নির্বাহের একমাত্র হাতিয়ার।

গতকাল থেকেই সালাম ঘরবন্দী হয়ে আছে। কেঁদেছে অনেক। ভেবেছিলো এমপির কাছে যাবে বিচার নিয়ে।
কিন্তু পরমুহূর্তে চিন্তা করেছে এতে মেয়ের সংসারে অশান্তি হতে পারে।
এক মেয়েকে হারিয়েছে তিনি। না খেয়ে মরে যাবে তবুও আরেক মেয়ের সংসারে অশান্তির কারণ হবে না।
ছোট্ট পলাশ বাবার পাশে হামাগুড়ি দিয়ে বই পড়ছে। ক্লাস ফোর এ পড়ে সে।

সেলিনা উঠোন ঝাঁড়ু দিচ্ছে। এমন সময় তাদের উঠোনে এসে দাঁড়ায় কয়েকজন পুরুষ। সবাইকেই চেনে সেলিনা। এরা জমিদার এর সাথের লোক। সেলিনা মাথার ঘোমটা আরও একটু টেনে নেয়।
আতোয়ার নামের লোকটা তার পান খাওয়া দাঁত গুলো বের করে হেসে বলে
” জামাই কোনে তোমার? ডাকো তারে।
সেলিনা ঝাঁড়ু ফেলে রুমে ঢুকে।

“হুনছেন?
জমিদারের লোকজন আইছে।
সালাম উঠে বসে।
” কোনে?
“বাইরে
আসেন
সালাম সাদা রংয়ের গেঞ্জি গায়ে চাপাতে চাপাতে বের হয়। ওনার পেছনে সেলিনাও যায়।
” কিছু ওইছে?
সালাম ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
আতোয়ার এক দলা থুথু উঠোনে ফেলে জবাব দেয়

“তোমার তো কপাল খুইলা গেছে। তোমার বিবিরে মনে ধরছে জমিদারের। তিনি লইয়া যাইতে কইছে। এক রাইতে মেলা টেহা দিবো। খালি জমিদাররে তৃপ্তি দিবার পারলেই কেল্লাফতে।
আতঙ্কে ওঠে সালাম। ভয়ে কেঁপে ওঠে সেলিনার সত্তা। দুপা পিছিয়ে যায় তিনি। ছোট্ট পলাশও গুটি গুটি পায়ে রুম থেকে বের হয়। সেলিনা ছেলেকে ধরে দাঁড়ায়।
সেলিম আমতাআমতা করে বলে

” কি কইতেছেন আপনারা? আমাগোরে টেহা লাগবো না।
আরেকটা লোক নাম তার ফজল। তিনি বলে
“তোমার টেহা না লাগলে নাই। জমিদারের তোমার বউরে লাগবোই লাগবো।
আমরা নিয়া যাইতেছি। ওনাগোরে প্রয়োজন ফুরাইলে সহিসালামতে দিয়া যামু।
সেলিনা ছেলেকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে

” আমার শরীরে কেউ হাত দিবেন না।
ওনাদের এগিয়ে আসতে দেখে বলে।
আতোয়ার সেলিনার হাত ধরে শক্ত করে
“তেজ দেখাবা না।

সেলিমকে বাকিরা ধরে ফেলে। টেনে হিঁচড়ে সেলিনা বেগমকে নিয়ে যেতে থাকে আতোয়ার। পলাশ মা মা বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। আশেপাশের বাড়ির মানুষ গুলো এগিয়ে আসে। কেউ সাহায্য করে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। পলাশ গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে থাকে। মায়ের পেছনে খানিকটা দৌড়ে যেতেই তাকেও কেউ ধরে ফেলে।

অসহায় সেলিম তাকিয়ে থাকে সেলিনার পানে।
আহারে জীবন
মেয়ের মৃত্যুর মাস ঘুরে নি। দুই হাতে মাটি দিয়েছে মেয়ের কবরে। এখন কি স্ত্রীকেও হারিয়ে ফেলবে? এই দুই হাতেই স্ত্রীর কবরে মাটি দিতে হবে?

দীর্ঘ দুই দিন পরে পূর্ণতা জমিদার বাড়িতে ফিরেছে। অভি কোনো একটা কাজে বাইরে রয়ে গিয়েছে। পূর্ণতা নিজ কক্ষে প্রবেশ করতেই বরাবরের মতো বিছানার ওপরে ডাইরিখানা দেখতে পায়। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে পূর্ণতার।
এই ডাইরি হচ্ছে পূর্ণতার পরম বন্ধু।
আজকে তারাহুরো করে নয়। বরং ধীরে সুস্থ ডাইরি খোলে।
৩৬ নং পৃষ্ঠায় নতুন করে লেখা হয়েছে লাল কালি দিয়ে।

প্রিয় পূর্ণতা
পরপারে তোমার সব আক্ষেপ মিটিয়ে দিবো। নদীর পাড়ে বালুর অট্টালিকায় সিমেন্ট বসাবো। বুকের মধ্যে যত্নে আগলাবো তোমায়। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবো তোমার হৃদয়।
তুমি অপেক্ষা করতে পারবে তো?
ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হয় পূর্ণতার। বিরবির করে বলে
” ইফতিয়ার চৌধুরী আপনাকে আমার প্রয়োজন”

অভি প্রবেশ করে কক্ষে। হাতের ডাইরি খানা পূর্ণতা রেখে দেয় পড়ার টেবিলে।
অভি ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে খুলতে বলে
“পূর্ণ কাপড় পাল্টে নাও ইফতিয়ার চৌধুরীর বাড়িতে যাবো।
“লোকটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
অভি দাঁড়ায়। তাকায় পূর্ণতার দিকে। বউ যে তাকে ক্ষেপাতে চাচ্ছে বেশ বুঝতে পারছে। তাই আলতো হেসে বলে
“আমার বউ শুধু আমার দিকে তাকাবে। এতেই চলবে আমার।

সবার আগে ঘুম ভাঙে রেশমা বেগমের। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি সকাল সকাল রান্না ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। নিজের জন্য কিছু খাবার বানাতে। অন্ধকার এখনো কাটে নি। তবে আবছা আলোতে সকল কিছুই দৃশ্যমান।
তিনি সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই পায়ের কাছে কিছু একটা বেঁধে যায়। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিচে তাকাতেই চিৎকার করে ওঠে।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২২

মানুষের মাথা পড়ে আছে তার পায়ের কাছে।
রেশমার চিৎকারে ঘুম ছুটে যায় সকলেরই। দৌড়ে আসে। এবং আতঙ্কে ওঠে সকলেই।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৪